Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মহীনের ঘোড়াগুলির গল্প

চল্লিশের দশক, শহর কোলকাতা৷ মধ্যরাত, একজন কবি এলোমেলো হেঁটে চলছেন৷ কিছু বিচ্ছিন্ন দৃশ্য একটি কবিতায় সাজাবেন বলে কবির কী বিশাল আয়োজন! রাতের পথে শব্দের সঙ্গ, আচমকা জন্ম এক নতুন কবিতার৷ কবিতার নাম ‘ঘোড়া’, কবি জীবনানন্দ দাশ ৷

“আমরা যাইনি ম’রে আজো-
তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়ঃ
মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায়
কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন-
এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ’পরে।”

জীবনানন্দ দাশ (ছবিসূত্র: Wikipedia)

তারপর চলে গিয়েছে অনেকদিন৷ সত্তরের দশক ছুঁই ছুঁই সময়ে বাংলা সংগীত জগতে চলছে ক্ল্যাসিক্যালের জয়জয়কার৷ চারদিক দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মতন প্রমুখ শিল্পীরা৷ মানুষ আটকে আছে চটকদার বাংলা সিনেমার গতানুগতিক সংগীত ধারায়৷ স্থবিরতাটা যেন সবাই টের পাচ্ছিলেন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তার কথাটি আমলে নিয়ে কেউই জায়গা থেকে সরতে পারছিলেন না৷

বিশ্ব সংগীত যেখানে সময়কে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে বাংলা সঙ্গীতের এমন হতাশাজনক স্থবিরতা জনৈক তরুণ গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে প্রচন্ড ভাবিয়ে তুলেছিলো৷ গৌতমদের একটি নিজস্ব গানের দল রয়েছে৷ বন্ধুরা মিলে বানিয়েছেন, যার কোনো নাম নেই৷ একবার তো বিব্রতকর অবস্থা; নাকতলার কোনো এক অনুষ্ঠানে তারা গাইতে উঠেছেন, অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের একজন জিজ্ঞেস করলেন- “দলের কী নাম?” থতমত সবাই, তাঁদেরই কেউ একজন কাঁচুমাঁচু স্বরে বললেন- “দলের নাম ‘সপ্তর্ষী’৷”

ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির পরিবেশনা (ছবিসূত্র: Wikipedia)

সে যাত্রায় রক্ষা হলো কোনোমতে৷ তবে তারপরই শিরোনামহীন সেই দলের নাম হয়ে গেলো সপ্তর্ষী৷ অবশ্য তাতে কোনো লাভ হলো না, কয়েকদিন পরেই সে নাম পাল্টিয়ে নতুন নাম দেয়া হলো ‘তীরন্দাজ’৷ তীরন্দাজ নামেও কেউ যেনো সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না৷ রীতিমত অস্বস্তিতে পড়ে আরেকদফা নাম পাল্টাতে হলো৷ এবারের নাম ‘গৌতম চট্টোপাধ্যায় বিএসসি ও সম্প্রদায়’৷

এমন করেই সব চলছিলো৷ এক রাতে দলের সবাই রাস্তায় হাঁটতে বেড়িয়েছেন, দলের এক সদস্য রঞ্জন ঘোষাল আবৃত্তি করছিলেন জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘ঘোড়া’ কবিতাটি৷ কবিতা শেষ হলে রঞ্জন প্রস্তাব করলেন- “দলের নাম মহীনের ঘোড়াগুলি রাখলে কেমন হয়?” গৌতম যেনো সেটির অপেক্ষাতেই ছিলেন৷ একলাফে লুফে নিলেন, উত্তর দিলেন- “এক্ষুনি ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।” সেই ১৯৭৪ সাল থেকেই দলের নাম ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’, যেটি এ যাবৎকালে বাংলা ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে সবচাইতে জনপ্রিয় ব্যান্ডদের একটি ৷

কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, তৎকালীন সময়ে মহীনের ঘোড়াগুলির জনপ্রিয়তা এখনকার মতন এত তুঙ্গে ছিলো না৷ ষাটের দশকে বব ডিলানের হাত ধরে যে ‘আরবান ফোক’ ধারার প্রচলন ঘটেছিলো, অনেকে মহীনের ঘোড়াগুলিকে বাংলা গানের জগতে সে ধারারই অনুসারী বলে থাকেন৷ রাজনীতি, দারিদ্র্য, অর্থনীতি, অন্যায়-অবিচার, বিপ্লব, ভালোবাসা, একাকীত্ব, স্বাধীনতা, ভিক্ষাবৃত্তি, যৌনপেশাসহ আরো বহুমুখী বিষয় নিয়ে গান রচনা করেছে মহীনের ঘোড়াগুলি।

গৌতমের বাম আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিলো। তিনি বিখ্যাত নকশাল আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন৷ তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তা মহীনের ঘোড়াগুলির গানে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে৷ উল্লেখ্য, তাঁদের গানে তাঁরা নির্দিষ্ট কোনো সংগীত ধারাকে অনুসরণ না করে বরং বিভিন্ন ধারার পরীক্ষামূলক চর্চায় মনোনিবেশ করেছেন৷ সেটিই একসময় তাঁদের ধারা হয়ে ওঠে৷ কিন্তু তখনকার সময়ে শ্রোতারা রোমান্টিক সুরেলা ঘরানার গানগুলোতে এত বেশি সম্মোহিত ছিলেন যে, তাঁদের পক্ষে নতুন কোনো ধারার গান গ্রহণ করা সম্ভবই হয়ে ওঠেনি৷

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়- শ্রোতাদের পক্ষ থেকে প্রায়ই ব্যান্ডের সদস্যদের পোস্টবক্সে বিরক্তিসূচক চিঠি আসতো৷ এর ফলে শুরু করার মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে আশির দশকের গোড়ার দিকে এই ব্যান্ডটি ভেঙ্গে যায়৷ ব্যান্ড বন্ধ হবার পর ব্যান্ডের সকল সদস্য যে যার মতন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন৷ বিভিন্ন কর্মজীবনে মনোনিবেশ করার আগে তাঁদের যে তিনটি অ্যালবাম রেকর্ড হয়েছিলো সেগুলো যথাক্রমে- সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক, অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব, দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি৷ শোনা যায়, শুধু গানেই নয়, স্টেজ শো-গুলোতেও তাঁদের উপস্থাপনা ছিলো ব্যতিক্রমধর্মী৷ তাঁদের কনসার্টের টিকিটগুলো ছিলো অন্যরকম৷ কখনো সেগুলো ছিলো ডাকটিকিট সদৃশ, কখনো সেখানে থাকতো সকল সদস্যের আঙুলের ছাঁপ৷

মহীনের ঘোড়াগুলির একটি কনসার্টের টিকেট (ছবিসূত্র: doridro.com)

‘৮১ সালে ভেঙে যাবার পর আশির দশকের শেষ দিকে প্রেসিডেন্সী কলেজের এক তরুণ, নাম সুব্রত ঘোষাল, মহীনের ঘোড়াগুলির ‘ভালো লাগে’ গানটি শুনে এঁদের প্রতি তীব্র আগ্রহবোধ করেন৷ তিনি গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে খুঁজে বের করে দেখা করেন এবং গৌতমের সঙ্গে যাবতীয় আলোচনার পর মহীনের ঘোড়াগুলিকে পুনর্গঠনের প্রস্তাব রাখেন৷ সুব্রতর সঙ্গে জ্যামিং এর পর গৌতম নিজেও যেনো ভেঙে যাওয়া মহীনের ঘোড়াগুলিকে পুনর্গঠনের দায়িত্ব অনুভব করেছিলেন৷ যে গানগুলোকে লোকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো, গৌতম সনাতনীয় সঙ্গীত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে সে গানগুলোকেই ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে নতুন করে মহীনের ঘোড়াগুলিকে সামনে আনার স্বপ্ন সাজান৷ ১৯৯৫ সালের বইমেলায় তাঁদের অ্যালবাম ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ রিলিজ করে সে স্বপ্ন পূরণ করেন৷ তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি৷ গানগুলো গণজোয়ারকে এতই প্রভাবিত করেছিলো যে, অল্প দিনেই ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ কিংবদন্তী ব্যান্ড হিসেবে মানুষের মনে জায়গা করে নেয় এবং সে জোয়ার আজও বহমান৷

জলরঙে মহীনের ঘোড়াগুলি (ছবিসূত্র: dammygraphy.wordpress.com)

নাগরিক অধিকারকে অনুভব করে জীবনের যাবতীয় টানাপোড়ন গান গেয়ে বর্ণনা করার ক্ষমতা ছিলো মহীনের ঘোড়াগুলির৷ একদিকে প্রেম, একদিকে বৈরাগ্য; এক দিকে হতাশা, অন্যদিকে প্রাপ্তির হিসেব সাজানোয় বাংলা গানে মহীনের ঘোড়াগুলির ছিলো যশস্বী ভূমিকা৷ এ জন্যই বুঝি এখনো তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা একটুও কমেনি; বরং দিনকে দিন তাঁরা যেনো আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন নাগরিক জীবনযাত্রায়৷

একটি অ্যালবাম কভার (ছবিসূত্র: Wikipedia)

এরপর ১৯৯৬ এবং ১৯৯৭ সালে মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত ৫ম ও ৬ষ্ঠ অ্যালবাম ‘ঝরা সময়ের গান’ ও ‘মায়া বাজারে আসে’৷ ১৯৯৯ সালে, যেবার ‘খ্যাপার গান’ অ্যালবামটি রিলিজ হলো, সে বছরটায় মহীনের ঘোড়াগুলি তথা পুরো বাংলা আধুনিক সংগীতের ইতিহাসের এক অপূরণীয় ক্ষতি ঘটে গেলো৷ গৌতম হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেন ৷

গৌতম চট্টোপাধ্যায় (ছবিসূত্র: Wikipedia)

ব্যান্ডে গৌতম গাইতেন, লীড গিটার ও স্যাক্সোফোন হাতে তাঁকে দেখা যেতো৷ বিশ্বনাথ ড্রামে ছিলেন, প্রদীপ বাজাতেন বাঁশি৷ এব্রাহাম কখনো পিয়ানো, কখনো ভায়োলিন ছিলেন৷ রঞ্জন দেখতেন মিডিয়া সম্পর্কের বিষয়টা৷ রাজার পর তাপস ও তপেশ গীটার ধরেছিলেন, আর এসব নিয়ে গোটা মহীনের ঘোড়াগুলি; যারা গানে গানে স্বপ্ন দেখতেন৷

প্রকৃতিকে কাছাকাছি রেখে নাগরিক গল্পগুলো অকপটে বলে যাবার শক্তি বা সাহস সবার ছিলো না৷ মহীনের ঘোড়াগুলি সেটুকু করেছে, বাংলা গানকে দিয়েছে অন্য মাত্রা৷ এখনো আমরা আমাদের যাবতীয় অনুভূতি বর্ণনায় মহীনের ঘোড়াগুলির কাছে হাত পাততে পারি, এটুকু একটি ব্যান্ডের জন্য কম কিছু কি?

ধন্যবাদ, মহীনের ঘোড়াগুলি৷ পাশে থেকে, আমাদের হয়ে গাইবার জন্য।

তথ্যসূত্র

১. sites.google.com/site/mohaprithibi/Home/sattitarartimir/ghora

২. bn.wikipedia.org/wiki/মহীনের_ঘোড়াগুলি

৩. somewhereinblog.net/mobile/blog/benqt60/29522670

৪. sachalayatan.com/guest_writer/49974

Related Articles