Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

র‍্যাগনারক: পৃথিবীর মহাবিপর্যয়ের ভাইকিং উপকথা

পৃথিবীতে শেষ দিককার মহাবিপর্যয় নিয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মাঝে বিভিন্ন রকম বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। ব্যতিক্রম ছিলো না অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত উত্তর, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে লুন্ঠন ও বাণিজ্য পরিচালনা করা নাবিকগোষ্ঠী ভাইকিংরাও। পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহ সেই ক্রান্তিকালের তারা নাম দিয়েছিলো ‘র‍্যাগনারক’।

একের পর এক মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপদেবতাদের উত্থান, মৃতদের সেনাবাহিনীর আগমন, সর্বোপরি দেবতাদের সাথে অপদেবতাদের মরণপণ যুদ্ধ- এ সবকিছু নিয়েই ছিলো ভাইকিংদের র‍্যাগনারক। মানুষের কল্পনার দৌড়ের চমৎকার নিদর্শন হিসেবে এই নর্স মিথলজি যে কাউকেই নির্মল আনন্দ দিতে সক্ষম!

ভাইকিংদের বিশ্বাস মতে শেষের শুরুটা হবে ভয়াবহ এক শীতকালের মধ্য দিয়ে। প্রায় দেড় বছর ধরে পুরো পৃথিবী ঢাকা পড়বে শীতের চাদরে, হাড় কাঁপানো এক শীত। সেই শীতের প্রভাবে মারা যাবে বিশ্বের সকল মানুষ, শুধুমাত্র স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ভাইকিংরা ছাড়া। তাদের বিশ্বাস ছিলো, ভয়াবহ সেই শীতও তাদের কাবু করতে পারবে না। তবে চিন্তার বিষয় হলো, এরপর যে যুগ শুরু হবে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। এরপরের যুগটির নাম তারা দিয়েছিলো ‘পতিতাবৃত্তির যুগ’!

ভাইকিং যোদ্ধা; Source: wallpapersafari.com

এ যুগে মানবজাতির অবস্থা হবে সত্যিই ভয়াবহ। দীর্ঘকালের শৈত্যপ্রবাহে পৃথিবীতে দেখা দেবে চরম খাদ্যসঙ্কট। বেঁচে যাওয়া মানুষেরা তখন খাবারের সন্ধানে একে অপরের সাথে মরণপণ লড়াইয়ে লিপ্ত হবে, এমনকি লড়াই বাধবে বাপ-বেটার মাঝেও। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো, ভাইকিংদের বিশ্বাস মতে সেই সময়ে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়বে ইনসেস্টের মতো জঘন্য কাজও।

ধ্বংসের কথা যেহেতু আসলো, তাহলে ভাইকিংদের বিশ্বাস মোতাবেক খারাপ দেবতাদের নিয়েও জানা যাক। সেই দেবতারা মানুষদের সবসময় খারাপ কাজে প্ররোচিত করতো। এমনকি কেউ কেউ এতটাই ভয়াবহ ছিলো যে, আশেপাশে তাদের উপস্থিতিও হতে পারতো একজন মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট! তবে সৌভাগ্য বলতে হবে মানবজাতির। কারণ ভাইকিংরা বিশ্বাস করতো খারাপ সে দেবতাদের অনেক আগেই এমন কোনো এক জায়গায় বন্দী করে রাখা হয়েছে যেন তারা কারো কোনো ক্ষতি করতে না পারে।

এদের মাঝে অন্যতম ভয়াবহ একজন ছিলো নেকড়ের মতো দেহাবয়বের ফেনরির। ভাইকিং বিশ্বাস অনুসারে, মানবজাতির ইতিহাস শুরু হওয়ার আগেই ভালো দেবতারা ফেনরিরকে বন্দী করে ফেলতে সক্ষম হয়, জাদুর তলোয়ার দিয়ে আলাদা করে রাখে তার দুটো চোয়াল। সে একবার ছাড়া পেলে ধ্বংসের লীলাখেলা শুরু হবে গোটা বিশ্বে।

ফেনরির; Source: vsbattles.wikia.com

দেড় বছরের সেই শীতের পর ফেনরিরকে মুক্ত করতে কাজ শুরু করবে তার ছেলেরা। ফেনরিরকে মুক্ত করতে দরকার ভূমি বিদীর্ণ হওয়া। এজন্য প্রথমে তার এক ছেলে সূর্যটাকে গিলে খাবে, আরেকজন চাঁদ সহ অন্যান্য নক্ষত্রগুলো গিলে নেবে! তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাবে গোটা বিশ্বজগত। ভয়াবহ ভূমিকম্প শুরু হয়ে যাবে গোটা পৃথিবী জুড়ে। তখনই শিকল ছিড়ে মুক্তি পাবে ফেনরির।

ভূমিকম্পে ফেনরিরের সাথে মুক্তির স্বাদ পাবে ধূর্ত দেবতা লোকিও। অবশ্য নর্স মিথলজি মতে লোকির কাহিনী বেশ করুণই বলতে হবে। দেবতারা তার সামনে তার ছেলেকে খুন করে। এরপর ছেলেটির নাড়িভুঁড়ি বের করে সেগুলো দিয়েই হাত-পা বেঁধে আটকে রাখা হয় লোকিকে। লোকির দুর্দশা এরপরেও শেষ হয় নি। বেঁধে রাখার পর তার উপর রাখা হয় বিষাক্ত একটি সাপ যার বিষ ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তো তার মুখে, অসহ্য যন্ত্রণা দিতো তাকে। স্বামীর যন্ত্রণা কমাতে লোকির অমর স্ত্রী আজীবন চেষ্টা করে যায় যেন তার মুখে সেই বিষ না পড়ে, তবে বারবার ব্যর্থ হয় সে।

লোকির দুর্দশা; Courtesy: Louis Huard

তো দেবতারা কেন লোকির উপর এত ক্ষেপলো? এর পেছনেও রয়েছে তার অপরাধের বিশাল বড় এক তালিকা। এর ভেতর উল্লেখযোগ্য কিছু হলো- স্বর্গের ভৃত্যদের হত্যা করা, ঘোড়ার সাথে সঙ্গম করা, দেবতা ওডিনের ছেলেকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টা করা ইত্যাদি। তবে সর্বশেষ অপরাধটি ছিলো একটি ভোজে আমন্ত্রিত না হয়েও সেখানে হাজির হয়ে সবকিছু ভন্ডুল করে দেয়া। শেষে দেবতারা আর ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে তাকে এত ভয়াবহ শাস্তি দেয় বলে বিশ্বাস করতো ভাইকিংরা।

সকল খারাপ দেবতাকে অবশ্য ভালো দেবতারা বন্দী করতে পারে নি, কেউ কেউ লুকিয়ে গিয়েছিলো আর সময়-সুযোগ মতো প্রতিশোধের আশায় ছিলো। মিডগার্ডের বিশালাকার সাপ ছিলো তেমনি এক প্রাণী। দেবতা থরের নজর এড়াতে সে সমুদ্রের একেবারে তলদেশে গিয়ে বসেছিলো, অপেক্ষায় ছিলো উপযুক্ত সময়ের।

মিডগার্ডের সাপ; Source: greekmythology.com

ভাইকিংরা বিশ্বাস করতো, যখন ভূমিকম্প শুরু হবে, তখনই সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে আসবে দৈত্যাকৃতির সেই সাপটি, চলতে শুরু করবে মাটির পৃথিবীতে। সাপটি এতটাই বড় যে সে অনায়াসে সারা পৃথিবীকে পেঁচিয়ে ধরতে পারে। তাই ভূমির উপর দিয়ে তার সেই চলনে ফুঁসে উঠবে সমুদ্রের পানি, মারাত্মক বন্যায় ভেসে যাবে গোটা পৃথিবী।

সাপটি বন্যা সৃষ্টি করেই থামবে না। এরপর সে তার ভয়াবহ বিষ ছুঁড়ে দেবে সাগরে ও আকাশে। এভাবে একদিকে যেমন মানুষ বিষাক্ত পানির কবলে পড়বে, তেমনি অন্যদিকে আকাশ থেকে তাদের উপর ঝরবে বিষাক্ত বৃষ্টি!

জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের মতো পরবর্তী বিপদটা আসবে জল থেকে (ডাঙায় তো সাপ আছেই)। ভাইকিংরা বিশ্বাস করতো, মানব ইতিহাসে যেদিন থেকে মৃত্যুর সূচনা হয়েছে, সেদিন থেকেই মৃত ব্যক্তিরা শেষ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে আছে। তবে সবাই নয়, কেবলমাত্র যারা নরকে ঠাই পেয়েছে তারাই। সেই দিন তারা বিশাল এক নৌকা নিয়ে মানবজাতির অবশিষ্টাংশের বিরুদ্ধে অগ্রসর হবে। তবে সেটিও কোনো সাধারণ নৌকা হবে না, সেটি মৃত ব্যক্তির নখ দিয়ে বানানো! হ্রাইম্র নামক এক দানব নৌকাটিকে দেবতাদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রের পথে চালিয়ে নেবে, হাল ধরে থাকবে স্বয়ং লোকি।

মৃতদের সেনাবাহিনী; Source: kongregate.com

ভাইকিংরা বিশ্বাস করতো, লোকির সেই নৌকা বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় নখ আসবে মৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে। এমন বিশ্বাসের কারণে কেউ মারা গেলে তার ভাই/সহকর্মীরা তার হাত-পায়ের নখগুলো কেটে দিতো। তারপর অতিরিক্ত সতর্কতার অংশ হিসেবে কখনো আবার পুরো নখটিই তুলে ফেলা হতো। এদিকে ভাইকিংরা ছিলো খুবই সতর্ক। তারা মনে করতো নৌকা বানানোর জন্য যথেষ্ট নখ পেয়ে যাওয়া মানেই হলো পৃথিবীর শেষ ঘনিয়ে আসা।

দেবতাদের সাথে যেহেতু অপদেবতাদের যুদ্ধ বাধতে যাচ্ছে, সুতরাং ভয়াবহ কিছু একটাই যে ঘটতে যাচ্ছে তা তো সহজেই অনুমেয়। তবে ভয়াবহতম সেই যুদ্ধ অবলোকন বা এতে অংশগ্রহণের জন্য বেঁচে থাকবে না আর কোনো মানুষই। যুদ্ধপূর্ব প্রাকৃতিক ভয়াবহতায় মারা যাবে সবাই।

ভাইকিংদের বিশ্বাস অনুযায়ী সেদিন ফেনরির, লোকি, মিডগার্ডের বৃহদাকার সাপ, দানব ও মৃতদের সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লড়বে দেবতারা। তবে সেই যুদ্ধ শেষে বেঁচে ফিরতে পারবে না কেউই, সবাই ঢলে পড়বে মৃত্যুর কোলে!

Source: Wikimedia Commons

দেবতা থরের কথাই ধরা যাক। মিডগার্ডের সেই বিশালাকার সাপের সাথে তুমুল লড়াইয়ের এক পর্যায়ে হাতুড়ির এক আঘাতে সাপটির মাথা থেঁতলে দেবে থর। বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করতে গিয়ে অবশ্য সে টের পাবে মৃত্যুর আগে সাপটি তার বিষদাঁত বসিয়ে গেছে থরের শরীরে। এটা দেখে মাত্র নয় কদম পিছিয়ে যেতে না যেতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে থর নিজেও।

থর বনাম মিডগার্ডের সাপ; Source: Wikimedia Commons

ফেনরিরের সাথে যুদ্ধে মারা যাবে দেবতা ওডিন। ফেনরির তাকে একেবারেই গিলে ফেলবে। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তখন এগিয়ে আসবে ওডিনের ছেলে দেবতা ভিদার। তবে ভিদারের এই যুদ্ধে জয়ের জন্য দরকার মানবজাতির সাহায্য।

ওডিন বনাম ফেনরির; Source: Wikimedia Commons

ফেনরিরকে মারতে কেবল একটি উপায় বেছে নেবে ভিদার। এজন্য সে বিশালাকার ফেনরিরের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এরপর হাতে সর্বশক্তি দিয়ে আটকাবে উপরের চোয়াল, আর পা দিয়ে আটকে রাখবে নিচের চোয়াল। নিচের চোয়াল আটকে রাখতে ভিদারের পায়ে লাগবে বিশেষ এক ধরনের জাদুকরী জুতা। এই জুতা পায়ে গলিয়েই ফেনরিরকে দু’টুকরো করে ফেলবে ভিদার।

ভিদার বনাম ফেনরির; Courtesy: W. G. Collingwood

নিজেদের দেবতা হিসেবে ভাইকিং সমাজের প্রতিটি সদস্যেরই কর্তব্য ছিলো তাদের দেবতাদের সাহায্য করা। আর ভিদারের বেলায় এটি সম্ভব হতো তাকে চামড়া দেয়ার মাধ্যমে। ভাইকিংদের দেয়া এই চামড়াই পরবর্তীতে ভিদারের সেই জাদুকরী জুতা তৈরীতে কাজে লাগতো। প্রতিদিনই কাজে যাবার সময় প্রাচীন স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মুচিরা কিছু চামড়ার টুকরা ছুড়ে দিতো। এভাবেই দেবতাকে সাহায্য করছে ভেবে স্বস্তি পেতো তারা।

এরপরই পুরো পৃথিবীকে গ্রাস করে নেবে ভয়াবহ এক আগুন। মৃত্যু পরবর্তী বিচারে লোকির সাথে থাকা সেই মৃতদের সেনাবাহিনী এরপর আর নরকে ফিরে যাবে না, যাবে এর চেয়েও ভয়াবহ এক স্থানে, নাম তার নাস্ট্রান্ড। একে বলা হয় শয়তানদের গ্রেট হল। বিশালাকার সেই হলরুমটি বিষাক্ত সব সাপ দিয়ে পরিপূর্ণ। সেই সাপগুলোর মুখ থেকে বিষের মেঘ বের হয়। সেই মেঘ থেকে বৃষ্টির ন্যায় ঝরতে থাকে বিষ। সেই বিষাক্ত পরিবেশেই অনন্তকাল ধরে থাকতে হয় ধূর্ত দেবতা লোকির অনুসারী মৃতদের সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে।

নাস্ট্রান্ড; Source: listverse.com

ভালো মানুষদের স্থান হবে গিম্লে নামক এক জায়গায়। সেখানে তারা পান করার জন্য পাবে বিয়ার। ওদিকে খারাপদের জায়গা হবে বিষাক্ত সাপে পরিপূর্ণ এক দূর্গে।

র‍্যাগনারকের পুরো কাহিনী যে বানিয়েছে, তাতে যে অসঙ্গতির সে কোনো কমতি রাখে নি, সেটা তো বলাই বাহুল্য। অদ্ভুত সব গল্প দিয়ে ভরা পুরো ব্যাপারটিই। শেষটাও হয়েছে তেমনি পরস্পরবিরোধী কিছু তথ্য দিয়ে।

একটু আগেই যদিও বলা হয়েছিলো, মারা যাবে বিশ্বজগতের সবকিছুই, কথাটি এ পর্যায়ে এসে আবার ভুল প্রমাণিত হয়। কারণ দুজন মানব-মানবী ও ছয়জন দেবতা শেষ দিনের সেই ভয়াবহতার পরেও বেঁচে থাকবে। দেবতারা সবাই থর ও ওডিনের সন্তান। দুজন মানুষ বেঁচে থাকবে, কারণ পুরো সময়টাই তারা লুকিয়েছিলো।

লিফ নামের সেই পুরুষ ও লিফথ্রাসির নামের সেই নারী ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের সময় জাদুর এক বনে লুকিয়ে থাকাতেই বেঁচে যাবে। সকাল বেলার কুয়াশা পান করেই বেঁচে থাকতে হয় তাদের। সূর্যের একটি মেয়ে (!) থাকবে যে কিনা এসে সূর্যের দায়িত্ব নেবে। আবারো দুজন মানব-মানবী থেকে শুরু হবে মানবজাতির নতুন ইতিহাস।

ফিচার ইমেজ- wallpapersafari.com

Related Articles