Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সোলস: আত্মার সাথে সুরের আত্তীকরণের ব্যান্ড

আত্মার বাঁধনেই নাকি হয় আত্মীয়তা। সুরের জাদুতে হাজারো মানুষকে সেই আত্মীয়তায় বাঁধতেই হয়তো এমন নামকরণ। এই ব্যান্ডটি হাজার হাজার শ্রোতাকে দু’হাত ভরে দিয়েছে অসংখ্য গান আর অগণিত সুন্দর মনের প্রতিভাবান শিল্পী। সোলস তাই শুধু একটি ব্যান্ড নয়, এ যেন একটি প্রতিষ্ঠান, যা থেকে জন্ম নিয়েছে এক একজন নক্ষত্র, যারা স্বমহিমায় জ্বলছেন পরিপূর্ণ গৌরবে।

সুপার সোলসের প্রচ্ছদ; Source: soulsbd.com

সোলসের প্রশংসা যতই করা হোক না কেন, ততই যেন কম হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর দেশ যখন এক গভীর ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন একদল তরুণ সাহসী যুবক যেন গানের সুরে স্তব্ধ করে দিতে চাইল সকল অস্থিরতা। প্রথাগত সঙ্গীতচর্চাকে ভেঙে ওয়েস্টার্ন রক ঘরানার সাথে বাংলার সুরজগতকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় বিভোর এই তরুণের দল। সংগ্রহে নেই কোনো ভালো গিটার বা ড্রামস। নেই একটি গানের দল চালানোর মতো অর্থ। ছিল শুধু মনোবল আর নিজেদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। স্বাধীনতার পরের বছরই ‘সুরেলা’ নাম দিয়ে যাত্রা শুরু। আর তার পরের বছর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘সোলস’, যা আজও অটুট আছে লক্ষ শ্রোতার অন্তরে।

সোলসের প্রথম দিককার ছবি; Source: bangla.bdnews24.com

সুব্রত বড়ুয়া, সাজেদ উল আলম ও মুমতাজুল হকের হাত ধরে প্রথম গড়ে ওঠে ব্যান্ডটি। এরপর গুটি গুটি পায়ে পথ চলা শুরু সোলসের। ব্যান্ডের সদস্যদের আমন্ত্রণে নকীব খান, তপন চৌধুরী, আহমেদ নেওয়াজ ও রুডি থমাসদের আগমন। ধীরে ধীরে ব্যান্ডকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার চেষ্টা। মূলত চট্টগ্রামেই চলছিল ব্যান্ডের অনুশীলন।

সোলসের শুরুর পথচলাটা মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। বাংলা গান তখনও রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, লোকগান আর আধুনিক পপ গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাংলা গানের ব্যান্ডের ধারণাটাও কিছুটা নতুন সবার মনে। তার উপর বিদেশী ঢঙে স্বদেশী গান। তাই অনেকেই যেন ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না এমন এক গানের দলের আবির্ভাব।

গাইছেন তপন চৌধুরী; Source: bangla.bdnews24.com

সে সময় ব্যান্ডগুলোর বেশিরভাগ পারফর্মেন্স ছিল বড় বড় ক্লাব এবং হোটেলে। তাই মূলত ইংরেজি গানের কাভার করাই ব্যান্ডগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল। সে কারণে তখন ব্যান্ডগুলোর নামও ইংরেজি নামে রাখা হত। সোলসের সদস্যরা একটা সময়ে নিজেরাই গান বাঁধার সিদ্ধান্ত নেন। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে একটি ফোক ঘরানার গান কম্পোজ করে ফেললেন নকীব খান। তাতেই যেন অনেকটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে ব্যান্ডের সদস্যরা। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ পপ কম্পিটিশানে নাম লেখায় সোলস এবং শ্রেষ্ঠ ব্যান্ড নির্বাচিত হয়। সেই থেকেই শুরু হয় সোলসের জয়রথ।

অনুষ্ঠানের পর সোলস ব্যান্ড; Source: bangla.bdnews24.com

আশির দশককে সোলসের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই সময় আরও কিছু নবীন মুখ সোলসে পদার্পণ করেন যারা পরবর্তীতে বাংলাদেশের গানের জগতে একেকটি বারুদে পরিণত হন। ১৯৮০ সালে গায়ক হিসেবে নাসিম আলী খান অন্তর্ভুক্ত হন সোলসে। এর কিছুদিন পর ড্রামার হিসেবে পিলু খান এবং সবশেষে লিড গিটারে আসেন আইয়ুব বাচ্চু। তখন ব্যান্ডের লাইন আপ দাঁড়ায় নকীব, তপন, নাসিম, বাচ্চু, পিলু, রনি, রুডি, শাহেদ এবং নেওয়াজ। নামগুলো শুনেই বোঝাই যাচ্ছে কী ভীষণ শক্তিশালী ব্যান্ড ছিল সোলস; এই দলে যে ম্যাজিক হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

ব্যান্ডের গড়ে ওঠার সময়কার ছবি; Source: dainikazadi.org

অনেক চেষ্টা, গানের জন্য ভালোবাসা আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১৯৮২ সালে বের হয় সোলসের প্রথম অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’। ঐতিহাসিক ব্যাপার হলো, এটিই বাংলাদেশের কোনো ব্যান্ডের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অ্যালবাম। সেই অ্যালবামে পাশ্চাত্যের গিটার আর ড্রামের সাথে সুমধুর বাংলা গানের কথা যেন মনের মাঝে আটকে থাকা ভাষাগুলোর প্রতিচ্ছবি হয়েই ধরা দিয়েছিল যুব সমাজের মনে। বাংলা গানের পুরো চেহারাই পাল্টে দিল এই একটি এ্যালবাম। ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘নদী এসে পথে’, ‘সুখ পাখি আইলো উড়িয়া’, ‘দরগাহে মোম জ্বেলে কী হবে’ ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ এসব যেন একেকটি গান নয়, যেন মনের স্তব্ধতা ভেঙে নিজেদের খুঁজে পাওয়ার আকুতি। যেন শেকড়ের টানে সময়ের সাথে আবার নতুন করে বাংলা গানকে খুঁজে পাওয়ার এক অসম্ভব ভালো লাগার অভিব্যক্তি। অ্যালবামের প্রত্যেকটি গানই শুধু সময়কেই জয় করেনি, মিটিয়েছে হাজারো মানুষের সুরের তৃষ্ণাও।

সোলসের বিভিন্ন অ্যালবামের প্রচ্ছদ; Source: pipra24.blogspot.co

বিটিভি তখন নতুন ধরনের গান-বাজনাকে বেশ পৃষ্ঠপোষকতা করছিল বলে সোলস বেশ সুফল পায়। টেলিভিশনে প্রচারের ফলে সোলসের জনপ্রিয়তা বেশ দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব ঘন ঘন ডাক পড়তে থাকে তাদের। ১৯৮২ সালে মুক্তি পেল সোলসের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘কলেজের করিডোরে’। অ্যালবামটিতে ‘কলেজের করিডোরে’, ‘ফরেস্ট হিলের এক দুপুরে’, ‘ফুটবল ফুটবল’, ‘খুঁজিস যাহারে’ ও ‘পাহাড়ের আঁকাবাঁকা’ গানগুলো জনপ্রিয়তা পায়।

সোলসের উত্থানের পথে নকীব খানের বিশেষ অবদান রয়েছে। ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’র মতো অনেকগুলো গানের কথা এবং সুর করেছেন তিনি। কলেজের করিডোরের মুক্তির কিছুদিন পরই নকীব খান এবং পিলু খান সোলস ত্যাগ করে রেনেসাঁ গঠন করেন। ফলে বেশ কিছু বছর বিরতির পর ১৯৮৭ সালে ‘মানুষ মাটির কাছাকাছি’ দিয়ে আবার নতুন করে  ফিরে আসে সোলস। এই অ্যালবামে আইয়ুব বাচ্চু প্রথম ‘হারানো বিকেলের গল্প বলি’ শিরোনামের একটি গানে কণ্ঠ দেন। এর পরের বছরই ব্যান্ডের চতুর্থ অ্যালবাম ইংরেজি ও বাংলা গানের সংমিশ্রণে করা হয়, যার নাম ছিল ‘ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট’। ছয়টি ইংরেজি এবং ছয়টি বাংলা গান দিয়ে অ্যালবামটি তৈরি করা হয়। ইংরেজি গান দিয়ে সোলসের গানের জগতে আসা হলেও এই প্রথম ইংরেজি গান অ্যালবামবন্দী করা হয়। তবে প্রতিটি গানই ছিল সোলসের নিজেদের তৈরি।

নকীব খান ও পিলু খান; Source: kalerkantho.com

১৯৮৮ সালের দিকে আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরে পার্থ বড়ুয়ার সোলসে আগমন ঘটে। এর পরের বছরই সোলসের লিড গিটারিস্ট এবং কম্পোজার আইয়ুব বাচ্চু ব্যান্ড ছেড়ে চলে যান এবং নিজের ব্যান্ড তৈরি করেন। অন্যদিকে তপন চৌধুরীও নিজের গান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে হঠাৎ এক ধরনের শূন্যতা নেমে আসে সোলসে। কিন্তু নাসিম আলী খান আর পার্থ বড়ুয়া বেশ শক্ত হাতে ধরে রাখেন ব্যান্ডকে। নিজেদেরকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় বড় ধরনের অনুষ্ঠান এবং নতুন অ্যালবাম করা থেকে বিরত থাকে দলটি।

এই সময়টাতে সোলস আবার নিজেদেরকে চেনার চেষ্টা করে। আগের প্রথাকে ভেঙে আবার নিজেদের মতো করে রূপ দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। নিজস্ব স্বকীয়তায় নিজেদেরকে আবার শক্তিশালী করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে অনেকটা সময়। তারপর ১৯৯৩ সালে সোলসের পঞ্চম এ্যালবাম ‘এ এমন পরিচয়’ দিয়ে অসংখ্য ভক্তের বুকে নতুন করে ঠাঁই করে নেয় সোলস। এই অ্যালবামেই তপন চৌধুরীকে শেষবারের মতো ব্যান্ডের সাথে গাইতে দেখা যায়। এই অ্যালবামে ‘এ এমন পরিচয়’ ছাড়াও ‘এই তো সেদিন’, ‘সাগরের এই প্রান্তরে’, ‘কুহেলি জানে কি’ ইত্যাদি গান বেশ জনপ্রিয় হয়।

এ এমন পরিচয় অ্যালবামের প্রচ্ছদ; Source: youtube.com

তবে সোলস তার আগের খোলস ভেঙে পুরোপুরি বেরিয়ে আসে ১৯৯৫ সালের ‘আজ দিন কাটুক গানে’ অ্যালবামের মাধ্যমে। এই অ্যালবামের গানের কথা, সঙ্গীতায়োজন এবং সুরে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা’, ‘চায়ের কাপে পরিচয়’, ‘নীরবে’, ‘ব্যস্ততা’, ‘এরই মাঝে’ ইত্যাদি গান এখনও মানুষের মুখে গুনগুন সুরে শোনা যায়। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় সোলসের সপ্তম অ্যালবাম ‘অসময়ের গান’। এই অ্যালবামে ‘আমি আর ভাবব না’, ‘ঐ দূর নীলে’ এবং ‘আইওনা আইওনা’ জনপ্রিয় হয়।

২০০০ সালে একটু ভিন্ন স্বাদের একুস্টিক মিউজিকে নিজেদের কিছু পুরনো গান, কিছু ওপার বাংলার জনপ্রিয় গান আর কিছু নতুন গানের মেলবন্ধনে তৈরি হয় তাদের ‘মুখরিত জীবন’ অ্যালবামটি। সুবীর সেনের জনপ্রিয় গান ‘সারাদিন তোমায় ভেবে’ নতুন করে আবার মানুষের মনে অন্য আঙ্গিকে উপস্থাপন করে পার্থ বড়ুয়ার কণ্ঠের জাদু।

সোলসের বর্তমান লাইন আপ; Source: jugantor.com

২০০৩ ও ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘তারার উঠোনে’ এবং ‘টু-লেট’ অ্যালবাম দুটি। টু-লেট অ্যালবামের ‘আগের জনম’ গানটি কথা ও সুরের জন্য বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ২০০৬ সালে মুক্তি পায় ‘ঝুট ঝামেলা’ অ্যালবামটি। নিত্যদিনের কিছু বাস্তব গল্পের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে এই অ্যালবামের কিছু গানে। ২০১২ সালে সোলসের ১২তম অ্যালবাম বের হয় ‘জ্যাম’ নামে। এতে নির্মলেন্দু গুণকে নিয়ে গানটি বেশ সাড়া ফেলে শ্রোতাদের মনে।

জ্যাম এ্যালবামের প্রচ্ছদ; Source: soulsbd.com

স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে স্বাধীন সময়ের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে চলছে সোলসের পথচলা। অনেক চড়াই উৎরাই পার করে সঙ্গীত জগতে এখনও শক্তিশালী স্থান দখল করে আছে ব্যান্ডটি। ভিন্নধর্মী কথা ও সুরে সব সময় শ্রোতাদের নতুন কিছু দেওয়ার চেষ্টা করে আসছে দলটি। এখন সেভাবে অ্যালবাম বের করা না হলেও নিয়মিত ব্যান্ডটিকে চোখে পড়ে টিভি, রেডিও ও বিভিন্ন শো-তে। সোলসের বর্তমান লাইন আপে আছেন পার্থ বড়ুয়া (লিড গিটার ও ভোকাল), নাসিম আলী খান (ভোকাল), মারুফ হাসান (বেস গিটার), শাহরিয়ার হোসাইন (কি বোর্ড) ও আহাসানুর রহমান (ড্রামস)। যেহেতু সোলসের গোড়াপত্তন ঘটেছিল চট্টগ্রামেই, তাই লেখাটি শেষ করছি ব্যান্ডটির চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গাওয়া একটি জনপ্রিয় গান দিয়ে, যাতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সৌন্দর্যের কথা বর্ণনা করে সেখানে বেড়াতে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

আইওনা, আইওনা আরার দেশত
আইওনা, আইওনা
তোয়ারা বেগে আইওনা আইওনা।
পাহাড় আছে সাইঙ্গর আছে
মনের মইধ্যে রং;
উচা নিচা পথ আছে
আছে মারফতি গান।
অফুরান ভালোবাসা আছে তোয়ারার লাই।।

ফিচার ইমেজ- soulsbd.com

Related Articles