Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কমিক্সের স্বর্গরাজ্য ব্রাসেলসের রাস্তা

কমিক্স পড়তে যারা ভালোবাসেন, তাদের জীবনের সকল জাগতিক আনন্দ যেন তালুবন্দী দু’হাতের কমিক্স বইয়ের চরিত্রগুলোর মাঝেই ন্যস্ত থাকে। কমিক্সের রংচঙে একেকটা চরিত্র তাদের কাছে বাস্তবের চাইতেও অনেক বেশি কিছু। চরিত্রগুলো তাদের এমন এক কল্পনা রাজ্যে নিয়ে যায়, যা বাস্তবের চাইতেও ঢের রোমাঞ্চকর। আর চরিত্রগুলোকে যদি বইয়ের পাতা হতে উঠে এসে দৈনন্দিন চলার রাস্তায় বিশাল বিশাল অট্টালিকার গায়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, তবে সেই সকল পাঠকদের নিশ্চয় মনে হবে যেন, তারা কল্পনার রাজ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ব্রাসেলসের বাড়ির দেয়ালে কমিক্স চরিত্ররা; Source: solsoutofoffice.com

এমনই এক কমিক্সপ্রেমী শহর ইউরোপের নগরকেন্দ্রিক দেশ বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস। ব্রাসেলসের রাস্তায় হাঁটতে গেলেই চোখে পড়বে উঁচু উঁচু অট্টালিকার দেওয়াল ধরে নেমে আসছে কুট্টুস, সাথে আছে নীল সোয়েটার পড়া টিনটিন। এমন হন্তদন্ত হয়ে নামতে দেখলে, মনে হওয়া স্বাভাবিক, কোনো নতুন অভিযানে নেমে পড়েছে তারা। পাশের বাড়ির দেয়াল থেকে হয়তো টিনটিনকে উদ্দেশ্য করে ডাকছে ক্যাপটেন হ্যাডক।

বাড়ির দেয়ালে টিনটিন, কুট্টুস ও হ্যাডক; Source: radissonred.com

আরও কিছুদূর হেঁটে যেতেই চোখে পড়বে অ্যাস্টেরিক্সের সাথে গল্পে মশগুল অবেলিক্স। এসব দেখতে দেখতে, হোঁচট খেয়ে পড়ার উপক্রম হওয়া অবাক কিছু নয়। কিন্তু হাস্যরসে ভর্তি এ শহরে তা দেখেও হাসির খোরাক জন্মানোর দৃশ্যটাও অকল্পনীয় নয়।

ব্রাসেলসের দেয়ালে জনপ্রিয় চরিত্র অ্যাস্টেরিক্স; Source: brusselspictures.com

ভাবতেই কেমন খটকা লাগছে, তাই না? ব্রাসেলসের রাস্তায় এমন দৃশ্য কিন্তু হরহামেশাই চোখে পড়ে। কমিক্সপ্রেমীদের জন্যে এ যেন এক স্বর্গরাজ্য। এই শহরের বিভিন্ন বাড়ির দেয়ালে বিশাল বিশাল ক্যানভাসে বিখ্যাত সব কমিক্স চরিত্র ফুটে উঠেছে বিভিন্ন শিল্পীর দক্ষ হাতের ছোঁয়ায়।

উঁচু অট্টালিকার সম্পূর্ণ দেয়াল জুড়ে কমিক্স চরিত্রের ছোঁয়া; Source: pinterest.com

কমিক্সের আবেদন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থাকলেও আধুনিক কমিক্সের জন্মস্থান ধরা হয় বেলজিয়ামকেই। বেলজিয়ামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে মিশে আছে কমিক্সের নেশা। ধারণা করা হয়, এখানে সাতশ’রও বেশি কমিক্স শিল্পী রয়েছেন। তাই অনেকে কৌতুকের সুরে বলেন, বেলজিয়ামের প্রতি বর্গ কিলোমিটারে একজন কমিক্স শিল্পীর খোঁজ মেলে। তবে বেলজিয়ামের মধ্যে ব্রাসেলসেই মনে হয় কমিক্স নিয়ে পাগলামি সবচাইতে বেশি। শহরটিকে কমিক্স বইয়ের রাজধানীও বলা হয়। এখানে আঁকাআঁকির প্রতিভা অল্পবিস্তর সকলের মাঝেই দেখা যায়। আর শহরের বিভিন্ন দেয়ালে আঁকা পরিচিত কমিক্সের চরিত্রগুলো সেই প্রতিভাই প্রমাণ করে।

দেয়ালে আঁকা আরও একটি মজার ছবি; Source: confusedjulia.com

বেলজিয়ামের অনেক কার্টুনিস্ট আছেন, যারা নিজেদের পেশা বদলে আর্টিস্ট হয়েছেন। বেলজিয়ামের কমিক্সগুলোর মধ্যে একটি পরিচিত নাম ‘স্পিরো’। ১৯৩৮ সালে প্রথম প্রকাশিত এই কমিক্সটি টিনটিন বা অ্যাস্টেরিক্সের মতো প্রতিষ্ঠিত কমিক্সগুলোর সাথে সমান তালে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই কমিক্সের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রবার্ট ভল্টার। তিনি পেশায় ছিলেন একটি কোম্পানির লিফটের পরিচালক। কিন্তু রক্তে ছিল ছবি আঁকার অদম্য নেশা। সুযোগ পেয়ে গড়ে তুললেন তার কমিক্স চরিত্র স্পিরো, যা বেলজিয়ামের একটি দৈনিকে নিয়মিত ছাপা হতো। পরবর্তীতে কমিক্সটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

দেয়ালে আঁকা জনপ্রিয় চরিত্র স্পিরো; Source: confusedjulia.com

বেলজিয়ামের মানুষের এই কমিক্স-প্রীতি কিন্তু একদিনে গড়ে ওঠেনি। অনেক বছর আগে থেকেই তাদের কমিক্সের প্রতি দুর্বলতা ছিল। তা সত্ত্বেও ১৯০০ সালের আগে বেলজিয়ামে নিজেদের কোনো কমিক্স চরিত্র রূপায়িত হয়নি। কমিক্সের কোনো ম্যাগাজিন বা বইও ছিল না তখন। ১৯০০ সালের দিকে ‘বেকাসিন’ ও ‘লেস পেইদস নিকোলেস’ নামে ফ্রান্সে দুটো কমিক্সের ম্যাগাজিন ছাপা হতে শুরু করে। সাথে ছিল তরুণদের নিজেদের আঁকা কিছু কমিক্সের বই। বিভিন্ন পত্রিকার এক কোণায় ছোট অংশ জুড়ে আলাদাভাবে কমিক্স আসতে শুরু করে বেলজিয়ামে। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের কাছে কমিক্সগুলো বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। কমিক্সগুলোর অধিকাংশই ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশের তৈরি। মার্কিন কমিক্সও তখন বেশ জনপ্রিয় হতে শুরু করে বেলজিয়ামে।

প্রথম দিকের কমিক্স চরিত্র বেকাসিন; Source: bedetheque.com

১৯৩৪ সালে, ওয়াল্ট ডিজনির ‘দ্য এডভেঞ্চার অফ মিকি মাউস’ কমিক্স দুনিয়ার চেহারা পাল্টে দিল। অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবীজুড়ে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বেলজিয়ামেও এসকল কমিক্সের আবেদন দিন দিন বাড়তে থাকে। রাতারাতি অনেক প্রকাশনা সংস্থা, এসব মার্কিন কমিক্সগুলো ছাপানোর জন্যে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বেলজিয়ামে কমিক্স আমদানি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। দ্রুত মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে প্রকাশনা সংস্থাগুলো। যেহেতু পুরো বেলজিয়াম জুড়ে কমিক্সের বেশ ভালো বাজার ছিল, স্থানীয় কমিক্স শিল্পীদের তখন কদর বাড়তে থাকে। প্রথমের দিকে তারা মার্কিন কমিক্সগুলোরই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুদিন পরেই নিজস্ব চরিত্র আর কাহিনী দিয়ে পাঠকদের মনোরঞ্জন করতে সক্ষম হয় এখানকার শিল্পীরা। এরপর থেকে বেলজিয়ামের কমিক্স বাজার বেশ শক্তিশালী হতে থাকে।

ওয়াল্ট ডিজনির আঁকা ‘দ্য এডভেঞ্চার অফ মিকি মাউস’ এর প্রচ্ছদ; Source: undergroundbooks.net

বেলজিয়ামের কমিক্সের ইতিহাসে সবচাইতে যুগান্তকারী আবিষ্কার ‘দ্য এডভেঞ্চার অফ টিনটিন’ এর টিনটিন চরিত্রটি। বেলজিয়ামের কার্টুনিস্ট জর্জেস প্রসপার রেমি, যাকে আমরা হার্জ নামেই বেশি চিনি, ১৯২৯ সালে ‘টিনটিন ইন দ্য ল্যান্ড অফ দ্য সোভিয়েতস’ দিয়ে এই কমিক্সের প্রথম যাত্রা শুরু করেন। মূলত টিনটিনকে দিয়েই বেলজিয়ামের মৌলিক কমিক্সের পথচলার শুরু। টিনটিনের মোট ২৪টি অভিযানের বই ৭০টিরও বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এছাড়াও লাকি লুক, দি স্মার্ফ, অ্যাস্টেরিক্স ইত্যাদিও বিশ্বের কমিক্সপ্রেমীদের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়।

চব্বিশটি টিনটিনের প্রচ্ছদের সংকলন; Source: 365booksplease.blogspot.com

কমিক্সের জনপ্রিয়তা সাধারণ মানুষের মাঝে ধরে রাখতে, ১৯৯১ সালে বেলজিয়াম কমিক স্ট্রিপ সেন্টারের সহযোগিতায় ব্রাসেলস শহরের স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে একটি অভিনব প্রকল্পের শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে ব্রাসেলসের কেন্দ্রে ল্যাকেন ও অদরগেম এলাকার কিছু বাড়ির খালি দেয়ালে কমিক্স বইয়ের বিভিন্ন চরিত্রের ছবি আঁকার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু খুব অল্প সময়ে তাদের এই কীর্তি স্থানীয়দের বেশ পছন্দ হতে শুরু করে এবং রাস্তাটির খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

বেলজিয়াম কমিক্স স্ট্রিপ সেন্টার; Source: theculturetrip.com

দেয়ালে আঁকা এই ছবিগুলোকে মূলত ‘ম্যুরাল’ বলা হয়ে থাকে। চাহিদার ভিত্তিতে পঞ্চাশটিরও বেশি কমিক্স ম্যুরাল তৈরি করে কমিক স্ট্রিপ সেন্টারটি। আর রাস্তাটি ‘কমিক স্ট্রিপ’ নামে পরিচিত হতে থাকে। বর্তমানে একে ‘কমিক বুক রুট ইন ব্রাসেলস’ বলা হয়। রাস্তাটির কমিক্স ম্যুরালগুলোর একেকটি ৩০ থেকে ৮০০ বর্গ মিটার পর্যন্তও হয়ে থাকে। বছরে শুধুমাত্র দুই থেকে তিনটি ম্যুরালই সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। জর্জ ওরুপুলাস এবং ডেভিড ভেন্ডিগার্ড এই ম্যুরালগুলোর সাথে জড়িত ছিলেন এবং সাথে ছিলেন অসংখ্য সহযোগী।

বিশাল বিশাল দেয়াল জুড়ে আঁকা ম্যুরাল; Source: theculturetrip.com

এই রাস্তার সুখ্যাতির ফলে এখানে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের ভিড় বাড়তে থাকে। অনেক কমিক্সপ্রেমীদের বিস্ময়ের স্থান এই কমিক্স স্ট্রিপ। অনেকের হয়তো কল্পনারও বাইরে যে একটি পুরো শহর কমিক্সের চরিত্র দিয়ে ঠাসা হতে পারে। ব্রাসেলসের পর্যটন সংস্থা প্রো-ভেলো দর্শনার্থীদের গোটা শহর ঘুরে দেখানোর জন্য দুই ঘণ্টার একটি সাইকেল ভ্রমণেরও ব্যবস্থা রেখেছে।

ব্রাসেলসের আরেকটি জনপ্রিয় ম্যুরাল; Source: confusedjulia.com

ব্রাসেলসে জুড়ে সর্বত্র যেন কমিক্সের মেলা। অসংখ্য দোকান, স্ট্যাচু, দেয়াল, জাদুঘর, বার, কফিশপ ইত্যাদিতে বিভিন্ন কমিক্স চরিত্রের প্রতিমূর্তি হরহামেশাই চোখে পড়ে। বই থেকে বাইরে চোখ রেখে, নিত্যদিনের কাজে কমিক্সের বন্ধুদের সাথী করে পেলে যে কোনো কমিক্সপ্রেমীর ভালো লাগা দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

ফিচার ইমেজ- blog.expedia.nl/brussel

Related Articles