Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আমাদের জীবন যেভাবে আটকে যাচ্ছে স্মার্টফোনের ভেতরে

মানতে কষ্ট হলেও কঠিন সত্য হলো, বর্তমান সময়ে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি আগ্রহের চেয়ে একটি স্মার্টফোনের প্রতিই আমাদের অনেক বেশি আগ্রহ। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আমাদের প্রেমকাহিনী থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন, অবসর সময় কাটানো, এমনকি শরীর-স্বাস্থ্যের উপর স্মার্টফোনের বিস্তর প্রভাব পড়েছে। আমরা আমাদের ফোনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছি। কিছু ক্ষেত্রে সেটা কাজের প্রয়োজনে নির্ভরশীলতা হলেও, আদতে স্মার্টফোনকে নিজেকে অবজ্ঞা করার কাজেই ব্যবহার করছি আমরা। মানুষের সাথে প্রযুক্তির এই ভয়াবহ সম্পর্কের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে কিছু কথা থাকছে এই লেখায়।

১. আসক্তি

বর্তমান প্রজন্মের স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা দিনের ২৪ ঘণ্টার বড় একটি সময় কাটায় তাদের স্মার্টফোনে সময় ব্যয় করে। ব্যাপারটা এতটাই বহুল প্রচলিত হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এটাকে কেউ কেউ আসক্তি হিসেবে মানতেও নারাজ। কিন্তু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়, স্মার্টফোনের কারণে আমরা চুপচাপ দু’দণ্ড বসতেও পারছি না। একটু ফুরসৎ পেলেই নেট ব্রাউজিং, চ্যাটিং, ডাউনলোডিং শুরু হয়ে যাচ্ছে!

সময়ে-অসময়ে স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরা; source: pocketnow.com

সুস্থির হয়ে বসে নিজের অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে ভীত হয়ে উঠছে অনেকেই। মস্তিষ্ক খাটিয়ে কিছু চিন্তা করতে পারছে না তারা, কল্পনাশক্তি কমে যাচ্ছে। দুঃখ, অনুশোচনা, আবেগ, জীবনের লক্ষ্য নিয়ে ভাবনা ইত্যাদি এড়ানোর জন্য স্মার্টফোনকে ব্যবহারের ব্যর্থ চেষ্টা করছে অনেকেই। এভাবে স্মার্টফোনে আসক্ত হওয়ার ফলে দুর্বিষহ জীবন ও অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যৎ তাদেরকে আরও শক্ত করে জাপটে ধরছে। যার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।

২. পরিবার ও প্রেম

আমরা সবাই আমাদের পরিবারকে ভালবাসি, ভালোবাসার মানুষটির প্রতি সংবেদনশীল ও যত্নবান থাকি। কিন্তু সবসময় কি আমাদের সময়টা ভাল যায়? কত ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে বিব্রত হই আমরা। কষ্ট পাই, হতাশায় ভুগি। পরিবার হয়তো আমাদেরকে বুঝতে পারে না, হয়তো আমরা পরিবারের চাহিদা মেটাতে পারি না কিংবা পরিবারের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা হয়ে ওঠে না। ফলে দেখা যায়, পরিবার-পরিজনদের সাথে মনোমালিন্য ও একধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে যতটুকু ভালবাসা, সাপোর্ট, আবেগ, হৃদয়গ্রাহী কথা ও উৎসাহের বাণী আশা করা হয় সেটাও হয়তো পাওয়া হয় না, ভুল বোঝাবুঝি হয়। সব মিলিয়ে একধরনের মানসিক অশান্তি ও চাপে ভুগতে শুরু করে মানুষ। এখান থেকে মুক্তি পেতে সে ধীরে ধীরে স্মার্টফোনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। তার হাতের ছোঁয়ার পাওয়া মাত্রই আদেশ পালন করে স্মার্টফোন। ফলে ধীরে ধীরে ফোনটি তার সবচেয়ে কাছের ও ঘনিষ্ঠ বস্তু হয়ে পড়ে।

নিজেদের অজান্তেই স্মার্টফোনের হাতে বন্দি হয়ে যাচ্ছি আমরা; source: img.etimg.com

পরিবার, পরিজন ও ভালোবাসার মানুষটির সাথে বিপদজনকভাবে দূরত্ব বাড়তে থাকে তার। অথচ তার উচিত ছিল জীবনের সমস্যাগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া, সময় দেওয়া ও সেগুলো সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করা। সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়াটা কখনও কোনো সমাধান হতে পারে না। পরিবার, বন্ধু, প্রিয়জনের সাথে দূরত্ব তৈরি করতে করতে করতে স্মার্টফোনে আসক্ত ব্যক্তিরা একসময় একা হয়ে যায়। পরবর্তীতে তারা মারাত্মক হতাশায় ভুগতে শুরু করে।

৩. ডেটিং

আজকাল প্রেম করাটা যেন ডাল-ভাত হয়ে গেছে, তাই না? লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি আছে ফেসবুকে, অনলাইনে। প্রেম করার জন্য একজনকে খুঁজে পাওয়াটা খুব কঠিন কিছু নয়। কোনোদিন সামনাসামনি দেখা না হয়েও স্রেফ চ্যাটিং আর ছবি আদান-প্রদান করেই প্রেম শুরু হয়ে যাচ্ছে। সবাই নিজের জন্য সেই তথাকথিত ‘সঠিক ব্যক্তি/রাইট পারসন’ খুঁজতে ব্যস্ত। কিছুদিন প্রেম করে হিসেব না মিললেই সম্পর্ক শেষ! স্মার্টফোনে তৈরি সম্পর্ক স্মার্টফোনেই ইতি। আবার নতুন কারও খোঁজে নেমে পড়া। এটাকে কি ভালোবাসা বলে? রূপকথার গল্পের মতো ‘সঠিক ব্যক্তি’টিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘রাইট পারসন’ বলতে হয়তো কিছু নেই। ভালোবাসার মাধ্যমে কারও সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া/উপযুক্ত করে নেওয়াটাই ভালোবাসার প্রধান অর্জন। তাই ভালোবাসায় জড়ানোর ক্ষেত্রে ‘সঠিক ব্যক্তি’ বিষয়টি কখনও পূর্বশর্ত হতে পারে না।

স্মার্টফোন ঘন ঘন সম্পর্ক বদলাতে বলে না বা প্রেম, ভালোবাসার শিক্ষা দেয় না আমাদেরকে। এটা আমাদের সাথে লক্ষ লক্ষ ব্যক্তির ভার্চুয়াল সংযোগ ঘটিয়ে দেয় মাত্র। ভালবাসা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এখানে সহমর্মিতা, আবেগ, বোঝাপড়া ও মানবিক দুর্বলতা জড়িত। এ ব্যাপারে স্মার্টফোন আমাদেরকে প্রকৃতপক্ষে কোনো সাহায্য করতে পারে না।

মানসিকভাবে ভঙ্গুর হয়ে বেড়ে উঠছে তরুণ প্রজন্ম; source: ikydz.com

বরঞ্চ অনেক কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণী পর্যন্ত এই স্মার্টফোনের মাধ্যমে ‘প্রেম’ নামক মোহে পড়ে মানসিক আঘাত পাচ্ছে। যেটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে পরবর্তী জীবনে। সাইবার ক্রাইম, ব্ল্যাকমেইল ও আত্মহত্যা পর্যন্ত হচ্ছে।

৪. মূল্যায়ন

স্মার্টফোনগুলো পুরো দুনিয়াটাকে সরাসরি একদম হাতের মুঠোয় এনে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের অজান্তেই আমাদের দৃষ্টিসীমাকে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছে এই স্মার্টফোনগুলো। ফোন হাতে নিয়ে আমরা প্রকৃতি দেখতে ভুলে যাচ্ছি। প্রচণ্ড পরিশ্রম শেষে ক্লান্ত হয়ে বসে আয়েশ করতে ভুলে যাচ্ছি, কারণ তখনও আমাদের হাতে স্মার্টফোন থাকে। পরিপূর্ণ ঘুম দিয়ে সকাল সকাল বিছানা ছাড়তে ভুলে যাচ্ছি। রাত জেগে স্মার্টফোন ব্যবহার করায় সকালে দেরিতে ঘুম থেকে উঠছি।

রাত জেগে স্মার্টফোনে সময় অপচয় করে মানসিক ও শারীরিক ক্ষতিসাধন করি আমরা; source: sciencedaily.com

কাজে যাওয়ার আগে ন্যূনতম এক ঘণ্টাও আমরা নিজেদের দিতে পারছি না। যাওয়ার পথেও সেই স্মার্টফোনে মুখে গুঁজে থাকছি। আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘের ভেলা আমাদের চোখে পড়ে না। চারপাশ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা কমে যাচ্ছে। অনেক ছোট ছোট কিন্তু চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত করছি নিজেদের।

৫. চেক-ইন

রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে, বন্ধুর বাসায় গিয়ে, সিনেমা হলে গিয়ে, সমুদ্র দেখতে গিয়ে চেক-ইন না দিলে চলে? স্ট্যাটাস থাকবে বন্ধুমহলে? ওরা তো চেক-ইন দেয়, আমি কেন দেব না? এভাবেই চলে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এক হাস্যকর প্রতিযোগিতা। এসব কি খুবই দরকারি? জীবনে কতটুকু গুরুত্ব রাখে এসব ভার্চুয়াল চেক-ইন?

কখনও বাবা-মায়ের কাছে সম্পর্কের চেক-ইন দিয়ে দেখা হয়? তারা কেমন আছেন? আমাদেরকে নিয়ে তাদের ভাবনা, পরিকল্পনাটা কী? জানতে চাওয়া হয় কখনও আমাদেরকে কিছু বলার আছে কিনা তাদের? পারিবারিকভাবে আড্ডা দেওয়া হয় ভাই, বোন, বাবা, মাকে নিয়ে?

ভার্চুয়াল জগতে নয়, নিজের পরিবারকে বেশি সময় দিন; source: tophdimgs.com

কখনও ছোট্ট একটা বাচ্চার সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হয়? বাস্তবে বাস করে ভার্চুয়াল জগতেই অধিকাংশ সময় অপচয় করছেন কিনা ভেবে দেখেছেন কখনও? চেক করে দেখেছেন, স্মার্টফোন হাতে আসার আগের আপনি আর এখনকার আপনির মাঝে পার্থক্য কতটা? আদৌ স্মার্ট হয়েছেন কি? নাকি ভার্চুয়াল দুনিয়ার মিথ্যা মোহে নষ্ট করে চলেছেন নিজেদের মূল্যবান সময়গুলো? ভার্চুয়াল জগতটা আপনার বাস্তব জগত থেকে কতকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, খেয়াল করেছেন?

৬. লাইক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা

স্বীকার করুন আর না-ই করুন, ‘লাইক’ পেতে আমাদের সবারই ভাল লাগে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের শেয়ার করা ছবি, স্ট্যাটাস, কবিতা, গল্প প্রকাশ করে চলেছি। স্মার্টফোনগুলো সবাইকে অবারিত সুযোগ করে দিচ্ছে। এটা মন্দ নয়। কিন্তু যখন শুধুমাত্র লাইক পাওয়ার আশাতেই এসব করা হয়, তখন সেটা আর নিরীহ অবস্থানে থাকে না। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মিথ্যে, বানোয়াট, অশ্লীল লেখা ও ছবি প্রায়ই দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে। সেগুলোর প্রভাব ভার্চুয়াল জগতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। খুনোখুনি থেকে শুরু করে দাঙ্গা পর্যন্ত বেঁধে যাচ্ছে। হাতে হাতে স্মার্টফোনের কল্যাণে মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে চটকদার নিউজ বা ছবি।

সোস্যাল মিডিয়ায় যেভাবে কনটেন্ট ভাইরাল হয়; source: robertjrgraham.com

সত্য, মিথ্যা যাচাই না করেই ‘লাইক’ পাওয়ার আশায় সবাই শেয়ার করছে। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আমরা সবাই দৃষ্টি আকর্ষণ করায় ব্যস্ত। কেউই সুস্থির নই। ভাবনা-চিন্তার সময় নেই, সবাই ঝাঁপিয়ে পড়তে উন্মুখ, সেই ঝাঁপটা আগুনে হলেও কারও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।

৭. সেলফি

সেলফি ভালো জিনিস। আমরা সবাই সেলফি তুলি, তোলায় দোষ নেই। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা অনেকেই খুবই বালখিল্যতার পরিচয় দেই সেলফিতে। কুকুরের মতো জিহ্বা বের করা, মুখ বাঁকা করা, চোখ ট্যাঁরা করা সহ শত শত অপরিপক্ক ভঙ্গিতে আমরা সেলফি তুলি। আমরা ভাবি সেলফি মানেই এমন অদ্ভুত, উদ্ভট কিছু।

প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী র‌্যামব্যান্ট নিজেই নিজের ছবি আঁকতেন। নিজের সুদীর্ঘ জীবনে একশ’রও বেশি ছবি এঁকেছেন তিনি। কিন্তু একটি ছবিতেও বালখিল্য মুখভঙ্গি আঁকেননি। উনি নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে গেছেন গভীরভাবে। কী ছিলেন আর ধীরে ধীরে কী হচ্ছেন। জীবনের মানে খুঁজেছেন, কী করলেন এক জীবনে সেই হিসেব মেলাতে চেয়েছেন।

অন্যদিকে আমরা সেলফি বলতে শুধু মশকরাকেই বুঝি। আমাদের কোনো প্রকৃত লক্ষ্য নেই। লক্ষ্যহীনভাবে সময় অপচয় করে চলেছি। সেলফি তোলাটা মজার পাশাপাশি আর্টও হতে পারে সেটা আমাদের মাথায় আসে না। বরঞ্চ আমরা বিপদজনকভাবে সেলফি তুলতেই বেশি পছন্দ করি।

সেলফি তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে এরকম সংবাদ প্রায়ই পাওয়া যায়। এছাড়াও সেলফি তোলার প্রতি আসক্তিকে মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। স্মার্টফোনের দৌরাত্ম্যে নিজের ছবি তোলাটাও একধরনের মানসিক ব্যধিতে পরিণত হয়েছে!

স্মার্টফোন তৈরি করছে দূরত্ব; source: govtech.com

স্মার্টফোনের কয়েকটি খারাপ দিক নিয়ে লেখা হয়েছে মানে এই নয়, স্মার্টফোন গ্যাজেটটিই খারাপ। স্মার্টফোন অত্যন্ত কার্যকরী একটি বস্তু। কিন্তু এর কার্যকারিতা নির্ভর করছে ব্যবহারকারীর উপর। ব্যবহারকারী যদি সচেতন না হন, তাহলে নিজের ক্ষতির পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের এমনকি দেশেরও ক্ষতি করে ফেলতে পারেন।

সত্যি বলতে কী, আমরা যতটা উন্নত প্রযুক্তির সংস্পর্শে চলে এসেছি, এই প্রযুক্তির সাথে যথাযথভাবে খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো পরিপক্বতা আমাদের এখনও হয়ে ওঠেনি। তাই আমাদেরকে অনেক সচেতন হতে হবে। স্মার্টফোন কীভাবে ব্যবহার করছি, কাকে ব্যবহার করতে দিচ্ছি, এসব নিয়ে সচেতন না হলে এর শাস্তি অচিরেই ভোগ করতে হবে আমাদের।

ফিচার ইমেজ- albertonrecord.co.za

Related Articles