Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বুলিমিয়া নার্ভোসা: মুটিয়ে যাবার ভয় (২য় পর্ব)

অনেকেই রয়েছেন যারা চিন্তিত থাকলে বা একাকিত্ব বোধ করলেই খাওয়া-দাওয়ায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। অর্থাৎ খাবারের মাধ্যমে মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকা। মুটিয়ে যাবার ভয় মোটামুটি সকলের মধ্যেই দেখা যায়, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসচেতন মহলে। আর এই ভয় থেকেই শুরু হয় ইটিং ডিসঅর্ডার। ধরনে পার্থক্য থাকলেও সব ধরনের ইটিং ডিসঅর্ডারই মোটা হবার ভয় থেকেই হয়ে থাকে। যেমন- অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসাতে মোটা হয়ে যাবার ভয়ে খাওয়াই বন্ধ করে দেয়। কিন্তু যদি এমন হয় অনেক খাবার খাওয়ার পর মনে পড়ল মোটা হয়ে যেতে পারে এবং সেজন্য তৎক্ষণাৎ বমি করে ফেলার চেষ্টা বা মাত্রাতিরিক্ত ব্যায়াম ইত্যাদি শুরু করে দিলেন? সেটাও কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। এটিও এক প্রকার ইটিং ডিসঅর্ডার। এর নাম ‘বুলিমিয়া নার্ভোসা’।

বুলিমিয়া নার্ভোসা কী?

ভয়াবহ এক ইটিং ডিসঅর্ডারের নাম ‘বুলিমিয়া নার্ভোসা বা বুলিমিয়া’। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি খাবার দেখলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না এবং গোগ্রাসে খেতে থাকেন। খাবার পর হঠাৎ মনে হবে মোটা হয়ে যাবেন বা ওজন বেড়ে যাবে। এই ভাবনা মাথায় আসার সাথে সাথেই বিভিন্নভাবে চেষ্টা করবে গ্রহণকৃত খাবার বের করে দিতে। গলা পর্যন্ত হাত ঢুকিয়ে বমি করে, ওষুধ খেয়ে, মাত্রারিতিরিক্ত ব্যায়াম করে বা অন্য কোনো উপায়ে। এটা শরীরের জন্য কতটা ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে  না।

বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি গলায় হাত ঢুকিয়ে বমি করার চেষ্টা করে; source: CBS news

মার্কিন মনোচিকিৎসক জেরাল্ড রাসেল ১৯৭৯ সালে এ রোগের বর্ণনা দেন এবং শ্রেণীবিভাগ করেন। বুলিমিয়া নার্ভোসা কথাটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে যার অর্থ ‘সাংঘাতিক ক্ষুধার্ত’। এ ধরনের রোগীদের যত দ্রুত সম্ভব প্রফেশনাল ব্যক্তিবর্গের সাহায্য নেয়া প্রয়োজন।

প্রকারভেদ

বুলিমিয়াকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়-

  • অল্প সময়ের মধ্যে অনেক খেয়ে ফেলবেন এবং সাথে সাথেই ইচ্ছাকৃত বমি করে, হাই পাওয়ারের হজমি ওষুধ খেয়ে সেটাকে প্রশমনের চেষ্টা করবেন। প্রতিনিয়ত এরকম করেই যাবেন।
  • অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর খেয়ে ফেলবেন কিন্তু এর পরপরই মাত্রাতিরিক্ত ব্যায়াম করবেন বা না খেয়ে থাকবেন।

কাদের হয়?

সাধারণত তরুণীদের ভেতরে বেশি দেখা গেলেও যেকোনো বয়সী পুরুষ এবং মহিলারই বুলিমিয়া হতে পারে।

বুলিমিয়ার আক্রান্ত ব্যক্তি অল্প সময়ে প্রচুর খেয়ে ফেলেন এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না নিজেকে; source: bune.de

কেন হয়?

সৃষ্টিজগতে হয়তো একমাত্র মানুষই তার শারীরিক গঠন নিয়ে চিন্তিত থাকে এবং খাদ্যাভ্যাসে সেই চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। আর এর থেকেই হতে পারে বুলিমিয়ার মতো ইটিং ডিসঅর্ডার।

নিম্নোক্ত কারণে হতে পারে বুলিমিয়া-

  • নিজের বাহ্যিক গঠন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা;
  • আত্মমর্যাদার অভাব;
  • লাইফ স্ট্রেস;
  • লাইফ ট্রমা বা কখনো নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকলে।

লক্ষণ

বেশ কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলোকে একসাথে কারো মাঝে দেখলে বুলিমিয়ায় আক্রান্ত বলে ধরে যেতে পারে

শারীরিক লক্ষণ

  • ঘনঘন ওজন পরিবর্তন হওয়া (হঠাৎ বেড়ে যাওয়া আবার কমে যাওয়া);
  • কখনোই ওজন কম হয় না, স্বাভাবিক বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি থাকতে পারে;
  • ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করার কারণে গালে এবং গলায় ক্ষতের সৃষ্টি, দাঁতের ক্ষতি হওয়া বা দাঁত হলুদাভ হয়ে যাওয়া;
  • মাঝেমাঝে খাবার সহ্যই করতে না পারা;
  • কোষ্ঠকাঠিন্য;
  • মেয়ে এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে মেন্সট্রুয়েশন বন্ধ হয়ে যাওয়া বা অনিয়মিত হওয়া;
  • অবসন্নতা;
  • ক্লান্ত বোধ করা;
  • ঘুমে ব্যাঘাত।

গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করার সময় হাত ও দাঁতের ক্ষতি হয়; ছবিসূত্রঃ ptmedical.pt

হাতের এরকম ক্ষতকে রাসেলের সাইন বলা হয় যা দেখে বুলিমিয়া রোগীকে সনাক্ত করা যায়; source: Kyukyusha

মনস্তাত্ত্বিক লক্ষণ

  • দেহের গঠন, খাদ্যাভ্যাস এবং ওজন নিয়ে সবসময় চিন্তিত থাকা;
  • বেশি খাবার ফলে নিজেকে দোষারোপ করা, লজ্জিত হওয়া;
  • আত্মমর্যাদার অভাব;
  • নিজেকে মোটা ভাবা (যদিও বয়স এবং উচ্চতা অনুযায়ী ওজন স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে);
  • বারবার খাওয়ার ইচ্ছা কাজ করা আবার খাওয়াকে নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছাও কাজ করা;
  • নিজের দেহ নিয়ে প্রবল অসন্তুষ্টি;

বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির দাঁতের অবস্থা; source: Slideplayer

আচরণগত লক্ষণ

  • গোগ্রাসে খাওয়া;
  • খাবার পরপরই ওয়াশরুমে যাওয়া এবং বমি করার চেষ্টা করা। বমি না হলে গলায় আঙুল ঢুকিয়ে বমি করার চেষ্টা;
  • একা একা খাওয়া বা লুকিয়ে লুকিয়ে খাওয়া;
  • বেশিরভাগ সময় একা একা থাকতে চাওয়া;
  • খাবার নিয়ে মিথ্যা বলা, যেমন- না খেয়েও বলবে খেয়েছে, প্রচুর খেয়েও বলবে খায়নি এরকম;
  • প্রচুর ব্যায়াম করা, এমনকি অসুস্থ থাকলেও। ব্যায়াম করতে না পারলে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাওয়া;
  • খাবারে জন্য প্রচুর টাকা খরচা করা;
  • নিজেকে কষ্ট দেয়া, এমনকি আত্মহত্যারও চেষ্টা করা।

বুলিমিয়ার প্রভাব

বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ তথা জীবন থাকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। সবচেয়ে ভয়াবহ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হলো ডিহাইড্রেশন। জোর করে বমি করা, রেচন-নাশন ওষুধ সেবন ইত্যাদি দেহের ইলেক্ট্রোলাইটিক ব্যালেন্স নষ্ট করে ফেলে যার ফলে দেহে, পটাশিয়ামের মাত্রা অনেক কমে যায়। পটাশিয়ামের মাত্রা কমে যাওয়ার ফলে তন্দ্রাভাব, ঘোলাটে চিন্তাভাবনা থেকে শুরু করে অনিয়মিত হৃদকম্পন (অ্যারিদমিয়া), হৃদপেশি দুর্বল হয়ে পড়া এবং মৃত্যুও হতে পারে। এছাড়াও পটাশিয়ামের অভাবে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। শুধু পটাশিয়াম কমে যায় তা নয়, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম এবং ভিটামিনের অভাবও লক্ষণীয়। তাছাড়া রোগীর লো ব্লাড প্রেশার এবং অ্যানিমিয়া হতে পারে।

বমির চেষ্টার সময় গলায় এবং গালে ও হাতে সৃষ্ট ক্ষত থেকে ইনফেকশন হতে পারে। ইনফেকশনের মাত্রা বেড়ে যেতে থাকলে সেখান থেকে ক্যান্সারও হবার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া রোগীর মাঝে দুশ্চিন্তা এবং হতাশা অনেক বেড়ে যায়। তাদের ভেতর ওসিডি’র লক্ষণগুলো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বারবার বমির চেষ্টা থেকে হাতে সৃষ্ট ঘা; source: Ehc-neuwied.co

অপুষ্টির কারণে হরমোন নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে যা সেক্স ড্রাইভ নষ্ট করে দেয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণু উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং সন্তান ধারণ ক্ষমতা হারাতে পারেন। আর কোনো গর্ভবতী মহিলা যদি বুলিমিয়ার আচরণগুলো করতে থাকেন তাহলে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, যেমন- মিসক্যারেজ, ডায়াবেটিস, জন্মগত ত্রুটি ইত্যাদি।

চিকিৎসা

বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সনাক্ত করা যায়, তত ভালো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, কেননা তারা লুকিয়ে রাখেন তাদের আচরণগুলো। তাই পরিবারের সদস্যদের সজাগ থাকতে হবে সবচেয়ে বেশি।

যেহেতু বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে নেতিবাচক ধারণা এবং আত্মমর্যাদার অভাব বুলিমিয়ার মূল কারণ, তাই থেরাপির মূল উদ্দেশ্য হবে এই দুটি দিককে উন্নত করে তোলা।

প্রথম ধাপ

বুলিমিয়ার চিকিৎসায় প্রথমেই ‘খাদ্য গ্রহণ করা এবং বের করে দেয়া’ এই চক্র ভেঙে স্বাভাবিকভাবে খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত করাতে হবে।

‘খাবার গ্রহণ এবং বের করে দেয়া’ চক্র; source: slideplayer

এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অনুসরণ করা জরুরি-

  • ক্ষুধা লাগলে তারপর খাবেন এমনটা না করে বরং কিছুটা ক্ষুধা লাগছে অনুভব করলে তখন খান।
  • নিয়মিত খান; যেমন- ৪ ঘণ্টা পরপর খাওয়ার অভ্যাস করুন।
  • কী খাচ্ছেন তা খেয়াল করে খান, খাবারের প্রতিটি স্বাদ, গঠন অনুভব করে খাওয়ার চেষ্টা করুন।

দ্বিতীয় ধাপ

নেতিবাচক মনোভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে, বিশেষ করে শারীরিক গঠন, ওজন এবং খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কিত নেতিবাচক ধারণাগুলো। এক্ষেত্রে অনুসরণীয়-

  • নিজের আবেগকে অনুভব করছেন কীভাবে তা বোঝার চেষ্টা করুন।
  • যা ঘটছে তা মেনে নেয়ার মানসিকতা খুব জরুরি।
  • মনের ভেতরে এই ধারণা পোষণ করুন যে, আপনি আপনার অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, সে ক্ষমতা আপনার রয়েছে। সেগুলো আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করবে কেন! যখন প্রচন্ড অস্থির লাগবে তখন বসে পড়ুন, ভাবতে থাকুন কেন এমন হচ্ছে। প্রথম প্রথম সম্ভব না হলেও আপনি চাইলেই পারবেন।

ডাক্তারের পরামর্শ

ইনফেকশন বা অন্যান্য জটিলতাগুলোকে সারিয়ে তুলতে ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা।

কী করবেন যদি আপনার পরিচিত বা পছন্দের কেউ বুলিমিয়া আক্রান্ত হয়ে থাকে?

সহযোগিতা করুন

মনে রাখবেন, বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ করেই রেগে যেতে পারেন, আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারেন। যদি তা না হয়ে তিনি কিছু বলেন তাহলে শুনুন তার কথাগুলো। তবে জাজমেন্টে যাবেন না।

অপমান করবেন না বা দোষারোপ করবেন না

বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি এমনিতেই অনেক স্ট্রেসের ভেতর দিয়ে গিয়ে থাকেন। তার উপর আপনি যদি আরো নেতিবাচক কথাবার্তা বলেন তাহলে তার জন্য মারাত্মক হয়ে উঠবে।

রোগীকে ইতিবাচক ধারণা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে হবে; source: bulimia-archives

ভালো উদাহরণ দিন

তার সামনে ভালো উদাহরণ তুলে ধরুন। যেমন আপনার নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণাগুলো।

সর্বোপরি সচেতনতাই পারে বুলিমিয়ার ঝুঁকি কমাতে। নিজে সচেতন হোন, অন্যকে সচেতন করুন। সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন এবং নেতিবাচকতাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।

প্রথম পর্ব- অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা

ফিচার ইমেজ- Generation Wired

Related Articles