চিকুনগুনিয়া কী, কারণ এবং প্রতিকার

আজকাল বড্ড বেশি চোখে পড়ছে, কানে আসছে শব্দটি, যার সাথে মিশে আছে ভয়। কখন জানি চিকুনগুনিয়া হয়। আশেপাশে মশা দেখলেই তিড়িং করে লাফিয়ে উঠি। এই বুঝি মশাটা কামড়ে দিল। এই বুঝি পড়লাম চিকুনগুনিয়ার কবলে। এই বর্ষা বাদলের দিনে মশাদেরও কমতি নেই। কী করে বুঝি কোনটা এডিস, কোনটা নয়? জানি, এই অভিজ্ঞতা আমার মতো এখন আপনাদের অনেকেরই হচ্ছে। মশা এমন এক প্রাণী যার কাছ থেকে সহজে মুক্তি নেই। ফলে ভাগ্যের উপর ভর করে মশার কামড় এড়িয়ে চলা ছাড়া তেমন কোনো উপায়ও নেই। তবে হ্যাঁ, যেকোনো রোগ প্রতিরোধ বা প্রতিকারে সচেতনতা আবশ্যকীয়। শুধু নিজের জন্য না হোক, বাড়ির আর পাঁচ জনের কথা ভেবেও যতটুকু সম্ভব প্রতিরোধ গড়ে তোলা, চিকুনগুনিয়া সম্পর্কে জানা এবং চিকুনগুনিয়া হয়ে গেলে বিচলিত না হয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা নেয়ার জন্য নিজেকে তৈরি রাখাই একান্ত কাম্য।

এডিস মশা; ছবিসূত্রঃ youtube.com

চিকুনগুনিয়া কী

প্রথমে আসা যাক চিকুনগুনিয়া কী সেই প্রশ্নের উত্তরে। এটি মূলত একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের দুই থেকে চার দিনের মধ্যে শুরু হয় জ্বর, সাথে থাকে শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যথা। জ্বর সাধারণত দুই-চার দিনের মধ্যে চলে গেলেও রয়ে যায় ব্যথার যন্ত্রণা। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এই ব্যথা এমনভাবে ছড়ায় যে হাত পা নড়াচড়া করানো, হাঁটাহাঁটি করা, এমনকি শুয়ে থেকেও এপাশ ওপাশ পর্যন্ত করা যায় না। আর এই ব্যথার স্থায়িত্বকালেরও কোনো হিসেব নেই। সপ্তাহ, মাস কিংবা বছরও পার হয়ে যেতে পারে। আর এই ব্যথাই মূলত চিকুনগুনিয়ার ভয়ের কারণ।

চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী; ছবিসূত্রঃ dailymotion.com

ভাইরাসের বিস্তার

আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানো এডিস মশা সুস্থ কাউকে কামড়ালে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এডিস (Aedes) গণের দুটি প্রজাতি রয়েছে যা Aedes aegypti Aedes albopictus ভাইরাসের বাহক হিসেবে পরিচিত। মানুষ ছাড়াও বানর, পাখি, তীক্ষ্ণ দাঁতযুক্ত প্রাণী; যেমন- ইঁদুরে এই ভাইরাসের জীবনচক্র বিদ্যমান। অনেকে একে ডেঙ্গু ভাইরাসের সাথে তুলনা করে। তবে ডেঙ্গু ভাইরাসের সাথে এর পার্থক্যের মূল কারণ হলো ডেঙ্গু ভাইরাস শুধু স্তন্যপায়ীদের আক্রান্ত করে।

ল্যাবরেটরিতে মশার পরীক্ষা; ছবিসূত্রঃ youtube.com

রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিটিউট, সংক্ষেপে আইইডিসিআরের মতে রোগটি প্রথম ১৯৫২ সালে আফ্রিকাতে দেখা যায়। পরবর্তীতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন- ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মায়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়াতে এটি বিস্তার লাভ করে। বাংলাদেশে প্রথম ২০০৮ সালে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এই ভাইরাসের প্রার্দুভাব দেখা যায়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এই রোগ দেখা যায়। তবে এরপর বিচ্ছিন্ন দুই-একজন রোগী ছাড়া এ রোগের বড় ধরনের কোনো বিস্তার আর বাংলাদেশে দেখা যায়নি। কিন্তু হঠাৎ করেই এ বছরের শুরু থেকে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। প্রথমে ঢাকা থেকে শুরু হলেও এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেই ছড়িয়ে পড়ছে এই রোগ। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস আক্রান্ত রক্তদাতার রক্ত গ্রহণ করলে এবং ল্যাবরেটরীতে নমুনা পরীক্ষার সময়ে অসাবধানতায়ও এ রোগ ছড়াতে পারে।

এডিস ইজিপ্টি মশা; ছবিসূত্রঃ youtube.com

চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ

মশা কামড়ানোর ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে জ্বর দেখা দিতে পারে। এই ভাইরাস সাধারণত ২-১২ দিনের মতো থাকতে পারে। ভাইরাসের আক্রমণে আকস্মিক উচ্চমাত্রার জ্বর, শরীরে ব্যথা ও লাল বর্ণের ছোপ ছোপ দাগ দিয়ে শুরু হয়। এই সকল দাগ রোগের শুরুতেই দেখা দিতে পারে, আবার অনেক সময় জ্বর হওয়ার দুই থেকে তিন দিন পর জ্বর কমতে শুরু করলে তখনও হতে পারে। এছাড়া অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, পেটব্যথা, ফটোফোবিয়া বা আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা, কনজাংটিভাইটিস ইত্যাদি। তবে কোনো উপসর্গ না দেখা দিয়েও চিকুনগুনিয়া হতে পারে। শিশু, বয়স্ক এবং গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসার জটিলতা একটু বেশি।

চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর লক্ষণসমূহ; ছবিসূত্রঃ careerline24.com

উপসর্গ দেখা দিলে করণীয়

কারো মাঝে চিকুনগুনিয়ার উপসর্গগুলো দেখা দিলে এক সপ্তাহের মধ্যে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে ভাইরাসটি সেরেলজি এবং আরটি-পিসিআর (Serology Ges এবং RT-PCR) পরীক্ষার মাধ্যমে সনাক্ত করা যায়। আইইডিসিআরে নির্ভুলভাবে চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার সকল ব্যবস্থা রয়েছে।

চিকনগুনিয়ার লক্ষণ; ছবিসূত্রঃ youtube.com

চিকুনগুনিয়া ধরা পড়লে করণীয়

এবার আসা যাক চিকুনগুনিয়া হয়ে গেলে আমাদের কী করণীয় সেই আলোচনায়। প্রথমেই বলে রাখা ভালো- ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো প্রকার ঔষধ সেবন করা উচিত নয়। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের কার্যকরী কোনো টিকা নেই। প্রকৃতপক্ষে এ রোগের কোনো চিকিৎসাও নেই। চিকিৎসা নেই বলাতে বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক নিয়মে এই জ্বর ভালো হয়ে যায়। জ্বর বেশি হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ সেবন করা যেতে পারে। তবে কোনো প্রকার ব্যথানাশক ঔষধ একেবারেই খাওয়া যাবে না। অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ঔষধ এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা তৈরি করতে পারে। ব্যথা বেশি হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এছাড়াও-

  • প্রচুর পরিমাণ পানি, ডাব, ফলের রস বা জুস, স্যালাইন, স্যুপ এবং এ ধরণের তরল জাতীয় খাদ্য খেতে হবে। পাশাপাশি ভিটামিন সি জাতীয় খাবার রোগীর জন্য খুব উপকারী। সেজন্য লেবু জাতীয় ফল, পেয়ারা, আঙ্গুর, পেপে, আনারস ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণ খেতে হবে।
  • চিকুনগুনিয়া হওয়ার পরও যাতে করে মশা আবার কামড়াতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। নবজাতক, গর্ভবতী মা, বয়স্ক এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস ও হৃদরোগ আছে, তাদের চিকুনগুনিয়া হলে একটু বাড়তি যত্ন নিতে হবে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী রুটিন তৈরি করতে হবে।
  • শরীরের বিভিন্ন গিঁটে ব্যথার জন্য এর উপরে ঠাণ্ডা পানি এবং হালকা ব্যায়াম উপকারী হতে পারে। তবে প্রাথমিক উপসর্গ ভালো হওয়ার পর যদি গিঁটের ব্যথা ভালো না হয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেতে হবে।

চিকুনগুনিয়া হলে করণীয়; ছবিসূত্রঃ adscollect.com

প্রতিকার নেই, তাই প্রতিরোধই কাম্য

চিকুনগুনিয়ার প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধ করা অনেক বেশি বাঞ্ছনীয়। যে একবার চিকুনগুনিয়ার খপ্পড়ে পড়েছে, তাকে সইতে হবে অমানুষিক ব্যথা ও যন্ত্রণা। তাই সচেতনতায় চিকনগুনিয়া প্রতিরোধে একান্ত কাম্য।

  • শুধু স্ত্রী মশা দিনের বেলা কামড়ায়। এরা একবারে একের অধিক ব্যক্তিকে কামড়াতে পছন্দ করে। একবার রক্ত খাওয়া শেষে ডিম পাড়ার পূর্বে তিন দিনের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। এদের ডিমগুলো পানিতে এক বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। অল্প পরিমাণ জমে থাকা পানিও ডিম ফোঁটার জন্যে যথেষ্ট। এডিস মশা স্থির পানিতে ডিম পাড়ে। তাই ঘরের বালতি, ফুলের টব, গাড়ির টায়ার প্রভৃতি স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • দিনের বেলায় ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে।
  • এসি থেকে যে পানি পড়ে জমতে থাকে, তা সবসময় পরিষ্কার করতে হবে।
  • পুরো ঘরে মাঝে মাঝেই মশা মারার স্প্রে ব্যবহার করতে হবে।

দিনের বেলা মশারি ব্যবহার করা; ছবিসূত্রঃ adscollect.com

চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে সরকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কারণ আমরা শুধুমাত্র নিজেদের বাড়ির আশেপাশের খেয়ালই রাখতে পারব। কিন্তু বাড়ির বাইরে যে ডোবা, নালা, জলাবদ্ধতা বা ময়লার স্তুপ আছে এবং সেখান থেকে জন্ম নেয়া মশার উপদ্রব কমানো আমাদের হাতে নেই। তাই সরকার এবং সিটি কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে এ সকল জলাবদ্ধতায় প্রতিনিয়ত মশা নিধন কর্মসূচী পালন করতে হবে এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সচেতনতাই পারে চিকুনগুনিয়ার বিস্তার রোধ করতে।

ফিচার ইমেজ: barta-pathok.com

Related Articles