Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হুবাল: প্রাচীন মক্কার প্রধান প্যাগান দেবতা

পবিত্র মক্কার সাথে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তা হলো পবিত্র ক্বাবা। আরবের মরুর বুকে এই মক্কা যে কত প্রাচীন শহর তা নির্ণয় করা হয়ত বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিশাল মরুর বুকে এই মক্কায় মানবজাতির পদার্পণ হয়েছিল কোনো এক কালে। আর সেই সাথে মানববসতিও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছিল সেখানে। মানুষের বসবাসের সাথে সাথে তাদের ধর্মেরও সূচনা ঘটে। মক্কায় তাই উপাসনার জন্য ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেবতার মূর্তি তৈরি হতে থাকে। তেমনি এক দেবতার মূর্তি ছিল হুবাল।

প্রাক-ইসলামী আরবদের ধর্ম ও জীবনব্যবস্থা, বিশেষ করে হিজাজের মধ্যে, বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। এছাড়া, তারা তাদের ধর্মের একটি বাণিজ্যও তৈরি করে। হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জন্মেরও প্রায় চারশো বছর আগে আমর বিন লুহাই নামে হিজাজের একজন রাজা ছিলেন যিনি ক্বাবার ছাদে হুবাল নামে এক মূর্তি স্থাপন করেন। এটি কুরাইশদের অন্যতম প্রধান দেবতা ছিল‎‎। বলা হয়ে থাকে- ক্বাবা এবং তার আশেপাশে মোট ৩৬০টি মূর্তি ছিল, এবং প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব দেবতা ছিল। মূর্তিগুলোর আকার-আকৃতি উপাসকদের কল্পনানুসারে তৈরি করা হয়েছিল। ‎‎হুবাল ছাড়াও ক্বাবার ছাদে শামস নামে আরও একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল‎‎। মক্কায় তীর্থযাত্রীদের সাথে আনা কুরবানির পশুদের রক্ত ক্বাবায় থাকা দেবতাদের প্রতি উৎসর্গ করা হতো, এবং কখনও কখনও এমনকি মানুষকেও বলি দেওয়া হতো। এসব কিছু সৃষ্টিকর্তার কাছে উৎসর্গ করা হতো। মূর্তিপূজার পাশাপাশি তারা সূর্য ও চন্দ্রেরও উপাসনা করতো।

মক্কার পৌত্তলিক আরবরা ক্বাবাতে হুবাল নামে এক চন্দ্র দেবতার উপাসনা করতো। ক্বাবাতে থাকা ৩৬০ দেবতার মূর্তির মধ্যে হুবাল ছিল সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত। তবে আল্লাহকেও ক্বাবার প্রতিপালক হিসেবেও উপাসনা করা হতো। কিন্তু পৌত্তলিক আরবরা আল্লাহর কোনো দৈহিক প্রতিমূর্তি তৈরি করেনি। হুবাল ছিল সেই প্রতিমূর্তি যার মাধ্যমে পৌত্তলিক আরবরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতো। পৌত্তলিক মক্কার সিরায়‎‎ ‎‎হুবালের‎‎ চিত্রের পাশে দাঁড়িয়ে‎‎ প্রার্থনা করার চিত্র ও গল্প রয়েছে।2

হুবাল মূলত প্রাক-ইসলামী যুগের কুরাইশ গোত্রের সর্বোচ্চ উপাস্য ছিল।‎ ইবনে হিশাম থেকে‎ জানা যায়, পবিত্র ক্বাবা এলাকার কাছে হুবাল নামে একটি মূর্তি ছিল। হিশাম ইবনে আল ক্বালবি তার কিতাব আল আসনাম বা বুক অব আইডলস-এ লিখেছেন,

মূর্তির সামনে সাতটি তীর রাখা হয়েছিল, যা ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য নিক্ষেপ করা হতো, বিশেষ করে কঠিন ক্ষেত্রে, যেমন- কেউ কাউকে হত্যা করেছে বা কুমারিত্ব এবং বিবাহ অথবা এই ধরনের ঘটনায়।‎

ক্বাবাতে হুবালের মূর্তি ছিল; Image source: booksfact.com

তিনি আরো লিখেছেন,

ক্বাবা এবং তার আশেপাশে কুরাইশদের বেশ কয়েকটি মূর্তি ছিল। ‎‎এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল‎‎ ‎‎হুবাল‎‎। এটি তৈরি করা হয়েছিল একজন মানুষের আদলে, যার ডান হাতটি ছিল ভাঙা। এটি এই অবস্থায় কুরাইশদের দখলে এসেছিল এবং তাই তারা এর জন্য একটি সোনার হাত তৈরি করেছিল। এটি কাবার ভেতরে দাঁড় করানো ছিল, এবং এর সামনে সাতটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তীর ছিল। এর মধ্যে একটিতে ‘বিশুদ্ধ’ এবং অন্যটির উপর ‘বহিরাগত’ শব্দটি লেখা হয়েছিল।

যখনই কোনো নবজাতকের বংশকে সন্দেহ করা হতো, তারা ‎‎হুবালের উদ্দেশ্যে‎‎ বলিদান করত। তারপরে তীরগুলোকে ঝাঁকুনি দিত এবং নিক্ষেপ করতো। তীরগুলো যদি ‘বিশুদ্ধ’ শব্দটি দেখায়, তাহলে শিশুটিকে বৈধ ঘোষণা করা হতো, এবং গোত্র তাকে গ্রহণ করতো। আর যদি তীরগুলো ‘বহিরাগত’ দেখায়, তবে শিশুটিকে অবৈধ ঘোষণা করা হতো, এবং তাকে প্রত্যাখ্যান করতো। তৃতীয় তীরটি মৃতদের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে সম্পর্কিত ছিল, এবং চতুর্থটি ছিল বিবাহ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য। ‎‎অবশিষ্ট তিনটি তীরের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়নি।

যখনই তারা কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করত বা কোনো যাত্রা শুরুর প্রস্তাব দিত বা অন্য কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করতো, তখন তারা ‎‎হুবালের‎‎ দিকে অগ্রসর হতো এবং এর আগে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তীরগুলো ঝাঁকুনি দিত। তীরে যে ফলাফলই আসতো না কেন, তারা তা অনুসরণ করতো এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতো।‎‎4,5

‎ইবনে হিশাম (ইবনে হিশাম ৩২) থেকে জানা যায়, হযরত মুহাম্মদ (সা) এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব ক্বাবার নিকটে একটি পুরানো কূপ পরিষ্কার করছিলেন। সেটি ‘জমজম’ নামে পরিচিত ছিল। এটি পরিষ্কারের সময় তিনি কিছু প্রাচীন বর্ম এবং স্বর্ণ খুঁজে পান। এগুলো মূলত আরবের জুরহুম গোত্রের সদস্য আমর বিন হারিসের রেখে যাওয়া সম্পদ, যা তিনি তার গোত্রের মানুষদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য জমজম কুয়ায় লুকিয়ে গিয়েছিল। এগুলো ক্বাবার মধ্যে রক্ষিত ছিল। যখন তার গোত্রের মানুষরা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে বিভিন্ন পাপে ডুবে গিয়েছিল, তখন তিনি তাদের এসবে বাধা দিলে তারা তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে। এই অবস্থায় তিনি ক্বাবা থেকে এসব মূল্যবান সম্পদ নিয়ে তা জমজম কুয়ায় ফেলে দিয়ে কুয়ার মুখ বালি দিয়ে ভরাট করে দেন। পরবর্তীতে কুরাইশ গোত্রের আব্দুল মুত্তালিব স্বপ্নে দিকনির্দেশনাপ্রাপ্ত হয়ে এই কুয়া আবিস্কার করেন7

কুরাইশ গোত্র দাবি করে, এই অনুসন্ধানে অংশ নেওয়ার অধিকার তাদেরও রয়েছে। আব্দুল মুত্তালিব তা অস্বীকার করেন, কিন্তু তিনি বিষয়টি একটি পবিত্র অংশ হিসেবে সমর্পণ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি বলেন, ক্বাবার জন্য দুটি হলুদ রঙের, কুরাইশ গোত্রের জন্য দুটি সাদা রঙের এবং নিজের জন্য দুটি কালো রঙের তির তৈরি করবেন। খাপ বা তীরের তূণীর থেকে বেরিয়ে আসা দুটি তির নির্ধারণ করবে সম্পত্তিটি কার কাছে ছিল। এতে সবাই একমত হয়, এবং তাই তিনি ক্বাবার জন্য, কুরাইশদের জন্য এবং নিজের জন্য ভিন্ন ভিন্ন তির তৈরি করেন। তারপর তারা একজন যাজককে তিরগুলোর দায়িত্ব দেন। হুবালের মূর্তির পাশে তিরগুলো রাখা হয়, যা ক্বাবা এলাকার মধ্যে ছিল। তারপরে তিনি তূণী থেকে তিরগুলো তুললেন যাতে নির্ধারণ করা যায় যে গুপ্তধনের অংশ কার হবে।‎10

এরপর আরেকটি ঘটনা (ইবনে হিশাম ৩৩) রয়েছে, যখন আব্দুল মুত্তালিব জমজম খনন করার সময় কুরাইশের বিরোধিতার মুখোমুখি হন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, যদি তার দশটি পুত্রসন্তান হয় এবং তাকে রক্ষা করতে পারে, তবে তিনি তাদের মধ্যে একজনকে ক্বাবায় উৎসর্গ করবেন। অতঃপর যখন তার দশটি পুত্র সন্তান হলো, তখন তিনি তাদের (পুত্রদের) তাঁর শপথের কথা বললেন। তারা তাঁর আনুগত্য করতে রাজি হয়েছিল এবং জিজ্ঞাসা করেছিল যে তাদের কী করতে হবে। তিনি বলেছিলেন যে তাদের প্রত্যেককে অবশ্যই একটি তীরে নিজেদের নাম লিখে সেটি তার কাছে আনতে হবে। তারা এটা করল এবং তিনি তাদের কাবার পাশের হুবালের মূর্তির সামনে নিয়ে গেলেন।‎

আরও একটি বিস্তৃত ব্যাখ্যা হুবাল সম্পর্কে জানা যায়,

হুবালের সামনে সাতটি তির ছিল, যার প্রতিটিতে কিছু শব্দ ছিল। একটিতে ‘রক্ত-মূল্য’ (Blood-price) দিয়ে চিহ্নিত করা ছিল। রক্তের মূল্য কাকে দিতে হবে তা নিয়ে তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হলে তারা সাতটি তির দিয়ে ভাগ্য গণনা করত এবং যার কাছে ঐ তিরটি পড়ত তাকে অর্থমূল্য পরিশোধ করতে হতো। আবার একটিকে ‘হ্যাঁ’ এবং অন্যটিকে ‘না’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং যে বিষয়ে দৈববাণী আহ্বান করা হতো সেই বিষয়ের ফলাফল অনুযায়ী তারা কাজ করতো।

একটিতে ‘পানি’ লিখে চিহ্নিত করা ছিল। যদি তারা পানির জন্য মাটি খনন করতে চাইত, তারা ঐ তিরটি ছুড়ত এবং যেখানে ঐ তির পড়ত সেখানে তারা পানি খোঁজার কাজ শুরু করতো। অন্য একটিতে ‘নিজের’, আরেকটি ‘নিজের নয়’, এবং আরেকটিতে ‘অধিভুক্ত’ এই কথাগুলো চিহ্নিত করা ছিল। যদি তারা কোনো ছেলের খৎনা করতে চাইত, বিয়ে করতে চাইত, লাশ দাফন করতে চাইত বা কারো বংশতালিকা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতো, তাহলে তারা তাকে একশত রৌপ্য মুদ্রা এবং একটি উট জবাই দিয়ে হুবালের কাছে নিয়ে যেত এবং যে লোকটি তার ভাগ্য গণনা করবে তাকে সেসব দিয়ে দিত।

অতঃপর তারা যাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল তাকে এগিয়ে নিয়ে এসে বলত: “হে আমাদের দেবতা, এই হলো ‘অমুক’-এর পুত্র ‘তমুক’, যার ব্যাপারে আমরা জানতে চাই। তাই তার ব্যাপারে সঠিক পথ দেখাও।” তারপর যে ব্যক্তি তির নিক্ষেপ করবে তাকে তারা বলতো, “নিক্ষেপ কর!” যদি ‘নিজের’ লেখা তিরটি বের হতো, তাহলে সে তাদের গোত্রের প্রকৃত সদস্য হতো; যদি ‘অধিভুক্ত’ আসতো তবে সে একজন মিত্র হিসেবে থাকতো; এবং যদি ‘নিজের নয়’ লেখা তির বেরিয়ে আসতো তবে ধরা হতো তাদের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক ছিল না এবং সে মিত্রও ছিল না। এভাবে তারা তিরের লেখা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিত আর তাদের কাজকর্ম পরিচালনা ও নির্ধারণ করতো। (ইবনে হিশামঃ ৯৭-৯৮)

হুবাল সম্পর্কে শিলালিপি থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়; Image source: islamicawarness.com

‎প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিকরা হুবালকে নিয়ে নানা রকম ধারণা দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, হুবাল আল-লাতের ভাই, কারো মতে হুবাল একজন চন্দ্রদেবতা, এবং কেউ কেউ মত দিয়েছেন যে দক্ষিণ আরবের পুরাণগুলো চন্দ্র-পিতা, সূর্য-মা এবং সান্ধ্য নক্ষত্রের (শুক্র) ত্রিত্বের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, যেখানে হুবাল পুত্র ছিল এবং এরকম আরও অনেক কিছু। যদিও অনেক ঐতিহাসিক এই ধারণাগুলো ছড়িয়ে দিতে পছন্দ করেন, তবে সেগুলোর খুব বেশি প্রমাণ নেই। এছাড়া, এমন কোনো শক্ত প্রমাণও নেই যা হুবালকে দক্ষিণ আরব, এমনকি মক্কার আশেপাশের এলাকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত করে। কয়েকটি জায়গা থেকে কেবলমাত্র তথ্যের উত্স রয়েছে। প্রথমটি প্রাথমিক ইসলামী সাহিত্যে, দ্বিতীয়টি প্রাচীন শিলালিপি এবং গ্রাফিতি থেকে।‎

তাহলে হুবাল কোথা থেকে এলো? ইসলামী সূত্রগুলো আমাদের কিছু ধারণা দেয়। আল-আজরাকি আমাদের জানিয়েছেন, ‘আমর ইবনে লুহাই মেসোপটেমিয়ার হিট (বর্তমান ইরাক) থেকে হুবালের একটি মূর্তি নিয়ে আসেন এবং তিনি এটি ক্বাবার পাশে স্থাপন করেন। প্রাক-ইসলামী তীর্থযাত্রার সময় লোকেরা হুবালের কাছে আসত এবং তার উপস্থিতিতে তারা তাদের চুল মুণ্ডন করত।” তিনি বলেন, মূর্তিটি স্ফটিকের (কোয়ার্টজ) তৈরি যার একটি হাত সোনার ছিল। হিশাম ইবনে আল ক্বালবি তার বুক অব আইডলসে আমাদের সোনার হাতের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে হুবালের মূর্তিটি ‘বিলাস আস-শামের আল-বালকা’ থেকে অর্থাৎ, দামেস্ক থেকে এসেছিল। তার ডান হাত উঁচু ছিল, কিন্তু এটি ভেঙে গিয়েছিল। আরবরা ডান হাতটি সোনা দিয়ে মেরামত করে দিয়েছিল।‎

তবে অনেকেই মনে করে, হুবাল কেবল একটি নামই ছিল, এবং কখনও হুবালের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু সেটি ভুল প্রমাণিত হয় যখন প্রত্নতত্ত্ববিদরা হুবাল নামটি পাথরে, শিলালিপিতে এবং গ্রাফিতিতে লেখা দেখতে পান।‎ এছাড়া আধুনিক আরব জুড়ে পাথর এবং ক্যানিয়নের দেয়ালে গ্রাফিতির অনেক টুকরো খুঁজে পাওয়া গেছে।‎ সামুডিক গ্রাফিতিতে বিন হুবালকে একটি নাম হিসেবে বা ‘পুত্র ও হুবাল’ হিসাবে পাওয়া যায়। সুতরাং, এ থেকে বলা যায় যে নামটির অস্তিত্ব ছিল।

‎হুবালের নাম দেখা যায় প্রায় ২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, ইতালির পোজুলি শহরের একটি নাবাতিয়ান শিলালিপিতে। এই শহরটি রোমের একটি বন্দর ছিল এবং এমন একটি জায়গা যেখানে আরব ও নাবাতিয়ান বণিকরা একত্রিত হতো। ধারণা করা হয়, সেখানে একটি নাবাতিয়ান মন্দির ছিল এবং হুবালের নাম সেখানে উল্লেখ করা ছিল। হুবালের পুত্রকে ইতালির একটি নাবাতিয়ান মন্দিরে পাওয়া গিয়েছিল।‎ হুবালের উল্লেখ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি একটি সমাধি শিলালিপিতে রয়েছে, এবং এটি প্রাচীন নাবাতিয়ান শহর মাদাইন সালেহতে রয়েছে। এই শহরটি কিছুটা পেট্রার মতো এবং সেখানে ১৩৮টি নাবাতিয়ান সমাধি রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, পেট্রার পর মাদাইন সালেহ নাবাতিয়ান সমাধি শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম

সিরিয়া বা ফিলিস্তিন থেকে প্রাপ্ত ‘হাজর মূর্তি’ হুবাল সম্পর্কে কিছু তথ্য দেয়; Image source: islamcompass.com

নাবাতিয়ানদের খুব সামান্যই লিখিত ইতিহাস থাকলেও মরুভূমিতে তাদের হাজার হাজার গ্রাফিতি ও শিলালিপি আছে। এমনই একটি অদ্ভুত শিলালিপির প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার (সমাধির উপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ) হুবাল এবং দুশারাকে একত্রিত করে।‎ কিন্তু কীভাবে এই দুই দেবতাকে একত্রিত করা যায়?‎

দুশারা নামটি ‘ধু আল-শারা’ থেকে এসেছে। এখানে দুটি শব্দ ধু (Dhu) এবং শা’রা (Sha’ra)। ধু মানে একটি আর শা’রা হলো পর্বতমালা। শা’রা হলো সেই পর্বতমালা যা পেট্রা এবং আরবের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। তবে শুরুতে ‎এই দেবতার কোনো নাম ছিল না। প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিকরা দীর্ঘদিন ধরে ভাবছেন যে, এই দেবতা কে? এর নামই বা কী? পরে বিভিন্ন শিলালিপি থেকে জানা যায়- একে শা’রা পর্বতমালার একজন দেবতা বা প্রভু হিসেবে পূজা করা হতো। আবার, আরো একটি শিলালিপি খুঁজে পাওয়া গেছে যা পর্বতমালার প্রভু হিসেবে হুবালকে উল্লেখ করে। একটি সাফাইটিক শিলালিপি থেকে আরো জানা যায় দুশারা ছিল দেবী আল-লাতের পুত্র। যদি এটি সঠিক হয়, তবে দুশারা ও হুবাল একই দেবতার দুই নাম। তাই এটা ধারণা করা যায় যে পেট্রাতে একে দুশারা বললেও মক্কায় একে হুবাল বলে ডাকা হতো। মাদাইন সালেহ-এর সমাধিটি থেকে জানা যায় হুবালকে পর্বতের দেবতা বা প্রভু হিসেবে দেখা হতো।

দুশারা দেবতার মূর্তি; Image source: pinterest.com

‎হুবাল সম্পর্কে তেমন তথ্য না থাকলেও এ পর্যন্ত আমরা যা পেলাম, তাতে এটা স্পষ্ট যে এই মূর্তিটি আরবের আরও উত্তর দিক থেকে এসেছে। আর সেটি সিরিয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফিলিপ কুরি হিট্টি বিশ্বাস করেন যে, হুবাল নামটি একটি আরামাইক শব্দ থেকে এসেছে এবং তাই তিনি বলেছেন যে হুবাল দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল যার একটি আরামাইক মূলশব্দ ছিল। উপসর্গটি হলো হু (Hu), যা আরামীয় শব্দ ঈশ্বর বা আত্মা বোঝায়, এবং বিশেষ্য হলো বা’ল বা বা’আল (Ba’al)। মোয়াবী ভাষায় হুবাল হলেন বা’আলের দেবতা বা ঈশ্বর।‎

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে হযরত ইলিয়াস (আ) এর লোকদেরকে বা’আল দেবতার উপাসনা ছেড়ে সত্যিকারের সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করার উপদেশ দিয়েছেন।

তোমরা কি বা’আলকে ডাকো এবং পরিত্যাগ করো শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহকে? – সুরা সাফফাত (আয়াত: ১২৫)

‎বা’আলের সাথে হুবালের এই সম্পর্ক অনেক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। মজার ব্যাপার হলো, কিছু টিকে থাকা বা’আল দেবতার মূর্তি রয়েছে, যেখানে তাকে একজন মানুষ হিসাবে দেখানো হয়েছে। তার ডান হাতে কিছু একটা ধরে রেখেছে। ‎বাম হাতটি সম্ভবত একটি লাঠি/পাতা/ফুল/ক্লাব ধরে রেখেছে । ডান হাতটি একটা বড় লাঠি ধরে আছে, যার শেষে কিছু একটা আছে। সম্ভবত এটি একটি বিদ্যুতের রড বা কোনও ধরণের অস্ত্র রয়েছে

বা’আল দেবতা; Image source: commons.wikimedia.org

বা’আলের একটি ছোট মূর্তি এখনও আছে। এই মূর্তি তার ডান হাত উঁচু করে রেখেছে, তবে তাতে কিছুই নেই। কিছু থাকলেও তা শত শত বছর আগে হারিয়ে গেছে। আপাতদৃষ্টিতে আরবের যারা এই মূর্তি পেয়েছিল তারা হুবালের ভাঙা হাতটি সোনা দিয়ে ঠিক করেছিল এবং তার ডান হাতটি উপরে তুলে দিয়েছিল। এই মূর্তি মূল ক্বাবার কাছে রাখা ছিল এবং লোকেরা এটি ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য ব্যবহার করতো।‎

‎উপরে আলোচনা থেকে এটি অনুমান করা যায় যে হুবাল, দুশারা এবং বা’আল একই দেবতা হলেও স্থানভেদে এই দেবতার বিভিন্ন নাম দেখা যাচ্ছে।

মাঝের মূর্তিটি বালশামিনের; Image source: worldhistory.org

সিরিয়ার পালমিরা নামের প্রাচীন শহরটিও নাবাতিয়ান বণিকদের ব্যবসায়িক পথের সাথে যুক্ত ছিল। সেই শহরে বালশামিনকে উৎসর্গীকৃত একটি মন্দির রয়েছে। সিরিয়ার প্রাচীন মন্দির এবং স্থানগুলোর সাম্প্রতিক ধ্বংস থেকে রক্ষা পাওয়া একটি চুনাপাথরের উপর খোদিত মূর্তির চিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। জানুয়ারি ১২১ খ্রিষ্টাব্দের তারিখ লেখা পাথরটি ফ্রান্সের শহর লিওনের ‘মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস’-এ সংরক্ষিত রয়েছে।

দুশারা এবং বালশামিনের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। উভয়ই পুরুষ দেবতা, সর্বশ্রেষ্ঠ, এবং স্বর্গের শাসক। ডা. জন হিলি, নাবাতিয়ানদের ধর্মের উপর একজন বিশেষজ্ঞ, যিনি দুশারা, বালশামিন এবং আরও অনেক দেবতাকে একই দেবতা হিসেবে বিবেচনা করেছেন, যেগুলো ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে উপাসনা করা হতো। হুবাল এবং বালশামিনও প্রায় একই দেবতা বলে মনে হয়। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা ব্যবহৃত বিভিন্ন নাম এবং ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে এদের কথা এসেছে। এমনকি তাদের মন্দিরগুলোও দেখতে অনেকটা একই রকম ছিল।‎

‎পেট্রাতে একটি শিলালিপি রয়েছে যা জানায় যে বালশামিন নাবাতিয়ানদের রাজাদের দেবতা। এতে অনেক রাজা ও তাদের পরিবারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ‘আইন ইশ-শাল্লালেহ’ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে যেখানে বালশামিন এবং দুশারা উভয়কেই রাজার প্রভু হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।  এটি পর্বতের প্রভু দুশারার মতো; যদিও এই নাম হারিয়ে গেছে, কিন্তু মাদাইন সালেহ-এর শিলালিপি থেকে অনুমান করা যায় যে এটিই হুবাল দেবতা।‎ অর্থাৎ ‎হু’বাল, দুশারা এবং বালশামিন এসব মূর্তির মধ্যে সম্পর্ক খুব কাছাকাছি। এরা পর্বতমালার প্রভু এবং পুরুষ দেবতা হিসেবে পরিচিত ছিল।‎

হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও ইসলাম আগমনের আগে আরবদের প্রত্যেকের ঘরে নিজেদের আলাদা মূর্তিও ছিল। এছাড়া আরবরা জ্বিন এবং সেই সাথে আরো কিছু অস্পষ্ট দেবতায় বিশ্বাস করত। হুবাল ছাড়াও প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের অন্যান্য প্রধান দেব-দেবীদের মধ্যে ছিল দেবী আল-লাত, আল-উজ্জাহ, আল তালফ, এবং ভাগ্যের দেবী মানাত‎‎‎‎। এছাড়া ক্বাবার কালো পাথরও তাদের উপাসনার সাথে যুক্ত ছিল‎‎। ক্বাবার কালো পাথর, যা মুসলমানরা আজ শ্রদ্ধা করে, তা হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জন্মেরও আগে মক্কার পৌত্তলিকরা উপাসনা করতো। পৌত্তলিকদের বিশ্বাসমতে, ক্বাবার কালো পাথরটি সূর্য, চাঁদ, তারা বা অন্য কোনো গ্রহ থেকে পড়েছে, এবং তাই সেটি মহাজাগতিক শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।6

দেবী আল-লাত, আল-উজ্জাহ ও মানাতের মূর্তি; Image source: commons.wikimedia.org

hubal-the-chief-pagan-god-of-ancient-mecca

Related Articles