Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বনবিবি: সুন্দরবনের বাঘ ও মানবসমাজের ত্রাণকর্ত্রী 

কাঁচা কাষ্ঠ, ফাটা হাঁড়ি
কেমনে ভাত রাঁধব আমি
বনবিবি মা, আমায় উপায় বল না…

এমনই করে সুর করে গান গেয়ে গেয়ে বনদেবীর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে সুন্দরবন এলাকার সাধারণ মানুষ। বনদেবী, বনবিবি, বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী আরও অসংখ্য নামে পরিচিত তিনি। হিন্দুদের কাছে তিনি দেবী, মুসলমানদের কাছে পিরানী। তাকে বলা হয় সুন্দরবনের ‘গার্ডিয়ান স্পিরিট’ বা রক্ষাকারী শক্তি। মৌয়াল বা মধু সংগ্রাহক, কাঠুরে, বাওয়াল, জেলে সম্প্রদায়ের কাছে তিনি পরম আস্থার প্রতীক। সুন্দরবনের ৬০-৪০ ভাগ অংশ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত, দুই অঞ্চলের মানুষের কাছেই সমান জনপ্রিয় বনবিবি। দক্ষিণবঙ্গের আবহমান সংস্কৃতির সাথে মিশে থাকা বনবিবিকে স্মরণ করে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় ‘মা বনবিবির পূজা’। আজ তবে জেনে নেয়া যাক বনবিবি সম্পর্কে।

ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ বই থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাজা দক্ষিণ রায়, বণিক ধোনাই ও মোনাই এবং গাজী পীর প্রায় একই সময়ে বিরাজমান ছিলেন। ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে আরব এক ফকির পরিবারে জন্ম নেন বনবিবি। তার বাবার নাম ইব্রাহীম, মতান্তরে বেরাহিম, মায়ের নাম গুলান বিবি। কথিত আছে, ইব্রাহীমের প্রথম স্ত্রী ফুলবিবির কোনো সন্তান না হওয়ায় চিন্তিত ছিলেন তারা। পরবর্তীতে ফুলবিবির অনুমতি নিয়ে গুলানবিবি মতান্তরে গোলালবিবিকে বিয়ে করেন ইব্রাহীম। তবে শর্ত ছিল, ভবিষ্যতে ফুলবিবির একটি মনোবাসনা অবশ্যই তাকে পূরণ করতে হবে।

বনবিবির মূর্তি; Source: cloudfront.net

গুলানবিবি গর্ভধারণ করলে ফুলবিবি হিংসায় কাতর হয়ে পড়ে। তার সেই জমিয়ে রাখা ইচ্ছে পূরণের শর্ত এবার সে আদায় করে নেয় গুলানবিবিকে সুন্দরবনের জঙ্গলে নির্বাসনে পাঠিয়ে। তার কিছুদিনের মধ্যে সেই জঙ্গলেই গুলানবিবির ঘর আলো করে জন্ম নেয় দুই সন্তান বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলি বা শাহ জঙ্গুলি। শাহাজঙ্গুলি বনবিবির ছোটভাই নাকি যমজ ভাই, তা নিশ্চিত করে জানা যায় না। তাদের দেখাশোনার জন্য নাকি স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছিল চার দাসীকে। বনবিবি সেখানে বড় হয় এক মাদী হরিণের কাছে। সাত বছর পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে গুলানবিবিকে দুই শিশু সন্তানসহ মক্কাতে ফিরিয়ে নিতে আসেন ইব্রাহীম। কিন্তু বাবার সাথে সুন্দরবন ছেড়ে মক্কায় যেতে অস্বীকৃতি জানায় বনবিবি। সুন্দরবনের মানুষ ও পশুদের সাথে তার এমন হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল যে, তাদের ছেড়ে বাবার হাত থেকে চলে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। বোনের টানে বনবিবির সাথেই জঙ্গলে রয়ে যায় শাহাজঙ্গুলি।

অন্য একটি গল্পে বলা হয়, ফুলবিবির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মক্কা থেকে সুন্দরবনে চলে আসেন ইব্রাহীম-গুলানবিবি দম্পতি। এখানেই জন্ম হয় বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলী দুই ভাইবোনের। এই দুই সন্তানের জন্মের পরে সুন্দরবন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে ইব্রাহীম পরিবার। ‘বনবিবির কেরামতি’ বা ‘বনবিবির জহুরনামা’ নামক গ্রন্থে বনবিবির এমনি আরও অসংখ্য গল্পের কথা বর্ণিত আছে। বলা হয়, একবার মসজিদে খেলতে গিয়ে বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলি খুঁজে পায় দুটি জাদুর টুপি। এই জাদুর টুপিতে চেপে তারা ঘুরে বেড়ায় হিন্দুস্তানের আঠারো ভাটির দেশে। অন্য একটি মতানুসারে হযরত জিবরাঈল (আ.) তাদের আঠারোটি দেশ ঘুরিয়ে দেখান। হিন্দুস্তানে পৌঁছে আযান দেন শাহাজঙ্গুলি।

পূজারত পুরোহিত; Source: publicbroadcasting.net

বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলি যখন সুন্দরবন সংলগ্ন আঠারো ভাটির দেশে পৌঁছান, তখন সেখানকার রাজা ছিল নিষ্ঠুরতার প্রতীক দক্ষিণ রায় বা রায়মণি। শাহাজঙ্গুলির সেই আযানের ধ্বনি কানে যায় দক্ষিণ রায়ের। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বন্ধু সনাতন রায়কে পাঠায় রাজা। সনাতন এসে দুই ভাইবোনের কথা জানালে নিজ সাম্রাজ্য থেকে তাদের উৎখাত করতে উদ্যত হয় দক্ষিণ রায়। দক্ষিণ রায় নিজে যুদ্ধের ময়দানে যেতে চাইলে তার মা নারায়ণী তাকে থামিয়ে দেয়। নারায়ণী নিজের সৈন্যসামন্ত নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বনবিবি আর শাহাজঙ্গুলির সাথে ছিল অলৌকিক ক্ষমতা, কাজেই দীর্ঘযুদ্ধের পরে হার মানতে বাধ্য হয় নারায়ণী ও তার বাহিনী। তবে দয়াপরবশ হয়ে বনবিবি তার অর্জিত সাম্রাজ্যের অর্ধেকটা দান করে নারায়ণী ও তার পুত্রকে। নারায়ণীর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে সুন্দরবন অঞ্চলের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেয় বনবিবি, দক্ষিণ রায় রাজত্ব করে জঙ্গলের গহীন কোণে।

বনবিবিকে নিয়ে শুরুর দিকে যারা কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে বায়ানুদ্দিন আর মোহাম্মদ খাতের অধিক জনপ্রিয়। তাদের দুজনের লেখায় বেশ মিলও পাওয়া গেছে। কবিতা বা গল্পগাথাগুলোয় দুটি প্রধান কাহিনী উঠে এসেছে, রাজা দক্ষিণ রায়ের সাথে বনবিবির যুদ্ধ এবং দুখের সাথে তার দেখা হওয়ার ঘটনা। ২০০৪ সালে অমিতাভ ঘোষ তার ‘দ্য হাংগ্রি টাইড’ নামক পরিবেশবাদী উপন্যাসে এই ঘটনা দুটিকে ‘দুখে’স রিডাম্পশন’ বা ‘দুখের মুক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ক্বেরাতুল হায়দার এক পাদটীকায় উল্লেখ করেছেন বনবিবি আর কেউ নন, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) এর কন্যা ফাতিমা (রা)! তবে এই কথার কোনো প্রমাণ নেই। জঙ্গলে বসবাসরত বাঙালি মুসলমানদের মুখে মুখে তিনি বনের যাবতীয় বিপদ-আপদ থেকে রক্ষাকারী বনবিবি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

বনবিবির মেলায় দর্শনার্থীরা; Source: ruralindiaonline.org

দুখের গল্প অনুসারে, বাজিরহাটি নামক এক গ্রামে বাস করতো দুই মৌয়াল ভাই ধোনা আর মোনা, মতান্তরে ধানাই আর মানাই। ধোনা একবার পরিকল্পনা করে সাতটি নৌকা নিয়ে আঠারো ভাটির দেশের মহলে বা একদম গভীরে যাবে মধু সংগ্রহ করতে। তার ভাই মোনা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। কাজেই একলা ধোনা গরীব এক রাখাল বালক দুখেকে সাথে নিয়ে যাবে বলে মনস্থির করে। জঙ্গলে যাওয়ার আগে দুখের মা তাকে বলে, “বনে আমার মতো তোর আরেক মা আছে, কোনো বিপদে পড়লে তাকে স্মরণ করবি”। নির্ধারিত সময়ে যাত্রা শুরু করে নৌকার বহর কেন্দোখালি চরে পৌঁছায়। সে সময় ঐ অঞ্চলের রাজা ছিল দক্ষিণ রায়। ভুলক্রমে রাজাকে ভেট বা উপহার দিতে ভুলে যায় ধোনা। কাজেই নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী তিনদিন মধু বা মোম সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকতে হয় তাদের। তৃতীয় রাতে ধোনার স্বপ্নে দেখা দেয় দক্ষিণ রায়, ভুলের মাশুল হিসেবে নরবলি দেয়ার আদেশ দেয় তাকে। বেশ বাকবিতণ্ডার পরে শেষ পর্যন্ত দুখের প্রাণের বিনিময়ে রাজার কাছ থেকে মধু আর মোম নেয়ার অনুমতি আদায় করে লোভী ধোনা।

কাজেই পর্যাপ্ত মধু আর মোম নিয়ে দুখেকে একা ফেলে রেখে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে নিজ গ্রামে চলে আসে ধোনা। বাঘরূপী রাজা দক্ষিণ রায় যখন দুখেকে মেরে ফেলতে উদ্যত হয়, তখনই দুখের মনে পড়ে যায় মায়ের কথা। মনে মনে সে সাহায্য প্রার্থনা করে বনবিবির কাছে। তার সেই ডাক শুনে ভাই শাহাজঙ্গুলিকে সাথে নিয়ে ছুটে চলে আসে বনবিবি। সম্মুখ যুদ্ধে বাঘবেশী দক্ষিণ রায়কে হারিয়ে দেয় শাহাজঙ্গুলি। হেরে গিয়ে বড় খান গাজীর কাছে আশ্রয় নেয় দক্ষিণ রায়, সবার কাছে তিনি গাজী পীর নামেই খ্যাত। শেষ পর্যন্ত গাজী পীর গিয়ে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বনবিবির কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে তারা নিষ্ঠুর রাজার কোনো ক্ষতি করবে না। বিনিময়ে গাজী দুখেকে সাত নৌকাভর্তি মূল্যবান সব ধন-রত্ন উপহার দেন। বনবিবির পোষা কুমির সেকোর পিঠে চড়ে গ্রামে ফিরে যায় দুখে। নিজ গ্রামে এসে বনবিবির এই কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করে দুখে। তার কথায় অভিভূত হয়ে সে গ্রাম তো বটেই, পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও শুরু হয়ে যায় বনবিবির উপাসনা। ধোনা তার ভুল বুঝতে পেরে মেয়ে চম্পার সাথে দুখের বিয়ে দেয় এবং দুখেকে গ্রামের চৌধুরী বা প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

পশ্চিমবঙ্গের জয়নগরে বনবিবির মন্দির; Source: behenji26.com

সেই থেকে অদ্যাবধি দেবীর মর্যাদায় সুন্দরবনের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছেন বনবিবি। প্রতিবছর বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী পহেলা মাঘ, ইংরেজি ১৬ জানুয়ারি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বসে বনবিবির মেলা, পালিত হয় বনবিবির পূজা। খ্রিস্টীয় ১৮৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ বেশ কিছু অঞ্চলে ঘটা করে বনবিবির পূজা করা হয়। এটি আমাদের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশে পরিণত হয়েছে।

ফিচার ইমেজ- cloudfront.net

Related Articles