Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শহীদ নূর হোসেন: স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রমিথিউস

সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই ভূখণ্ডে নানান স্বৈরাচারী শাসকেরা তাদের অত্যাচার নিপীড়ন চালিয়ে গেছে এবং এখানকার মানুষেরা তা প্রতিহত করতে সচেষ্ট হয়েছে। কখনো এই স্বৈরাচারী শাসকদের সফলভাবে উৎপাটন করতে পেরেছে জনগণ, আবার কখনো অত্যাচারী শাসকের আঘাতে তারা হয়েছে রক্তাক্ত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫২, ৬৯, ৭১ তারই জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। তাই এ কথা বলাই যায় যে, বাংলাদেশের ইতিহাস গণতন্ত্রের ইতিহাস।

স্বৈরাচারের উত্থান

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ স্বৈরাচারের কালো থাবা পড়ে বাংলাদেশের ওপর। ক্ষমতায় আসেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তিনি শুরু করেন একের পর এক ফ্যাসিবাদী আচরণ। কিন্তু যে দেশের ইতিহাসই গণতন্ত্রের ইতিহাস, সে দেশে স্বৈরতন্ত্র স্থায়ী হবে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তৎকালীন সাধারণ মানুষ তা হতেও দেয়নি। প্রথমদিকে মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সরকারকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসলেও সরকার তা আমলে নেয়নি। পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে মানুষের দাবির আওয়াজ আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে, বেগবান হতে থাকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন।

১৯৮৬ সালের ৭ মে এরশাদ সরকারের অধীনে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের দল জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৭৬টি আসন লাভ করে। তবে নির্বাচনের পর থেকেই বিভিন্ন জালিয়াতির সন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ হয় তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে সাধারণ জনগণ এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে এবং একইসাথে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেয়। সে ডাকে সাড়া দেয় হাজার হাজার মানুষ। হাজার মানুষের সেই ভিড়ে স্বীয় আলোয় জ্বলজ্বল করছিল এক টগবগে তরুণ, নাম তার নূর হোসেন।

তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ; source: bd24live.com

নূর হোসেনের বেড়ে ওঠা

১৯৬৪ সালের কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে ঢাকার নারিন্দায় মজিবুর রহমান ওরফে কাঞ্চন মিয়া ও মরিয়ম বেগমের কোলে আসে তাদের তৃতীয় পুত্র। হয়তো ভেবেছিলেন এই সন্তান তাদেরকে নূরের মতোই আলোকিত করবে। সে কারণে সন্তানের নাম রাখলেন নূর হোসেন। ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করলেও তার পৈতৃক নিবাস ছিল পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের ঝাটিবুনিয়া গ্রামে।

শৈশবে নূর হোসেনকে বেশ কয়েকবার আবাসস্থল পরিবর্তন করতে হয়। তবে নানান জায়গায় বিচরণের পর এসে স্থায়ী হন ঢাকার ৭৯/১ এর বনগ্রাম রোডে। দুরন্ত ও চঞ্চল স্বভাবের নূর হোসেনের শৈশব কাটে দরিদ্রতার মধ্য দিয়েই। তবুও পিতার কল্যাণে প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যান হেসেখেলেই। তবে হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হবার পর দারিদ্র্যের সাথে আর পারলেন না। পরাজয় মেনে নিয়ে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে কাজে যোগদান করেন। প্রথমে কাজ শুরু করেন মোটর মেকানিক হিসেবে।

তবে কাজে যোগদান করলেও জ্ঞানের অন্বেষণ থেমে থাকেনি তার। নিয়মিতই পড়তেন পত্রিকা, রাখতেন দেশ-বিদেশের সব রকমের খবরাখবর। তারই ফলস্বরূপ নিজের প্রচেষ্টায় কাজের বিরতিতে অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে এবং যে দারিদ্র্যের কারণে তার পড়াশুনা বন্ধ হয়েছিল, তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সদরঘাটের কলেজিয়েট নৈশ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন।

পড়াশোনার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও বেশ সচেতন হয়ে উঠছিলেন নূর হোসেন। দেশের সঙ্কটের কথা বুঝতে পেরে তখন থেকেই স্থানীয় রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে গিয়ে ধীরে ধীরে বিভিন্ন মিটিং, মিছিলে হয়ে ওঠেন সক্রিয় এবং একটা সময় এই মিটিং, মিছিল, আন্দোলনই হয়ে যায় তার প্রাণ।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে নূর হোসেন

১৯৮৬ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে শুরু হয় সরকার পতনের আন্দোলন। ক্রমেই আন্দোলন হতে থাকে বিস্তৃত। দেশের হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় এই আন্দোলনে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকা মহানগর অবরোধের ডাক দেয় পাঁচ, সাত ও আট দলীয় জোট। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সে বছরের ৯ – ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় সবধরনের সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে। এমনকি চারজনের বেশি মানুষের একসাথে চলাফেরার ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

গণতন্ত্রের প্রতীক নূর হোসেনের জীবন্ত পোস্টার; source: somewhereinblog.net

অবরোধে অংশগ্রহণের জন্য দু’দিন আগেই বাসা থেকে পালিয়ে যান নূর হোসেন। অবরোধের দিন সকালে বাবা-মা তাকে খুঁজতে বের হলে মতিঝিলে নির্মাণাধীন ডিআইটি মসজিদের (বর্তমানে রাজউক মসজিদ) দোতলায় তাকে খুঁজে পান। মিছিলে অংশগ্রহণের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে আগেই নিজের বুকে-পিঠে শ্লোগান লিখে রেখেছিলেন। বাবা-মাকে দেখে তা ঢেকে ফেললেও মায়ের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি। আতঙ্কগ্রস্ত মা তাকে বাড়ি ফিরে যেতে বললেও তিনি বাড়ি ফিরে যাননি। কেননা সামনে যে তার অনেক কাজ বাকি!

‘স্বৈরাচার নীপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ সাদা রঙ দিয়ে নূর হোসেনের কৃষ্ণ বর্ণের বুকে-পিঠে শ্লোগানটি লিখে দিয়েছিল তার বন্ধু মোঃ ইকরাম হোসেন। কেডস, জিন্সের প্যান্ট পরে খালি গায়ে বুকে-পিঠে তার অমর শ্লোগান লিখে সেদিন সেই মসজিদ থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

© Dinu Alam

সকাল ন’টায় শুরু হয় সেদিনের অবরোধ কর্মসূচি। শুরু থেকেই বিভিন্ন স্থানে মিছিলে আসা মানুষদের গ্রেফতার করতে থাকে পুলিশের সদস্যরা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মিছিলে বাড়তে থাকে লোক সমাগম এবং নড়তে থাকে স্বৈরাচারের ভিত। বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে পুলিশের লাঠিচার্জ। সঙ্গত কারণেই এতো মানুষের সম্মিলিত মিছিল দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল স্বৈরাচারী শাসক। তাই আর চুপ করে থাকতে না পেরে গুলি ছোঁড়ার আদেশ দিলেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের।

১১ই নভেম্বর, ১৯৮৭ এর বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকা; source: istishon.com

গুলিস্থান থেকে জিরো পয়েন্টের দিকে এগুতে থাকা একটি মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন নূর হোসেন। চোখে-মুখে তার ছিল গণতন্ত্র উদ্ধারের পিপাসা, যা চোখ এড়ায়নি দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরও। জীবন্ত প্রাচীরপত্র হয়ে আসায় তিনি ছিলেন সকলের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে। মিছিলটি জিরো পয়েন্টের সামনে আসামাত্রই পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ সময় পুলিশের ছোড়া একটি বুলেট সোজা নূর হোসেনের বুক বরাবর আঘাত করে। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন নূর হোসেন। তার পাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন আরও দু’জন। শহীদ হন যুবলীগ নেতা নূরুল হুদা বাবুল ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ক্ষেতমজুর নেতা আমিনুল হুদা টিটো।

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নূর হোসেনকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাবার চেষ্টা করা হলে সেখানেও বাধা দেয় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা নূর হোসেনকে রিকশা থেকে নামিয়ে আরও অত্যাচার করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর পর তাকে পুলিশের ভ্যানে তুলে নেয়া হয়। পরবর্তীতে রাতের অন্ধকারে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তাকে জুরাইন কবরস্থানে মাটি চাপা দিয়ে দেয়। আর এভাবেই চোখে-মুখে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে সুস্থ গণতন্ত্রের আশায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন শহীদ হন নূর হোসেন।

শহীদ নূর হোসেনের সমাধিসৌধ; source: jagonews24.com

নূর হোসেনের মৃত্যুতে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আরও বেশি গতির সঞ্চার হয়। তার বুকে পিঠে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ একটি জাতীয় শ্লোগানে রূপান্তরিত হয় এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রতীকে পরিণত হয়। অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে এবং দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

শহীদ নূর হোসেনের অবদান স্মরণ ও সম্মাননা

নূর হোসেনের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে ১০ নভেম্বরকে ‘শহীদ নূর হোসেন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে বাংলাদেশে এই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। এছাড়া নূর হোসেন যে স্থানে গুলিবিদ্ধ হন, সেটিকে তার প্রতি সম্মানপূর্বক জিরো পয়েন্টের পরিবর্তে ‘নূর হোসেন স্কয়ার’ হিসেবে নতুন নামকরণ করা হয়।

ফুলার রোডে নূর হোসেনের সম্মানে তৈরি ভাস্কর্য; source: thereport24.com

তার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে দুই টাকা মূল্যের স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্যে বাংলার ইতিহাসের সর্বোচ্চ জ্ঞানী-গুণী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ভাস্কর্যের পাশে স্থান পায় শহীদ নূর হোসেন সেই অমর প্রতিবাদী শ্লোগান সংবলিত একটি ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেণ ভাস্কর শামীম সিকদার।

ফিচার ইমেজ– প্রথম আলো

Related Articles