Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উয়ারী-বটেশ্বর: মাটির নিচের প্রাচীন নগর

বাংলাদেশে বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যেমন পাহাড়পুর বা সোমপুর বিহার, মহাস্থানগড়, লালবাগ কেল্লা, ষাটগম্বুজ মসজিদ ইত্যাদি সবই স্বাভাবিকভাবে মাটির উপরেই অবস্থিত। তবে আপনারা কি জানেন, মাটির নিচে অবস্থিত এমন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও রয়েছে এদেশে! হ্যাঁ, উয়ারী-বটেশ্বর হচ্ছে আমাদের মাটির নিচে অবস্থিত সেই অমূল্য নিদর্শন। চলুন আজ তাহলে জানা যাক হাজার বছরের পুরনো এক দুর্গ নগরীর কথা।

অবস্থান

উয়ারী ও বটেশ্বর মূলত দুটি আলাদা গ্রাম। তবে গ্রাম দুটি পাশাপাশি থাকায় এবং সেখানে প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধধর্মের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া যাওয়ার কারণে, তারা একসাথে উয়ারী-বটেশ্বর নামেই পরিচিত। ঢাকা থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত নরসিংদী জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে বেলাব ও শিবপুর উপজেলার পাশে গ্রাম দুটির দেখা মেলে।

উয়ারী-বটেশ্বরের মানচিত্র; Source: Banglapedia.com

ইতিহাস

ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ শতাব্দীতে মারুয়া রাজবংশের আমলে উয়ারী-বটেশ্বরের এই দুর্গ নগরীতে মানুষের প্রথম বসবাস শুরু হয়। প্রচুর ফসিল সহ এখান থেকে প্রাপ্ত প্রত্নতত্ত্বগুলো, যেমন- কাঠের তৈরি বাটালি, হাতে ব্যবহার উপযোগী কুঠার ইত্যাদি যাচাই করে ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এই এলাকায় মানববসতি গড়ে উঠে ঠিক নব্যপ্রস্তর যুগের প্রথম দিকেই। পরবর্তীতে উয়ারী-বটেশ্বরে খনন কাজ চালানোর ফলে আরো কিছু প্রত্নতত্ত্ব পাওয়া গেছে। সেসব নিদর্শন, যেমন- কালো মাটির পাত্র, মাটিতে গর্ত করে বসবাস করার ঘর ইত্যাদি পর্যালোচনা করে ধারণা করা হয়, এখানে তাম্র-প্রস্তর যুগেও মানুষের বসবাস ছিল।

মাটির নিচে ঘর; Source: shmirzawpnews

বর্তমানে যে খনন কাজ চলছে তাতে আরও প্রাচীন হাতিয়ার, জনপদ, বাণিজ্য, স্থাপত্য, অলঙ্কার, মুদ্রা, প্রযুক্তি এবং শিল্পেরও প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। ধারণা করা হয়, গ্রীসের বিখ্যাত ভূগোলবিদ, জ্যোতিষী এবং গণিতবিদ টলেমি তার ‘জিয়োগ্রাফিয়া’ বইয়ে ‘সোনাগড়া’ নামে যে উন্নত, ধনী এবং সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাচীন শহরের নাম উল্লেখ করেছিলেন, সেটাই হলো উয়ারী-বটেশ্বর। এ থেকে অনুমান করা হয়, উয়ারী-বটেশ্বরে বর্তমান যে নগরীর সন্ধান পাওয়া গেছে তার বয়স প্রায় ২,৫০০ বছর।

উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত অনেক প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন পরীক্ষা করে জানা যায়, এই নগরীর সাথে ৪,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীন সিল্ক রুটেরও সংযোগ ছিল। নদীবন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র হওয়ায় ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন অনেক প্রাচীন নগরী, ভূমধ্যসাগর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক পুরাতন অঞ্চলের সাথেও উয়ারী-বটেশ্বরের যোগাযোগ ছিল।

ঘরে যাবার জন্য ছিল সিঁড়ির মতো ধাপ; Source: bangladeshunlocked.blogspot.com

তাই ধরে নেয়া হয়, উয়ারী-বটেশ্বর হচ্ছে বাংলাদেশের সবচাইতে প্রাচীন মহা-জনপদ এবং ‘অসমরাজার গড়‘ নামে যে দুর্গটি (বর্তমানে মাটির বাঁধ) আছে, তা নগরীটির রাজধানী।

আবিষ্কার

পাথরখণ্ড হাতে হাবিবুল্লা পাঠান এবং পাশে হানিফ পাঠান; Source: Dailystar.net

উয়ারী-বটেশ্বর আবিষ্কারের পেছনে যাদের অবদান সবচাইতে বেশি, তারা হলেন স্থানীয় স্কুল শিক্ষক হানিফ পাঠান এবং তার ছেলে হাবিবুল্লাহ পাঠান।১৯৩৩ সালে উয়ারী গ্রামে কিছু শ্রমিক মাটি খনন করার সময় একটি মাটির পাত্রে কিছু মুদ্রা পায়। অধিকাংশ মুদ্রা হাত বদল হয়ে গেলেও হানিফ পাঠান জানতে পেরে দ্রুত ৩০-৩৫টি মুদ্রা সংগ্রহ করেন। এগুলো ছিল তৎকালীন ভারত এবং বঙ্গদেশের প্রাচীন রৌপ্যমুদ্রা। এ থেকে তিনি নিশ্চিত হন যে, নিশ্চয়ই এখানে কোনো প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন লুকায়িত আছে।

তিনি তার ছেলে হাবিবুল্লাহ পাঠানকে এ ব্যাপারে জানিয়ে রাখেন। ১৯৫৫ সালে বটেশ্বর গ্রামে শ্রমিকদের খননের ফলে দুটি লোহার পিণ্ড পাওয়া যায়। একটি দেখতে ত্রিকোণাকার, অপরটির এক মুখ চোখা। তার এক বছর পরেই উয়ারী গ্রামে তিন হাজারেরও বেশি রৌপ্যমুদ্রা সম্বলিত এক ভাণ্ডার পাওয়া যায়। হানিফ পাঠান পরবর্তীতে নিজের একান্ত প্রচেষ্টায় একটি সংগ্রহশালা তৈরি করেছিলেন, যেখানে তিনি এ ধরনের নিদর্শনগুলো জমিয়ে রাখতেন।

হানিফ পাঠানের সংগ্রহশালা; Source: archaeology.org

১৯৭৪-৭৫ সালের পর থেকে হাবিবুল্লাহ পাঠান আরো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করে জাদুঘরে জমা দেওয়া শুরু করেন। এতদিন একরকম অবহেলিত থাকার পর ২০০০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন উদ্যমে শুরু হয় খনন কাজ। এই খনন কাজের পরই আবিষ্কার হয় প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বের দুর্গ নগরী, চলাচলের বিভিন্ন গলি, ইটের স্থাপনা, দুর্লভ ও মূল্যবান পাথর, পাথর দিয়ে তৈরি বাটখারা, কাঁচের পুতির মালা ও বেশ কিছু মুদ্রা ভাণ্ডার। প্রাপ্ত নিদর্শনগুলোই পরবর্তীতে উয়ারী-বটেশ্বরের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে; Source: dailystar.net

বর্তমানে হানিফ পাঠান বেঁচে না থাকলেও, তার শখের সংগ্রহশালাটি এখনও রয়েছে। এটি তার ছেলে হাবিবুল্লাহ পাঠানের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। ৬১ বছর বয়সী হাবিবুল্লাহ পাঠান আজও তার পিতার এই বিস্ময়কর সংগ্রহশালাটি সমৃদ্ধ করতে সদা তৎপর।

নিদর্শন

উয়ারী-বটেশ্বরের প্রায় ৫০টি প্রত্নস্থান থেকে প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার। যেমন- নব্যপ্রস্তর যুগের কাঠের তৈরি হাতিয়ার, পাথরের তৈরি দু’ধারী কুঠার, ছুরি, হাতুড়ি-বাটালী, লৌহবল্লম ইত্যাদি।

কিছু হাতিয়ার; Source: wari-bateshwar.blogspot.com

নরসিংদী জেলায় যে প্রাচীন শিল্প-বাণিজ্যের প্রথম প্রসার লাভ করেছিলো, তা জানা যায় এখানে প্রাপ্ত বিভিন্ন ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, বাটখারা এবং আরো কিছু নিদর্শন থেকে। সেসময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য উয়ারী-বটেশ্বর এলাকার মানুষদের নির্দিষ্ট মাপের কিছু বাটখারার প্রয়োজন ছিল। প্রাপ্ত গ্রানাইট, ক্রিস্টাল এবং জেস্পারের বিভিন্ন মাপের এবং আকৃতির বাটখারাগুলো পর্যালোচনা করে ধারণা করা হয় যে, এগুলো হয়তো পুঁতি পরিমাপ করার কাজে ব্যবহৃত হতো। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন নিদর্শন, যেমন- স্যান্ডউইচ আকারের কাঁচের পুতি এবং রোলেটেড মৃৎপাত্রও পাওয়া গেছে এখানে। এ কারণে ধারণা করা হয়, দূর-দূরান্তের জনপদ এবং শহরগুলোর সাথেও উয়ারী-বটেশ্বরের ব্যবসায়ীক সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিল।

কিছু পুঁতি; Source: archaeology.org

‘অসমরাজার গড়’ নামে পরিচিত দুর্গ নগরীতে খননের ফলে তৎকালীন জনবসতির ব্যবহার্য অনেক জিনিসপত্রের নিদর্শনও পাওয়া গিয়েছে। যেমন- সেসময়ে তাদের বসবাস করা গর্তের ঘর, পানি সংগ্রহের কূপ, বিভিন্ন আকৃতির চুলা এবং কালো রঙের পাত্রের পাশাপাশি পোড়ামাটির লাল রঙের পাত্রও পাওয়া গিয়েছে। সেই সাথে তৎকালীন মানুষদের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা প্রচুর পাথরের তৈরি খণ্ডও পাওয়া গিয়েছে। এসব খণ্ড পরীক্ষা করে ইতিহাসবিদরা ধারণা করছেন, এগুলোর ভেতর কিছু কিছু খণ্ড বিভিন্ন জ্যামিতিক ও ত্রিকোণমিতিক সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করা হতো। এ থেকে বোঝা যায়, সে সময়ের উয়ারী-বটেশ্বরে বসবাসকারী মানুষদের মাঝে পরিমাপ ও গাণিতিক বিষয়েও ভালো জ্ঞান ছিল। প্রাপ্ত প্রচুর পুঁতি এবং পুঁতির তৈরি মালা থেকে ধারণা করা হয়, এখানে পুঁতি তৈরির কারখানাও ছিল, যেগুলো দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করা হতো।

বিভিন্ন মাপের বাটখারা; Source: aiub.edu

বর্তমানে দেখার মতো আরো যেসব নিদর্শন রয়েছে তা হলো চারিদিকে পরিখা সম্বলিত ৬০০x৬০০ মিটার আয়তনের চারটি দুর্গ-প্রাচীর ও অসমরাজার গড়। উয়ারী-বটেশ্বর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে শিবপুর উপজেলায় ‘মন্দির-ভিটা’ নামে একটি বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। জংখারটেক নামে পাশের একটি গ্রামে আরেকটি বড় বৌদ্ধমন্দির রয়েছে। এ থেকে ধারণা করা হয়, উয়ারী-বটেশ্বরের প্রাচীন জনপদ মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল।

মন্দির-ভিটা; Source: offroadbangladesh.com

উয়ারী-বটেশ্বরের প্রায় ৫০টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের মধ্যে প্রধান যেসকল স্থান থেকে বেশি নিদর্শন পাওয়া গেছে সেগুলো হলো- রাঙারটেক, সোনারতলা, কেন্ডুয়া, মরজাল, টঙ্গীরাজার বাড়ি, টঙ্গীরটেক, জংখারটেক, মন্দির-ভিটা ইত্যাদি।

ফিচার ইমেজ: deshebideshe.com

Related Articles