Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আল মাসুদি: ইসলামের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ

হেরোডটাসের নাম সকলের জানা। তাকে বলা হয় ইতিহাসের জনক। তবে ইতিহাসে আরো একজন হেরোডটাস আছেন, তা কি জানা আছে? তার নাম হেরোডটাস না হলেও তার কাজ তাকে এনে দিয়েছিল ‘দ্য হেরোডটাস অব দ্য আরব’ খেতাব। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইতিহাস এবং ভূগোল নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে কাজ করেছেন। তাকে ইসলামের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। তার পুরো নাম আবু আল হাসান আলী ইবনে আল হুসাইন ইবনে আলী আল, মাসুদি যিনি সংক্ষেপে আল মাসুদি নামে পরিচিত।

আল মাসুদি (৮৯৬-৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ); source: tribune.com.pk

আল মাসুদি খুব সম্ভবত ৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব, পরিবার ও শিক্ষা- এসব বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যই পাওয়া যায় না। তবে তার ভ্রমণবিলাসিতার কথা প্রায় সকল ইতিহাসবিদই লিখে গেছেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই আল মাসুদি তার যাযাবর জীবনের শুরু করেন এবং মৃত্যুর কয়েক বছর আগে পর্যন্ত তার এই ভ্রমণ অব্যাহত থাকে। পারস্য, শাম (বর্তমান সিরিয়া), আর্মেনিয়া, আজারবাইজান হয়ে কাস্পিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে ভোলগা অঞ্চল, মধ্য এশিয়া, ভারত, কানবালু বা বর্তমান মাদাগাস্কার, ওমান, দক্ষিণ আরব, গ্রীক সাম্রাজ্য ও স্পেনে ঘুরে মিশরে গিয়ে শেষ হয় তার এই দীর্ঘ ভ্রমণ। অনেক ইতিহাসবিদ তার ভ্রমণের তালিকায় চীন ও শ্রীলংকাও যোগ করেন। কেননা তার ইতিহাস বিষয়ক লেখায় চীন ও শ্রীলংকা সম্বন্ধে ব্যাপক পরিমাণে তথ্য ছিল।

আল মাসুদি কেবল একজন অসামান্য ভূগোলবিদই ছিলেন না, ছিলেন একজন চমৎকার লেখকও। আর তার লেখার আগ্রহও ছিল ভীষণ বৈচিত্র্যময়। বিশেষত বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ক লেখায় তিনি একজন পথিকৃৎ হয়ে আছেন। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখা ‘কিতাব আল মুরাজ আল ধাহাব’, যার ইংরেজি অনুবাদ ‘গোল্ডেন মিডোজ’ই একমাত্র অক্ষত অবস্থায় বর্তমানকাল পর্যন্ত টিকে আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে এই বইটি ছাড়া আল মাসুদির অধিকাংশ লেখাই হারিয়ে গেছে। ভূগোল আর ইতিহাসের বাইরেও তার জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছিল সৃষ্টিতত্ত্ব, আবহাওয়াবিদ্যা, সমুদ্রবিজ্ঞান, জোতির্বিজ্ঞান, ইসলামিক শরিয়াহ আর আরব লোকজ সংস্কৃতি দিয়ে। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, তার জন্মের দেড়শ’ বছর পূর্বে ৭৫১ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হওয়া তালাসের যুদ্ধ আল মাসুদি তথা তৎকালীন আরো অনেক পণ্ডিতের জ্ঞানচর্চার পেছনে ভূমিকা রেখেছিল। সে যুদ্ধে মুসলিমরা চীনা কাগজ প্রস্তুতকারীদের বন্দী করে আরবে নিয়ে এসেছিল এবং কাগজ তৈরির পদ্ধতি আয়ত্ত করেছিল। ফলে আরবে কাগজের প্রচলন শুরু হয় এবং কাগজে ছাপা বইয়ের দাম অনেক কমে যায়। বিশেষ করে বাগদাদে গড়ে ওঠে অসংখ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। আর বইয়ের এমন সহজলভ্যতাই সে সময়ের মুসলিম পণ্ডিতদের জ্ঞানচর্চার পথ সুগম করে।

মধ্যযুগীয় বাগদাদ; source: Worldbulletin

আল মাসুদির শিক্ষা সম্বন্ধে কিছু জানা না গেলেও এটুকু জানা যায় যে তার জ্ঞানের প্রধান উৎস ছিল গ্রীক এবং রোমান ইতিহাস ও বিজ্ঞান এবং তার ভ্রমণ। তিনি তৎকালীন সমাজে প্রচলিত অনেক কুসংস্কার থেকে নিজেকে সফলভাবে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। প্রচলিত তথ্যের উপর অন্ধভাবে বিশ্বাস স্থাপন না করে তিনি ভ্রমণের মাধ্যমে প্রামাণিক ভৌগোলিক তথ্য সংগ্রহ করেন। তখন মুসলিমদের জন্য স্বর্ণযুগ হলেও খ্রিস্টানদের জন্য ছিল ‘ডার্ক এইজ’ বা অন্ধকার যুগ। প্রভাবশালী চার্চই তখন খ্রিস্টানদের বিজ্ঞানচর্চা নিয়ন্ত্রণ করতো। মধ্যযুগে ইউরোপীয়দের বিজ্ঞানচর্চা ছিল সম্পূর্ণরূপে চার্চ কেন্দ্রিক। তাদের বিশ্বাস ছিল যে পৃথিবী একটি বিশাল সমতল প্লেটের মতো যা চারদিক থেকেই জলবেষ্টিত। কিন্তু আল মাসুদি এই ধারণা উড়িয়ে দেন। তিনি পর্যবেক্ষণ দ্বারা পৃথিবী যে গোলাকার সে বিষয়ে নিশ্চিত হন। তার মতে পৃথিবী সমতল হলে ভূপৃষ্ঠ সর্বদা জলনিমগ্ন থাকতো। কিন্তু পৃথিবী গোলাকার বলেই সমুদ্রে জাহাজ ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয়।

আল মাসুদির মানচিত্র;source: aboutislam.net

আল মাসুদি পৃথিবীর সমুদ্র এবং মহাদেশগুলোর সীমানা নির্ধারণের প্রয়াস চালান। এক্ষেত্রে তিনি গ্রীক প্রথা অনুযায়ী জাপানকে পূর্ব সীমানা এবং পশ্চিমের সীমানা হিসেবে একটি দ্বীপপুঞ্জকে নির্ধারণ করেন। সমুদ্রের ব্যাপারে আল মাসুদির ধারণা কিছুটা প্রাচীন ধারণার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, পুরো পৃথিবীকে চক্রাকারে ঘিরে আছে একটি মহাসমুদ্র, যা অন্যান্য সকল সাগরের সাথে যুক্ত। তার মতে, আরব সাগর ছিল পৃথিবীর বৃহত্তম সাগর। তবে আরব ও চীনের মধ্যবর্তী পারস্য সাগর সহ মোট সাতটি সাগরের সীমানা ও দিক নির্ণয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন আল মাসুদি, যা তৎকালীন আরব ব্যবসায়ীদের ভীষণ কাজে দেয়।

তখনকার ভূগোলবিদদের জন্য একটি বড় সমস্যার নাম ছিল কাস্পিয়ান সাগর। এই কাস্পিয়ান সাগর উত্তর দিকের কোনো সাগরের সাথে যুক্ত নাকি কৃষ্ণ সাগরের সাথে যুক্ত, এ ব্যাপারে তারা দ্বিধান্বিত ছিলেন। ‘দ্য অক্সাস’ বা আমু নদী নিয়েও ছিল সংশয়। এ দু’টি সমস্যার সমাধান করেন আল মাসুদি। তিনি তার পর্যবেক্ষণ থেকে বলেন, কাস্পিয়ান সাগর কোনোটির সাথেই যুক্ত নয়। অন্যদিকে আমু নদীরও কাস্পিয়ান বা কৃষ্ণ সাগরের সাথে কোনো সংযোগ নেই। বরং আমু পতিত হয়েছে আরাল সাগরে। তিনি বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ভোলগাকে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করতেন এবং ভোলগাকে একটি ব্যস্ত ‘ব্যবসায়িক মহাসড়ক’ বলে অভিহিত করেন। অন্যদিকে আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগর পরস্পর সংযুক্ত বলে মত প্রকাশ করেন মাসুদি।

ভোলগা নদী; source: Gail’s Cruise Holidays – WordPress.com

“পৃথিবীতে এমন কোনো স্থান নেই যা সর্বদা জলনিমগ্ন থাকে, এমন কোনো স্থান নেই সর্বদা ভূমি থাকে। বরং একটি ধ্রুব আবর্তন চক্রাকারে চলতে থাকে যা সদা গতি পরিবর্তনশীল নদীসমূহ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভূপৃষ্ঠেরও রয়েছে যৌবন এবং বার্ধক্য, যেমনটি রয়েছে উদ্ভিদ ও জীবের। তবে জীবের বৃদ্ধি একসাথে ঘটতে থাকলেও ভূপৃষ্ঠের যৌবন/বার্ধক্য চক্র ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে চলতে থাকে।”-আল মাসুদি

একাধিকবার সমুদ্রযাত্রা করা আল মাসুদি সমুদ্রে নাবিকদের প্রতিকূল পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন সমুদ্রের দিক নির্ণয়ের চেষ্টা করেন এবং নিরাপদ রুট মানচিত্রে সংযোজন করেন। তিনি নীল নদের প্রকৃত উৎস সম্পর্কিত সমস্যা নিয়েও কাজ করেন। “সিন্ধু উপত্যকার সাথে নীলনদের সংযোগ রয়েছে”-এ সম্বন্ধীয় তত্ত্ব অস্বীকার করেন মাসুদি। তিনি বরং নীল নদের উৎস হিসেবে আবিসিনিয়া উপত্যকার কথা বলেন। অন্যদিকে আল মাসুদি তার সময়ের একজন বিখ্যাত আবহাওয়াবিদও ছিলেন। তিনি ‘হারকেন্দ’ বা বর্তমান বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি বায়ুর গমন বিষয়ক বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন।

মিডোজ অব গোল্ড; ছবিঃ WikiShia

আল মাসুদি পরিবেশ সম্পর্কে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন এবং তিনি প্রাণ প্রকৃতির সাথে প্রাত্যহিক মানবজীবনের সংযোগ ঘটাবার চেষ্টা করেন। নিজের চারপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে তিনি বলেন- “প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের জীবনধারা তিনটি বিষয় দ্বারা প্রভাবিত করে। পানি, উদ্ভিদ এবং ভূসংস্থান।” এ ব্যাপারে তিনি যুক্তি দেখান যে, কোনো অঞ্চলে পানির পরিমাণ বেশি হলে সেখানে আর্দ্রতা বেশি হয় যা সেখানকার মানুষের মেজাজ হালকা রাখে। অন্যদিকে শুষ্ক অঞ্চলের মানুষ কিছুটা খিটখিটে হয়। আবার জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলের মানুষ কিছুটা হিংস্র প্রকৃতির হতে পারে! পক্ষান্তরে, মরুভূমির মানুষ বিপরীত প্রকৃতির। তবে মাসুদির মতে, মানুষের বাসস্থান নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় নির্ণায়ক হওয়া উচিত- পর্বতের নৈকট্য, সাগর বা নদীর উপস্থিতি এবং পর্যাপ্ত উদ্ভিদ।

আরবের যাযাবর বেদুইনদের জীবন সম্পর্কে আল মাসুদির রয়েছে বিচিত্র পর্যবেক্ষণ। তার মতে, শহুরে জীবনের তুলনায় এই যাযাবর জীবনই শ্রেয়। কেননা শহর মানুষের ঘুরে বেড়ানো এবং মুক্ত পরিবেশে বসবাসের ইচ্ছাকে দমন করে ফেলে। আরবরা মুক্তভাবে বসবাস করে বলেই তারা শারীরিকভাবে বলবান হয়! তিনি মানুষের আচরণ ও বৈশিষ্ট্যের উপর আঞ্চলিক প্রভাব চমৎকারভাবে বর্ণনা করেন। তিনি তার পর্যবেক্ষণ থেকে বলেন, উত্তরাঞ্চলে যেখানে সূর্যের তাপমাত্রা কম এবং শীতের আধিক্য বেশি, সেখানকার মানুষজন বদমেজাজি, ঝগড়াটে, ধীর বুদ্ধির, মোটা চামড়া বিশিষ্ট, অধিক মাংসপেশিবহুল, নীল চোখ এবং কোঁকড়ানো লাল চুল বিশিষ্ট হয়। আরো উত্তরে বরফে বসবাসকারী মানুষেরা নিষ্প্রভ এবং বর্বর স্বভাবের হয়। তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন। তা হচ্ছে, এক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলে বসবাস করলে তার মধ্যে নতুন জাতিসত্ত্বার বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়। তিনি তুর্কি থেকে ভারতে গিয়ে বসবাস করা মানুষের জীবন পর্যবেক্ষণ করে এ ধারণাটি দেন।

উত্তরাঞ্চলের মানুষ সম্পর্কে আল মাসুদির ধারণা; source: sites.google.com

আল মাসুদি দাবি করেছিলেন, তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জনৈক সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ এর একজন বংশধর। তবে তার এই দাবিতে সমসাময়িক অনেক উচ্চবংশীয় মুসলিম তার উপর ক্ষিপ্ত হন। কেননা আল মাসুদি ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী। আর এজন্যই তার ‘কিতাব আল মুরাজ আল ধাহাভ’ এর মতো অসাধারণ কাজও মুসলিমদের মধ্যে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। ১৮৬১ সালে এর ইংরেজি অনুবাদ ‘মিডোজ অব গোল্ড’ প্রকাশের পর এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হচ্ছে যে তার অধিকাংশ তথ্যবহুল মূল্যবান কাজই হারিয়ে গেছে। ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, আল মাসুদির শিয়া ও মুতাজিলি ভাবধারার জীবন ধারণের জন্যই আরবরা তার কাজগুলো গুরুত্ব সহকারে সংরক্ষণ করেনি।

আগেই বলা হয়েছে, উনিশ বছর বয়সে আল মাসুদি যে ভ্রমণ শুরু করেন, তা শেষ করেন তার মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর আগে। নিজের শেষ গন্তব্য মিশরেই তিনি জীবনের শেষভাগ কাটান। সম্ভবত ৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মিশরের ফুসতাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই গুণী পণ্ডিত।

ফিচার ইমেজ- BrowseBiography.com 

Related Articles