Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যান্ড্রু কার্নেগি: সাধারণ তাঁতশ্রমিক থেকে বিশ্বসেরা ধনী হয়েছিলো যে মানুষটি

বিশ্বসেরা ধনী বলতে আমাদের অধিকাংশের চোখের সামনে ভেসে উঠে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস কিংবা আমেরিকান বিজনেস ম্যাগনেট ওয়ারেন বাফেটের নাম। তবে আজ যার কথা বলবো তার সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়তো খুব একটা জানি না। শুনতে একটু বিস্ময়কর মনে হলেও সত্য যে, তাকে বলা হয় ‘বিশ্বের সেরা ধনী’ কিংবা ‘ম্যান অব স্টিল’। ইস্পাত শিল্পের অগ্রদূত, কার্নেগি স্টিল কোম্পানীর এ প্রতিষ্ঠাতা বিংশ শতাব্দীর প্রথম ১৮ বছরে (১৯০১-১৯১৯) দু’হাত খুলে দান করেছেন প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৭৯ বিলিয়ন ডলার!

এ বিপুল বিত্তবৈভব উপার্জনকারী মানুষটি তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল মাত্র ১.২ ডলার সাপ্তাহিক মজুরিতে। কিন্তু নিজ উদ্যম, প্রচেষ্টা আর বহুমুখী প্রতিভার দ্বারা আমেরিকা তথা বিশ্বের সেরা ধনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তিনি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিনিয়োগ প্রতিভা বলা হয় তাকে। জীবনের সাফল্যের জন্য তার কাছে প্রধান মূলমন্ত্র ছিল ‘বিনিয়োগ এবং আরো বেশি বিনিয়োগ‘। আর প্রেরণা? সেটা তিনি নিজেই নিজেকে দিতেন। তার ভাষায়, “কেউ যদি নিজেকে অনুপ্রাণিত না করতে পারে, তাহলে তাকে মধ্যম মানের হয়েই থাকতে হয়, তা সে অন্যান্য ক্ষেত্রে যতই প্রতিভাবান হয়ে থাকুক না কেন।” এখানে যার কথা বলা হয়েছে, তিনি হচ্ছেন অ্যান্ড্রু কার্নেগি। আমেরিকার বিখ্যাত এ শিল্পপতি দেশটির ইস্পাত শিল্পের বিকাশে বিরাট ভূ্মিকা রেখেছেন এবং শেষ জীবনে শিক্ষাবিস্তারে ও নানা দাতব্য কাজে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।

অ্যান্ড্রু কার্নেগি; Source: Wikimedia Commons

অ্যান্ড্রু কার্নেগির জন্ম ১৮৩৫ সালে স্কটল্যান্ডের এক তাঁতির ঘরে। উনিশ শতকের শুরুতে শিল্প বিপ্লবের জোয়ারে প্রথাগত তাঁতিদের পেশায় এক অসহনীয় দুর্যোগ নেমে আসে। এর ফলশ্রুতিতে স্কটল্যান্ডের ডুনফার্মলিনে অ্যান্ড্রুর বাবা উইলের একমাত্র তাঁতটিও বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৪৮ সালে আমেরিকান স্বপ্নে আশ্রয় খুঁজতে থাকা কার্নেগিরা আটলান্টিক পাড়ি দেন। অবশ্য পেনসিলভানিয়ার পিটার্সবার্গে অ্যান্ড্রুর আন্টিরা আগেই এসে বসতি গড়েছিলেন। তারাও একই পিটার্সবার্গে ঠিকানা বেছে নেন।

আমেরিকান স্বপ্নে অ্যান্ড্রুর পরিবারের অন্নের সন্ধান মিললেও অবস্থার তেমন একটা উন্নতি হয়নি। সেই কথা ভেবেই ১৩ বছর বয়সী অ্যান্ড্রু এবং তার বাবা উইল পিটার্সবার্গের এক টেক্সটাইল মিলে চাকরি নেন। কিছুদিন পর অ্যান্ড্রুর বাবা মিলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবারও নিজের তাঁত খোলেন এবং সেখানে নিজেদের বোনা কাপড় ফেরি করতে থাকেন। অ্যান্ড্রু সেই মিলেই সাপ্তাহিক ১ ডলার ২০ সেন্ট মজুরিতে দৈনিক ১২ ঘণ্টা করে সুতার নাটাই পরিবর্তনের কাজ করতে থাকলেন। একনিষ্ঠভাবে কারখানার কাজে লেগে থাকার ফলস্বরূপ অ্যান্ড্রু কারখানায় প্রশাসনিক দায়িত্ব পান। কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তনের তাগিদে এ কাজটি ছেড়ে দেন অ্যান্ড্রু।

নতুন কিছু শেখার কাজে অ্যান্ড্রু ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আর তাই রাতে কারখানার কাজ শেষে নিয়মিত হিসাব রক্ষণের ক্লাসে অংশ নিতেন তিনি। কাপড় কলের চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর তিনি সাপ্তাহিক ২.৫০ ডলার মজুরিতে টেলিগ্রাফ অফিসে মেসেঞ্জার বয়ের কাজ নেন। তৎকালীন সময়ে মেসেঞ্জারদের একটু আলাদা চাহিদা ছিল। সাপ্তাহিক মজুরি ধরা হলেও কাজটা অনেকটাই কমিশন ভিত্তিক ছিল। শহরের বাইরের বার্তা প্রদানের কাজে কমিশন বেশি ছিল আর সবার তাতে আগ্রহেরও কমতি ছিলো না। অ্যান্ড্রু সেখানে সব কিছু একটা সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসেন যাতে সব কমিশন এক জায়গায় জমা হয় এবং সবাই একসঙ্গে ভাগ করে নেন। এর কিছুদিন পর তিনি পেনসিলভানিয়া রেলরোড কোম্পানিতে টেলিগ্রাফ অপারেটরের চাকরি নেন। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই তিনি ঐ কোম্পানীর অনেক উপরের অবস্থানে উঠে যান। তার এ পরিবর্তনের একমাত্র কারণ ছিল অধ্যাবসায় ও কঠোর পরিশ্রম। এ সুবাদে অ্যান্ড্রু তৎকালীন দ্রুত প্রসারণশীল রেলশিল্পের মাঠ পর্যায়ের সঙ্গে অনেকটাই সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। এখানেও তিনি পরবর্তীতে রেল কোম্পানির রেলপথের সুপার পদে উন্নীত হন।

Source: carnegie.org

কিন্তু যিনি হবেন বিশ্বের সেরা ধনী, তিনি তো সামান্য চাকরি আর পদোন্নতি নিয়ে বসে থাকার লোক না। তাই চাকরির পাশাপাশি আয় বাড়াতে একপ্রকার বিনিয়োগমুখী হয়ে গেলেন অ্যান্ড্রু। তৎকালীন সম্ভাবনাময় কুরিয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগে মনস্থির করলেন তিনি। শেষমেশ মায়ের কাছ থেকে তাদের বাড়ী বিক্রির ৬০০ ডলার নিয়ে সেই সময়কার কুরিয়ার ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আডামস এক্সপ্রেস’ নামক কুরিয়ার কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে অ্যান্ড্রু বিনিয়োগকারীর খাতায় নাম লেখান। সেই অ্যাডামস এক্সপ্রেসে বিনিয়োগের পর অ্যান্ড্রু আরো বেশ কিছু কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। এর মধ্যে কিনে নেন উডরাফস্লিপিং কার কোম্পানি, কলাম্বিয়া অয়েল কোম্পানিসহ বিবিধ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার। সেই পথ ধরে আঠারো শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি এসে বার্ষিক ৫০ হাজার ডলারের কাছাকাছি লভ্যাংশ পেতে থাকেন যা সেই সময়ে চাকরির ২,৪০০ ডলার বেতন থেকেও ঢের বেশি।

এজন্যই অ্যান্ড্রু কার্নেগি তার লেখা ‘গসপেল অব ওয়েলথ’ শিরোনামে ২০ পৃষ্ঠার এক প্রবন্ধে বলেছেন,

“রক্ত, ঘাম ও শ্রম হচ্ছে তাদের পুঁজি, যারা জীবনে বড়জোর বেঁচে থাকতে পারে অথবা তাতেও ব্যর্থ হয়। অর্থকে নিয়োগ করতে হবে, তাহলে অর্থই সম্পদ বৃদ্ধির কাজ করবে। সম্পদ বৃদ্ধির মহান কাজে কোনো আইনের বাধা হওয়া উচিত নয়। সম্পদ অর্জনের পর সেটিকে আবার সমাজের কাজে বিনিয়োগ করতে হবে। রাষ্ট্র নয়, সমাজে বিনিয়োগের এ কাজটি করবেন সেসব আলোকিত ও সফল মানুষ, যারা সম্পদ অর্জন করেছেন।”

অন্যদিকে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের দামামা শুরু হওয়া সত্ত্বেও অ্যান্ড্রু কার্নেগি সেই রেলরোড কোম্পানিতে চাকরি চালিয়ে যান। সেই সময়ে রেলপথই ছিলো একমাত্র ভরসা। যুদ্ধে যাওয়ার নিয়ম থাকলেও তিনি সেটা সুকৌশলে এড়িয়ে যান। যা-ই হোক, যুদ্ধকে এড়িয়ে গেলেও যুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত সময়ে তিনি কাজ করেছেন নিজের মেধা, বুদ্ধি আর দক্ষতা দিয়ে। যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলার গুরুদায়িত্ব নেন অ্যান্ড্রু। তখন রেলগাড়ি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাহন। দূরদর্শী অ্যান্ড্রু যুদ্ধকালীন সময়েই ক্ষতিগ্রস্থ রেললাইন, রেলসেতু নির্মাণের জন্য খোলেন ‘কিস্টোন ব্রিজ’ নামে একটি কোম্পানি। কিন্তু তার বিনিয়োগ বন্ধ হয়নি, সেতুর জন্য ধাতব পাতের প্রয়োজনে টাকা ঢালেন আরো একটি বড় আয়রন মিলে। পরবর্তীতে কিছুদিনের মধ্যে আরেকটি কারখানা একীভূত করে সেটার নাম রাখেন ‘ইউনিয়ন আয়রন মিলস’। এছাড়াও নতুন শহরে বাড়িঘর, অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সিমেন্ট, রড, বালি, টেলিগ্রাফ লাইনসহ আরো অনেক কিছু মেরামতের দায়িত্বও নেন তিনি।

বিনিয়োগ মায়েস্ত্রোখ্যাত এ বিনিয়োগকারী এই পর্যায়ে রেলপথ নির্মাণের উপকরণ প্রস্তুত ও রেল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের মাধ্যমে দ্বিমুখী মুনাফা লাভ করছিলেন। রেল কোম্পানিতে বিনিয়োগ থাকায়  তার লোহা ও ইস্পাত পরিবহনে রেল কোম্পানির চার্জের ফি কমাতে অ্যান্ড্রু কার্নেগি নিজের প্রভাব খাটান।

কার্নেগি সবসময় বিশ্বাস করতেন- ‘সাশ্রয়ই সাফল্যের চাবিকাঠি’। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ব্যয় সংকোচন করো, মুনাফা এমনিই বড় হবে।

প্রায় এক দশকের মধ্যেই কার্নেগি অনেকগুলো ইস্পাত কারখানার মালিক হন। বয়স ৫০ বছরের কোঠা ছাড়িয়ে যাওয়া শুরু করলে কিছু ব্যবসায়িক দায়িত্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া শুরু করেন তিনি। এরপর ইস্পাত কারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট, শ্রমিক বিদ্বেষ, শ্রমিক মারা যাওয়াসহ বিবিধ কারণে অ্যান্ড্রু কার্নেগি তার অনেক ব্যবসা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তবুও তার প্রতি শ্রমিকদের একটা অসন্তোষের জায়গা থেকেই যায়।

বিপুল বিত্তবৈভবের অধিকারী হয়েও অ্যান্ড্রু কার্নেগি ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে যাননি। তিনি সমাজের উন্নতির জন্য দাতব্য কাজে, বিশেষ করে শিক্ষাখাতে ব্যাপক হারে অর্থ ব্যয় করেছেন। তার লেখা ‘গসপেল অব ওয়েলথ’ বইয়ে সমাজের অন্য ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরও মানুষের কল্যাণে অর্থ ব্যয়ের আহ্বান জানান তিনি। তার টাকায় আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও কানাডায় প্রতিষ্ঠিত হয় প্রায় ৩,০০০ লাইব্রেরী। এছাড়া হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনেও তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। মহান এ দানবীরের প্রতি সম্মান জানিয়ে তার মৃত্যুর পরও তার সম্পদ থেকে দান করা হয় তৎকালীন সময়ে ৩০ মিলিয়ন ডলার। এখনো আমেরিকান তথা বিশ্বের উদ্যমী মানুষদের কাছে আদর্শ হয়ে আছেন অ্যান্ড্রু কার্নেগি।

Related Articles