Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেরোলি টাকাস: এক হাতেই অলিম্পিক জয়ী শ্যুটার

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কিছু সত্য ঘটনা লুকিয়ে আছে, যা আমাদের জীবনে আনতে পারে অজেয়কে জয় করার শক্তি। ব্যর্থতা বা না পাওয়ার গ্লানিতে ডুবে থাকার চাইতে নতুন উদ্যমে নতুনভাবে পথ শুরু করার নামই তো জীবন। সেই ধরনের এক সত্যি ঘটনার রূপকারের নাম কেরোলি টাকাস, যিনি পুরো বিশ্বের বুকে উদাহরণ হয়ে আছেন তার একাগ্রতা, অধ্যবসায়, নিষ্ঠা এবং হার না মানা প্রত্যয় দিয়ে। অলিম্পিকে পরপর দু’বার শ্যুটিংয়ে স্বর্ণ জয়ের রেকর্ড করে গড়েছেন অনন্য কীর্তি। অনেকে হয়তো ভাবছেন, এ আর এমন কী! অলিম্পিকে কতজনই তো স্বর্ণ জয় করে। কিন্তু কেরোলির কাহিনী ছিল ভিন্ন। তার এই অলিম্পিক জয়ের পেছনে রয়েছে অনেক ত্যাগ, পরিশ্রম ও হতাশার গল্প।

কেরোলি টাকাস; Source: theculturetrip.com

১৯১০ সালের ১০ জানুয়ারি, ইউরোপের হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট শহরে কেরোলির জন্ম। পড়াশুনা শেষ করে যোগ দেন আর্মিতে। তার শ্যুটিংয়ে অসম্ভব আগ্রহ ছিল। আর্মির ট্রেনিংয়ের সব পরীক্ষায় বেশ দক্ষতার সাথে পাশ করেন তিনি। নিয়মিত অনুশীলনীতে আর্মির সেরা শ্যুটার নির্বাচিত হন তিনি। ২৬ বছর বয়সেই তাকে হাঙ্গেরির শ্রেষ্ঠ শ্যুটার বলে বিবেচনা করা হত। জাতীয় পর্যায়ের প্রায় সকল প্রতিযোগিতায় অন্যান্য প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে জয় করে নিয়ছিলেন প্রথম স্থান।

কেরোলির শ্যুটিং অনুশীলন; Source: swikblog.com

তার সামনে লক্ষ্য তখন অলিম্পিক। ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করছিলেন ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের জন্যে, সেটাই ছিল তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু হাঙ্গেরিয়ান আর্মির নিয়মে শুধুমাত্র কমিশনাররা অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করতে পারতেন। সেসময় কেরোলি ছিলেন আর্মির একজন সার্জেন্ট। তাই আর তার নাম দেওয়া হলো না ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে।

কিন্তু তাই বলে কেরোলি থেমে থাকেননি। লক্ষ্য ঠিক করলেন পরের অলিম্পিক, যা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯৪০ সালে। কিন্তু মানুষের স্বপ্ন আর বাস্তব সবসময় এক হয় না। ১৯৩৮ সালে কেরোলির বয়স যখন ২৮, তখন এক আর্মি ট্রেনিংয়ের সময় তার ডান হাতে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। ফলে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার ডান হাত, যে হাতের উপর নির্ভর করে স্বপ্ন দেখা অলিম্পিক জয়ের। এক লহমায় তার স্বপ্ন ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

দুর্ঘটনার পর কেরোলি; Source: kalamfanclub.com

একটি দুর্ঘটনা তার জীবনের সব স্বপ্ন এলোমেলো করে দিল। না পাওয়ার গ্লানি তখন তাকে ঘিরে ধরেছে চারিদিক থেকে। নিজেকে সকলের সান্ত্বনার পাত্র হিসেবে বেছে নিতে নারাজ ছিলেন তিনি। তার সামনে দুটো পথই খোলা ছিল। একটি হলো আত্মহত্যা, আরেকটি হলো নিজের স্বপ্নপূরণে আরেকবার লেগে পড়া। প্রথম পথটাই সর্বাপেক্ষা সহজ ছিল তার জন্যে। কিন্তু কেরোলি অন্য আর পাঁচজন সাধারণের মতো ছিলেন না, তার চোখে ছিল বিশ্বজয়ের শপথ। নিজেকে পৃথিবীর সামনে প্রমাণ করা তখনও বাকি রয়ে গেছে তার। হাসপাতাল থেকে ফেরার এক মাসের মধ্যেই নিজেকে আবার মানসিকভাবে দৃঢ় করে তুললেন কেরোলি। এক হাত হারালে কী হবে, আরেক হাত তো আছে। লেগে পড়লেন সেই হাত গড়ার কাজে। যে হাত দিয়ে কখনো কলম পর্যন্ত ধরেননি, সেই হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার মতো কঠিন সাধনায় লিপ্ত হলেন। লোকচক্ষুর আড়ালে দিনের পর দিন শুধু অনুশীলন করে চলেছিলেন কেরোলি। কাউকেই জানতে দেননি তার এই অনুশীলনের কথা।

অনুশীলনরত কেরোলি; Source: pkarunblog.wordpress.com

এক বছর পর, ১৯৩৯ সালে বিশ্ব পিস্তল শ্যুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হল। কেরোলি সেখানে উপস্থিত হলেন। অন্যান্য প্রতিযোগীরা জানতেন যে, কেরোলি একজন বিশ্বমানের শ্যুটার ছিলেন। তাই সকলে তাকে সান্ত্বনা দিতে আসলেন। সকলে ভাবলেন, তিনি বোধহয় সকলকে অনুপ্রেরণা দিতেই প্রতিযোগিতায় উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু তাদের এই ভুল ধারণা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। যখন ঘোষণায় প্রতিযোগীদের নামের সাথে কেরোলির নাম নেওয়া হলো, তখন সকলে বুঝে গেলেন কেরোলির অভিপ্রায়। তারপরেও সকলে সহজভাবেই নিয়েছিলেন কেরোলিকে, একটু সহমর্মিতাও ছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতায় নামার পর সকলের বোধ উম্মোচন হলো। প্রকৃত বীর কখনো বাঘের থাবার ভয়ে ঘরে লুকিয়ে থাকে না। সকলকে অবাক করে দিয়ে কেরোলি তার একমাত্র অবলম্বন বাম হাতেই জিতে নিলেন প্রতিযোগিতা। সকলের চোখে-মুখে তখন একটাই বিস্ময়, আর তা হলো কেরোলি।

কেরোলির জীবনদর্শন; Source: digitalworldupdates.com

কিন্তু কেরোলির স্বপ্ন ছিল আরও সুদূরপ্রসারী। পরের বছরের অলিম্পিকে সোনা জয়ের স্বপ্নে বিভোর তিনি। কিন্তু অপেক্ষা যেন কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছিল না। এ যেন প্রকৃতির কাছে প্রকৃত যোদ্ধার বারবার পরীক্ষা দিয়ে চলা। এবার তার স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যার কারণে ১৯৪০ সালের অলিম্পিক বাতিল ঘোষণা করা হয়। তবুও থেমে থাকেননি কেরোলি। আবার নতুন উদ্যমে লেগে পড়েন অনুশীলনে। কারণ ১৯৪৪ সালের অলিম্পিকে তাকে অবশ্যই জয় করতে হবে অলিম্পিক। নিজের সকল একাগ্রতা কেন্দ্রীভূত করলেন ১৯৪৪ সালের অলিম্পিকের উপর। দিন-রাত এক করে অনুশীলন করতে লাগলেন কেরোলি।

কেরোলির নতুন লক্ষ্য ছিল ১৯৪৮ এর অলিম্পিক; Source: sportskitpro.com

কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন পিছু ছাড়ছিল না কেরোলির। যুদ্ধের জন্যে আবারও বাতিল হয়ে গেল ১৯৪৪ সালের অলিম্পিক। এবার হয়তো অনেকেই ভাবছেন, আর কত? এবার নিশ্চয় কেরোলির সকল স্বপ্নকে পেছনে ফেলার অপেক্ষা। কিন্তু ব্যাপারটি হলো পুরো উল্টো। কিছুই যেন তাকে থামিয়ে রাখতে পারে না তার লক্ষ্যবস্তু থেকে। ১৯৪৮ সালে অবশেষে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হল।

১৯৪৮ সালের অলিম্পিকে উপস্থিত দর্শকের একাংশ; Source: scienceandmediamuseum.org.uk

১৯৩৮ সালে যখন এক হাত হারালেন, তখন তার বয়স ছিল ২৮, ১৯৪৮ এর অলিম্পিকে এসে তার বয়স হলো ৩৮। অনেক নবীন ও দুর্দান্ত সব শ্যুটার চলে এসেছে পৃথিবীর বুকে। যেকোনো খেলায় নবীনদের সাথে প্রতিযোগিতা করা বেশ কষ্টসাধ্য। কিন্তু নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন কেরোলি। তিনি জানতেন তার লক্ষ্যবস্তু কোথায়, যা পাওয়ার জন্যে তার এত বছরের কষ্ট ও সাধনা। পুরো পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে শ্যুটিংয়ে স্বর্ণ জয় করলেন কেরোলি। এই প্রাপ্তি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, যার বীজ পোঁতা হয়েছিল অনেক আগেই। অনেকেই ভাবতে পারেন, এবার হয়তো কেরোলি তার সাধনায় লাগাম টেনে ধরেছেন। কিন্তু কেরোলি সেই মানসিকতায় গড়া ছিলেন না। ১৯৪৮ সালে  অলিম্পিক জয়ের পর আবার নতুন উদ্যমে লেগে পড়লেন ১৯৫২ সালের অলিম্পিকের জন্যে এবং স্বাভাবিকভাবেই সেবারও স্বর্ণ জয় করলেন তিনি।

অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের পর কেরোলি; Source: digitalworldupdates.com

সেই সময় পর্যন্ত অলিম্পিকে একই ইভেন্টে পরপর দু’বার স্বর্ণজয় ছিল কেরোলির তৈরি এক বিশ্বরেকর্ড। আর কেরোলি ছিলেন তৃতীয় এমন ব্যক্তি যিনি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ের স্বাদ পেয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের ৫ জানুয়ারি ৬৫ বছর বয়সে হার না মানা এ বীর মৃত্যুবরণ করেন।

কেরোলির সমাধি; Source: quora.com

আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক না পাওয়ার ক্রন্দন ও আর্তনাদ। অজুহাতের তালিকা আমাদের কাছে অনেক বিশাল। ‘পারব না’ বা ‘পারছি না’ শব্দগুলো আমাদের অনেকের অস্থিমজ্জায় ঢুকে গেছে। আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে পাওয়ার চাইতে না পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে চলেছে ঠিকই, কিন্তু চেষ্টা ও একাগ্রতার কাছে লক্ষ্যজয় কখনো অসম্ভব নয়। কেরোলি তাই শুধু একজন অলিম্পিক বিজয়ী নন, তার জীবনী হলো চেষ্টা ও একাগ্রতা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করার জ্বলন্ত উদাহরণ।

ফিচার ইমেজ- bolplatoon.com

Related Articles