Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মোহাম্মদ বাজিক: মৃত্যুপথযাত্রী শিশুদের সেবা করাই যার ধর্ম

সন্তান অনেকেই দত্তক নিয়ে থাকেন। কিন্তু অনেকেই সেটা করে থাকেন নিজেরা নিঃসন্তান হওয়ায়, নিঃসঙ্গতা কাটাতে। অনেকে অবশ্য শুধুই মানবতার খাতিরে নিজেদের সন্তান থাকা সত্ত্বেও দত্তক নিয়ে থাকেন। কিন্তু আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস প্রবাসী লিবিয়ান-আমেরিকান নাগরিক মোহাম্মদ বাজিক দত্তক নেওয়ার ব্যাপারটিকে অন্য এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তিনি শুধু বেছে বেছে সে ধরনের শিশুদেরকেই দত্তক নিয়ে থাকেন, যাদের মৃত্যু নিশ্চিত, চিকিৎসকরা যাদের আশা ছেড়ে দিয়েছেন!

মোহাম্মদ বাজিক; ছবিসূত্র: faithit.com

মোহাম্মদ বাজিকের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা লিবিয়াতে। ১৯৭৮ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার উদ্দেশ্যে তিনি আমেরিকায় যান। এরপর তিনি সেখানেই এক আমেরিকান নারীকে বিয়ে করেন এবং ১৯৯৭ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করার মধ্য দিয়ে আমেরিকাতেই স্থায়ী হন।

আমেরিকায় যাওয়ার আগে বাজিক ম্যারাথন দৌড়বিদ ছিলেন। তবে দৌড়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও বর্তমানে তিনি অন্য এক প্রতিযোগিতায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তিনি বিশ্বের খুব অল্প সংখ্যক মানুষদের মধ্যে একজন, যারা তাদের জীবন নিয়োজিত করেছেন শুধুমাত্র মরণব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদেরকে দত্তক নিয়ে লালন-পালন করার কাজে।

ম্যারাথন প্রতিযোগিতার মেডেল বিজয়ী মোহাম্মদ বাজিক; ছবিসূত্র: everipedia.com

এবিসি নিউজের সাথে এক সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ বলেন, যখন পিতামাতারা জানতে পারে, যে তাদের সন্তান অক্ষম বা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা তাদের দেখাশোনা করার সামর্থ্য রাখে না। তারা তাদের সন্তানদেরকে ফস্টার হোমে স্থান দিতে বাধ্য হয়। তারা সন্তানদেরকে হাসপাতালে অথবা কেয়ার গিভিং ফ্যাসিলিটিতে প্রেরণ করে, যেখানে শিশুদের দেখাশোনা করা হয় ঠিকই, কিন্তু তারা তাদের পরিবারের আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়।

মোহাম্মদ বলেন, তিনি জানেন যে পৃথিবীতে এই শিশুদের খুব বেশি আপনজন নেই। কিন্তু তাদের এরকম অসহায় অবস্থায় আত্মীয়-স্বজনের সংস্পর্শ খুবই প্রয়োজন। তাই এ ধরনের শিশুদেরকেই মোহাম্মদ দত্তক নেন, যেন তারা পরিবারের আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত না হয়। যখন তারা মৃত্যুবরণ করে, তখন যেন তারা তাদের নতুন পরিবারের পাশে থেকেই মৃত্যুবরণ করতে পারে।

পালিত কন্যার সাথে মোহাম্মদ; ছবিসূত্র: pbs.org

সব সময়ই যে এ ধরনের শিশুরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল পিতামাতার সন্তান হয়, এমন না। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের পিতামাতা হয়তো অপরাধী, অথবা নেশাগ্রস্ত। কিন্তু মোহাম্মদের কাছে সবাই সমান। দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সাদা-কালো, আমেরিকান-অ্যারাবিয়ান, মুসলমান-খ্রিস্টান কিছুই বিবেচনা করেন না। মানবতাই তার কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয়। একজন মানুষ হয়ে অন্য একজন মানুষের বিপদে সাহায্য করাটাই তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৮৯ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মোহাম্মদ এরকম ৪০টিরও বেশি শিশুকে দত্তক নিয়েছেন, যাদের মধ্যে ১০ জন তার হাতের উপর দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। মোহাম্মদের হাতে প্রথম শিশুর মৃত্যু হয় ১৯৯১ সালে। কন্যা শিশুটি আক্রান্ত হয়েছিল তার কৃষিজীবি মায়ের ছিটানো কীটনাশক স্প্রে দ্বারা, যেটা তার মেরুদন্ডকে এত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল যে, তাকে সব সময় বিশেষভাবে তৈরি কাঠামোবদ্ধ পোশাক পরিধান করে থাকতে হতো। মাত্র এক বছর মোহাম্মদের আশ্রয়ে থাকার পর সে মৃত্যুবরণ করে।

পালিত কন্যার সাথে মোহাম্মদ; ছবিসূত্র: ABC News

আরেকটি পুত্র শিশু ছিল, যে জন্ম থেকেই Short-Gut Syndrome নামক রোগে আক্রান্ত ছিল। তার অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে তাকে ১৬৭ বার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। মাত্র আট বছর বয়সেই সে মারা যায়।  মোহাম্মদের ভাষায়, কিছু কিছু শিশুর মৃত্যু তাকে খুব বেশি আঘাত করে। কয়েকজনের ক্ষেত্রে তাকে তিনদিন পর্যন্ত কাঁদতে হয়েছিল। কিন্তু এই আঘাত সত্ত্বেও তিনি নতুন আরেকটি শিশু দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছপা হন না।

মৃত শিশুর কবরের সামনে মোহাম্মদ; ছবিসূত্র: Mohammed Bzeek

এই মুহূর্তে মোহাম্মদের সাথে দত্তক নেওয়া সন্তানদের মধ্যে আছে ছয় বছর বয়সী পালিত কন্যা, যে Microcephaly নামক বিরল ধরনের এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, যে রোগের ফলে শিশুটির মস্তিষ্ক এবং শরীর সুগঠিত হতে পারে নি। ফলে মেয়েটি দেখতে কিংবা শুনতে পায় না এবং তার হাত ও পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত। দিনের মধ্যে ২২ ঘন্টাই তাকে টিউবের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাস এবং খাবার গ্রহণ করতে হয়। তার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন হওয়ায় মোহাম্মদকে প্রায় প্রতি রাতেই মেয়ের কাছে সোফাতে ঘুমাতে হয়, যদি রাতের বেলা হঠাৎ জরুরী প্রয়োজন হয়, সেই ভয়ে।

পালিত কন্যার সাথে মোহাম্মদ; ছবিসূত্র: Mohammed Bzeek

মোহাম্মদ জানেন, মেয়েটি শুনতে পায় না। কিন্তু তারপরেও তিনি তার সাথে অবিরত কথা বলেন, তার হাত ধরে বসে থাকেন, তার সাথে খেলেন। তিনি বলেন, সে হয়তো শুনতে পায় না, কিন্তু স্পর্শ তো অনুভব করতে পারে! তার তো প্রাণ আছে, সে-ও তো মানুষ!

পিবিএস ডকুমেন্টারী চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ বলেন, মরণব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদেরকে দত্তক নেওয়া এবং তাদের দেখাশোনা করা অত্যন্ত কষ্টকর কাজ। তিনি জানেন, এই শিশুরা বেশিদিন তার সাথে থাকতে পারবে না, তাদের আয়ুষ্কাল সীমিত এবং এদের মৃত্যু বারবার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করবে। কিন্তু তারপরেও তিনি তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন।

পালিত কন্যার সাথে মোহাম্মদ; ছবিসূত্র: pbs.org

তার ভাষায়, একে অন্যকে সাহায্য করাই তো মানুষের কর্তব্য। মোহাম্মদ বাজিক একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম। তিনি বলেন, এই শিশুদেরকে দত্তক নেওয়ার মতো কষ্টকর কাজে তিনি অনুপ্রেরণা পান তার ধর্মবিশ্বাস থেকে। একজন মুসলমান হিসেবে অন্য একজনের বিপদে সাহায্য করা তার কর্তব্য। তার মতে, মৃত্যু জীবনের অংশ। কিন্তু এই শিশুগুলো, যাদেরকে দেখাশোনার জন্য কেউ নেই, তাদেরকে মৃত্যুর আগে কিছুদিন দেখাশোনা করা, ভালোবাসা দেওয়া, এই কষ্টকর সময়টুকুতে তাদেরকে পরিবারের অভাব বুঝতে না দেওয়া– এটাই তাকে সবচেয়ে বড় আনন্দ দেয়।

পুত্র আদমের সাথে মোহাম্মদের পুরানো ছবি; ছবিসুথ্য: ABC News

অন্যদের দেখাশোনা করা মোহাম্মদের নিজের জীবন কিন্তু নিষ্কন্টক না। তার নিজের সন্তান, আদম, যার জন্ম ১৯৯৭ সালে, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। তার হাড় অত্যন্ত ভঙ্গুর এবং তার শারীরিক বৃদ্ধিও সীমিত। মোহাম্মদের স্ত্রী, যিনি সব সময় তার সাথে শিশুদেরকে দেখাশোনা করতেন, ২০০৫ সালে মারা গিয়েছেন। তার পর থেকে দত্তক নেওয়া শিশুদেরকে তার একাই দেখাশোনা করতে হয়।

গত বছরের নভেম্বরে তিনি জানতে পারেন, তিনি নিজেই কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত। ডাক্তার যখন তাকে জানান যে, তাকে শীঘ্রই অপারেশন করতে হবে, তখন তিনি প্রথমে রাজি হননি। কারণ তিনি হাসপাতালে গেলে তার ছেলে এবং পালিত কন্যাদের কে দেখাশোনা করবে? পরে অবশ্য তিনি অপারেশন করান।

পরলোকগত স্ত্রীর সাথে মোহাম্মদ; ছবিসূত্র: buzzworthy.com

পিবিএসের সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, হাসপাতালে শুয়ে তার মধ্যে নতুন করে এই ভাবনা আসে, যে তার মতো ৬২ বছর বয়সী এক বৃদ্ধও যদি হাসপাতালে এরকম একাকীত্ব অনুভব করে, তাহলে মৃত্যুপথযাত্রী শিশুদের মানসিক অবস্থা তো আরও দুর্বিসহ হওয়ার কথা! তিনি বলেন, হাসপাতালের এই অভিজ্ঞতা তাকে আরও অবনমিত করেছে এবং শিশুদের জন্য কাজ করার ক্ষেত্রে তাকে আরও প্রেরণা জুগিয়েছে।

মোহাম্মদ বাজিক গত দুই দশক ধরেই এই মহান কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। কিন্তু প্রচারবিমুখ এই মহান সমাজসেবকের কথা কখনোই মিডিয়াতে উঠে আসেনি। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছয়টি দেশের নাগরিকদের উপর আমেরিকায় প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে মোহাম্মদ এবং তার মতো আরও শতশত সমাজসেবী মুসলমানদের গল্প মিডিয়াতে উঠে আসতে থাকে, যাদের শ্রম এবং সেবার উপর আজকের আমেরিকা অনেকটাই নির্ভরশীল। ট্রাম্পের জারি করা নিষেধাজ্ঞায় মোহাম্মদের জন্মস্থান লিবিয়ার নামও আছে।

পুরস্কার নিচ্ছেন মোহাম্মদ; ছবিসূত্র: goodnewsgum.com

মোহাম্মদের গল্প মিডিয়াতে উঠে আসার পর আমেরিকানদের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া লক্ষ্য করা যায়। অনলাইন ফান্ড রেইজিং এর মাধ্যমে তার শুভাকাঙ্খীরা তার জন্য প্রায় দেড় লাখ ডলার উত্তোলন করে। মোহাম্মদ জানান, এই টাকা তিনি তার বাড়িতে একটি নতুন ছাদ তৈরি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থাপন এবং তার ১৪ বছরের পুরানো ভ্যানটা প্রতিস্থাপনের কাজে ব্যয় করবেন, যেন তিনি আরও সহজে শিশুদের জন্য খাটতে পারেন।

Related Articles