Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাদার তেরেসা: মানবসেবায় অনন্যপ্রাণ এক নারীর কথা

নীল পাড় সাদা শাড়িতে তিনি আসেন ভারতে; এসেছিলেন বিপন্ন, অসুস্থ, অসুখী আর হতদরিদ্র মানুষের কাছে আশার আলো হয়ে। এই পৃথিবীর কাছে যারা ছিল অনাকাঙ্খিত, পরিবার যাদের ত্যাগ করেছিল, ভাগ্য ও জীবন যাদের অভিশাপ দিয়েছিলো আর সমাজ যাদের গ্রহণ করেনি কোনোকালেই; সে সকল অনাশ্রিত, অসমর্থ, অসুস্থ, অবহেলিত, স্নেহবঞ্চিত মানুষদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন সহানুভূতি, স্নেহ, সেবার অবিচল প্রতিশ্রুতির এক মূর্তরূপ। এমনকি সমাজ ও পরিবার থেকে বিতাড়িত, চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত কুষ্ঠরোগীদের তিনি শুধু আশ্রয়ই দেননি, প্রাণের মায়াকে তুচ্ছ করে নিজ হাতে তাদের সেবা করেছেন দিনের পর দিন। পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছেন, আমরা বিংশ শতাব্দীর সেই মহৎপ্রাণ নারী মাদার তেরেসার কথা বলছি। তাঁর জীবন, কর্ম, ত্যাগ আর অর্জন নিয়েই আমাদের আজকের এই লেখা।

মানবসেবায় অনন্য এক নারী; source: telegraph.co.uk

সুদূর মেসিডোনিয়ার বর্তমান ‘স্কাপা’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেও তিনি আর্তমানবতার ডাকে পাড়ি জমিয়েছিলেন এই ভারত উপমহাদেশে। ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট পৃথিবীর আলো দেখেন তিনি। বাবা নিকোল বোজেক্সাকে হারিয়েছিলেন মাত্র আট বছর বয়সে। বাবার মৃত্যু যেন দুঃখ-কষ্ট আর বিভিন্ন প্রতিকূলতা নিয়ে আসে পুরো পরিবারের ওপর। কিন্তু মা ড্রানাফিল বোজেক্সা তার সন্তানদের লালন-পালন আর বেড়ে ওঠার সাথে কোনো আপোষ করেননি। মাত্র বারো বছর বয়সে মানবসেবার প্রতি অন্তরের তাড়না অনুভব করেন তিনি। একে তো ধর্ম অন্তঃপ্রাণ ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম, তার ওপর মা ড্রানাফিলের চার্চের প্রতি প্রবল আনুগত্য পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান এগনেস গোক্সি বোজেক্সার (পরবর্তীতে মাদার তেরেসা) ওপর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে বাবার মৃত্যুর পর সে যখন মায়ের সবচেয়ে কাছের হয়ে ওঠে, তখন। এগনেসের পুণ্যাত্মা ও দরদী মা-ই যেন তার মধ্যে মানবসেবার প্রতি আত্মত্যাগের এই সুপ্ত বীজটি বপন করেন। ছোট্ট এগনেস সারাজীবন মনে রেখেছিল মায়ের কথাগুলো- “বাছা, অন্যদের না দিয়ে কখনো এক লোকমা খাবারও মুখে তুলো না। আর জেনো, তাদের মধ্যে অনেকে হয়তো আমাদের আত্মীয় না, কিন্তু সকল মানুষই আমাদের আপন, আমাদের নিজের”। সত্যি কী শক্তিশালী প্রভাবটাই না রাখতে পারেন একজন মা তাঁর সন্তানের জীবনে!

১৯২৮ সালে মাত্র আঠারো বছর বয়সে ঘর ছেড়ে পৃথিবীর পথে পা বাড়ান এগনেস, নিজেকে উৎসর্গ করেন রুগ্ন-ক্লিষ্ট মানবতার সেবার জন্য। তার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় একটি মিশনারী পরিচালিত স্কুলে, পরে শিক্ষাগ্রহণ করেন রাষ্ট্রচালিত একটি মাধ্যমিক স্কুলে। বালিকা এগনেস গান গাইতেন একা, কখনোবা দলবদ্ধ হয়ে, তাঁর কণ্ঠের মাধুর্য নতুন মাত্রা দিতো ধর্মীয় গানগুলোকে। বারো বছর বয়সে এক তীর্থযাত্রায় অংশ নেন এগনেস, যা তার মনকে সম্পূর্ণভাবে ঐশ্বরিক পবিত্রতার দিকে চালিত করে।

তরুণী মাদার তেরেসা : historycollection.co

মানবসেবাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে ঘর ও সংসার জীবনের আনন্দ ত্যাগ করে এসে তিনি যোগ দেন আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে মিশনারী মেয়েদের দল ‘সিস্টার্স অব লোরেটো’তে এবং সেখানেই তিনি সাধু সেইন্ট তেরেসার নামানুসারে ‘সিস্টার ম্যারি তেরেসা’ নাম গ্রহণ করেন। সেখান থেকে তিনি ভারতে পাড়ি জমান এবং দার্জিলিংয়ে ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করেন। পূর্ব কলকাতায় বহু বছর তিনি মিশনারির মেয়েদের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পদে নিযুক্ত ছিলেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি খুব ভালো বাংলা ও হিন্দী শিখে নেন। স্কুলে তিনি ইতিহাস ও ভূগোল শেখানোর পাশাপাশি কীভাবে শিক্ষা দ্বারা এই অঞ্চলের মেয়েদের দরিদ্রতা দূর করা যায়, সেদিকেও মনোনিবেশ করেন। সিস্টার তেরেসা ধর্মের পথে পবিত্রতার ও সেবার শপথ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম নেন ১৯৩১ সালের মে মাসে। এরপর শিক্ষকতার অনেকগুলো বছর পার করে ২৪শে মে, ১৯৩৭ সালে তিনি তাঁর চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিক শপথ নেন

৩৬ বছর বয়সে তিনি নিজের হৃদয়ে ভারতের গরীব অসহায় মানুষদের জন্য কিছু করার তাড়না অনুভব করেন। তিনি নিজের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন জায়গা থেকে মৌলিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নেন, আর তারপর বেরিয়ে পড়েন ভারতের রাস্তায় দরিদ্রের মধ্যে, যারা হতদরিদ্র, অভাগাদের মধ্যেও যারা সবচেয়ে অসহায়, সেই আশাহীন, সহায়-সম্বলহীন মানুষদের জন্য। খুবই সামান্য সম্বল নিয়ে ১৯৪৮ সালের ভারতে এটা কোনো সহজ কাজ ছিল না। এমন প্রায়ই হতো যে হতদরিদ্রের মুখে খাবার তুলতে গিয়ে তিনি নিজেই অনাহারে থেকেছেন কতদিন, এমনকি খাবারের জন্য হাত পাততে হতো অন্যদের কাছে। তাঁর সমগ্র জীবনই যেন দেখিয়ে গেছে, কীভাবে অন্যদের দূঃখের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়। সে বছরের ১৭ই আগস্ট তিনি নীল পাড়ের সাদা শাড়ি তুলে নেন নিজের পরবর্তী সারা জীবনের জন্য। ধীরে ধীরে তাঁর এই শাড়িই হয়ে ওঠে বস্তি থেকে রাস্তা পর্যন্ত কলকাতার সকল অবহেলিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, স্নেহহীন মানুষদের জন্য আশা ও মমতার প্রতীক। নিজের প্রার্থনার খাতায় তিনি লিখে যান- “হে ঈশ্বর, আমাকে শক্তি দিন এই মানুষগুলোর জীবনের আলো হয়ে ওঠার, যেন আমি তাদেরকে অন্তত আপনার দিকে ফেরাতে পারি।” যেন তাঁর ধর্মীয় সকল জ্ঞান আর নিজের সমস্ত চেতনা তাঁকে এক মুমূর্ষু ও দুস্থ মানবতার সেবার জন্য ডাকছিলো।

মানুষের হাসিতেই ছিল তার হাসি : a12.com

মানুষের হাসিতেই ছিল তার হাসি : a12.com

মাদার তেরেসা খুব শীঘ্রই নিজের সকল ইচ্ছাশক্তি আর আন্তরিকতা নিয়ে নেমে গেলেন। প্রথমে মৃতপ্রায়, গৃহহী্‌ন, নিঃস্ব মানুষদের মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের ব্যবস্থা করলেন। নিজের আপ্রাণ চেষ্টায় প্রথমে স্থানীয় সরকারকে বুঝিয়ে তিনি একটা জীর্ণ বাড়ির ব্যবস্থা করেন। আর তারপর তিনি চালু করেন খোলা আকাশের নিচে মৌলিক শিক্ষা প্রদানের জন্য এক বিনামূল্যের বিদ্যালয়। মিশনারি স্কুলের মাত্র কয়েকজন সিস্টার নিয়ে তাঁর গড়ে তোলা সেবামূলক এই পরিবারের সদস্য সংখ্যা এখন ৪,৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৫০ সালের ৫ই অক্টোবর কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে স্বীকৃতি পেয়ে এটি ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ নামে পথ চলা শুরু করে। ১৯৬৫ সালে পোপ ষষ্ঠ পলের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়ে এটি একটি আন্তর্জাতিক সেবামূলক ধর্মীয় পরিবার হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল আর সমগ্র পৃথিবী থেকে মাদার তেরেসার এই প্রতিষ্ঠানটি অর্থ সাহায্য পেতে থাকে আর তার সাথে বাড়তে থাকে তাদের কর্মের পরিধি। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে মাদার তেরেসা গড়ে তোলেন কুষ্ঠরোগীদের জন্য একটি আশ্রম, একটি অনাথ আশ্রম, একটি নার্সিং হোম, একটি মা ও শিশু ক্লিনিক এবং অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে গঠিত একটি ভ্রাম্যমান ক্লিনিক। অবহেলিতদের জন্য জীবনের প্রতিটি বছর এক এক করে উৎসর্গ করতে থাকেন মহৎপ্রাণ এই মানুষটি। এরই মধ্যে ১৯৬৩ সালে মানবসেবায় জীবন উৎসর্গ করা ছেলেদের নিয়ে ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি ব্রাদারস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুস্থ মানুষদের শারীরিক ও আত্মিক চাহিদা যথাসম্ভব পূরণের চেষ্টা করা। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটির আরো অনেকগুলো সহযোগী সংগঠন গড়ে ওঠে।

থাকবেন মানুষের হৃদয়ে চিরদিন : ndtv.com

সেইন্ট তেরেসা কখনোই জাত-ধর্ম-বর্ণের সীমানায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। তিনি সবসময় ঘোষণা করে গেছেন যে প্রকৃত ঈশ্বরপ্রীতি রয়েছে সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসায়। যেন তাঁর সারাটা জীবন ছিল পৃথিবীর অবহেলিত আর অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষগুলোর ভালবাসার অধিকার প্রতিষ্ঠার এক আপ্রাণ প্রচেষ্টা। তিনি বারবার বলে গেছেন- “রুটির ক্ষুধা মেটানোর চেয়ে অনেক বেশি কঠিন স্নেহের ক্ষুধা মেটানো”। তাঁর এই গভীর জীবনবোধের জন্যই হয়তো তিনি তাঁর সেবা ও স্নেহ কোন সীমানা দ্বারা আবদ্ধ রাখেননি। ধীরে ধীরে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে, দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকায়, যুদ্ধআক্রান্ত মুসলিম দেশগুলোতে পৌঁছাতে থাকে তাঁর স্নেহের আশীর্বাদময় স্পর্শ, এসে পৌঁছায় বাংলাদেশেও। ব্যাপক স্বীকৃতির সাথে তিনি পান সমালোচনাও। এসব গল্প আর তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়ের কথাগুলো নিয়ে আসবো আপনাদের জন্য পরবর্তী ও শেষ পর্বে।

Feature Image: un.org.al

Related Articles