“তবু আমারে দেব না ভুলিতে” নজরুল বলেছিলেন বটে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছেও তাই। যতদিন সাহিত্য থাকবে, বাংলা আর বাঙালি থাকবে কাজী নজরুল ইসলাম থাকবেন আমাদের মননে, অস্তিত্বে, মস্তিষ্কে, স্বত্ত্বায়। কাজী সাইফুল ইসলাম নামে বর্তমান সময়ের একজন বিশিষ্ট লেখক কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে লিখেছেন বই 'নজরুল'।
নজরুল ইসলামের জীবনে এত ঘটনা, এত রহস্য, এত গল্প যা এই বইটিতে কেন হাজার হাজার বই এর পেজেও বন্দী করা সম্ভব না। তবু স্লাইস অফ লাইফের মত কিছু কিছু ঘটনা দু' মলাটে আবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন লেখক। এই বইটিতে প্রেমিক নজরুলের দেখা পাবেন, পাবেন পিতা নজরুলের।
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে অনেক নারী এসেছিলেন। কেউ এসেছেন প্রেয়সী রূপে, মমতাময়ী মা রূপে, আবার প্রিয় স্ত্রী রূপে। তাদের সাথে নজরুলের সম্পর্ক ঠিক কেমন ছিল, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিয়েছেন। বেশ কিছু নজরুল গবেষকদের লেখা বই, নজরুলের সান্নিধ্যে আসা কিছু মানুষ যেমন ফিরোজা বেগম সহ বেশ কিছু মহীরথীদের সাথে দেখা কিছু ঘটনা- নজরুলের সাথে তাদের সাক্ষাৎকার মিলিয়ে এই ছোট্ট বইটি।
নার্গিস নামে নজরুলের সাথে এক মেয়ের বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের রাতে নজরুল পালিয়ে আসেন। কারণ? কারণ নজরুলের মামাশ্বশুর, কিংবা এক সময়ের প্রিয় বন্ধুর প্রতারণা। যে নজরুলকে কেউ বেঁধে রাখতে পারেননি, এমনকি নিজের মাও না, সেই নজরুল কে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন আলী আকবর আর নার্গিসের মা। কিন্তু প্রশ্ন রেখে যায় নিয়তি, বিয়ের আগে সেই শর্ত কি জানত না নার্গিস নিজেও?
সেই সময়ের ঘটনা নিয়ে কিন্তু এরকম স্বচ্ছ ঘটনা লেখা আকারে কমই পাওয়া যায়। সেই সময়ের বাস্তব কে বর্তমানে রূপ দেয়া সহজ ছিল না। শুরু থেকে বেশ রহস্যময় ভাবে শুরু করেছেন। ফিকশন আর নন ফিকশনের এই মিশেলে এই বইটি পাঠকের অন্তরে স্থান পেয়েছে আমাদের বিশ্বাস।
দোলন নামে এক মেয়ের সাথে নজরুলের পরিচয় হয়। সেই মেয়েটি তাঁর ভালোবাসা আর মায়ায় বেঁধে রেখেছিলেন। এই দোলন নিজের সমস্ত কিছু দিয়েই ভালোবেসেছিলেন নজরুলকে। নজরুলের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে অনেক কিছুই সহ্য করেছিলেন তিনি। বিধবা মা আর দোলনের জীবনে নজরুল ছিলেন দেবদূতের মতই। এই দোলন নিজের হাজার অসুস্থতা সত্ত্বেও নজরুলকে সেবা করে গেছেন শেষদিন পর্যন্ত।
হ্যাঁ দোলনই হল নজরুলের স্ত্রী, সন্তানের মা, নজরুলের সাথী প্রমীলা দেবী। নজরুল প্রমীলা দেবীকে ভালোবেসে নাম দিয়েছেলন। প্রমীলা শব্দের অর্থ অবসাদ। নজরুল বোধহয় জানতেন, প্রমীলা দেবীর জীবনে আসবে নানা ধরনের অবসাদ।
প্রমীলা দেবীর চরিত্র স্থাপনের জন্য উনার জীবনের ছোট বড় ঘটনা কে লেখক গল্পের প্রয়োজনে তুলে এনেছেন, তবে কোথাও সেটা অত্যুক্তি বলে মনে হয়নি।প্রমীলা দেবী বাস্তবিকই অত্যন্ত শক্ত মনের অধিকারী ছিলেন। তার প্রমাণ পাওয়া যাবে বইটা পড়েই। যেমন সন্তানের মৃত্যু, নিজের অসুস্থতা, ছোটবেলায় বাবাকে হারানোসহ কত ঝড় তুফান গেছে, কত হারানো, সব কিছু মিলিয়ে দুখু মিয়ার জীবন সঙ্গিনীর জীবনে ছিল দুঃখের সায়র। তবু তিনি নজরুলকে একা ফেলে তিনি জাননি, মৃত্যু তাদের আলাদা করেছিল। দ্বিধাহীন ভাবেই দোলন বা প্রমীলা দেবীকে অসম্ভব ভালোবাসতেন তিনি।
বলতে পারেন তাঁর 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি' আসলে এই গানটি কাকে নিয়ে লিখেছিলেন?
কাজী নজরুল ইসলাম পর পর দু'সন্তানকে হারান। প্রথম সন্তান ছিল কৃষ্ণ মুহাম্মদ আর বুলবুল। এই দুই সন্তানের মৃত্যু ভেঙ্গে দিয়েছিল সবকিছু । যদিও দুখু মিয়া সারাজীবনে সুখের দেখা খুব কম পেয়েছিলেন। জীবনের প্রতি ঘটনার সাথে সাথে তাঁর কলমে উঠে এসেছে গান কিংবা কবিতা। বুলবুলের মৃত্যুতে নজরুলের কলমে উঠে এসেছে কত গান। “ঘুমিয়ে গেছে ক্লান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি কিংবা বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল। “
নজরুল ইসলামের প্রতিটি লেখার পেছনে, প্রতি শব্দের পেছনে আছে এক গল্প। না ঠিক গল্প নয়, তার লেখা তাঁর জীবনাখ্যান। তাঁর অসংখ্য লেখার মধ্যে কিছু লেখার পেছনের গল্প পাবেন এই বইটিতে।
নজরুল প্রচন্ড অভিমানী ছিলেন। সেই অভিমানের কিছু ঘটনা বইটিতে লেখক অল্প কথায় তুলে ধরেছেন। লেখকের লেখার অন্যতম গুণ হল এটায়। অনেক বড় ঘটনাকে তিনি সহজ ভাষায় লিখে ফেলেন। কী ছিল সেই অভিমানের গল্প? জানার জন্য বইটা অবশ্যই পড়তে হবে। এই ছোট্ট ঘটনা অনেকের কাছেই বেশ অজানা।
নজরুলের খুব কাছের মানুষ ছিলেন “মতিহার” বা কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী। তাঁর কাছে লেখা প্রতিটি চিঠিতে ফুটে ওঠে তাঁর জীবনের অনেক চাওয়া পাওয়ার গল্প, না পাওয়ার বেদনা আক্ষেপ। তাঁর কাছে বলেছেন তাঁর ভালো লাগার কথা, না পাওয়ার কথা, ভালোবাসার কথা। মতিহার বন্ধুর পাশে থেকেছেন সবসময় ছায়ার মত, ভাইয়ের মত। অভিন্ন আত্মার ছিলেন এই দু'জন। বোধহয় মোতিহারের কাছেই নিজেকে উজাড় করে সবকিছু বলে দিতেন দ্বিধাহীন ভাবে।
হিন্দু নারীকে বিয়ে করেছিলেন, শাশুড়ি তাঁর সাথে থাকত কত কথা তাঁকে, স্ত্রীকে সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু বিদ্রোহী কবি থোড়াই কেয়ার করে সব কিছু। ফজিলাতুন্নেসার সাথে নজরুলের পরিচয় কিভাবে হয়েছিল সেটাসহ এর আগে পরের অনেক অজানা গল্প এই বইটিতে পাবেন।
একটা কারণবশত বিদ্রোহী কবি নিষিদ্ধ হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে চিরনিদ্রায় তিনি শায়িত। প্রতিদিন হাজারো শিক্ষার্থীর কলকাকলী, মসজিদের আজানের মধ্যে শুয়ে আছেন আমাদের নজরুল। তাঁর একান্ত ইচ্ছাই পূরণ হয়েছে
"মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।"
খুব অল্প কিছু ঘটনা দিয়ে সাজানো এই নজরুল নামের বইটি পড়ার পর মনে হয়, ইস! এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। সেই নজরুল কে আমরা কেউ আদতে চিনি না। চেনা সম্ভব নয়। কারণ ব্যক্তি নজরুল নিজের খুব সামান্যই আলোতে আসতে দিয়েছিলেন। নজরুলের জীবনকে বোঝা সবার পক্ষে আসলে সম্ভব না। কারণ তিনি নিজেকে একটা পর্দার আড়ালে রেখেছেন। তাঁর পাশে বসেও, থেকেও তাঁকে কেউ চিনতে পারেননি।
তাঁকে চেনার চেষ্টা করাটাও বেশ সাহসের কাজ বলে মনে হয়। লেখক সাহসের কাজ দেখিয়েছেন নজরুলের জীবনের কিছু অজানা তথ্য জানাবার চেষ্টা করেছেন। তবে বইটা তুলনা মূলক ছোট করে ফেলায় বেশ আক্ষেপ লাগে। কারণ নজরুল সম্পর্কে জানার জন্য এত গুছানো তথ্য সহজে পাওয়া যায় না, আর পাওয়া গেলেও এত আকর্ষনীয় করে লেখা থাকে না।
তথ্যবহুল এই বইটি অনেকের কাছে এই বইটি ভালো নাও লাগতে পারে, কারন নজরুলের জীবনের অনেক প্রেম আর ভালোবাসার কথা আছে এই বইটিতে। এটা বাঙ্গালি সমাজ স্বাভাবিক ভাবে দেখবেনা এটাই বাস্তব। বিশেষ করে ফজিলাতুন্নেসার সাথে ঘটা কিছু ঘটনা। তবে যেহেতু আগেও বলেছি, নজরুলকে চেনার সাধ্য কারো নেই, আর ছিলেন পাগলা গোছের সেকারনেই তাঁর কাজের কারণ খুঁজতে যাওয়া বেশ বোকামী।
এই বইটি সব দিক থেকে বেশ তথ্যবহুল, তবে লেখক চাইলে হয়তো আরো কিছু লেখা যুক্ত করতে পারত, মনে হয়েছে বেশ দ্রুত্তার সাথে তিনি শেষ করে ফেলেছেন। কিছু কিছু ঘটনাকে আর একটু বাড়িয়ে লিখলে পূর্ণতা পেত। যেমন ধরুন “বিদ্রোহী” কবিতা লেখার পেছনের ঘটনাকে আরো একটি পরিচ্ছদে যুক্ত করতে পারতেন। বইটিতে কিছু বানানের ভুল, অসম্পূর্ণ বাক্য চোখে পড়েছে। প্রকাশনী আর লেখকের কাছে আর্জি পরবর্তীতে যেন তা শুধরে নেন তাঁরা।
যদিও লেখক কাজী সাইফুল ইসলামের লেখনীর বড় গুণ সহজের পাঠকে আকৃষ্ট করে ফেলতে পারেন, আর এইটুকু বই লিখতে তাঁকে অনেক বেশি পড়াশোনা করতে হয়েছে। একজন বিদ্রোহী কবির জীবনকে এত বছর পরে তুলে আনা এত সহজ ছিল না।
সব কিছুর উপরে বইটি একটি দূর্দান্ত বই। এই বইয়ের যে বিষয়গুলো বেশ ভালো লেগেছে, সৈয়দা, নার্গিস, দোলন কিংবা প্রমীলাকে, ফজিলাতুন্নেসা কিংবা গিরিবালা দেবী কে। তাদের ব্যক্তিত্বকে খুব সুন্দর ভাবে লেখায় এনেছেন। তাদের জীবনের আগে পরের কিছু প্রাসঙ্গিক ঘটনা তুলে ধরেছেন। এই ঘটনাগুলো সেই ব্যক্তিদের একটা সুন্দর ছবি মানসপটে সাজাতে সাহায্য করেছে। নজরুলকে নিয়ে অনেক বই আছে, তাঁকে চেনার চেষ্টায় এই বই কিছু হলেও নজরুল প্রেমীরদের অন্তরআত্মা কে শান্ত করতে পারে। লেখক, ঐতিহ্য প্রকাশনী কে ধন্যবাদ এধরনের বই উপহার দেবার জন্য।
A book based on nation poet, Kazi Nazrul Islam. This is the Review of Bangla Book "Nazrul", By Kazi Saiful Islam.
Source: Tasfia Promy
kazi nazrul islam and Pramila debi photo: Prothom alo