Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাত রাজার ধন এক মানিক | মহারাজ সত্যজিৎ রায়ের ছোটবেলা

রায় পরিবার। সন্দেশ পত্রিকা নামেই চলে আসে যাদের পরিচয়। ১০০ গড়পার লেনে দাঁড়িয়েছিল সেই বিশাল বাড়ি, স্টুডিও আর ছাপাখানা। ছাপা হচ্ছে সন্দেশ পত্রিকা, রঙ-বেরঙের ছোটদের বই, আরও কত কী! সুকুমার রায়, ১৯২৩ সালে যখন মারা গেলেন, ছোট্ট মানিকের বয়স তখন মাত্র আড়াই বছর। 

সেই থেকে শুরু হলো বিপদ। একে একে বন্ধ হলো সন্দেশ পত্রিকা, থেমে গেল ছাপাখানা। দেউলিয়া হয়ে পড়ল ইউ রায় এন্ড সন্স। ব্যবসায়িক দেনায় পড়ে বিক্রি করে দিতে হলো সব। বিশাল রায় পরিবার ছড়িয়ে পড়ল এদিক-সেদিক। একেকজন জব্বলপুর, ভবানীপুরসহ কত জায়গায়।

গড়পার, নামটা শুনেই মনে পড়ে আমাদের সবার প্রিয় জটায়ুর কথা। সত্যজিৎ রায়ের সব লেখাতেই উঠে এসেছিল তাঁর জীবনের অনেক ছোট কথা। তিনি যেখানে যেখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন সব মিলেই। ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ে লেখক ছোটবেলার অনেক কথাই বলেছেন। সত্যজিৎ রায়, সুকুমার রায়, এবং রায় পরিবারের অনেক জানা-অজানা তথ্য নিয়েই রায় পরিবারের আরেক নক্ষত্রের লেখা বই ‘সাত রাজার ধন এক মানিক’। 

নলিনী দাশ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর নাতনী, সত্যজিৎ রায়ের পিসতুতো বোন, জীবনানন্দ দাশের ভ্রাতৃপত্নী। বলতে দ্বিধা নেই, পুরো রায় পরিবার যেন এক আকাশ নক্ষত্রে পূর্ণ। নলিনী দাশ নিজেও দুর্দান্ত মেধাবী ছিলেন শিক্ষাজীবনে। লিখেছেন ছোটদের গোয়েন্দা গল্পের সিরিজ ‘গোয়েন্দা গণ্ডালু’। সম্পাদনা করেছেন সন্দেশ পত্রিকা। 

সন্দেশ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক ও লেখিকা নলিনী দাশ; Image Source: Wikimedia Commons

নিজের ছোটবেলার গল্পের সাথে নলিনী দাশ রায় পরিবারের সাত রাজার ধন এক মানিক, আমাদের সবার প্রিয় মহারাজ সত্যজিৎ রায়ের ছোটবেলা আরো একবার তুলে ধরেছেন। 

ছোটবেলায় মানিক নামের এই ছেলেটি কিছু বোঝার আগেই বাবাকে হারান। মাসতুতো, পিসতুতো, খুড়তুতো ভাই-বোনদের সাথে তাদের দিন কাটত। শান্ত স্বভাবের মানিক যখন গড়পারের বাড়ি ছেড়ে চলে আসে তখন বয়স কত আর হবে— ছ’ কিংবা সাত। এত বিশাল পরিবারের সবার মধ্যে বন্ধন কখনও এতটুকু কমেনি। সবার সাথে সবার যোগাযোগ যেমন ছিল, প্রয়োজনে একে অন্যকে ঠিক তারা পাশে পেয়েছিলেন।

এই বিশাল ইউ রায় এন্ড সন্স উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নিজে নকশা করে তৈরি করেন। নলিনী দাশের কথা থেকে জানা যায়, প্রায় তিন তলার এই বাড়িতে কোনটা ছিল সাজার ঘর, কোনটা খাবার ঘর, কোনটা কেবল বই পড়ার ঘর। কত হাসি, গান, খেলা, আয়োজন- সেসব বাড়ি বিক্রির সাথে সাথে হারিয়ে গেল। তবে হারিয়ে যায়নি এ বাড়ির রত্নেরা। 

ইউ রায় এন্ড সনস; Image Source: getbengal.com

খুব অদ্ভুত লাগে, আজকাল সম্পর্কে স্বার্থ ছাড়া কিছু পাওয়া যাবে না। কিন্তু মানিককে নিয়ে তার মা যখন ভাই এর বাড়িতে উঠল, তখন সেই টুটুমামার বাড়ি হয়ে উঠেছিল রায় এন্ড সন্সের আরেকটি শাখা। মা ছেলের সম্পর্কের খুব সুন্দর কিছু চিত্র লেখিকা তুলে ধরেছেন। মা সুপ্রভা দেবী নিজে রোজগার করতেন, পৈতৃক সম্পত্তির কিছু পেতেন মানিক। অনেক কিছু মিলে সুপ্রভা দেবী নিজের ভাইয়ের সংসারে কিছু সাহায্যও করতেন। রাজমহলের মতো জীবন দিতে না পারলেও যে শিক্ষা, মনন আর মেধা নিয়ে আমাদের মানিক মহারাজা বড় হয়েছেন, তা নিয়ে কিছু বলতে যাওয়া ধৃষ্ঠতা বটে। 

‘সাত রাজার ধন এক মানিক’ বইটি পড়ে বোঝা যায়, একদিকে রক্তে-অস্থিতে-মজ্জায় লেখা যেমন সত্যজিতের ছিল, সেরকম সিনেমা বানানোর পোকা তৈরি হয়েছিল এই টুটুমামার বাড়িতে এসেই। মজার ব্যাপার হলো- প্রচুর বই পড়তেন সত্যজিৎ রায়, আর মা তাকে সেসব বই কিনে দিতেন। এই বই পড়ার নেশা তাকে আর দশজন থেকে আলাদা করে তুলেছিল, সেটা নাকি তিনি নিজেই জানতেন না। 

আসলে এই বই নিয়ে লিখতে গেলে অনেক কিছু বলা হয়ে যাবে। সত্যজিতের জানা-অজানা অনেক গল্প আর ইতিহাস পাঠক জানতে পারবেন। ঘুরে-ফিরে মা-ছেলের গল্প, সত্যজিতের ছোটবেলা ইতিহাসের পাতা থেকে একেবারে চোখের সামনে তুলে এনেছেন নলিনী দাশ। লেখিকার সাথে আমাদেরও আক্ষেপ, সুকুমার রায় কিংবা সুপ্রভা দেবী তাদের আদরের মানিকের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। জানতে পারলেন না কী এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের জন্ম দিয়েছেন তারা। 

বাংলা সাহিত্যের অবিসংবাদিত এই মহারাজার জীবন তার লেখা গল্পের মতোই। নানা ছন্দে আর রহস্যে পরিপূর্ণ। তার লেখা চরিত্রের সাথে সাথে আমরাও ঘুরেছি গিরিডিতে, গড়পারে, ভবানীপুরে। বই পড়ার সময় মনে হবে আমি তো জটায়ুর সাথে এই শহরে হেঁটেছি, সেই যে আমাদের সবুজ এম্বাসেডর। কিংবা প্রফেসর শংকুর সাথে গিরিডির কোনো নির্জন ঘরে। কলকাতার অলিগলি, শহরতলি সব। 

নলিনী দাশের সাত রাজার ধন এক মানিক; Image source: goodreads.com

একজন মানুষ এত প্রতিভাধর হতে পারে সেটা রায় পরিবারের মানিক দেখিয়ে দিয়েছেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন ক্যামেরা। পেয়েছিলেন পুরস্কারও। নির্লোভ এই মানুষটির চরিত্রের অনেক অজানা দিক তার বোন আমাদের জানিয়েছেন। 

খুব ছোট্ট এই বইটি যেন এক খোলা আকাশের মতো। কত বিচিত্র তথ্য, অনেক চেনা তথ্য যেন নতুন করে জানা গেল। সবকিছু নিয়ে যেমন বলতে ইচ্ছে করছে, আবার মনে হচ্ছে কিছু তোলা থাক না, না হলে যেন হারিয়ে যাবে সব!

নলিনী দাশ এই বইয়ের এক অংশে সত্যজিতের লেখা কিছু চিঠির অংশ, সত্যজিতের কাছে লেখা নানাজনের চিঠি, মানিকের তোলা ছবি, মানিকের নিজের ছবি এবং পুরো রায় পরিবারের বংশের একটি বংশলিপি আমাদের জন্য যুক্ত করেছেন। যদিও সব কিছু স্পষ্ট নেই, তবু এই বই এক অমূল্য সম্পদ।

ভাইয়ের মতই দারুণ মেধাবী লেখিকা। তিনি চার মেয়েকে নিয়ে লিখেছিলেন গোয়েন্দা গল্প। মোট দু’খণ্ডের এই বইগুলোতে আছে সত্যজিৎ রায়ের আঁকা অনেক ছবি। সেই বই বাজারে এখনও খুঁজলে পাওয়া যায়। লেখার দিক থেকে নলিনী দাশের প্রশংসা করতেই হয়। সহজ সাবলীল ভাষায় একটি জীবনী তিনি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। পুরো সময় এক মোহাচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি। ছোটবেলার স্মৃতি যেভাবে তিনি তুলে ধরেছেন, সেক্ষেত্রে বলতেই হয় পরিবারের রক্তের ধারা তিনি বজায় রেখেছেন। 

অনেকের কাছে এই বইটি ভালো না-ও লাগতে পারে, কারণ কিছু কিছু ক্ষেত্রে একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসেছে, বিশেষত মানিকের গড়পার ছেড়ে আসা, সুপ্রভা দেবীর সাথে তার সম্পর্ক এরকম কিছু ব্যাপার। তবে আপনি যদি মানিকভক্ত হয়ে থাকেন, তাহলে এই ছোটখাট বিষয় অগ্রাহ্য করে পড়ে ফেললে সময় খারাপ কাটবে না।

Language: Bangla

Topic: A book review on Saat Rajar dhon ek manik by Nalini Das

Necessary links are hyperlinked in the article. 

Feature Image: goodreads.com

Related Articles