বরুণার অনুরোধে সুনীল ১০৮ টা নীল পদ্ম খুঁজে এনেছিল, দুরন্ত ষাড়ের চোখে বেঁধেছিল লাল কাপড়। অনুরোধে আবার অনেকে নাকি ঢেকি ও গেলে। তবে অনুরোধ না হলেও কথায় কথায় একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিলেন ফিলিয়াস ফগ। জুল্ভার্ণ এর লেখা আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ বই থেকে নির্মিত হয়েছে এক দূর্দান্ত চলচিত্র “ Around the world in 80 days” .। সিনেমার গল্প আর বই এর এবং মূল গল্প নিয়ে কিছু তথ্য জানাচ্ছি আপনাদের ফিসিয়াস ফগ নামে এক ব্যক্তি। সে বহু টাকার মালিক। কিন্তু সে যেমন রহস্যময়, তাঁর টাকার উৎস কেউ জানেনা। তাঁকে কেউ কোনদিন কাজ করতে দেখেনি। শুধু দেখেছে কাজ করে যেতে।
খুব নিয়ম মেনে চলা এই ফগ। যদি ব্রেকফাস্ট সকাল ১০ টার কথা বলেন, সেটা কোন ভাবেই ৯.৫৯ কিংবা ১০.০১ হলে চলবে না। তাঁর কোন কর্মচারী তাঁর এই স্বভাবের কারনে স্থায়ী হয় না। কেউ যদি নিজে চলে যায়, আর একজন কে নিজে উদ্ভট কারণ দেখিয়ে ছাটায় করেন। শেষমেশ পাসোপার্তো নামে এক ব্যক্তি নিয়োগ পায়। তাঁর স্বভাবও পাগলাটে ধরনের, প্রচুর কথা বলতে পারে। এদিকে বইটির তথ্য অনুসারে প্রতিদিন তাস খেলায় বিপুল বাজী জেতেন ফগ আর সেটা বিলিয়ে দেন।
একদিন কোন এক ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় উত্তাল ক্লাবঘর। কথায় কথায় ফগ বাজী ধরলেন, মাত্র ৮০ দিনে তিনি পুরো বিশ্বভ্রমণ করবেন। আর সেটা হবে সে সালের ২ রা অক্টোবর, পৌনে ৯ টা থেকে, ২১ শে ডিসেম্বর পৌনে ৯ টা। সাল আর রাত না দিন পৌনে ন’টা সেটা নাহয় পাঠক কিংবা দর্শক মুভি দেখার পরে আর বই পড়বার পরে জেনে নেবেন।
বাজি ধরতে ভালোবাসেন ফগ। আর এত বড় এক কাজে বাজি না ধরে থাকতে পারেন? বেশ দৃঢ় কন্ঠেই বলেছিলেন
“A true Englishman doesn't joke when he is talking about so serious a thing as a wager.”
― Jules Verne, Around the World in Eighty Days
সোজা বাংলায় যাকে বলে “ভদ্রলোকের এক কথা” । আর তাই পূর্বঘোষণা ছাড়াই হুট করেই বেয়ে পড়লেন বিশ্বভ্রমণে। সাথে লেজুড় হিসেবে পার্সো। নির্দিষ্ট দিনে উড়ন্ত বেলুনে চেপে বসলেন দু’জন।
এদিকে এই দু’ পর্যটকের পিছু নিল এক গোয়েন্দা। কিন্তু কেন ? এদিকে তাঁর বন্ধুরা কেউ বিশ্বাস করতে পারেনা যে ফগ এই কাজ সমাপ্ত করতে পারবে। অন্যদিকে বিশ্বভ্রমণে নানা ঝামেলায় পড়তে হয় ফগ আর তাঁর সাগরেদকে। একে একে সমস্যা অনেক দেরি করিয়ে দিচ্ছে ফগ কে। সে কীভাবে সম্পন্ন করবে এই ভ্রমণ?
এ এক কল্পকাহিনী। জুলভার্ণ সেই কবে লিখেছেন। ১৮৭২-১৮৭৩ সালে প্রকাশিত এই বইটি পর্দায় আমরা দেখতে পাই ১৯৫৬ সালে। এত বছর আগে কি নিখুঁত ভাবে এই ছবির পেছনের মানুষেরা ছবিটিকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, ভাবলেও অবাক লাগে।
মজার ব্যাপার হল ফগ যখন দক্ষিণএশিয়ায় আসেন, মানে সেই সময়ের অধিকাংশ চিত্র ধারণ করা হয় বাংলাদেশ এর শ্রীমঙ্গল। ট্রেন, পাগলা হাতি সহ বেশ বড় একটা অংশ চিত্রায়িত হয়েছে সেখানে।
সত্যি সত্যি পরিচালক সহ পুরো সিনেমা টিম ১৩ টি দেশ ভ্রমণ করেন আর মোট শুটিং সেট ছিল প্রায় ১৪০টি।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশ। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল এবং বর্তমান লাউয়াছড়া এলাকায় শুটিং চলে। যারা লাউয়াছড়া এবং শ্রীমঙ্গল এলাকায় সেই শুটিং স্পট চিহ্নিত করা আছে। হলিউডের একটা ছবি সেই কবে আমাদের দেশে শ্যুট করা হয়েছিল! কি অদ্ভুত না? ফগ বিশ্বভ্রমণে এসে আমাদের দেশে ঘুরে গিয়েছিলেন, ভাবতেই শিহরন জাগে।
অস্কারজয়ী এই মুভিকে গুগল বা Idmb রেটিং এ ৬+ দেয়া হলেও এটা আসলে ৮ এর বেশি হওয়া উচিৎ। কারণ এত যুগ আছে ছিল না গুগল কিংবা প্রযুক্তি। হাতের মুঠোয় বিশ্ব না থাকার পর ও জেদের বসে একজন পুরো দুনিয়া দেখতে বেরিয়েছিলেন। কি অদ্ভুত! এই গল্পের ধারণা করা, প্রতিটি দেশকে নিয়ে লেখা, প্রতিটি ঘটনা এত নিখুঁত ভাবে বই কিংবা সিনেমায় তুলে ধরা যে ভুল ধরার জায়গা কম পাওয়া যায়।
উড়ন্ত বেলুনের দৃশ্য, উঁচু হিমবাহ থেকে বরফ খন্ড তুলে ড্রিংক্স ঠান্ডা করার দৃশ্য কিংবা রেলগাড়ি চেপে দুধারে নয়নাভিরাম দৃশ্য । কোনটা ছেড়ে কোনটা কে নম্বর দেব বলুন তো? বই পড়ার সময় মনে হবে আপনি নিজেই লড়ছেন পাগলা হাতির সাথে আবার সিনেমা দেখার সময় মনে হবে এই বেলুনে চড়ে আপনি নিজেই ঘুরছেন পুরো দুনিয়া।
পাগলাটে পার্সো কিংবা সিরিয়াস ফগ, দু জনের কথার মধ্যে হিউমার যেমন পাবেন তেমন পাবেন সিরিয়াস কথা বার্তা। এই মুভির একটা দৃশ্যে রকেট উড্ডয়ন দেখা যায়। তবে সেটা বেশ রহস্যময়। কে বা কারা সেই রকেট উড়িয়েছিল, কবে কেন , কি উদ্দেশ্যে কিছু জানা যায় না। লেখকের মত পরিচালক সিনেমা তৈরিতেও অনেক রহস্য রেখে গেছেন।
গোয়েন্দা চরিত্রটি বেশ বোকা বোকা মনে হলেও সে কি আসলেই বোকা না বোকা সেজে ছিল? গোয়েন্দার অভিনয় অনেকের কাছে ভালো না লাগলেও ফগ এবং পার্সোকে সবাই ভালোইবাসেন।
এদিকে ফগের বন্ধুমহলের কথা বার্তা শুনে মাঝে মধ্যে একটু রাগ হতে পারে। মানুষকে জাজ করার স্বভাব কিন্তু আজকের না। না জেনে না বুঝে অন্যকে নিয়ে সমালোচনা করা বেশ পুরাতন ট্র্যাডিশন এর দেশের মানুষের। না এই দেশ না এই পৃথিবীর মানুষের।
পরিচালক ছিলেন Michael Todd । এই অস্কারজয়ী মুভির ডিরেক্টর হিসেবে Michael Anderson দারুণ কাজ দেখিয়েছেন বলায় বাহুল্য। ৮০ দিনে না হলেও ফগের সাথে সাথে ১৮৮ মিনিটে আপনিও পুরো দুনিয়া ঘুরতে পারবেন। তবে ঠিক ৮০ দিন শেষে নিজের জেদ বা শপথ পূরণ করতে পারবেন তো? ফগ কি পেরেছিলেন? নাকি ব্যর্থ হয়েছিলেন?
Cantinflas নামের এই অভিনেতা পার্সোর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই মুভি দিয়ে তাঁর অভিনয় জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে কমেডিয়ান হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। David Niven অভিনয় করেন পর্যটক বা মূল চরিত্রে। কথা বলার ভঙ্গী, রাগ, জেদ সহ প্রতিটি বিষয় তিনি ত্রুটিহীন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বই এর ফগ আর মুভির ফগ কে একই ব্যক্তি বলে ভুল করবেন। বইটিতে ফগের যে বর্ণনা লেখক দিয়েছেন্ম পর্দার ফগ যেন ঠিক একই ধাঁচে গড়া।
শেষমেশ বলব , ফগ কিংবা পার্সোর কথা বা কাজ আমাদের যা শেখায় তা হল, জেদ থাকলে, ইচ্ছা আর স্পৃহা থাকলে যে কোন অসম্ভব কে সম্ভব করা সম্ভব। মোটিভেশনাল খটমটে ডকুফিকশন দেখে ঘুম আসতে পারে, এই মুভি দেখলে সেটা তো আসবেই না। বরং দেখা শেষ করে মনে হবে, আরে আমি যে কাজ পারব না ভেবেছিলাম, সেই কাজ আমি করে দেখাবো। মন খারাপ থাকলে, ভেঙ্গে পড়লে এই মুভি হতে পারে মহাঔষধ। তবে আপনার এই আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ করার মত দম আছে কী?