নানা আঙ্গিকে সিনেমা
সেলুলয়েডে ফুটবল
“সব খেলার সেরা বাঙ্গালীর তুমি ফুটবল”...
এদেশে আবাহনী-মোহমেডান দৌরথে কতই না মাতামাতি দেখা যেতো একসময়ে। কালের বিবর্তনে দেশীয় ফুটবল তার জৌলুস হারালেও হারায়নি বাঙ্গালীর ফুটবলপ্রীতি। তাইতো বিশ্বকাপের সময় আর্জেন্টিনার সাদা-আকাশী কিংবা ব্রাজিলের পতাকার হলুদে ছেয়ে যায় সারা দেশ। পাঠকদের জন্য রইলো ফুটবল নিয়ে সারা বিশ্বে নির্মিত ও আলোচিত গোটা দশেক চলচ্চিত্র সমাচার।
ভিক্টোরি (১৯৮১)
ফুটবল নিয়ে নির্মিত কাহিনিচিত্রের মধ্যে সর্বকালের সেরা হিসেবে প্রথম সারিতেই যে চলচ্চিত্রটি স্থান পায় তার নাম ‘ভিক্টোরি’। জন হাস্টন নির্মিত এই আমেরিকান ছবিটি মূলত হাঙ্গেরিয়ান চলচ্চিত্র ‘টু হাফ টাইমস ইন হেল’-এর অনুপ্রেরণায় নির্মিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনী বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় একদল প্রতিবাদী যুবক। সেই দলকে কারাবন্দী করে রাখা হয় এবং তাদের অভিনব এক প্রস্তাব দেয়া হয় নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ার শর্তে। তারা যদি একটি ফুটবল দল করে জার্মানীর জাতীয় দলের সাথে একটি ম্যাচে অংশ নেয় এবং জিতে যায়, তবেই তাদের মিলবে কারামুক্তি। এটা মূলত নাৎসিদের একটা প্রপাগান্ডামূলক চাল ছিলো, যেটা শেষদিকে অন্য এক রূপ নেয়। উত্তেজনায় ভরা এ ছবিতে র্যাম্বোখ্যাত সিলভেস্টার স্ট্যালোনের পাশাপাশি আরো অভিনয় করেছেন ব্রাজিলের কিংবদন্তী ফুটবলার পেলে ও ইংলিশ ফুটবলার ববি মুর।
শাওলিন সকার (২০০১)
ফুটবল নিয়ে আলোচিত ছবির তালিকার দ্বিতীয় স্থানরত হংকংয়ের এই ছবিটি হয়তো অনেকে স্যাটেলাইট টিভির কল্যাণে ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছেন। হংকং পরিচালক স্টিফেন চৌ নিজেই ছবিটির মূল ভ‚মিকায় অভিনয় করেছেন। আধুনিক জীবনে মার্শাল আর্টের নানা অধ্যাত্মিক প্রয়োগ দেখানো হয়েছে পুরো ছবিজুড়ে। মার্শাল আর্ট-কমেডি নির্ভর ছবিটিতে হাসি ও অ্যাকশন ছাড়াও তুলে ধরা হয়েছে কিছু মানবিক বক্তব্য। ক্যান্টনীয় উপভাষায় নির্মিত ছবিটির পরতে পরতে লক্ষণীয় ছিলো কুংফুর একটি ধারা যার নাম শাওলিন কুংফু।
অফসাইড (২০০৬)
ইরানি চলচ্চিত্রকে বিশ্ব দরবারে যারা সমীহ এনে দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জাফর পানাহি। সত্যবাদী, নির্ভীক এ নির্মাতা সে দেশের কট্টরপন্থী সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ইরানের প্রকৃত অবস্থা তার ছবিগুলোতে তুলে ধরেছেন সুনিপুণভাবে। গৃহবন্দী থাকার পরও একটুও থামেনি তার চলচ্চিত্র নির্মাণরথ। পানাহির এমনই এক প্রতিবাদী ছবি ‘অফসাইড’, যার প্রেক্ষাপট ইরানি এক মেয়ে এবং ফুটবলকে ঘিরে। ইরানে খেলাধুলা দেখার জন্য স্টেডিয়ামে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, কিন্তু এক তরুণীর অদম্য ইচ্ছার কাছে অনেকটা হার মেনে যায় সেই নিয়ম বাঁধন। ২০০৬ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের ইরান-বাহরাইনের একটি ম্যাচ দেখতে এক তরুণী পুরুষ বেশে ঢুকে পড়তে চায় স্টেডিয়ামে। বাকি গল্প পুরো ছবিতে প্রকাশ্য। ইরানে ছবিটির চিত্রায়ণ হলেও ছবিটি সে দেশে প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে রৌপ্যভালুক পুরস্কার জিতে নেয় ছবিটি। বলা হয়ে থাকে, ছবিটি পরিচালকের নিজের মেয়ের জীবন কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছিলো।
বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম (২০০২)
ইংল্যান্ডের স্টার ফুটবলার ডেভিড বেকহ্যামের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। ফ্রি কিকে বলকে বেন্ড করে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের দেয়াল ভেঙ্গে কি অসাধারণ ভাবেই না বলকে জালে পাঠাতেন তিনি। এ ধারণাকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে ব্রিটিশ-জার্মান চলচ্চিত্র ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’। ছবির শেষদিকে ক্যামিও উপস্থিতিতে বেকহ্যামকে দেখা গেলেও পুরো ছবিতে রয়েছে তার আদর্শ। ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত ব্রিটিশ নির্মাতা গুরিন্দার চাড্ডা পরিচালিত এ ছবিটি লন্ডনে বসবাসরত পাঞ্জাবী এক শিখ পরিবারের মেয়ে জাসমিন্দার ওরফে জেসের ফুটবলার হওয়ার লড়াইয়ের গল্প। ছবিতে অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান খ্যাত কেইরা নাইটলি, বলিউডের অনুপম খেরসহ একঝাঁক গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রী।
গোল ট্রিলজি (২০০৫/০৮/০৯)
ব্রিটিশ ফ্রাঞ্চাইজি চলচ্চিত্র ‘গোল’ সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র চলচ্চিত্র, যেখানে সর্বাধিক সংখ্যক ফুটবলারকে ক্যামিও চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে। ডেভিড বেকহ্যাম, জিনেদিন জিদান, রোনাল্ডো, কাকা, স্টিফেন জেরার্ড, ইকার ক্যাসিয়াস, লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো থেকে শুরু করে কে নেই এ ছবিতে। চলচ্চিত্র সিরিজটির কাহিনি সান্তিয়াগো মুনেজ নামের এক কিশোরের ফুটবলার হওয়ার সংগ্রাম নিয়ে। চলচ্চিত্র সিরিজটির প্রথম পর্বে মেক্সিকান এই কিশোর অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ইংলিশ ক্লাব নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের হয়ে খেলার সৌভাগ্য অর্জন করে। দ্বিতীয় পর্বে গিয়ে তার স্বপ্ন পুরণ হয় বেকহ্যাম, জিদান, রাউলদের হয়ে স্প্যানিশ ক্লাব রিয়েল মাদ্রিদে খেলার। ছবির শেষ পর্বে এসে সান্তিয়াগো তার নিজ দেশ মেক্সিকোর হয়ে ২০০৬ জার্মানী বিশ্বকাপে অংশ নেয়। চলচ্চিত্রগুলোর মজা হচ্ছে সত্যিকারের সব ফুটবল ম্যাচ দেখার মত অনুভ‚তির জন্ম নেয় চিত্রনাট্যে অন্তর্ভুক্ত ম্যাচগুলো দেখতে গিয়ে।
ধান ধানাধান গোল (২০০৭)
তালিকার এবারের চলচ্চিত্রটি বলিউডের। বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত ‘ধান ধানাধান গোল’ যুক্তরাজ্যে বসবাসরত একদল দক্ষিণ এশীয়ের কাহিনী। ফুটবলের প্রতি টান থেকেই এই দলটি সাউথহল ইউনাইটেড নামে একটি ফুটবল ক্লাব গঠন করে। এ ক্লাবের খেলোয়াড়দের মধ্যে কেউ বা ভারতীয়, কেউ বা পাকিস্তানী কিংবা বাংলাদেশী। চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন চরিত্রে দেখা গেছে জন অ্যাব্রাহাম, বোমান ইরানি, আরশাদ ওয়ারসি ও বিপাশা বসুকে। দলের মেহেন্দীর গাওয়া হাল্লা বোল গানটি ছবিটির দৃশ্যায়নে আলাদা মাত্রা এনে দেয়। বক্স অফিসে অসফল হলে, ছবিটি সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। ২০০৭ কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
পেলে-বার্থ অফ অ্যা লিজেন্ড (২০১৬)
সর্বকালের সেরা ফুটবলার পেলেকে নিয়ে ২০১৬ সালে হলিউডে নির্মিত হয় ছবি ‘পেলে-বার্থ অফ অ্যা লিজেন্ড’। কিংবদন্তী পেলেকে তো আমরা অনেকেই চিনি, কিন্তু কেমন ছিলো তার ছেলেবেলা তা কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না। এখানেই ছবিটির বিশেষত্ব। ছবিটি দেখলে পেলের বেড়ে ওঠার পুরো ব্যাপারটা ভালো করে বোঝা যাবে। ছবিতে দেখানো হয়েছে ব্রাজিলের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাথরুম পরিষ্কারের কাজ করা বাবার সাথে গাছের পাকা আম দিয়ে ছোটবেলায় পেলের ফুটবল প্রাকটিস করা! পেলে ও তার বন্ধুরা কিভাবে বাদাম চুরি করে সেই টাকা দিয়ে ফুটবলের বুট কিনে খেলেছিলো, তারও উল্লেখ আছে ছবিতে। উল্লেখ আছে ব্রাজিলের ট্রেডমার্ক জিঙ্গা স্টাইল ফুটবলের। ছবিতে বাড়তি হিসেবে রয়েছে এ.আর. রহমানের অসাধারণ আবহসঙ্গীত।
রুডো অ্যান্ড কার্সি (২০০৮)
অস্কারজয়ী মেক্সিকান পরিচালক আলফোনসো কুয়ারোন প্রযোজিত ফুটবলনির্ভর চলচ্চিত্র ‘রুডো অ্যান্ড কার্সি’। ছবিটি পরিচালনা করেছে তারই ভাই কার্লোস কুয়ারোন। মেক্সিকোর প্রত্যন্ত গ্রামের সৎ দুই ভাই টাটো ও বেটো। টাটোর স্ট্রাইকার হিসেবে তার এলাকায় খুব সুখ্যাতি রয়েছে, অপরদিকে তার ভাই বেটো গোলকিপার। এলাকার চলাকালীন কোন একটি ম্যাচের সময় দুই ভাইয়ের প্রতি নজর পড়ে এক ফুটবল ট্যালেন্ট স্কাউটের। শর্তমতে দুই ভাইয়ের যে কোন একজন তার সাথে যেতে পারবে শহরে আর সেখানে গিয়ে বড় ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ পাবে। কে হবে সেই ভাগ্যবান, সেটি নির্ধারিত হয় পেনাল্টি শ্যুটআউটে। স্প্যানিশ ভাষায় নির্মিত ছবিটি ২০০৮ সালে মুক্তি পায়।
এগারো (২০১১)
তালিকার এবারের ছবিটি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবি যার নাম ‘এগারো’। অরুন রায় পরিচালিত ছবিটি ১৯১১ সালের বৃটিশ শাষিত ভারতে মোহন বাগান ও ব্রিটিশ আর্মির ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের মধ্যকার ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে। ১৯১১ সালের ১৯ জুলাইয়ের মোহনবাগান ক্লাব খালি পায়ে ফুটবল খেলে হারিয়ে দেয় ইংল্যান্ডের ইস্ট ইয়র্কশায়ার ক্লাবকে। এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি তাই পশ্চিমবঙ্গের মোহনবাগান সমর্থকদের কাছে অনেকটা স্বদেশী আন্দোলনের মতই ঘটনা।
জাগো (২০১০)
পরিচালক খিজির হায়াত খান নির্মিত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র ‘জাগো’ মুক্তি পায় ২০১০ সালে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সেরা ক্রীড়া নিয়ে চলচ্চিত্রের তালিকা তৈরি করলে অধিকাংশের ভোটে ‘জাগো’ই তালিকার শীর্ষে থাকবে। ছবির কাহিনী বাংলাদেশের কুমিল্লা একাদশ ও সীমান্তের ওপারের ভারতের ত্রিপুরা একাদশের ফুটবল দৌরথকে ঘিরে। ছবিতে দেখানো হয় অতীতে কুমিল্লা একাদশ কখনই ত্রিপুরার সঙ্গে একটি ম্যাচেও জেতেনি। কুমিল্লার সেই জয়ের খরা ঘুচিয়ে দেশের মান রাখতে দলটিতে কোচ হিসেবে যোগ দেয় স্বাধীন বাংলা দলের এক সাবেক খেলোয়াড়। জয়ের জন্য মরিয়া দলটির প্রাণপণ প্রস্তুতি শুরু হয় এই কোচের নেতৃত্বে। অর্ণবের সঙ্গীতায়োজনে ছবির সবকটি গানই মনে দোলা দেয়।
লেখাটির শেষটায় একটা ঘটনার উল্লেখ করা যাক। ২০১৪ বিশ্বকাপে খবর এসেছিলো, বগুড়ার ধুনট সদরের সিকতা সিনেমা হলে রাতের শো'তে চলচ্চিত্রের পরিবর্তে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখানো হয়েছে। হল কর্তৃপক্ষ নাকি খেলা দেখার টিকিটের মূল্য সেবারে ১০ টাকা নির্ধারণ করেছিলো। লোডশেডিং বাঁচিয়ে প্রিয় দলের খেলা দেখতে তাই হলে ছিলো উপচে পড়া ভিড়। বাঙ্গালীর ফুটবল প্রেম কতখানি তা এই ঘটনা থেকেই সহজে অনুমেয়। আর তাই তো বেঁচে থাক বাঙ্গালীর ফুটবল প্রেম, সেই সাথে বেঁচে থাক সেলুলয়েডে খেলাধুলাসহ নানা ঘরানার কালজয়ী চলচ্চিত্রগুলো।