আগেই বলা হয়েছে যে বাংলার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল তার পেছনে রাজশক্তি কাজ করেনি। মুসলমান শাসকদের প্রধান কেন্দ্র ছিল দিল্লী। অথচ দিল্লীর নিকটবর্তী অঞ্চলে জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ হিন্দুই রয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে বাংলা ছিল দিল্লী থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, মোগল আমলে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা আদেশ জারি করেছিলেন কোনোরকম ধর্মান্তকরণের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে সেনাপতি, শাসক, বড় আমলা হিসেবে পশ্চিম থেকে যারা এসেছিলেন তারা নিজেদেরকে অভিজাত মনে করতেন। মুসলমান হলেও তাদেরকে বলা হতো আশরাফ। আর নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের বলা হতো আতরাফ। আশরাফ-আতরাফদের সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব ছিল। শাসক আশরাফরা পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত। অথবা দুই এক পুরুষ আগে ভারতের বাইরে পশ্চিমের দেশ থেকে এসেছেন। মোটকথা বহিরাগত। তাদের ভাষাও ছিল ভিন্ন। ফার্সি, উর্দু, ইত্যাদি। বাংলা নয়। ধর্মের দিক দিয়েও তারা প্রধানত ছিলেন শিয়া। তারা নিজেরাও নিম্নবর্ণের শ্রমজীবী হিন্দুদের মুসলমান বানাতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তারা আতরাফদের নিচু জাত বলে মনে করতেন। যদিও ইসলাম ধর্মে জাতিভেদ বলে কোনো কিছু কোনোদিনই ছিল না। আশরাফরা বাস করতেন নগরে। আর আতরাফরা থাকতেন গ্রামে, পেশায় কৃষিজীবী। “আশরাফ-আতরাফ বিভাজনের প্রসঙ্গটি স্বচ্ছভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল মুকুন্দরামের ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’র মঙ্গলকাব্যে বিধৃত ষোড়শ শতাব্দীর নগরবাসী বহিরাগত মুসলমান ও গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র ধর্মান্তরিত ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আর্থ-সামজিক অবস্থানের নিপুণ বর্ণনায়।” (অতীশ দাসগুপ্ত)
স্বাভাবিকভাবেই শাসকশ্রেণি আশরাফ মুসলমানরা ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল। আর শাসকশ্রেণি মাত্রই অত্যাচারী। কিন্তু যে বহিরাগত ধর্ম প্রচারকদের হাত ধরে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, সেই ধর্মের প্রচারকরা প্রতিক্রিয়াশীল-শোষক-শাসক ছিলেন না। বরং সাম্যে বিশ্বাসী ছিলেন। তারা ছিলেন সাধু পুরুষ এবং অবশ্যই মহাপুরুষ। তারা ছিলেন প্রধানত সুন্নি মুসলমান এবং সুফী মতবাদে বিশ্বাসী।
বাংলার সাধারণ মানুষ এই মহাপুরুষদের জীবন আচরণ দেখে এবং নতুন ধর্মের (ইসলাম) মধ্যে সাম্য তথা তুলনামূলক প্রগতিশীল উপাদান দেখে আকৃষ্ট হয়। এই প্রসঙ্গে আরও দুইটি বিষয় আলোচিত হওয়া আবশ্যক। একটি হচ্ছে দার্শনিক দিক। অপরটি হচ্ছে অর্থনৈতিক দিক।
বাংলার গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের মধ্যে সহজিয়া মতবাদ যে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করছিল সে কথা আগেই বলা হয়েছে। জনগণ ধর্ম প্রচারকদের সুফি মতবাদের সঙ্গে সহজিয়া মতবাদের সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছিল। তাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণে মনের দিক থেকেও তাদের কোনো বাধা ছিল না। বাংলার লোকায়েত সমাজে প্রচলিত দর্শন এই ক্ষেত্রে ইসলামের বিস্তারকে সহজতর করেছিল। এই দর্শনটি ছিল বেদ বিরোধী এবং তার প্রকাশ ঘটেছিল ‘সহজিয়া’ ধর্মের মধ্যে। সহজিয়া দর্শনের স্বীকৃতি এসেছিল অষ্টম শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল বংশের রাজত্বকালে। ‘সহজিয়া’ মতবাদ কেবল বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপার ছিল না। বাংলার হিন্দু সমাজেরও এক বড় অংশের মধ্যে তার প্রভাব ছিল।
সহজিয়া ঐতিহ্যের দুইটি ধারা প্রকাশিত হয়েছিল—সগুণ ও নির্গুণ। বৈষ্ণব সহজিয়া ভক্তিবাদের প্রকাশ ঘটেছিল সগুণ ধারায় যার শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন শ্রীচৈতন্য দেব ও চণ্ডীদাস। আর নির্গুণ সহজ পথের পথিক হলেন বাউল সাধকরা। চৈতন্যদেব ও চণ্ডীদাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামাজিক অবদান হলো ব্রাহ্মণ্য ধর্মের জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ। তবে বৈষ্ণব সাধকদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান সত্ত্বেও তাদের সহজ পন্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সীমিত থাকলো রাধা ও কৃষ্ণের লীলার জয়গানে।
অন্যদিকে নির্গুণ বাউল সাধকরা অধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন। ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভই তাদের দর্শন চেতনার মূল বিষয় ছিল। তবে তারা ঈশ্বরকে খুঁজেছেন চৈতন্যের গভীরে, মনের মানুষ রূপে। সেই জন্য বাউল সাধকরা ছিলেন মানবিক। তাদের সংগীতে যত না আধ্যাত্মিকতার বিষয় রয়েছে, তার চেয়ে বেশি রয়েছে মানবিকতার স্পর্শ। বাউল সাধকদের এই ঐতিহ্যই সুফিবাদী ইসলামী মতবাদকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। সূফীবাদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা থাকলেও মানবিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল।
মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের এক মহৎ কাজ বাউল গনের সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৭ সালে ‘হারামনি’ নামে। সেই সংকলনের ভূমিকা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন—“আমাদের দেশে যারা নিজেদের শিক্ষিত বলেন তারা প্রয়োজনের তাড়নায় হিন্দু-মুসলমানের মিলনের নানা কৌশল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অন্যদেশের ঐতিহাসিক স্কুলে তাঁদের শিক্ষা। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেছে। বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি—এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েছে, অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা-সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি, এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু-মুসলমানের কণ্ঠ মিলেছে। কোরান-পুরাণে ঝগড়া বাঁধেনি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদ-বিরোধে বর্বরতা। বাঙলা দেশের গ্রামের গভীর চিত্তে উচ্চ সভ্যতার প্রেরণা স্কুল কলেজের আগোচরে আপনা-আপনি কিরকম কাজ করে এসেছে, হিন্দু ও মুসলমানের জন্য এক আসন রচনার চেষ্টা করেছে, এই বাউল গানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়।”
বাংলার বাউল ও উত্তর ভারতের সুফি সাধকদের মধ্যে অনেক মিল পাওয়া যায়, যারা ধর্মীয় সমন্বয়ের গান গেয়েছেন। উত্তর ভারতেও অনেকে সুফি সাধকদের মাধ্যমে লোকায়ত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
এই প্রসঙ্গে তাঁতি সম্প্রদায়ের মুসলিম সাধক কবীরের কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যাক। হিন্দুস্তানি ভাষায় বাধা গান বঙ্গানুবাদ করে নিচে উদ্ধৃত হলো।
“খোদা যদি মসজিদেই বাস করেন তবে বাকি জায়গাটা কার? তীর্থে মূর্তিতেই যদি রাম থাকে তবে তার বাইরে বিস্তীর্ণ সমাজটা দেখে কে?”
“আমাকে যদি হিন্দু বলতে চাও, তবে আমি হিন্দু নই। আমি মুসলমানও নই। তবে কী আমার পরিচয়? পাঁচ তত্ত্বের এই শরীর, তার মধ্যে অনির্বচনীয় নিগূঢ় পুরুষ করছেন লীলা, এই পরিচয় ছাড়া আর কী বলতে পারি?”
আবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বাংলাদেশের লোকসমাজে যে দার্শনিক পরিবেশ ছিল, তাতে সুফি মতবাদী ইসলাম ধর্ম খুব সহজে জায়গা করে নিতে পেরেছিল।
ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্ম ইসলামকে ম্লেচ্ছ অথবা শত্রুভাবাপন্ন ধর্ম হিসাবে দেখে থাকলেও সহজিয়ারা ইসলাম ধর্মকে সেভাবে দেখেনি। তাই বাঙালি গরিব কৃষকের মনকে সহজেই টানতে পেরেছিল উদারপন্থী সুফিবাদী ইসলাম ধর্ম।
একইভাবে শরীয়ত পন্থী কট্টর মোল্লাতন্ত্র হিন্দু ধর্মকে যেভাবে শত্রুতার মনোভাব নিয়ে দেখে, সুফি সাধকদের সহিষ্ণু মানোভাবের সঙ্গে তার দুস্তর তফাৎ ছিল। সুফি দর্শনের সঙ্গে মত বিনিময় প্রসঙ্গে সহজিয়া সাধকদের মধ্যেও পার্থক্য ছিল। নির্গুণ সহজিয়ারা অর্থাৎ বাউলরা যতটা সুফিদের প্রসঙ্গে সহিষ্ণু ছিলেন, সগুণ সহজিয়ারা অর্থাৎ বৈষ্ণবরা ততটা উদার ছিলেন না।
এবার ইসলাম ধর্ম বিস্তারের কারণ অনুসন্ধানে অর্থনৈতিক দিকটা দেখা যাক। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে গঙ্গানদীর মূল স্রোত গঙ্গার শাখা পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়। ফলে বাংলার জনপদের সাথে উত্তর ভারতের সংযোগ সহজতর ও অধিক বিস্তৃত হয় জলপথের মাধ্যমে। আগে গঙ্গার নদীর পানি প্রধানত ভাগিরথী দিয়ে প্রবাহিত হতো। এর ফলে বাংলায় ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। তুর্ক-আফগান যুগের শেষ পর্বে এবং মুঘল রাজত্বের প্রথম পর্বে অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দী থেকে বাংলার সমাজে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটে। এই ঘটনাটির সঙ্গে ইসলাম ধর্মের প্রসারের বিষয়টি যুক্ত ছিল কীভাবে?
এই সময় একদিকে যেমন শাসনকর্তাদের কাছ থেকে অধিক রাজস্ব আদায়ের চাপ তৈরি হয়েছিল, অন্যদিকে তারই প্রয়োজনে অথবা জীবিকার প্রয়োজনে জঙ্গল কেটে নতুন জমি উদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় পূর্ব বঙ্গেই জলা-জঙ্গল বেশি ছিল। তাই জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষি জমি উদ্ধারের ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়েছিল পূর্ব বঙ্গে অর্থাৎ সেই অঞ্চলে, যা আজ বাংলাদেশ নামে পরিচিত। তাই দেখা যায়, রাজস্ব আদায়ের বৃদ্ধির হার পূর্ব বঙ্গেই বেশি ছিল। ১৫৯৫ থেকে ১৬৫৯ সালের মধ্যে অর্থাৎ অর্ধশতাব্দীকালের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় এই বৃদ্ধির হার ছিল ১১৭ শতাংশ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় তা ছিল ৫৪ শতাংশ।
এই অর্থনৈতিক দিকটি কীভাবে ইসলাম ধর্ম বিস্তারের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল তা জানা যায় ঐতিহাসিক অতীশ দাসগুপ্তের নিম্নোক্ত গবেষণালব্ধ বিবরণ থেকে।
“রাজস্ব সংগ্রহের বর্ধিত মূদ্রা অর্জনের জন্য জমির সন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন হলো কৃষি কর্মে উৎসাহী নতুন নেতৃত্বের তত্ত্বাবধানে পরিশ্রমী কৃষক শ্রেণির, যারা স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্বন্ধে অভিজ্ঞ। এই আর্থিক তাগিদ যে সম্ভাবনা সৃষ্টি করল তার বিভিন্ন অভিমূখ ছিল। উৎসাহী নেতৃত্ব দিতে যারা এগিয়ে এলেন তাদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান উভয় ধর্মাবলম্বী মানুষই ছিলেন। যা লক্ষণীয় তা হলো, উৎসাহী হিন্দুদের অধিকাংশ ছিলেন উচ্চ বর্ণের বর্হিভূত, আর উৎসাহী মুসলমানদের বেশিরভাগই শরীয়ত পন্থী ছিলেন না, তাদের আনুগত্য ছিল বিভিন্ন সুফি সম্প্রদায়ের সঙ্গে। এদের নেতৃত্বে পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নিম্ন বর্ণের কৃষক সমাজভুক্ত বিশাল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ সাড়া দিলেন জঙ্গল সাফ করে কৃষি জমি সম্প্রসারণের অভিযানে। এদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্মাবলম্বী বেশ কিছু উদ্যোগী মানুষ। তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল সুফি সম্প্রদায়ভূক্ত মুসলমান নেতৃত্বের। তার ফলস্বরূপ যে বিশাল সংখ্যক কৃষক পূর্ববঙ্গে এদের ডাকে সাড়া দিয়েছিল, তাদের অধিকাংশ সুফি মতামতের প্রভাবের মধ্যে আসতে শুরু করলেন। তুর্ক-আফগান-মুগল শাসকরা কিন্তু এই প্রভাব আরোপিত করেননি। এটি হলো আর্থিক তাগিদের আরেকটি অভিমুখ বা বৈশিষ্ট।”
Chapter 2, Palashi theke muktizuddha (1st Part) Writen by Haider Akbar Khan Rano
Feature Image: itibritto.com