পলাশীর যুদ্ধ থেকেই আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছি। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রথমে বাংলা দখল করে, পরে ক্রমে ক্রমে সারা ভারত দখল করেছিল। ১৭৫৭ এর পলাশীর যুদ্ধ থেকে ১৯৪৭ এর ভারতের স্বাধীনতা লাভ—এই সময়কালকে যদি ইংরেজের রাজত্বকাল ধরি, তাহলে সেটা হবে ১৯০ বৎসর। (১৯৪৭ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ চলে গেলেও আমরা অরেক ধরনের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছিলাম। পাকিস্তানের এক ধরনের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিলাম। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম।) আমরা এখানে বৃটিশ যুগের কথাই আলোচনা করছি। ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ এই একশত বৎসর আমরা ছিলাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীন। ভাবতে অবাক লাগে যে, আমাদের শাসক ছিল একটি বাণিজ্যিক কোম্পানী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৫৭ সাল থেকেই শাসকে পরিণত হয়েছিল। যদিও নামে অন্য কেউ যথা মীর জাফর, মীর কাশিম প্রমুখ নবাব হয়েছিল। তাদের নবাব বানিয়েছিল কোম্পানী। ১৭৬৫ সালে তারা সর্বপ্রথম দিল্লীর বাদশাকে কিছু রাজস্ব প্রদানের পরিবর্তে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজত্ব দখল করে।
১৮৫৭ সাল থেকে আমরা সরাসরি বৃটিশ রাজার কলোনীতে পরিণত হলাম। ১৮৫৭ সালেও মহান সিপাহী বিদ্রোহের সময় পর্যন্ত দিল্লীর লাল কেল্লায় বাস করতেন মোগল শাসকদের বংশধর। নামে সম্রাট হলেও তার শাসন ক্ষমতা দিল্লী শহর পর্যন্তও ছিল না। তবু নামকেওয়াস্তে তিনি ছিলেন দিল্লীর বাদশা। দিল্লীর শেষ স্বাধীন বাদশাহর নাম বাহাদুর শাহ। ১৮৫৭ সালে সিপাহী অভ্যুত্থান বা ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ পরাজিত হলে তিনি ইংরেজদের হাতে বন্দী হন। স্বাধীন ভারতের প্রতীক চিহ্নটুকুও মুছে গিয়েছিল।
যাই হোক আমরা আলোচনার সুবিধার্থে বৃটিশ রাজত্বকালকে অখন্ড ১৯০ বৎসর ধরেই আলোচনায় অগ্রসর হব। প্রায় দুইশত বৎসর ধরে বৃটিশরা আমাদের নির্মমভাবে শোষণ করেছে, যা ছিল খুবই বর্বর ও নিষ্ঠুর। তবে অর্থনৈতিক শোষণের রূপ একেক যুগে একেক রকম ছিল। শাসক ইংরেজরা ছিল পুঁজিবাদী বা বুর্জোয়া। ইতিপূর্বে ভারতবর্ষে অন্যান্য যারা বাইরে থেকে আক্রমণ করেছিল, তাদের সঙ্গে ইংরেজদের এটা ছিল মৌলিক পার্থক্যের বিষয়।
ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রক্ষমতায় যে বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল, এই দুইশ বৎসরে তাদেরও অনেক পরিবর্তন হয়। প্রথমে ছিল বাণিজ্য পুঁজির যুগ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছিল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যারা ভারত ও প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে দ্রব্য ক্রয় করে ইউরোপে বিক্রি করত। বাণিজ্য পুঁজির যুগেই তারা ভারতকে কলোনী বানিয়েছিল। এই সময়কালেই আদিম পুঁজির সঞ্চয় হয়েছিল। ১৭৫৭ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত ছিল বাণিজ্য পুঁজির যুগ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বৃটেন শিল্প পুঁজির যুগে প্রবেশ করে। তখনও ভারত বৃটিশের দখলে ছিল। এই সময় বৃটেনে শিল্প বিপ্লব সম্পন্ন হয় এবং এক শ্রেণির শিল্প-কলকারখানার মালিকের অভ্যুদ্বয় ঘটে, যারা কার্যত বৃটেনের শাসন ক্ষমতা দখল করে। তাদের লক্ষ্য ছিল ভারতকে তাদের শিল্পজাত পণ্যের বাজারে পরিণত করা। অতএব সেই যুগের শোষণ পদ্ধতিও আগের চেয়ে ভিন্ন হবে। আরও পরে ইংল্যান্ডে একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ হয় যখন শিল্প ও ব্যাংক পুঁজির একত্রীকরণ ও একচেটিয়াত্বের উদ্ভব ঘটে। এই সময় বৃটেন কলোনীতে পুঁজি পাচারও করে অধিকতর মুনাফার জন্য। এই তৃতীয় স্তরটিকে লেনিন ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। কালপর্ব হিসেবে ভাগ করলে আমরা বলতে পারি ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত বাণিজ্য পুঁজির যুগ এবং ভারতবর্ষ বাণিজ্য পুঁজির কলোনী ছিল। ১৮৫৭ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি ভারতবর্ষ বৃটেনের শিল্পপুঁজির কলোনী ছিল। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষ বৃটেনের সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির কলোনী ছিল। এবার আমরা দেখব কোন যুগে শোষণের ধরন কেমন ছিল।
বাণিজ্য পুঁজির যুগ
বাণিজ্য পুঁজির যুগেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং তারা ভারতে একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার লাভ করেছিল। অবশ্য ভারতে ইউরোপের অন্যান্য দেশের এই ধরনের কোম্পানী ব্যবসা করত। ফরাসি, ওলন্দাজ (নেদারল্যান্ডস) ও পর্তুগীজ। এর মধ্যে ইংরেজরাই অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী দেশ দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। ফরাসি ও পর্তুগিজদের দখলেও ছিটেফোঁটা কলোনী ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর লক্ষ্য ছিল সস্তায় ভারতীয় পণ্য ক্রয় করে ইউরোপে বিক্রি করা। রাজত্ব লাভের পর তাদের প্রচেষ্টা ছিল কত সস্তায় বাংলা তথা ভারত থেকে এই দেশের শিল্পজাত পণ্য যথা মসলিন কাপড়, সিল্ক কাপড়, সুতি কাপড় ও অন্যান্য জিনিস কেনা যায়। এই পর্যায়ে তাদের শোষণের ধরণটি ছিল জোরজবরদস্তি করে বাঙালি তাঁতিদের কাছ থেকে নগণ্য দামে জিনিস ক্রয় করা। এর সঙ্গে যুক্ত হলো অতিরিক্ত খাজনা আদায় করা। শোষণের পদ্ধতিটা ছিল খুবই বর্বর। এটাই ছিল বৃটিশ পুঁজির জন্য আদিম সঞ্চয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই ধরনের লুণ্ঠনের কারণেই দেখা দিয়েছিল ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ (ছিয়াত্তরের মন্বন্তর)।
বাণিজ্য পুঁজির যুগের উপনিবেশের ও লুণ্ঠনের ধারাটিকে বিশ্ব বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ বলেছিলেন, “পুরানো ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা”।
শিল্প পুঁজির যুগের কলোনী
ভারত থেকে লুণ্ঠিত অর্থ সম্পদ দিয়েই ইংল্যান্ডে পুঁজির বৃদ্ধি ঘটে। ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটার ক্ষেত্রে ভারতের অবদান ছিল অনেক। ভারত ও অন্যান্য কলোনীর লুণ্ঠন, আফ্রিকা থেকে মানুষ শিকার ও দাস ব্যবসা এবং আমেরিকা মহাদেশ লুণ্ঠন—এইভাবে বৃটিশ শিল্প পুঁজির ভিত্তি তৈরি হয়েছিল। এখন বৃটিশ শিল্পের মালিকরা বিশেষ করে কাপড় ও সুতাকলের মালিকরা আর ভারত থেকে কাপড় আমদানিতে আগ্রহী নয়, বরং তারা ভারতের শিল্পকে ধ্বংস করে তাদের মিল কলকারখানার বাজার করতে চেয়েছিল। শিল্প পুঁজির সঙ্গে আগের বাণিজ্য পুঁজির দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল ইংল্যান্ডে। তার প্রতিফলনে দেখা যায়, ইংল্যান্ডে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে, কোম্পানীর দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু হয়েছিল। বার্ক প্রমুখ রাজনীতিবিদ কোম্পানীর বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতেন। কোম্পানীর লুন্ঠন ব্যবস্থার সবচেয়ে কঠোর সমালোচক ছিলেন পুঁজিতন্ত্রের তাত্ত্বিক অ্যাডাম স্মিথ। তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া ব্যবসারও বিরোধিতা করেছিলেন। ১৮১৩ সালে কোম্পানীর একচেটিয়া ব্যবসার সনদ উঠে গেল। কিন্তু কোম্পানীর শাসন অব্যাহত ছিল সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত (১৮৫৭)।
শিল্প পুঁজির যুগে আরম্ভ হলো শোষণের আরেক ধরন। আগে বৃটিশ বণিকরা ভারত থেকে কাপড় কিনত এবং ইউরোপে বিক্রি করত। এখন হলো উল্টো ব্যবস্থা। বৃটিশ কারখানায় তৈরি কাপড় ভারতে বিক্রি করতে হবে। আগে ভারত ‘পৃথিবীর কারখানা’ রূপে খ্যাতি অর্জন করেছিল। এখন ভারত ক্রমান্বয়ে শুধুই কৃষিপ্রধান দেশে পরিণত হলো। পরিকল্পিতভাবে ভারতের তাঁত ও অন্যান্য শিল্প ধ্বংস করা হলো। অন্যদিকে ইংল্যান্ড হয়ে উঠলো ‘পৃথিবীর কারখানা’।
বাণিজ্যপুঁজির যুগে ভারত থেকে বৃটেনে কাপড় যেত। এই যুগে তা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে। নিচের পরিসংখ্যান থেকেই বিষয়টি বোঝা যাবে। ভারত থেকে বৃটেনে রপ্তানিকৃত কাপড়ের টুকরো—
১৮১৪ সাল—১২ লক্ষ
১৮৩৫ সাল—৩ লক্ষ
১৮৪৪ সাল—৬৩ হাজার
অন্যদিকে বৃটেনের কাপড়ের মিলে তৈরি কাপড় ভারতে আমদানি হয়েছিল—
১৮১৪ সালে—১০ লক্ষ গজ
১৮৩৫ সালে—৫১০ লক্ষ গজ
বৃটেনের সুতোকলে তৈরি সুতো বৃটেন থেকে ভারতে আমদানির পরিমান এই সময়ে (১৮১৮ সাল থেকে ১৮৩৬ সাল) বৃদ্ধি পেয়েছিল ৫২০০ গুণ।
এইভাবে বৃটেন হলো শিল্পজাত পণ্যের (কাপড় অথবা সুতো) উৎপাদনকারী এবং ভারত তার বাজার। অন্যদিকে ভারত হয়ে উঠল কাঁচামালের সরবরাহকারী। যেমন বৃটেনের সুতোকল ও কাপড়ের মিলের জন্য ভারত থেকে বৃটেনে তুলা রপ্তানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেল। নিচের পরিসংখ্যান থেকেও তা বোঝা যাবে।
ভারত থেকে বৃটেনে তুলা রপ্তানির পরিমাণ—
১৮১৩ সালে—৯০ লক্ষ পাউন্ড (ওজনে)
১৮৪৪ সালে—৮৮০ লক্ষ পাউন্ড (ওজনে)
১৯১৪ সালে—১৬৩০ লক্ষ পাউন্ড (ওজনে)
পশমের জন্য কাঁচামাল ভারত থেকে বৃটেনে রপ্তানির পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৮৩৩ সালে যা ছিল ৪০০০ (চার হাজার) পাউন্ড (ওজনে) তা ১৮৪৪ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ লক্ষ পাউন্ডে (ওজনে)।
ভারত থেকে খাদ্য শস্যের রপ্তানি (বৃটেনে) ঠিক একইভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
১৮৪৯ সালে ছিল ৮ লক্ষ পাউন্ড (মুদ্রায়)
১৮৭০ সালে ছিল ৭৯ লক্ষ পাউন্ড (মুদ্রায়)
১৯১৪ সালে ছিল ১৯৩ লক্ষ পাউন্ড (মুদ্রায়)
এমনিতেই আধুনিক যন্ত্রশিল্পে উৎপাদিত কাপড় সুতো ইত্যাদি পণ্যের দাম সস্তা হবে এবং তার সঙ্গে তাঁত ইত্যাদি কুটির শিল্প টিকে থাকতে পারে না। পারেওনি। ওপরন্তু বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের শিল্পজাত পণ্যের বাজার নিশ্চিত করতে তাঁতীদের আঙ্গুল কেটে দিয়েছিল। বিশেষ করে ঢাকার মসলিন কাপড় উৎপাদনকারীদের। অতএব শিল্পপুঁজির যুগেও সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও অত্যাচার একইভাবে বর্বর রয়ে গিয়েছিল। তাছাড়াও বৃটিশ সরকারের শুল্কনীতি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে বৃটিশ শিল্পপতিদের জন্য সহায়ক হয়। যথা, ১৮৩৬ সালে বাংলায়, ১৮৩৮ সালে বোম্বাই(বর্তমানে মহারাষ্ট্র) এবং ১৮৪৪ সালে মাদ্রাজে (বর্তমানে তামিলনাড়ু) উৎপন্ন কাঁচা তুলা ইংল্যান্ডে রপ্তানির জন্য যে শুল্ক ছিল, তা রহিত করা হয়েছিল।
এই কালপর্বে ভারতে নীল চাষ প্রবর্তন করে ইংরেজ বণিকরা, যা ইংল্যান্ডের কাপড় শিল্পের জন্য প্রয়োজন ছিল। ১৮৩১ সালে শুধু বাংলাতেই ৩০০ থেকে ৪০০ নীলকুঠি ছিল যার মালিক ছিল ইংরেজরা। নীলকুঠিতে যেসব ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ ছিল তাদের অত্যাচার ছিল নির্মম ও বর্বর। তারা কৃষকদের নীলচাষ করতে বাধ্য করত এবং দাম কম দিত। তাছাড়া দৈহিক অত্যাচারও যুক্ত ছিল। নীলকুঠির ইংরেজ মালিকদের অত্যাচারের ওপর ভিত্তি করে দীনবন্ধু মিত্র যে নাটক লিখেছিলেন “নীলদর্পণ”, তা ছিল ইতিহাস বিখ্যাত। নীলদর্পণ নাটক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। নীল চাষীদের বিদ্রোহ উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ফিন্যান্স পুঁজির যুগ
ইংল্যান্ডসহ সমগ্র পুঁজিবাদী জগতে এক পর্যায়ে শিল্পপুঁজি ও ব্যাংক পুঁজির মিলন ঘটে এবং একচেটিয়া পুঁজিতন্ত্রের আবির্ভাব হয়। অর্থাৎ একই পুঁজিপতি (পুঁজিপতি কোম্পানী বা পুঁজিপতি গোষ্ঠী) একই সঙ্গে হয়ে বসল শিল্প ও ব্যাংকের মালিক। স্বল্পসংখ্যক কোম্পানী গোটা অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ রতো। এই যুগকেই লেনিন বলেছেন ফিন্যান্স পুঁজির যুগ এবং সেটাই হলো লেনিনের মতে সাম্রাজ্যবাদী যুগ।
ভারতবর্ষ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কলোনী ছিল বাণিজ্য পুঁজি, শিল্পপুঁজি এবং ফিন্যান্স পুঁজির যুগে। অর্থাৎ পুঁজিবাদের তিন যুগেই আমরা বৃটেনের কলোনী ছিলাম। ফিন্যান্স পুঁজির যুগটি শুরু হয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে। ফিন্যান্স পুঁজির যুগের একটা বৈশিষ্ট হলো উপনিবেশ বা অনুন্নত দেশে পুঁজির রপ্তানি, কারণ তাতে অধিকতর মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। কলোনীতে শ্রমশক্তি সস্তা, কাঁচামাল সস্তা ও সহজলভ্য, জমিও সস্তা। তাই এই যুগে পুঁজির রপ্তানি একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য লাভ করে। কিন্তু কলোনীতে পুঁজিবাদ বিকাশ লাভ করুক, এটা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদীরা চায় না। তাই ভারতীয় পুঁজির বিকাশ তারা ঠেকাতে চেয়েছিল নানাভাবে।
বৃটিশ পুঁজি এদেশে এসেছিল মুনাফা লুট করে নিতে, দেশকে শিল্পায়িত করতে নয়। এই পুঁজি লেগেছিল সরকারকে প্রদত্ত ঋণের আকারেও। রেলপথ নির্মাণ, টেলিগ্রাফ নির্মাণ, খনি ও কাঁচামাল প্রসেসিংয়ের জন্য এই পুঁজি ব্যয়িত হয়েছিল। ১৮৫৮ সালে বৃটিশ সরকার যখন সরাসরি ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেছিল তখন বৃটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছ থেকে ৭০০ লক্ষ পাউন্ড ঋণ গ্রহণ করেছিল। বলাই বাহুল্য এই ঋণের বোঝা আসলে চেপেছিল ভারতের জনগণের কাঁধে।
১৯১৯ সালে ভারত ও সিংহলে (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) নিয়োজিত বৃটিশ লগ্নি (ফিন্যান্স) পুঁজির পরিমাণ ছিল ৩৬৫০ লাখ পাউন্ড। তার মধ্যে কোন শিল্পে বা খাতে কত ব্যয় হয়েছিল তার একটা বিবরণ পাওয়া যায় স্যার জর্জ পেইস কর্তৃক প্রদত্ত চার্ট (নিম্নে প্রদত্ত) থেকে—
দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভবইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী অথবা বৃটিশ সরকার চায়নি যে, ভারতে বুর্জোয়া বিকাশ ঘটুক। তবু উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভারতেও বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। ১৮৫১ সালে ‘বোম্বাই উইভিং এ্যান্ড স্পিনিং কোম্পানী’র উদ্যোগে ভারতে প্রথম কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠিত হয় যা কাজ শুরু করে ১৮৫৫ সাল থেকে। ১৮৭২-৭৩ সালের দিকে বোম্বাইতে ১৮টি এবং বাংলায় দুইটি কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের বুর্জোয়ারা বৃটিশ শিল্প বুর্জোয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে কি না, এই ভয়ে বৃটিশ বুর্জোয়ারা তাদের সরকারকে দিয়ে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করায়। ভারতে বিলাতি কাপড় আসার পথে যে আমদানি শুল্ক ছিল, তা বাতিল করা হয় ১৮৮২ সালে। অন্যদিকে ভারতে প্রস্তুত কাপড়ের ওপর নতুন এক কর (excise duty) বসানো হলো।এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ তথা ভারতে দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেণির আগেই শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল। বৃটিশরা যে রেলওয়ে স্থাপন করেছিল সেই নির্মাণ কাজে এবং পরবর্তীতে রেলওয়েতে কর্মরত শ্রমিকরাই ছিল এদেশের প্রথম শ্রমিক শ্রেণি। ১৮৬২ সালেই পরাধীন ভারতে কোলকাতার নিকটে হাওড়ার ১২০০ রেলশ্রমিক আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে কয়েকদিন ধর্মঘট পর্যন্ত করেছিলেন। সেই খবর আবার ছাপা হয়েছিল “সোমপ্রকাশ” নামক পত্রিকায়, যে পত্রিকার সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যুক্ত ছিলেন।উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে চা বাগান, কাপড়ের মিল ও জুট মিল (চটকল) গড়ে উঠেছিল। চা বাগানগুলো ছিল প্রধানত ইউরোপীয় মালিকানাধীন। বস্ত্রশিল্পের ৯৯ শতাংশ পুঁজি ছিল ভারতীয়। আর চটকলে ইউরোপীয় কর্তৃত্বই প্রধান ছিল।১৯০৫ সালে ভারতে মোট ফ্যাক্টরির সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ২৬৮৮টি। শিল্পে নিয়োজিত ভারতীয় পুঁজির মধ্যে বাঙালির অংশ ছিল নগণ্য আর বাঙালি মুসলমান পুঁজিপতি কেউ ছিল না। ১৯০৫ সালে ভারতীয় পুঁজি নিয়ে গঠিত ব্যাংকের সংখ্যা ছিল ৯ টি। ১৯০৭ সালে প্রথম ভারতীয় মালিকানাধীন লৌহ ও ইস্পাত শিল্প গড়ে উঠেছিল—“টাটা আয়রণ এ্যান্ড স্টীল কোম্পানী”।বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে লড়াই করেই ভারতীয় পুঁজি বিকাশ লাভ করেছিল। অন্যদিকে বাংলার তথা ভারতের শ্রমিকদের দ্বন্দ্ব ছিল বৃটিশ পুঁজি ও ভারতীয় পুঁজি—উভয়ের সঙ্গে। ১৯২১ সালের হিসেব অনুযায়ী ভারতের শ্রমিক সংখ্যা ছিল মোট ১,৫৭,০০,০০০।
Chapter 5, Palashi theke muktizuddha (1st Part) Writen by Haider Akbar Khan Rano
Feature Image: itibritto.com