উদাস মনে দরদ দিয়ে কোথায় একা বুড়ো সুর ভাঁজছে, "ও আমার উড়ালপঙখী রে.."
খটখটে শুকনো দুপুর৷ কেমন শ্যাওলা ধরা প্রাচীন এক পুকুরের মতো, খুব নিস্তব্ধ একটা অনুভূতি৷ বড় দরদ দিয়ে গাইছে বুড়ো, মন হু-হু করা গানের সুরে ফুঁপিয়ে উঠছে থেকে থেকে৷
আমি বুক ভরে নি:শ্বাস নেই, গ্রামের বাতাসে কেমন আপন একটা গন্ধ, অনুভব করতে পারি প্রতি শ্বাসকণায়৷ ধূলোমলিন আবরণে হাঁটছি আদুল পায়ে, অবশ্য তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই আমার৷ এ মাটিতে আবর্জনা নেই, বিষ নেই, আছে কেবল আদিমতার সুবাসে মাখা ধূলি কাদা৷
কতো প্রাচীন এই গ্রাম? "আড়াইশো বছর তো হবেই৷ তিনশো'ও হতে পারে৷'' ভাবলাম আমি৷
পোকা বিল..সোনা বিল..জারুই নদী.. সব মজিরখিল পেরিয়ে উত্তরে৷ মজিরখিলে আমার আদি নিবাস৷ আমার গ্রাম৷
জনশ্রুতি আছে মজু ভুঁইয়া নামে এক আরব বণিক বাংলার বুকে বাণিজ্য করতে এসে এই মাটি, এই মানুষদের ভালবেসে ফেললেন৷ সাথীরা সবাই গেল ফিরে, তিনি একা রয়ে গেলেন সহজ-সরল বাংলার মানুষগুলোর টানে৷ বিয়ে-থা করে সংসার পাতলেন৷ সেই দিলখোলা বিদেশি মানুষটির নামেই হলো গ্রামের গোড়াপত্তন- " মজিরখিল"
নামের মতোই শান্ত, নিরিবিলি, স্নিগ্ধ আমাদের গ্রাম৷ ছিমছাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়টা বাড়ি, ফাঁকা মাঠ পেরিয়ে পুরাতন মসজিদ, দূর দিগন্ত ছোঁয়া ছবির মতো সবুজ ফসলের ক্ষেত, সারি সারি গাছ, উঠানে মাচায় হরেকরকম লতা-পাতা সবজি, একটু দূর এগোলে সীমানায় ফ্যাকাসে সাদা মেঠো পথ৷ এই বেশ ছিমছাম মজিরখিল৷ মানুষগুলোও ভারী শান্তিপ্রিয়, নির্বিবাদী৷ দুপুরের এই সময়টা এতো আশ্চর্য নীরব সবকিছু! মনে হয় যেন জনমানব নেই এই গ্রামে একটিও৷ সবাই যেন অঘোর ঘুমে কাতর, নিস্পৃহ৷ অথচ ইন্দ্রিয় একটু সজাগ থাকলেই বুঝতে পারবেন সতর্ক, নীরব অনেক জোড়া চোখ অনুসরণ করছে আপনাকে, আপনার প্রতিটা ধাপ.. প্রতিটা নি:শ্বাস..
গ্রাম বাংলার এই এক বৈচিত্র্য- প্রকৃতি আপনার চোখে ধরা দেবে এক রকম, গভীরে গেলে উপলব্ধি করবেন সবকিছু আসলে কতো অচেনা৷ চৌষট্টি হাজার গ্রামের পরতে পরতে কতো রহস্য লুকিয়ে আছে- আপনার সাদা চোখে তা কোনদিন ধরাও পড়বে না৷ সুপ্রাচীন বটবৃক্ষের মতো প্রকৃতির হৃদয়ে প্রোথিত সে রহস্য, প্রাচীন শ্যাওলার মতো প্রবঞ্চক- চোখের সামনেই আছে, কিন্তু দৃষ্টি এড়িয়ে যায় সবসময়৷ আজ আমি এমনই এক রহস্যের সন্ধানে আছি৷
হনহন করে হেঁটে চলেছি আমি৷ স্কুলের পুকুরপাড় পেরিয়ে কোণায় হালিমদের বাড়ি, টের পাই বেড়ার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে কতোগুলো কৌতূহলী চোখ, খেলা থামিয়ে তাকিয়ে আছে ইকলি-মিকলি বাচ্চাগুলো৷ অনেকদিন পর বাড়ি এসেছি তো!
ডানে বাঁক নিলে সোজা ক্ষেত পেরিয়ে অনেকদূর মেঠো পথ- তারপর গ্রামের সীমানায় বাজার৷ বাজার পেরিয়ে আরো মিনিট কুড়ি হাঁটলে তবে আমার গন্তব্য- বিষ্ণুপুর৷
আপাতদৃষ্টিতে আর দশটা গ্রামের সাথে তেমন আহামরি কোন পার্থক্য পাবেন না বিষ্ণুপুরের, বেশ মামুলী একটি জায়গাই মনে হবে৷ কিন্তু ভেতরে ভেতরে কী এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য ধারণ করে চলেছে এ গ্রামের প্রকৃতি তা শুধু অনুভবের ব্যাপার৷
এক বিচিত্র গ্রাম এই বিষ্ণুপুর৷ নানারকম রহস্যে মোড়া এর ইতিহাস৷ বয়সে মজিরখিলের চেয়েও প্রাচীন এ গ্রাম৷ লোকেমুখে শুনি সেই কোন কালে আচারিঘাটের যুদ্ধের পর নাগা জ্যোষিরা শশাঙ্ক থেকে চম্পট দিয়ে এখানে আস্তানা গেড়ে বসে৷ সেখান থেকেই এ গ্রামের পত্তন৷ বয়োজ্যেষ্ঠ বিষ্ণু জ্যোষির নামে হলো নাম বিষ্ণুপুর৷ তখন তো চারপাশে গহীন অরণ্য ছিল এ এলাকায়৷ মেছো বাঘের আনাগোনা হামেশাই দেখা যেত৷ আমার নানার শৈশবেই একবার বাঘ পেটুয়াদের বাড়ি থেকে রাতের বেলা একটি দশ মাসের বাচ্চাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল৷ সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে শিশুটিকে একদম অক্ষত অবস্থায় খালপাড়ে পাওয়া যায়৷
চুপচাপ বসে আছে৷ বাঘের চিহ্নও নেই ধারেকাছে কোথাও৷ শুধু পাড়ের ভেজা নরম মাটিতে পায়ের ছাপ ফুটে আছে স্পষ্ট৷ শিশুটির চারদিকে চক্র করে কয়েক জোড়া বাঘের পায়ের ছাপ৷ লোকে বলে এগুলো সত্যিকারের বাঘ নয়, বহুরূপী৷ কামাখ্যা সাধক৷ এমন আরো কতো কাহিনী যে আছে প্রচলিত..
আমি গ্রামের সীমানায় ঢুকেছি দক্ষিণের রাস্তা ধরে৷ এই দিকে একটু আগালেই গ্রামের নাম করা বিশাল এক বিল- ''পোকা বিল''
এই পোকা বিল নিয়েও লোকেমুখে কতো যে রটনা, কতো কানাঘুঁষা! দুর্নামের শেষ নেই এ বিলের৷
সূর্য পশ্চিম দিকে আলতো করে হেলে পড়ছে৷ আশেপাশে কোন পথিক নেই৷ বিলের এদিকটায় দিনের বেলাতেও মানুষ পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে৷ সূর্যের কড়কড়ে তেজ এখন অনেকখানি কোমল হয়ে এসেছে৷ স্নিগ্ধ সোনালী রোদে বিরান রাস্তা ধরে চলতে চলতে দেখে নিই সেই পোকা বিল৷
আমি যাচ্ছি নিজু মামার কাছে৷ উনার ভাল নাম শেখ নিজাম উদ্দিন সাকা ইস্কান্দার, শুনেছি উনার পূর্বপুরুষরা নওয়াবের সিপাহী ছিল৷ সে গৌরব এখন কোথায় হারিয়ে যাওয়া সোনালী অতীত! নিজু মামা জীবনে তেমন কিছুই করতে পারেন নাই৷ বাউন্ডুলে মানুষ, বিয়ে থা করেছেন বটে কিন্তু তারা নি:সন্তান৷ পথেঘাটে ঘুরে নানারকম কাণ্ডকাহিনী করেই কেটে যায় উনার সময়৷ নিজু মামা বিষ্ণুপুরের এক বিচিত্র চরিত্র৷ তাকে নিয়ে কতোরকম রোমাঞ্চকর, মুখরোচক গল্প যে আছে! মাছ ধরতে খুব ভালবাসে লোকটা৷ এ তল্লাটে এমন কোন খাল, বিল, নদী বাকি নেই যেখানে নিজু মামার পা পড়ে নি৷ জীবনভর মাছ ধরতে ধরতে মানুষটা নিজেও যেন জলের সাথে মিশে গেছে৷ শরীরের চামড়া কেমন সবুজ সবুজ, গা থেকে শ্যাওলা পড়া গন্ধ আসে৷ লোকে বলে "ঐ নাইজ্যা! হারাদিন পানিত নাইমা নাইচ্যা বেড়াস!"
পোকা বিল.. সোনা বিল.. জারুই নদী.. নিজু মামা সারাদিন মোটামুটি এসব জায়গাতেই ঘোরাঘুরি করে, আর নাহলে বাজারে যায় তাড়ির আড্ডার আসরে৷ লোকটা গল্পবাজ আছে, রসিয়ে রসিয়ে দারুণ সব গল্প জমাতে পারে৷
আমি হাঁটতে হাঁটতে এমন কতো কথা যে ভাবছি৷ আমার খুব প্রয়োজন উনাকে৷ কোথাও কাউকে দেখছি না যে একটু জিজ্ঞেস করবো৷ ধু ধু ফাঁকা প্রান্তর৷ জনমানুষের কোন নিশানা দেখা যাচ্ছে না৷ ভারী মুশকিল হলো দেখছি! হাঁটার গতি আরো বাড়িয়ে দিই হনহন করে৷
আমি সেই তখন থেকে উনাকে একটা বিশেষ প্রয়োজনে খুঁজে বেড়াচ্ছি৷ আমি জানি এই কাজটা তাকে ছাড়া হবে না৷ খুব সাহসী মানুষের প্রয়োজন এ কাজে৷ বুকের পাটা লাগে৷ গোটা বিষ্ণুপুর খুঁজেও নিজু মামার মতো বেপরোয়া ডরহীন লোক পাওয়া যাবে না৷ মানুষ বলে, " কথায় আছে- সুখে থাকতে ভূতে কিলায়! আর আমাগো নাইজ্যা নিজেই ভূতরে কিলায়া পাকায়!"
"ধ্যাত!''
আমি হাঁটতে হাঁটতে মনের ভুলে বড়পুকুরের বাঁশঝাড়ের রাস্তায় চলে এসেছি৷ সামনে যে বিরাট বাঁশের ঝাড়টি দেখা যাচ্ছে দূর থেকে বড় অদ্ভুত লাগছে৷ মনে মনে প্রমাদ গুণলাম৷ এ পথে তো আসতে চাই নি৷ সিরাজবাড়ির রাস্তায় আগাবো ঠিক করেছিলাম৷ একটু ঘুরপথ হলেও ও রাস্তাটা নিরাপদ৷ বাঁশঝাড়ের রাস্তায় কিভাবে চলে এলাম বোকার মতো? এখন আবার ফেরত যাওয়াও মুসিবত৷ সময়ে কুলাবে না৷ সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছে৷
রোদের উত্তাপ নেই, তারপরও আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেলো৷ আমাকে যেতে হবে বাঁশঝাড় আর শ্যাওড়া গাছের ঝোপের ভেতর দিয়ে৷ দূর থেকেই কেমন অলৌকিক ভৌতিক একটা আবহ অনুভব করলাম৷ শ্যাওড়া গাছ খুব ঘন৷ সূর্যের আলো গাছের ঝাড় ভেদ করে পৌঁছাতে পারে না ঠিক৷ যার দরুণ জংলা পথটা দিনের বেলাতেও স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে৷ যতো তাড়াতাড়ি এই পথ পেরিয়ে যাওয়া যায় মঙ্গল৷ ঝোপের কাছাকাছি আসতেই কেমন ভ্যাপসা গরম একটা গন্ধ নাকে ঝাপটা মারলো৷ বোঁটকা একটা অনুভূতি, বমি চলে আসে গলায়৷ দিনেদুপুরে এতো আঁধার কেন এ মরার রাস্তায়? আমি বিহবল ভাবে ঘামতে ঘামতে হেঁটেই চলেছি আমার গন্তব্যে৷
বিষ্ণুপুরের এই জংলা বাঁশঝাড় নিয়েও কতো যে গা ছমছমে কাহিনী শুনেছি! এই সংকটের মুহূর্তে সব একের পর এক মনে পড়ে যাচ্ছে! একবার ভুঁইয়া বাড়ির শমসের এমনই এক পড়ন্ত বিকেলে এই বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে যাচ্ছিলো বড়শি দিয়ে বড়পুকুরে মাছ ধরবে বলে৷ হাঁটতে হাঁটতে শমসের হঠাৎ শুনে বাঁশের আগায় কেমন সড়সড় শব্দ৷ কী ব্যাপার এ আবার কেমন শব্দ? শমসের কৌতূহলী হয়ে উপরে তাকালো৷ তাকিয়ে যে দৃশ্য দেখলো শমসেরের ঘাড়ের রোম সরসর করে দাঁড়িয়ে গেলো! হতভম্ব হয়ে দেখে ঝাড়ের একদম উপরে, মাটি থেকে দশ হাত উপরে, ঘন অন্ধকারের ভেতর থেকে পাতিলের মতো বড় হলদে একটা মাত্র চোখ কেমন মিটমিট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে!
এটা দেখে শমসের হতবিহবল হয়ে উন্মাদের মতো দৌড়াতে দৌড়াতে জেলেপাড়ায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো৷ মাঝিপাড়ার লোকরা ওকে ধরাধরি করে তুললো৷ দেখে শমসেরের পুরো শরীরটা, চোখ-মুখ কেমন হলুদ হয়ে আসছে৷ আর মুখ দিয়ে বোবাদের মতো গোঁ গোঁ আওয়াজ বের হচ্ছে..
মাঝিপাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ মেঠুদাদু ঘটনা শুনে গম্ভীর হয়ে মন্তব্য করলেন, "ওই ছাওয়ালরে বংলী ভূত দেখা দিয়াছে৷"
এই "বংলী ভূত'' খুব চিত্তাকর্ষক এক চরিত্র- গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে এরা এক অতিকায় মাছখেকো দানো৷ দিনের বেলায় পানির আশেপাশে বাঁশঝাড়, অন্ধকার জংলা জায়গায় ঘুমিয়ে কাটায়৷ এরা সাধারণত মানুষের কোন ক্ষতি করে না৷ কিন্তু ঘুমানোর সময় কেউ এদের বিরক্ত করলে তা ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে৷
আঁধার নামলে এরা মাছ খেতে নামে৷ প্রায়ই দেখা যায় রাতের বেলা পানির ভেতর কোন কারন ছাড়াই তোলপাড়, শব্দ শোনা যায়৷ এগুলো বংলী ভূতেরই কাজ৷
আরেকটা ঘটনা মাথায় খেলে গেলো৷ এটা বেশ কয়েক বছর আগের কথা৷ সদু কাকার একমাত্র সন্তান পরাণ বিকেলে মাঠে খেলতে গিয়ে হারিয়ে গেলো৷ খেলাশেষে বাচ্চারা সবাই ঘরে ফিরে এসেছে, পরাণের কোন খোঁজ নেই! এতোটুকু বাচ্চা একটা ছেলে, দস্যিপনা করে বটে- কিন্তু একলা জঙ্গলে কই না কই হারিয়ে গেছে- পরাণের মা তো কেঁদেকেটে সারা!
এদিকে উত্তর পাড়ের এক নতুন বউ সেদিন বাঁশঝাড়ের কাছে গরু চরাতে দিয়েছিল৷ নতুন বউ, এতো কিছু তো জানে না বাঁশঝাড়ের দুর্নাম সম্পর্কে৷ শেষ বিকেলের দিকে গরু ঘরে নিতে এসেছে৷ হঠাৎ শুনতে পেলো বাঁশে বাঁশে ঘর্ষণের অদ্ভুত এক শব্দ৷ আর কেমন কড়মড় একটা আওয়াজ৷ বউ হাঁ করে উপরে চেয়ে দেখে- ওহ! কী বীভৎস অমানুষিক এক দৃশ্য! গলা ফাটিয়ে বিকট চিৎকার দিয়ে সেখানেই মাথা ঘুরে পড়ে মূর্ছা গেলো নতুন বউ৷
এদিকে আশেপাশে বেশ কয়েকজন পরাণকে খুঁজছিলো, মেয়ে কণ্ঠের চিৎকার শুনে সবাই তাড়াতাড়ি ছুটে এলো কৌতূহলী হয়ে৷ কিন্তু সেখানে এসে বাঁশঝাড়ের নিচে নতুন বউয়ের অজ্ঞান দেহ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়লো না৷ কী দেখে এমন ভয় পেয়েছে নতুন বউ? মুখ দিয়ে যেন গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে! মানুষজন হন্তদন্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো চিৎকারের কারণ খুঁজে বের করতে৷ বাঁশঝাড় আর জংলা মিলে এমন অন্ধকার কিছু ঠিকমতো দেখাও যায় না; হঠাৎ একজন বাঁশঝাড়ের উপরের দিকে তাকিয়ে কী একটা দেখে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো৷ মুখ দিয়ে ঘড়ঘড় অস্ফুট গোঙানির মতো শব্দ করে লোকটা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো৷ সাথের লোকজন তো হতবাক আবার কী হলো! ঠিক তখন আবছা অন্ধকারে বাঁশঝাড়ের মাথায় বাঁশে বাঁশে ঘর্ষণের সেই অপার্থিব শব্দ আবার ভেসে এলো৷ সাথে সেই অমানুষিক কড়মড় আওয়াজ৷ হাড় থেকে মাংস ছিঁড়ে ফেলার শব্দ৷ সবাই উপরে তাকিয়ে মুহূর্তের ভেতর ভয়ে জমে স্থির হয়ে গেলো৷ বাঁশে বাঁশে প্রচণ্ড ঘর্ষণ আর হুটোপুটির আওয়াজ, ভেতরে যেন কিসের ঝড় বয়ে যাচ্ছে; তারপরই দড়াম করে দশ হাত উপর থেকে প্রচণ্ড বেগে থপথপ করে একটা জিনিস পড়লো৷ সাথে সাথে সবাই পাগলের মতো দৌড় লাগালো ওখান থেকে৷ গ্রামে যখন তারা পৌঁছালো কারো মুখ থেকে কথা বের করা গেলো না কী ঘটনা৷ সবাই আতঙ্কে বোবাদের মতো অস্ফুট আর্তনাদ করছে৷
মাঝিপাড়ার জনগণ সদু কাকার নেতৃত্বে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখে বাঁশঝাড়ের নিচে পড়ে তার আদরের একমাত্র সন্তান পরাণের ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ৷ কোমরের নিচে থেকে শরীরে কোন মাংস নেই৷ হাড়গোড় চূর্ণবিচূর্ণ৷ যেন অতিকায় কোন দানো কোমরের নিচ টুকু কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়েছে তারপর প্রচণ্ড আক্রোশে হতভাগ্য পরাণের দেহটা সজোরে ছুঁড়ে মেরেছে৷ মাথার খুলি ডিমের খোসার মতো ভেঙ্গে মুড়মুড়ে হয়ে গেছে৷ ঘটনার আকস্মিকতায় কারো মুখ থেকে একটা শব্দও বের হলো না৷ তাড়াতাড়ি জীবিত আর মৃত দেহগুলো নিয়ে সেই নারকীয় জায়গা থেকে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসলো সবাই৷
গ্রামে সবাই কৌতূহলে আর আতঙ্কে ফেটে পড়ছে৷ অধীর উৎকণ্ঠায় সবাই অপেক্ষায় ছিলো৷ পরাণের বীভৎস মৃতদেহ দেখে ভয়ে দু:খে কান্নার রোল পড়ে গেলো৷ সবার মনে প্রশ্ন- কি ঘটেছিল শিশু পরাণের সাথে? কি দেখে ওরা এতো ভয় পেয়েছিল?
অনেকক্ষণ পরে যখন মানুষ সৎবিত ফিরে পেলো তখন জানা গেলো ঘটনা- কী দেখেছিল তারা সেই বাঁশঝাড়ে-
ঘটনাটি অদ্ভুত, অবাস্তব, অবিশ্বাস্য৷ তারা সেখানে গিয়ে দেখে পরাণ বাঁশঝাড়ের গায়ে ঝুলে আছে, পুরো শরীর ন্যাংটো, ওর পেছন দিক দেখা যাচ্ছে৷ ওরা ভাবলো ছেলেমানুষ দুষ্টুমি করছে নাকি৷ ধমক দিয়ে বললো পরাণকে নিচে নেমে আসতে৷ ঠিক তখন অদ্ভুতভাবে দুলতে দুলতে পরাণের দেহের সামনের দিক ওদের সামনে এলো- সবাই হতভম্ব হয়ে দেখলো পরাণের মুখ পেট সব থেঁতলে ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে কিছুই চেনার উপায় নেই! পরাণের মুণ্ডুটা প্রকাণ্ড একটা লাল লোমশ হাত আঁকড়ে ধরে আছে, হাতটা এক মানুষ সমান লম্বা তো হবেই৷ কিছুক্ষণ হাতটা পরাণের মুণ্ডু ধুরে ওদের সামনে নাচালো, তারপর অন্ধকারের ভেতর থেকে বিশাল একটা হাঁ কড়কড় করে কামড়ে পরাণের কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত ছিঁড়ে হাড় মাংস আলাদা করে ফেললো৷ তারপর সেই প্রকাণ্ড হাতটা মুখের হাঁ থেকে ছিন্ন ভিন্ন দেহটা বের করে সজোরে ছুঁড়ে মারলো নিচে মাটিতে সমবেত জনতার গায়ের উপর৷ কী অমানুষিক ভয়ংকর বীভৎস সে দৃশ্য!
ধারণা করা হয় শিশু পরাণ হয়তো খেলতে খেলতে দলছাড়া হয়ে বাঁশঝাড়ে এসে পড়েছিল৷ তার দুষ্টুমির কারণে বাঁশঝাড়ে ঘুমন্ত বংলী ভূত বিরক্ত হয়েই এই নির্মম শিক্ষা দেয়৷ সেই থেকে এই পথে কেউ আসার সাহস পায় না৷ বংলী ভূতের আতঙ্ক গ্রামবাসীর মনে ভীষণভাবে গেড়ে বসেছে সেই ঘটনার পর থেকে৷
এই ঘটনাটা মনে পড়তেই আমার মাথাটা দুলে উঠলো কেমন৷ ছমছমে আলো আঁধারির ভেতর দিয়ে হাঁটছি৷ বোঁটকা গন্ধের সাথে বাতাসে ভেসে আসছে বাঁশঝাড়ের মাথায় কেমন অদ্ভুত বিজাতীয় একটা শব্দ৷ বিকট কোন দৈত্য যেন ঘুমের ঘোরে নাক ডাকছে!
আমি শুকনো মুখে অনেকটা চোখ বন্ধ করেই তাড়াতাড়ি হেঁটে চলেছি৷ কোন ভাবেই পেছনে তাকানো যাবে না৷ ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করে কাঁপছে৷ মনে হচ্ছে যেন ঘাড়ের উপর কেউ শীতল শ্বাস ফেলছে- নি:শ্বাসের সাথে বীভৎস মাছ পঁচা গন্ধে নাড়িভুড়ি উল্টে যায়!
আমার মাথাটা আবারও দুলে উঠলো৷ বুকে থু দিয়ে মন শক্ত করে হাঁটতে লাগলাম৷ ভয় পেয়েছি টের পেলেই ভয়ংকর বিপদে পড়ে যাবো আমি৷ পেছনে সেই অপার্থিব বাঁশে বাঁশে ঘর্ষণের শব্দটা ভেসে আসছে৷ প্রচণ্ড আক্রোশে কেউ যেন ফোঁসফোঁস করছে৷ শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আক্রোশ৷
আমি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ থেকে বেরিয়ে আসলাম৷ যতো ভয়ই দেখাক না কেন পেছন ফিরে তাকানো যাবে না৷ হাঁটি হাঁটি পা পা করে সরে যাচ্ছি দূরে.. সেই অভিশপ্ত পথ থেকে অনেক দূরে..
সূর্য এখনও অস্ত যায় নি৷ বাঁশঝাড়ের পথটা এতো অন্ধকার ছিল যে মনে হচ্ছিলো সন্ধ্যা নেমে এসেছে৷ এই তো বাইরে কী সুন্দর ঝলমলে স্নিগ্ধ রোদ! এই তো নিজু মামার কুঁড়ে ঘর দেখা যাচ্ছে৷ ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন হলে উনাকে বাড়িতে পেয়েও যেতে পারি৷ ভেতরে ঢুকে হতাশ হলাম৷ যা আশা করেছিলাম, উনি বাড়িতে নেই৷ মামীকে জিজ্ঞেস করতেই পান খাওয়া দাঁত বের করে একগাল হেসে বললেন,
"কই আর যাইবো হ্যাতেনে? গোলদিঘীর পাড়ে বইসা ভূত কিলাইতাসে সন্দ করি!"
আমাকে গুড় চিড়া সাধলেন মামী৷ কিন্তু হাতে একদমই সময় নেই, এখনই রওনা দিতে হবে৷ আমি উঠে পড়লাম৷ উনি আবার এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকে না৷ তাড়াতাড়ি ধরতে হবে৷ মামী আমার তাড়াহুড়ো দেখে বুঝতে পারলেন৷ চোখ বড় বড় করে বললেন,
"তুমি আবার হেই পারে যাইও না! তুমার মামা বাড়িত আইলে আমি কইয়ুম উনারে তুমার কতা৷ তুমি অহন বাড়িত যাও!"
আমি লক্ষ্মী ছেলের মতো মাথা নেড়ে "জ্বী আচ্ছা" বলে বেরিয়ে হনহন করে গোলদিঘীর পাড়ে রওনা দিলাম৷ জায়গাটা এখান থেকে বেশি দূরে না৷ পাঁচ-দশ মিনিট হাঁটলে পৌঁছে যেতে পারবো৷ তবে হ্যা, মামীর সতর্কবাণী এমনই ফেলনা নয়, উনার কথা ঠিকই আছে৷ গোলদিঘী জায়গাটার বদনাম আছে৷ পাশেই পুরাতন শ্মশান ঘাট৷ সেই কাপালিকদের যুগ থেকে টিকে আছে- বহু পুরোনো এই শ্মশান ঘাট৷ যদিও এখন আর কেউ এ ঘাট মাড়ায় না৷ অনেক বছর হলো পশ্চিম পাড়ার নতুন শ্মশানে মড়া পোড়ায় হিন্দুরা৷ এই শ্মশান এখন পরিত্যক্ত, ধুঁকে ধুঁকে কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে রয়েছে৷ এটাকে কেন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল সেটাও একটা বিরাট ঘটনা৷ সে কাহিনী আরেকদিন বলবো৷ আমার এখন নিজু মামাকে ধরাই লক্ষ্য৷ শ্মশানের পাশ দিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছি৷ এখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পোড়া কাঠ, পোড়া জামাকাপড়ের অংশ বিশেষ- মহিলাদের..শিশুদের..৷ কড়ই গাছের ডালে এক খাবলা চুল ঝুলে থাকতে দেখলাম৷ একটু দূরে পোড়া একটা বালিশ, তার ভেতর ঘিনঘিন করে ইঁদুরের মতো কি যেন ছোটাছুটি করছে৷ আমি এসব আড়চোখে দেখতে দেখতে দেখি দিঘীর পাড়ে চলে এসেছি৷ আরে ঐতো পশ্চিম পাড়ে কে যেন বসে আছে দেখা যায়!
আমি পা টিপে টিপে সন্তর্পণে এগোলাম লোকটার দিকে৷ কার এতো বড় বুকের পাটা সূর্যাস্তের পর গোলদিঘীর পাড়ে একা একা মাছ ধরতে আসে! এমন বুকের পাটা তো বিষ্ণুপুরে শুধু একজনেরই আছে! ভাবলাম একটু মজা নেওয়া যাক লোকটার সাথে! তড়াক করে লাফ মেরে লোকটার কানের কাছে গিয়ে চিক্কুর মারলাম,
"আরে নিজু মামা নাকি?!"
কী আজব ব্যাপার লোকটার কোন বিকার নাই৷ কলের পুতুলের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে আমার দিকে তাকিয়ে ঘোলা ঘোলা কণ্ঠে বললো,
"কিও ভাইগ্না তুমি কই থেকে আইলা? এই সময়ে এই পথে তো কেউ আসে না! আমি এখানে আছি জানলা ক্যামনে?"
বলতে বলতে উনি দাঁত বের করে একটা হাসি দিলো৷ ভক করে কাঁচা মাছের গন্ধ নাকে ধাক্কা দিলো৷ আমি একটু অবাক হয়ে পাড়ে বসে পড়লাম৷ নাহ, মানুষটা একটুও বদলায়নি৷ লোকে যা বলে সবই ঠিক৷ আমি পাড়ে বসতেই নিজু মামা বড়শি ধরা অবস্থায়ই কিভাবে যেন পিছলে পিছলে আমার পাশে চলে আসলেন! পোড়া শ্যাওলার মতো
বিশ্রি একটা গন্ধ পেলাম৷
"ভাইগ্না কি একলা আইলা নি? সাহস আছে তুমার! হে হে হে!"
মানুষটার হাসি দিলখোলা কিন্তু ভারী কুৎসিত- হলদে দাঁত,
হাসলে কালো মাড়ি দেখা যায়৷
আমিও হেসে বললাম,
"মামী বললো আপনি এখানে আছেন৷ আমার আবার পোকা বিলে মাছ ধরার শখ৷ তাই ভাবলাম আপনার কাছেই আসি৷"
কী অদ্ভুত! লোকটা আমার কথা শুনে হাত থেকে বড়শি ফেলে দিয়ে হা হা করে গা কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো! মুখ থেকে কাঁচা মাছের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলো৷
"বলো কি ভাইগ্না! পোকা বিলে রাইতের বেলা মাছ ধরবার চাও? তুমার তো সেইই বুকের পাটা!"
আমি উনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনার হাসির সাথে মুখের ভেতর কাঁচা মাছের নাড়িভুড়ির মতো কি কি সব দেখা যায় গন্ধে আমার সাথে সাথে বমি চলে আসলো৷
আমি তাড়াতাড়ি তাগাদা দিয়ে বললাম,
"মামা আপনি তো শুনলাম ভূত কিলান! আপনি সাথে থাকলে আর কিসের ভয়? ভূতকে কিলায় পাকায় ফেলবেন!"
উনার মুখের হাসিটা যেন ম্লান হয়ে গেল এই কথাটা শুনে৷ মুহূর্তের জন্য সূক্ষ্ম ক্রোধের রেখা দেখতে পেলাম চোখেমুখে৷ তারপর আবার মুখটা হাসিতে ঢেকে গেলো৷ ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন চুপ করে৷ আমি কী বলবো ভেবে পাচ্ছি না৷ দেখলাম এই অন্ধকারেও উনার চোখ দুটো থেকে কেমন অদ্ভুত হলদে আভা জ্বলজ্বল করছে৷ মানুষটার মুখের তুলনায় চোখদুটো অস্বাভাবিক বড় লাগছে৷ যেন কপাল থেকে গালে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে চোখ দুটো৷ আমার কেন যেন সেই মাছখেকো বংলী ভূতের কথা মনে পড়ে গেলো.. বাঁশঝাড়ে দেখা সেই অতিকায় চোখ.. আমার মাথার টনটনে ভাবটা হঠাৎ ফিরে এলো খুব তীব্রভাবে৷ আমি ব্যথা সহ্য করতে না পেরে উঠে পড়লাম,
"থাক নিজু মামা আজকে আমার শরীরটা ভাল লাগছে না৷ আরেকদিন যাবো পোকা বিলে মাছ ধরতে আপনার সাথে৷"
লোকটা মুখ থেকে থক করে একগাদা থুতু ফেললো মাটিতে, থুতুর সাথে রক্ত আর নাড়িভুড়ির মতো কি যেন মিশে আছে৷
আমার মাথাটা আবার চক্কর দিয়ে উঠলো৷ হাত-পায়ে জোর পাচ্ছি না৷ মনে হচ্ছে যেন মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবো৷
নিজু মামা আমার দিকে তাকিয়ে মিচকি মিচকি হেসে
তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
"কিও ভাইগ্না ভয় খায়া গেলা? এই সাহস নিয়া তো পোকা বিলে জীবনেও মাছ ধরতে পারবা না! যাও, বাড়িত যাও৷ আমি বাজারে তাড়ি খাইতাম যাই তাইলে৷"
উনার কথা শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল৷ নাহ, এ কথার পর আর পিছপা হওয়া যাবে না৷ আমি কল্পনা করলাম নিজু মামা বাজারে তাড়ির আড্ডায় বসে রসিয়ে রসিয়ে বলছে আমাকে ভীতু বানানোর গল্প, "তারপর তো ভাইগ্না পাড়ে বইসা ডরে মুইতা দিলো লুঙ্গিতে হে হে হে!"
আর মতিন, আলামিন, সুমন সবাই খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসছে- এটা ভেবেই মাথায় জিদ চেপে গেলো৷
"চলেন মামা! দেখি আজ পোকা বিলে আপনি কয়টা ভূত কিলান!"
উনি রক্তচক্ষু করে বড়শি তুলে হনহন করে উঠে এলেন লুঙ্গি কাছা মেরে৷
"চলো ভাইগ্না! দেখি আইজ তুমার ভাগ্যে কী রাখসে পোকা বিল!"
এতোক্ষণে সন্ধ্যা ঘনিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে৷ আমরা চুপচাপ বড়শি কাঁধে হেঁটে চলেছি শ্মশানঘাট বাঁশঝাড় পেরিয়ে সেই অলৌকিক সব ভৌতিকতায় ঘেরা পোকা বিলের সন্ধানে৷ আমি মাঝপথে থেমে একটু বিড়ি ধরাতেই নিজু মামা খুব বিরক্ত হয়ে বললো,
"ধুর ভাইগ্না বিড়ি ফালাও! আমি বিড়ির গন্ধ সহ্য করতে পারি না!"
আমি অবাক হয়ে বললাম,
"আপনি আবার কবে থেকে বিড়ি টানা বন্ধ করলেন?"
উনি আবার মিচকি হেসে বললো,
"তুমার মামীরে কতা দিসি আর বিড়ি খাইবাম না৷ এরপর থুন বিড়ির গন্ধও সইতে পারি না!"
কী আজব কথা! মানুষটা এতো বদলে গেলো কবে? আমি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বিড়িটা কাদায় ফেলে দিলাম৷
প্যাঁচপ্যাঁচে কাদায় লুঙ্গি কাছা মেরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পোলের গোড়ায় এসে পড়েছি৷ আকাশে মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলায় এক আবেভাবূত আলো-আঁধারির রহস্যময় ছায়ালীমা তৈরি হয়েছে- এই অন্ধকার, এই আবার মেঘ কেটে বেরিয়ে আসে উথামথাম জোছনা৷
থেকে থেকে হিম হিম দখিনা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে৷ সেই বাতাসের সাথে দূর থেকে কোন অচেনা প্রাণীর ডাক শুনতে পাচ্ছি- শিশুর কান্নার মতো৷ গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে শুনলে! এমন পরিবেশে অদেখা ভুবনের বাসিন্দাদের কথা বেশি মনে পড়ে৷ নিজু মামা হেঁড়ে গলায় বললো,
"পোলে দেইখা শুইনা উইঠো ভাইগ্না! পইড়া যাইও না আবার পানিত! তাইলে কিন্তু শ্যাষ! হে হে হে!"
আমি বুঝতে পারলাম উনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন৷ এই পোলের গোড়ার বুড়ির কাহিনী বিষ্ণুপুরের আরেক কিংবদন্তী৷
সেবার দক্ষিণপাড়ার হানু দাদা কি কাজে গেছিলেন সদরে৷ সেখান থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেলো৷ গাড়ি তো পেলেন না, ভাবলেন হেঁটেই ধীরে-সুস্থে পার হয়ে যাবেন৷ এতো ঘুরপথে গিয়ে আর কী হবে, পোলের উপর দিয়েই শর্টকাট মেরে দেই৷
উনার ভাগ্যটাই এমন- সে রাতে অমাবস্যা ছিল৷ অন্ধকারে চোখে ঠাওর করা যায় না কিছু ঠিকমতো৷ পোলের ডানপাশে আবার জঙ্গল৷ হানু দাদা ভয় কাটানোর জন্য উঁচু গলায় গান ধরলেন৷ পোলের নিচে পানির স্রোত৷ মাঝে মাঝে দেখা যায় কলাগাছের গুড়ি ভেসে যাচ্ছে৷ দূর থেকে হঠাৎ দেখলে ভ্রম হয় মানুষের মৃতদেহ৷ হানু দাদা আরো জোরে গান ধরেন৷ হঠাৎ পোলের ওপারে থেকে একটা আওয়াজে হানু দাদার গান থেমে যায়৷ ও মাথায় কে যেন খটখট শব্দ করে হেঁটে আসছে৷ একটু কাছে আসতে দেখেন এক বুড়ি৷ কেমন কুঁজো হয়ে মাথাটা কাত করে দুলে দুলে আসছে৷ এতো রাতে কে আসবে এই পথে? এলাকার কেউ হলে তো উনার চেনার কথা৷ হানু দাদা কৌতুহলী হয়ে হাঁক ছাড়লেন,
"বুড়ি মা! আপনি কোন বাড়ির গো? কই যাইবেন?"
বুড়ি খলখল করে হেসে বললো,
"তুই আমারে পোলের গোড়া পার কইরা দে!"
বুড়ির কথার ভেতর কী ছিল জানি না, কিন্তু সাথে সাথে হানু দাদার শরীর দিয়ে স্রোতের মতো ঘাম ঝরতে লাগলো৷ মনে হচ্ছে যেন ঝরণার নিচে দাঁড়িয়ে আছে- এমন কুলকুল করে ঘাম ছুটছে৷ তারপরও মাথা ঠাণ্ডা রাখলেন৷ বুড়ির পরিচয় কি জানা দরকার৷
সাথে থাকা টর্চের আলো বুড়ির মুখের উপর মারতেই ভয়ে একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেলো উনার! এটা তিনি কী দেখলেন! বুড়ির মুখ দেখে মনে হচ্ছে মরা মানুষের চামড়া কেটে কেউ মুখের উপর লেপ্টে দিয়েছে৷ টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় এটা আসলে মানুষের মুখ না, চেষ্টা করছে মানুষের রূপ নিতে৷ নাক-চোখ-মুখ আছে, কিন্তু যেভাবে থাকার কথা সেভাবে নেই, অন্যরকম ভাবে আছে৷ তিনি টর্চ মারতেই বুড়ি খনখনে একটা শব্দ করে দাঁড়িয়ে গেলো৷ হানু দাদা দেখতে পেলেন বুড়ির মুখটা কেমন জীবন্ত হয়ে উঠে- চোখ-নাক-মুখ নড়তে থাকে৷ যেন প্রাণপণে চেষ্টা করছে সেগুলোকে জায়গামতো ধরে রাখতে, যেন এখনই খুলে পড়ে যাবে.. তিনি তাড়াতাড়ি উল্টোদিকে দৌড়ে পোল থেকে নেমে পাশের জঙ্গলের ভেতর রূদ্ধশ্বাসে খিঁচে দৌড় লাগালেন৷ পেছনে শুনতে পেলেন ঝুপ করে পানিতে কারো ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ৷ বীভৎস খনখনে গলায় উনার কানের পেছনে কে যেন বললো,
"তুই আমাকে পার করে দিলি না.."
আমি আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম৷ হঠাৎ পানিতে ঝুপ করে ভারী কিছু পড়ার শব্দে আমি ভীষণভাবে চমকে উঠলাম! হকচকিয়ে নিজু মামার বড়শি আঁকড়ে ধরলাম৷ উনি স্বভাবসুলভ দাঁত কেলিয়ে ভেটকি মেরে বললো,
"আরে ডর খাইয়ো না ভাইগ্না! এগুলি কিছু না, শামুকভাঙ্গুয়া হইবো আরকি৷ পানিত লাফ মারসে বুঝছো না?!"
উনার কথার কোন অর্থ মাথায় ঢুকছে না৷ আমার মাথা টনটন করছে৷ পোলের নিচে পানির গভীরে তোলপাড়ের মতো কি যেন হচ্ছে৷ অতিকায় কোন মাছখেকো দানো যেন কাউকে টেনে পানির নিচে নিয়ে যাচ্ছে আর সে বাঁচার জন্য প্রাণপণে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করছে৷
আমার চোখের ভুল কিনা জানি না অন্ধকারে বুঝাও যায় না কিছু ঠিকমতো কিন্তু মনে হলো পানির ভেতর থেকে হাঁ করে খাবি খাচ্ছে এমন একটা মাথা এক মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠেই আবার ডুবে গেলো!
আমার পা যেন জায়গায় অসাড় হয়ে গেল আর নড়তে পারছি না৷ নিজু মামা তাড়াতাড়ি আমাকে টেনে পোল পার করে বললেন,
"ঐ সব দেখতে নাই ভাইগ্না! রাইতে এমুন অনেক আলিঝালি দেখা যায়! ঐ দেহো পোকা বিলে আইসা পড়সি আমরা!"
আরে, তাই তো! এসে পড়েছি! সেই কিংবদন্তীর পোকা বিল৷ ঐযে কাশবন দেখা যাচ্ছে৷ আমাদের এখন সোজা কাশবনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে৷ পূর্ণিমার আলোয় অদ্ভুত লাগছে জায়গাটা৷ শুধু সামনে পেছনে কয়েক হাত দেখা যায়৷ আর চারপাশে শুধু কাশ আর কাশ৷ আমার আবার সেই টনটনে অনুভূতিটা ফিরে এলো৷ মনে হলো যেন এই কাশবনে আমরা একা না, আরো অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷ মামা আমার হাত শক্ত করে ধরে বললো,
"ভয় খাইও না ভাইগ্না!"
ভয় না পেতে বললেও আমার বুকটা ধুকপুক করতে লাগলো৷ মাথার হুঁশ হারিয়ে ফেলছি৷ চারদিক থেকে যেন পায়ের আওয়াজ ঘিরে ধরছে৷ কিছু দেখতেও পাই না সামনে-পেছনে সবখানে শুধু কাশ আর কাশ৷ আমি পাগলের মতো হামাগুড়ি দিয়ে আগাতে লাগলাম৷ এর মধ্যে হঠাৎ শুনতে পেলাম অনেকগুলো কণ্ঠ জোরে জোরে কালিমা পড়ছে "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ..''
আমরা তাকিয়ে দেখলাম কাশবনের ভেতর থেকে চারজন মানুষ বেরিয়ে আসছে৷ কাঁধে সাদা কাপড়ে একটা খাটিয়া৷ কারো লাশ নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারলাম৷ আমি খুব উৎকণ্ঠা বোধ করলাম৷ কে মারা গেলো? পরিচিত কেউ না তো?
হারিকেন হাতে বেঁটে করে লোকটাই খুলে জানালো, "তালি বাড়ির জামাই৷ বিয়া করসে কয়দিন হইলো মাত্র৷"
সফেদ দাড়িওয়ালা বয়স্ক একজন আফসোসের কণ্ঠে বললেন,
"আহারে বেচারা! সাঁতার জানতো না৷ পাকনামি কইরা একা একা গোসল করতে নামসে৷ ডুইবা গেল গা৷ এতো জোয়ান একটা পোলা! এতো অল্প বয়সেই মইরা গেলো!"
আমার মনটা ভার হয়ে গেলো৷ মানুষের জীবন কতো অনিশ্চিত৷ মুহূর্তের ভেতর কতো কিছু ঘটে যায়! এই রাতের বেলা কুখ্যাত পোকা বিলের পাড়ে লাশের সাথে আমরা কয়জন৷ কেমন মৃত্যুপুরীর মতো একটা অনুভূতি৷ সময়টা ভাল না৷ লাশটাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে বাড়িতে৷ সেজন্য পোকা বিল পার হতে হবে৷
"বাবা আপনারা কি কাজে এসেছেন?"
একজন বুড়ো জিজ্ঞেস করলো৷ নিজু মামা আগ বাড়িয়ে বললো,
"ভাইগ্নার পোকা বিলে মাছ ধরনের শখ হইসে!"
"নৌকা দেখতেসি না যে বাবা!"
তাই তো৷ নৌকা তো প্রয়োজন৷ এখানে তো বাঁধা থাকার কথা আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলাম না৷
"তাইলে আপনেরা এখানে একটু খাড়ান আমরা নৌকা নিয়া আসতেসি!"
আমরা কিছু বলার আগেই চারজন মুহূর্তের ভেতর কাশবনের ভেতর ঢুকে গেলো৷ নিজু মামা বললো,
"আয়হায় আমি কেমনে ভুইলা গেলাম উনাদের কইতে! ঝোপের পাড়ে সাঞ্জু মাঝির নৌকা বান্ধা আছে তো! চলো ভাইগ্না আমরা লাশটা উঠায় নেই৷ আইজ লাশ সহ মাছ ধরলা কি বলো?! হে হে হে!"
আমরা ধরাধরি করে নৌকায় খাটিয়া উঠালাম৷ ঐ চারজনের কোন সাড়াশব্দ নাই৷ লোকগুলো কাশবনের ভেতর দিয়ে কোথায় গেলো আজব! আমি আর নিজু মামা নৌকায় উঠে বসলাম৷ মামা বললেন,
"চলো নৌকা ছাইড়া দেই৷ উনাগো লাইগা বয়া থাইকা লাভ নাই৷"
"কী বলেন মামা! উনাদের না বলে চলে যাবো?"
"আরে আমি চিনি তালি বাড়ি৷ এখন নিয়া যাই সময় বাঁচবো৷ উনারা আমারে চিনে৷ সমস্যা হইবো না৷"
উঠে বসলাম দু'জন নৌকায়৷ নিজু মামা বৈঠা বাইছেন, আমি আবার বৈঠা বাইতে পারি না৷
একটা ব্যাপার নিয়ে একটু খটকা লাগছে৷ খাটিয়াটা অনেক হালকা লেগেছিল নৌকায় তোলার সময়৷ এতো হালকা তো হওয়ার কথা নয়! আমি কৌতূহলী হয়ে কাফনের সাদা কাপড়টা সরিয়ে ফেললাম খাটিয়ার উপর থেকে৷ কী আজব ব্যাপার! খাটিয়াতে কোন লাশ নেই! একদম শূন্য খাটিয়া! এটা কি হলো? আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো৷
"মামা, লাশ কই?''
"লাশ তো তুই হবি!"
কথা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো৷ নিজু মামা নৌকার উপর দাঁড়ানো৷ রক্তচক্ষু করে আমার দিকে তাকিয়ে হেঁড়েগলায় বলে উঠলেন,
"অনেকদিন কাউরে ডুবাই না পোকা বিলে৷ আইজ তোরে পাইসি!"
এই বলে নৌকা দুলাতে লাগলেন জোরে জোরে! আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম,
"মামা নৌকা উল্টায় যাবে তো!"
উনি মুখ হাঁ করে খলখল করে হেসে উঠলেন৷ মুখের ভেতর থেকে পঁচা কাঁচা মাছের গন্ধ ভকভক করে বের হচ্ছে বমি উদ্রেককারী৷ উনার গা থেকে শ্যাওলার এমন তীব্র আঁষটে একটা গন্ধ- নাকে নি:শ্বাস নিতে পারছি না৷
আমি প্রচণ্ড আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম,
"বাঁচাও! বাঁচাও!"
উনি আরো জোরে জোরে নৌকা দুলাতে লাগলো পাগলের মতো৷ এমন সময় শুনতে পেলাম কাশবনের ভেতর দিয়ে কে যেন দৌড়ে আসছে৷ আমি আরো জোরে চিৎকার শুরু করলাম৷ দেখি কাশবনের ভেতর থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে আসছেন নিজু মামা! আর চিৎকার করে বলছেন, "ঐ ভূতের বাচ্চা ভূত ছাইড়া দে আমার ভাইগ্নারে! নাইলে কিলায় পাকামু তরে আইজ!"
এই বলে উনি ঝাঁপ দিলেন পানিতে৷ নৌকার কাছে চলে আসছেন সাঁতার কেটে৷
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম৷ তাহলে এতক্ষণ আমি কার সাথে ছিলাম? তাকাতেই দেখি- নৌকার নিজু মামার মুখ থেকে হড়হড় করে নাড়িভুড়ি পঁচা গলা কি কি সব বের হচ্ছে! উনি রক্তচক্ষু করে আমার দিকে তাকিয়ে ঘুরতে ঘুরতে উল্টো হয়ে বিলের পানিতে পড়ে গেলেন! আমি থরথর করে ভয়ে কাঁপছি৷ এদিকে নৌকায় নিজু মামা সাঁতার কেটে উঠে এসেছেন৷ উনি বিরাট ঝাড়ি দিয়ে বললেন, ''তুমার পোকা বিলে মাছ ধরার শখ মিটসে এইবার? কে কইসিলো তুমারে এখানে আইতে? আমি তো তুমার মামীর থেকে শুইনাই দৌড়ায় আইসি বুঝছি তুমি এখানেই আইবা। আজকে আমি তো মাছ ধরতে যাই নাই বাজারে তাড়ির আড্ডায় আছিলাম!"
আমি বিহবল হয়ে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। কি বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। উনি আবার অন্য আরেক নিজু মামা না তো?
সেই রাতের ঘটনার পর আমার পোকা বিলে মাছ ধরার শখ জন্মের মতো মিটে গেছে৷ আমি জানি না সেই রাতে কি হয়েছিল, কি দেখেছিলাম আমি, কে ছিল আমার সাথে৷
হয়তো সবই আমার কল্পনা৷
কিন্তু এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমার জানা নেই- কিভাবে আমার সাথে সেই রাতের ঘটনার কয়েকদিন পরই খবর এলো তালি বাড়ির নতুন জামাই গোসল করতে বিলে নেমে পানিতে ডুবে মারা গেছেন!
গ্রাম বাংলার চৌষট্টি হাজার গ্রামের পরতে পরতে এমন কতো ব্যাখ্যাতীত রহস্য লুকিয়ে আছে- আমাদের সাদা চোখে তা কোনদিন ধরাও পড়বে না৷ সুপ্রাচীন বটবৃক্ষের মতো প্রকৃতির হৃদয়ে প্রোথিত সে রহস্য, প্রাচীন শ্যাওলার মতো প্রবঞ্চক- চোখের সামনেই আছে, কিন্তু দৃষ্টি এড়িয়ে যায় সবসময়৷