খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৭ অব্দ;
জিওন পর্বত, জেরুজালেম।
পরাস্ত হয়েছে যুদাহ নগরী। ধ্বংস হয়ে গেছে সলোমনের মন্দির। জুদাহ রাজ্যে বিখ্যাত জিওন পর্বতের পাদদেশে মন্দিরের ভাঙা অংশগুলোর উপর দাঁড়িয়ে আছে ব্যাবিলনের সেনা প্রধান গেডালিয়াহ আর তার অনুসারিরা। পর্বত ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পরাস্ত হওয়া যুদাহ রাজ্যের অধিবাসীরা। প্রায় এক লক্ষ যুদাহবাসীকে যুদ্ধবন্দি করা হয়েছে। দলে দলে দাঁড়িয়ে আছে নারী পুরুষ। যাকে যেখানে যেই অবস্থায় পাওয়া গেছে, সেভাবেই ধরে আনা হয়েছে।
তবে সম্রাট নেবুচাদনেজারের শাসনামলে জুদাহ আক্রমন নতুন কিছু নয়। এর আগেও একবার জুদাহ রাজ্য কব্জা করেছিলেন সম্রাট। তখন জুদাহ অঞ্চলের রাজা ছিল ফারাও নেকো। কারকেমিসের যুদ্ধে তাকে পরাভূত করে নেবুচাদনেজার জুদাহ দখল করে নেন। তারপর একুশ বছর বয়সী টগবগে সৈনিক জেডিকায়াহকে জুদাহ রাজ্যের রাজা ঘোষণা করেন ব্যাবিলনের সম্রাট। তবে জেডিকায়াহ এর নিকট নেবুচাদনেজারের শর্ত ছিল একটাই- সর্বদা নেবুচাদনেজারের অনুগত হয়ে থাকতে হবে।
কিন্তু তরুন ইহুদি রাজা তার সম্রাজ্যে ব্যাবিলনের আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি। কিছুদিন না যেতেই জেডিকায়াহ নেবুচাদনেজারের সাথে বেঈমানি করে বসল। ব্যাবিলনের শত্রু ফারাও রাজা হোপরাহ এর সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন পূর্বক জেডিকায়াহ ব্যাবিলনের আনুগত্য অস্বীকার করে বসল। এই বেঈমানির ফলাফল হল এক ভয়াবহ যুদ্ধ।
যদিও যুদ্ধটা মোটামুটি একপেশে বলা চলে। ব্যাবিলনের সম্রাট একের পর এক আক্রমন চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু জুদাহ রাজ্যের একদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়, ওপর দিকে কঠিন শিলার তৈরি অভেদ্য দেয়াল! অবশেষে জুদাহ রাজ্যে জেডিকায়াহ এর শাসনের এগারতম বৎসরের শুরুতে ত্রিশ মাস ব্যাপি একের পর এক ব্যর্থ অভিযান শেষে সাফল্য পেল সম্রাট নেবুচাদনেজার আর তার অনুসারি ব্যাবিলনীয় সৈন্যরা। জুদাহ রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু জেরুজালেমের দেয়াল ভেঙে শহরের ভেতরে প্রবেশ করল সম্রাট নেবুচাদনেজার। জেডিকায়াহ আর তার অনুসারীরা পালানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু ধরা পড়ে যায়। তাদেরকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রিবলাহতে। সেখানে জেডিকায়াহ এর চোখের সামনেই তার সন্তানদের হত্যা করা হয়। তারপর তাকে অন্ধ করে দিয়ে সেই অবস্থায় ব্যাবিলনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানেই তাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বন্দি থাকতে হবে।
জেরুজালেমে প্রবেশের মাঝে সম্রাটের অভিযান থেমে থাকেনি। সম্পূর্ণ জেরুজালেম ধ্বংস করে দেওয়ার আদেশ দিল সে নিজ অনুসারিদের। সহস্রাধিক জেরুজালেমবাসি ইহুদীকে যুদ্ধবন্দি করা হয়েছে। এদের নিয়ে যাওয়া হবে সমৃদ্ধ নগরী ব্যাবিলনে, দাস দাসী হিসেবে বিক্রি করা হবে ব্যাবিলন বাসির কাছে। এখন এই যুদ্ধ বন্দিদের সামনে উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে আছে অন্যতম সেনাপতি গেডালিয়াহ।
সম্রাট নেবুচাদনেজার এই মুহূর্তে আছে যুদাহ রাজার রাজমহলের অভ্যন্তরে। গুরুত্বপূর্ণ সভাসদদের নিয়ে যুদাহ রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনার ছক আঁকছেন তিনি। গেডালিয়াহর উপর তাই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে দায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন।
গেডালিয়াহ একটা বড় আকৃতির পাথরের উপরে উঠে দাঁড়াল। উদ্দেশ্য উপস্থিত সবাই যেন তাকে দেখতে পায়। বন্দী যুদাহবাসী বিশৃঙ্খলভাবে যত্র তত্র দাঁড়িয়ে আছে। শোরগোলের শব্দে কান পাতা দায়। গেডালিয়াহ সৈনিকদের নির্দেশ দিল তাদেরকে শান্ত করতে। যুদাহবাসীদের ঘিরে রাখা ব্যাবিলনের সৈনিকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হাতের তরবারির খোঁচায় খোঁচায় তারা যুদাহ অধিবাসীদের একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করল।
গেডালিয়াহ সমস্ত শোরগোল থেমে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। আনন্দের সংবাদটা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তার কানে আসেনি। তবে ইতিমধ্যে ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছে সে। পরাস্ত যুদাহরাজ্যের রাজা হিসেবে সম্রাট নেবুচাদনেজার গেডালিয়াহ কে ক্ষমতায় বসাতে চলেছেন। তাই তো চোখে মুখে তার প্রবল উৎসাহ। শোরগোল একটু কমে আসতেই গেডালিয়া লোহার তৈরি লম্বা চোঙ মুখের সামনে লাগিয়ে চিৎকার করল, “সাবধান...।”
লোহার চোঙ গেডালিয়ার কণ্ঠের জোর কয়েক গুন বাড়িয়ে দিয়ে ছড়িয়ে দিল জিওন পর্বত ছাড়িয়ে সমস্ত পার্বত্য অঞ্চলে।
যাও বা শোরগোল চলছিল, এই চিৎকারে সব থেমে গেল।
গেডালিয়াহ বলে চলেছে, “হে জুদাহ বাসি। আমার পক্ষ থেকে তোমাদের অভিবাদন জানাই কারণ তোমরা ব্যাবিলন নগরে দাস-দাসী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেতে চলেছ!”
উপস্থিত জনতার মধ্যে ক্রোধের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল আলোর বেগে। কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছেনা, “ব্যাবিলনের সৈনিকরা খোলা তরবারি হাতে তাদের ঘিরে রেখেছে। ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে যুদাহবাসীদের কুঁচি কুঁচি করে কাটতে পারলে খুব খুশি হবে তারা।”
“সবাই চুপ কেন?” চিৎকার করে বলে যাচ্ছে গেডালিয়াহ। “তোমাদের শত জনমের পুণ্যের ফলে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। নইলে তোমাদের মেরে গণ কবর দেওয়াটা আমাদের জন্য অনেক বেশি সহজ ছিল। আমি তোমাদের বেঁচে একটা সুযোগ দিতে চাচ্ছি।”
এখনও কেউ কিছু বলছে না।
“যথারীতি তোমরা যুদাহবাসী নিজেদের নিমকহারাম প্রমাণ করে চলেছ। যাই হোক, আমি বেশি কথায় যাব না। তোমাদের একটা কথা জানাতে চাই। বেঁচে থাকার এই সুযোগ পাওয়ার জন্য তোমাদের একটা শর্ত পালন করতে হবে।”
কেউ কিছু বলছে না এখনও। দুই একজন অতি উৎসাহী বলে উঠল, “কী শর্ত?”
“শর্তটা খুব সহজ। শর্ত হচ্ছে তোমাদের মধ্যে থেকে এক হাজার জন ব্যক্তিকে স্বেচ্ছায় আত্মাহুতি দিতে রাজি হতে হবে। তবে আমি চাই শুধু মাত্র যুবকেরা এগিয়ে আস। কারণ তোমরা নিশ্চয়ই চাও না যে মহিলা ও বাচ্চারা তোমাদের বাঁচানোর জন্য জীবন উৎসর্গ করুক।”
উপস্থিত জনতার মাঝে চিৎকার চ্যাচাম্যাচি শুরু হয়ে গেল। কেউ রাজি না এই অদ্ভুত শর্তে। এক হাজার মানুষের স্বেচ্ছা মৃত্যুর বিনিময়ে বাকিরা দাস- দাসী হবে? এটা কেমন কথা?
গেডালিয়াও চিৎকার করল, “চুপ করো সবাই। সবাই... চুপ করো”
উপস্থিত জনতার মাঝে চুপ করার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
“কী হলো? কথা কি কানে যায় না তোমাদের?”
কেউ শুনছে না। শোরগোল থামছে না।
“খবরদার। আর যদি কেউ একটা টু শব্দ করে তাহলে তার গর্দান যাবে।”
গেডালিয়াহর কথায় কারো কান নেই। চিৎকার করে সবাই সম্রাট নেবুচাদনেজারের মুন্ডুপাত করা শুরু করল। বাধ্য হয়ে গেডালিয়াহ আবার সৈন্যদের নির্দেশ দিল তাদের শান্ত করতে। বলা বাহুল্য, সৈনিকদের তরবারির খোঁচায় শ’খানেক যুদাহবাসী জখম হওয়ার পর তারা আবার শান্ত হল।
গেডালিয়াহ আবার চিৎকার করে উঠল, “আমার প্রশ্নের জবাব দাও যুদাহবাসী। তোমাদের মধ্যে কি এক হাজার জন রাজি আছে নিজের জীবন অন্যদের বেঁচে থাকার জন্য উৎসর্গ করতে?”
সবাই এক শব্দে চিৎকার করে উঠল, “নাআআআআআআ...।"
গেডালিয়া হাসছে, এই শর্ত শোনার পর জুদাহবাসীর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা সে আগেই আঁচ করে রেখেছিল। বলল, “রাজি যদি না থাক, তবে তোমাদের সামনে তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের ধরে ধরে হত্যা করা হবে। বল রাজি আছ কি না?”
সবাই আবার এক যোগে বলল, “নাআআআআআআ...”
গেডালিয়া হাতের নিশারায় কিছু একটা নির্দেশ করল। সৈন্যরা সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন মেয়ে মানুষকে ধরে টানতে টানতে সামনে নিয়ে এল। মেয়েরা প্রানভয়ে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল।
গেডালিয়া চোঙে মুখ লাগিয়ে বলছে, “এখনও সময় আছে। তোমরা রাজি হও। তা না হলে তোমাদের সামনেই তোমাদের অসহায় মা বোন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।”
সবাই চুপ, কেউ রাজি না।
গেডালিয়া ইশারা করতেই মুহূর্তের মাঝে ধরে আনা মেয়েদের ধর থেকে মাথা আলাদা করে দেয়া হল। অবশিষ্ট যুদাহবাসী চুপ চাপ এই দৃশ্য দেখল। কেউ টুঁ শব্দ করল না। এবার গেডালিয়ার ইশারায় সৈন্যরা কিছু বাচ্চা ধরে টেনে এনে তাদের গলায় তরবারি ধরল, গর্দান নামিয়ে দিতে প্রস্তুত।
গেডালিয়া চোঙে মুখ লাগিয়ে বলছে, “এবার তোমাদের সন্তানেরা যাবে যুদাহবাসী। এখনও সময় আছে স্বেচ্ছায় এক হাজার যুবক রাজি হয়ে যাও। আমি চাইলে তোমাদের মধ্য থেকে আমার ইচ্ছে মত এক হাজার যুবক বেছে নিতে পারতাম হত্যা করার জন্য। কিন্তু আমি তা না করে, তোমাদের সুযোগ করে দিচ্ছি নিজেরা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। আমি চাইনা ইতিহাসে এটা কোনো গণহত্যাকাণ্ডের ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হোক, আমি চাই এক মহান উদ্দেশ্যে যুদাহবাসীর আত্মাহুতির কথা সমস্ত মেসোপটেমিয়া মনে রাখুক। এমন সুযোগ তোমরা হাতছাড়া করোনা। আমাদের সম্রাট আমাকে বার বার করে নিষেধ করে দিয়েছেন যেন মহিলা ও বাচ্চাদের রক্তপাত না করতে। তোমরা আমাকে বাধ্য করো না।”
কারো মাঝে কোন ধরণের আগ্রহ দেখা গেল না।
গেডালিয়ার ঠোঁটের কোনে একটা তিক্ত হাসি দেখা দিল। বলল, “হে জুদাহবাসি। আমাদের সম্রাট এক কথা ঠিকই বলেন। তোমরা ইহুদীরা পশুর অধম। চোখের সামনে নিজেদের মা-বোন-সন্তানেরা মরছে, অথচ তোমাদের মাঝে কিছুমাত্র বিকার নেই। আমি বুঝেছি এভাবে হবেনা। তোমরা যখন স্বেচ্ছায় রাজি হলে না, আমার হাতে আর উপায়ান্তর রইল না।”
এবার গেডালিয়া ব্যাবিলনের সশস্ত্র সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলল, “তোমারা যাকে সামনে পাও, তাকেই ধর। মোট এক হাজার জনকে বন্দি করে নাও। এদের আলাদা করে পাহারের অপর প্রান্তের বিশাল চুল্লির কাছে নিয়ে যাও। তবে মহিলা ও শিশুদের রেখো না, সম্রাটের নিষেধ আছে। বাকিদের ধরে একটা লাইন করে ব্যাবিলনের পথে হাটিয়ে নিয়ে যাও। এরা আমাদের দাস দাসী হিসেবে আগামী কয়েক প্রজন্ম আমাদের সেবা করে যাবে...”