১৫৮০ খৃষ্টাব্দ;
মূল নদীবন্দর, যশোর, চন্ডিক্যান রাজ্য।
আগুয়ান যেমনি তেজস্বী ঘোড়া, ঠিক তেমনি তার গতি। অতি অল্প সময়ের মধ্যে মূল নদীবন্দরে চলে এল মাহতাব খান। রাগে ও ঘৃণায় তার সমস্ত শরীর জ্বলছে। শহরের মুল নদীবন্দরে নোঙর ফেলা ছিল রাজ সভাসদদের বহনের জন্য চার দাঁড়ের বিশেষ নৌকা। চারজন মাঝি মাল্লা গালে হাত দিয়ে ঝিমোচ্ছিল। মাহতাব হাঁক দিতেই তারা সবাই নড়ে চড়ে উঠল।
দ্রুত নৌকায় উঠে পড়ল মাহতাব। প্রতাপাদিত্য নিশ্চয়ই এতক্ষণে চারিদিকে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে মাহতাব খানকে ধরার জন্য। যা কান্ড করে এসেছে মাহতাব খান, তাতে করে একবার এখানে ধরা পড়লেই মৃত্যু নিশ্চিত। প্রতাপাদিত্য তাকে হাত-পা বেঁধে জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় দগ্ধ করবে, এই বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই রাজ্য ছেড়ে পালাতে হবে।
মাহতাব নৌকায় উঠেই মাঝিদের খুব দ্রুত নৌকা বাইতে আদেশ করল। নৌকার মাঝি মাল্লাদের কাছে এখনও রাজ সংবাদ এসে পৌঁছায়নি। তারা মাহতাবের তাড়াহুড়োর কারণ বুঝল না। সেনাপতি মাহতাব খান যে প্রতাপাদিত্যের রাজ্য ত্যাগ করে পালাচ্ছে, এটা মাঝি-মাল্লাদের জানা নাই। জানলে অবশ্যই মাহতাবকে কোন প্রকার সাহায্য করত না তারা। কারণ এই ধরনের কাজ করার শাস্তিস্বরূপ প্রতাপাদিত্য যে তাদের শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে লবণ মাখিয়ে দিবে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। তারা হয়ত ভেবেছে সেনাপতি কোন বিশেষ কারণবশত যশোর ছেড়ে মনোহরপুরে যাচ্ছে।
দ্রুত নোঙর তুলে দিয়ে নৌকা ছাড়া হল। যশোরের বায়ুমণ্ডল এই মুহূর্তে মাহতাবের কাছে বিষাক্ত ঠেকছে। তাছাড়া সে যত বড় বীর পুরুষই হক না কেন, একা পুরো এক রাজ্যের সকল যোদ্ধার বিরুদ্ধে লড়াই করার চিন্তা করাও বোকামি। আপাতত তাই পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু পালানোর পূর্বে একবার চন্ডিক্যান রাজ্যের মনোহরপুর হয়ে যেতে হবে তাকে। রানী দুর্গাবতীকে শেষবারের মতো একটু দেখে নিতে চায় সে। তবে ওখানে আরও একজন আছে, যার কাছ থেকেও বিদায় নেয়া প্রয়োজন।
নৌকাযোগে মনোহরপুরে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল মাহতাব খানের। মনোহরপুরে রাজা প্রতাপাদিত্যের অবকাশ যাপনের জন্য একটা বিশাল রাজবাড়ী ও বিচার কার্য পরিচালনার জন্য একটা রাজ দরবার রয়েছে। গোটা চন্ডিক্যান রাজ্যে যশোরের পর মনোহরপুর হচ্ছে দ্বিতীয় সমৃদ্ধ অঞ্চল। রাজ দরবারের নিরাপত্তার জন্য ত্রিশ জন বন্দুকধারীর একটা দল সব সময় পাহাড়া দিয়ে যাচ্ছে, এছাড়া আছে আরও পঞ্চাশ জন তলোয়ার চালনায় ওস্তাদ সেপাহি। রাজার অনুপস্থিতে এই অঞ্চলে রাজকার্য পরিচালনার জন্য রয়েছেন একজন নায়েব এবং অন্যান্য পনের থেকে বিশ জন কর্মচারী।
রাজা প্রতাপাদিত্য এর চরিত্র নিয়ে বলার মত ভাল কোন গুণই হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তার স্ত্রীদের সঠিক সংখ্যা কারো জানা নাই। কেউ কেউ ধারণা করে সংখ্যাটা চল্লিশের বেশি, এদের মধ্যে ছয় জনকে রাজা প্রতাপ রানীর মর্যাদা দিয়েছেন। তাছাড়া বেশ কিছু রক্ষিতা বা উপপত্নীও রয়েছে। এসব বিষয় মানুষ জানে, কিন্তু মানুষের অজ্ঞাতসারে নির্দ্বিধায় অনেক কাণ্ড করে যাচ্ছেন রাজা। কত সুন্দরী রমণী যে মহারাজের লালসার শিকার হয়ে বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ- তার ইয়ত্তা নেই।
মনোহরপুরের রাজবাড়িতে রাজা প্রতাপাদিত্যের চতুর্থ রাণী দুর্গাবতী বাস করছেন। তিনি পূর্বে যশোরের ধুমঘাট রাজপ্রাসাদের প্রধান রানী ছিলেন। কিন্তু আস্তে আস্তে বয়স বাড়তে থাকল, সন্তানাদি হল। একসময় রানীর যৌবনে ভাঁটা ধরল। কিন্তু প্রতাপাদিত্যের মৌমাছি মন কেবল চায় নিত্য নতুন ফুলের সন্ধান। তাই বয়স বাড়তেই তার কাছে দুর্গাবতীকে অত্যন্ত নীরস বলে মনে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তবে এই কারণে রাজা দুর্গাবতীকে মনোহরপুরে নির্বাসিত করে দিয়েছেন- এমনটি নয়।
দুর্গাবতী ছিলেন সাহসী মহিলা, এমন কি রাজার সব কথাও তিনি অকপটে মেনে নিতেন না। একবার যদি কোন কারণে রেগে জান, তাহলে তাকে শান্ত করা সহজ কথা নয়। প্রাসাদের অন্য সব রানীরা তাই তার ভয়ে সব সময় তটস্থ হয়ে থাকত। দুর্গাবতী অন্য সব রানীকে নিজের ক্রীতদাসীদের চেয়েও বেশি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন। তাই অবশেষে মহারাজা প্রতাপাদিত্য রানী দুর্গাবতীকে মনোহরপুরে নির্বাসন দিয়ে আপাতত এই দারুণ সঙ্কট থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেল।
অবশ্য এই নির্বাসন হল দুর্গাবতীর জন্য শাপে-বর। দুর্গাবতী মনোহরপুরে এসে রাজা প্রতাপের নিত্য ব্যভিচার, অত্যাচার ও হাহাকারে ভরা যশোরের বিষাক্ত বায়ু থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। রাজা প্রতাপাদিত্য বছরে দুই একবার মনোহরপুরের দিকে এলে দুর্গাবতীর মহলে দুই এক রাত কাঁটিয়ে যায়। তাছাড়া দুর্গাবতীকে এক প্রকার বিধবার জীবনই কাটাতে হয়।
রাণী দুর্গাবতী একটি কন্যা এবং একটি পুত্র সন্তানের জননী। কন্যার বয়স আঠার পেরিয়েছে আগেই, নাম অরুণাবতী। আর শিশুপুত্র অরুণকুমার পঞ্চম বৎসরে পা দিয়েছে কেবল। অরুণাবতী পূর্ণ যুবতী। তার রূপের সুখ্যাতি ইতিমধ্যে চন্ডিক্যানের সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেলে অনেক দূর। এই রূপ যেন বর্ষার ভরা নদীর মত,দুইকূল ছাপিয়ে উছলে পড়ছে জল। চোখে মুখে সারাক্ষণ লেগে আছে লাস্যময়ী নারীর প্রেমানুভুতির আশ্চর্য বিচ্ছুরণ। টানা টানা চোখের অপলক চাহনি হাজার পুরুষের প্রাণের পিপাসা লক্ষ গুন বাড়িয়ে দিতে সক্ষম।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে এত রূপের গৌরব থাকা সত্ত্বেও বয়স আঠার পেরিয়ে যাওয়ার পরও, এখনও অরুণাবতীর বিয়ে হয়নি। বাংলার কোন রাজ্যের কোন রাজকুমারী এতটা বয়স পর্যন্ত সাধারণত অবিবাহিত থাকে না। তবে এই রকম ভাবার কোন কারণ নেই যে অরুনাবতীর পিতা মাতা কন্যাকে মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসেন, এখনই বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠাতে চাচ্ছেন না বলে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন না। বিয়ে না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে- পাত্র না জোটা।
শুনতে অবাক লাগলেও ব্যাপারটা সত্যি যে মহারাজা প্রতাপাদিত্যের মত একজন দোর্দণ্ড- প্রতাপশালী রাজার কন্যার বিয়ের জন্য যোগ্য পাত্র পাওয়া যাচ্ছে না। রূপের এত প্রশংসা থাকার পরও অরুণাবতীর বিয়ে হয় নাই, কারণ কেউ তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয়। এমন রূপসী কন্যাকে কেউ বিয়ে করতে না চাওয়ার পেছনে অবশ্য ছোটখাট একটা ইতিহাস রয়েছে।
এই পাত্র না জোটার কারণ হচ্ছে প্রতাপাদিত্যের কুটিল মস্তিস্ক প্রসূত অসুস্থ চিন্তা ভাবনা। প্রতাপাদিত্যের রাজ্য বরিশাল পর্যন্ত বিস্তৃত। অনেক দিন থেকেই তার নজর আছে পার্শ্ববর্তী ছোট্ট রাজ্য চন্দ্রদ্বীপের দিকে। তখন চন্দ্রদ্বীপের রাজা ছিলেন কন্দর্পনারায়ণ। রাজা প্রতাপ তার বড় কন্যা বিন্দুমতির সাথে চন্দ্রদ্বীপের অধিপতি কন্দর্পনারায়ণের পুত্র রামচন্দ্রের বিয়ে ঠিক করে। বিয়ে হয়েও গেল খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু কীভাবে চন্দ্রদ্বীপ হাতিয়ে নেওয়া যায় সেই চিন্তায় তার রাতে আর ঘুম হয় না।
কন্দর্পনারায়ণের পর তার পুত্র রামচন্দ্র রাজ্যের মালিকানা হস্তগত করবে। সে জীবিত থাকা অবস্থাতে বিনাযুদ্ধে রাজ্য অধিকার করা অসম্ভব প্রতাপাদিত্যের পক্ষে। যুদ্ধ বাঁধলে তাতে প্রতাপই জিতবেন এ কথা এক প্রকার নিশ্চিত ভাবেই বলে দেয়া যায়। কিন্তু যুদ্ধের মাধ্যমে জবরদখল করে নেওয়া রাজ্য কতদিন নিজের করায়ত্তে রাখতে পারবেন প্রতাপের সে বিষয়ে সংশয় আছে।
রামচন্দ্র বারো ভূঁইয়ার একজন। বার ভূঁইয়া সদস্য হওয়ার শর্তের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ভূঁইয়ারা কখনোই পরস্পরের সাথে বিরোধে লিপ্ত হবে না। তাই প্রকাশ্যে প্রতাপ যদি চন্দ্রদ্বীপ দখলের অভিযানে নামে তাহলে অন্যান্য ভুঁইয়ারা রামচন্দ্রের পক্ষে অবস্থান নিবে নিঃসন্দেহে এবং তা হবে প্রতাপাদিত্যের জন্য চরম দূর্দিনের নামান্তর। অন্যান্য ভূঁইয়ারা তাকে একঘরে করে দিলে শেষে নিজ রাজ্য হারানো হয়ে যাবে সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাংলার সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা প্রকৃতি বরাবরই বাহিরের মানুষকে টানে। ভূ- ভারতের যে কোনো রাজ্যের রাজা চন্দিক্যানকে অরক্ষিত অবস্থায় দেখলে আক্রমন করে বসবে নিশ্চিত ভাবে। সুতরাং সম্মুখ যুদ্ধে নামার মত বোকামি করা চলবে না তার।
অগত্যা বাধ্য হয়ে প্রতাপাদিত্য তার মন্ত্রী শামাকান্তের সাথে পরামর্শ করে এক কৌশলের আশ্রয় নিলেন...
প্রতাপাদিত্য তার জামাতাকে এক বিশেষ উপলক্ষে ধূম-ধামের সহিত নিমন্ত্রণ করলেন। কুমার রামচন্দ্র শ্বশুরের নিমন্ত্রণ পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যশোরের রাজপ্রাসাদে সস্ত্রীক আগমন করল। দিনব্যাপী জামাতাকে বিশেষ সমাদার ও খাতির যত্ন করা হল। এদিকে বিশেষ গুপ্তচর ঠিক করে রাখা হয়েছে গভীর রাত্রে ঘুমন্ত অবস্থায় রামচন্দ্রকে খুন করার জন্য। পাষণ্ড রাজা একবার ও নিজের কন্যার কথা চিন্তা করে দেখল না। অল্প বয়সে মেয়েটি বিধবা হলে তাকে স্বামীর সাথে সতীদাহ হতে হবে। একজন পিতা কি করে নিজ হস্তে নিজ কন্যার মৃত্যুর বার্তা লিখতে পারেন তা জগতের অন্য কোন পিতার পক্ষে কল্পনাও করা সম্ভব নয়। ক্ষমতার লোভ মানুষকে জানোয়ারে রূপান্তর করে। প্রতাপের চারিত্রিক গুনাবলির মাঝে তার প্রমাণের কোন কমতি ছিলনা।
কিন্তু প্রতাপের এই ষড়যন্ত্র সফল হওয়ার সুযোগ পেলনা। বুদ্ধিমান রাজকুমারী বিন্দু টের পেয়ে গেল এই ষড়যন্ত্র। সে তার স্বামীকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে হুশিয়ার করে দিল। রামচন্দ্র বেশ বিচক্ষণ ছিল। রাতের বেলা গুপ্তচর হামলার পূর্বেই কৌশলক্রমে প্রতাপাদিত্যের প্রাসাদ থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে কোন ক্রমে পালিয়ে বেঁচে গেল রামচন্দ্র, পরে লোক পাঠিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে গেল সে। আর কখনও রামচন্দ্র যশোরে পদার্পণ করেনি।
কিন্তু এই ঘটনা লুকিয়ে থাকল না। রামচন্দ্র প্রতাপাদিত্যের এমন অসুস্থ চিন্তা ভাবনার কথা সমস্ত বাংলায় ছড়িয়ে দিল। ঘটনার রেশ বাংলা ছাড়িয়ে চলে গেল বহুদুর। এখনও লোক মুখে একথা ঘুরে বেড়ায়। আর যে এই ঘটনা শোনে, তারই শরীর ঘৃণায় রি রি করে হয়ে। এমনতর ঘটনার পর কোনও রাজা বা রাজার পুত্র কি জমিদার প্রতাপাদিত্যের অপরাপর কন্যার সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধে আবদ্ধ হতে চাইবে? কখনোই নয়। এ-দিকে মধ্যবিত্ত বনিক শ্রেণীর লোকেরাও কেউ রাজার কন্যার প্রতি আকৃষ্ট নন। কারো সাহস নেই সুন্দরবনের বাঘের ন্যায় মানুষের রক্ত-লোলুপ রাজা প্রতাপাদিত্যের কন্যার সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার চিন্তা করে। কে বিয়ে করার চিন্তা করে। এদিকে অহংকারী রাজা নিজেও কোন রাজা বা রাজপুত্র ব্যতিত অন্য কারো কাছে কন্যা সম্প্রদানের কথা কল্পনাও করে না। তাই তো মাহতাবের প্রতি অরুণার আসক্তির কথা রাজার কানে আরও আগে এলেও, রাজা কোন আমল দেননি। কিন্তু স্বর্ণময়ীর প্রেমে অন্ধ রাজা প্রতাপাদিত্য বাধ্য হয়ে নিজ অবস্থান থেকে সরে এসে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে মাহতাব খানের কাছে অরুণাবতীকে সমর্পনের ব্যাপারে সম্মত হলেন। কারণ মাহতাব ব্যতিত স্বর্ণময়ীকে তার হাতে তুলে দেওয়ার মত সাহস ও ক্ষমতা আর কারো নেই। কিন্তু প্রতাপের দুর্ভাগ্য যে খান সাহেব স্বর্ণময়ী-হরণ অভিযানে নেতৃত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানাল।
মাহতাব যে কাজ করে এসেছে তাতে করে যত দ্রুত সম্ভব চন্ডিক্যান ছেড়ে যাওয়াই তার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু প্রতাপাদিত্যের রাজ্য হইতে চিরবিদায় নেওয়ার পূর্বে অন্তত একবার মনোহরপুরে অবতরণ করে মাতৃতুল্য রাণী দুর্গাবতীর আশীর্বাদ নিয়ে যাওয়ার বিকল্প কিছু চিন্তা করতে পারছে না মাহতাব। অরুণাবতীকে তার ভাল লাগে সত্যি, কিন্তু সেই ভাল লাগায় কোন ধরণের প্রেমের নেশা কখনও প্রবেশ করার অবকাশ পায়নি। অরুণাবতীকে মাহতাব প্রেয়সী রূপে নয়, মনিবের কন্যা রূপেই সব সময় দেখেছে এবং সমীহ করে এসেছে। কিন্তু একটা অনুভূতির রূপে সন্ধান পেয়ে মাহতাব বেশ বিচলিত হয়ে পড়ল, সে অনুভব করতে পারছে চন্ডিক্যান ছেড়ে যাচ্ছে বলে যে কষ্ট হচ্ছে মাহতাবের, তার পুরোটা মহারানী দুর্গাবতীর জন্য নয়। অরুনাবতীকে আর কখনও চর্ম চক্ষুতে দেখার অবকাশ পাবেনা, এটাও বেশ কষ্ট দিচ্ছে তাকে।
মাহতাব খান ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে ডাঙায় উঠল। রাজ বাড়ি খুব কাছেই। বাড়ির প্রহরী মাহতাবকে দেখে সমীহ ভরে জায়গা ছেড়ে দিল দেখে মনে মনে হাসল মাহতাব। এরা এখনও জানেনা যে মাহতাব প্রতাপাদিত্যকে রীতিমত প্রহার করে পালিয়ে এসেছে। জানতে পারলে সম্মান দেয়ার পরিবর্তে পেছন থেকে পিঠে তলোয়ার বসিয়ে দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। মাহতাব অন্তঃপুরে প্রবেশ করল। রাণী দুর্গাবতী মাহতাব খানকে দেখে পরম আনন্দে পুলকিত হলেন।
তাড়াতাড়ি ব্যতিব্যস্ত হয়ে দাসীদের নির্দেশ দিলেন মাহতাবের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য। “এই তোরা হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে কি দেখছিস? জলদি যা, জল খাবারের আয়োজন কর। দেখছিস না বাছা আমার কতদুরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। আহারে। কেমন মুখটা শুকিয়ে গেছে।”
মাহতাব খান জলযোগের আয়োজন দেখে রাণীকে বলল, “মা! আমার জলখাবার খাওয়ার মত সময় নেই। আমি এসেছি আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে। আমাকে এখনই মহারাজের রাজ্য ছেড়ে পালাতে হবে। যদি বেঁচে থাকি এবং আল্লাহ যদি কপালে সুদিন লিখে রাখেন, তাহলে আবার একদিন আপনার চরণে এসে ঠাঁই নেব মা।”
দুর্গাবতী হত বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে মাহতাবের দিকে, “বল কি মাহতাব? চলে যাবে? মাকে ছেড়ে চলে যাবে তুমি? হঠাৎ কি এমন ঘটল যে একেবারে রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার পণ করে বসেছ?”
মাহতাব কালক্ষেপণ করল না। যতটা সম্ভব সংক্ষেপে পুরো বিষয়টা বিস্তারিত বুঝিয়ে বলল রানী দুর্গাবতীকে। শুধু রাজার মুখের ওপর পাদুকা চালনা করার ব্যাপারটি একটু চেপে গেল।
সব কিছু শোনার পর রাণী দুর্গার চোখ থেকে অঝোরে অশ্রুধারা গড়াতে লাগিল। তবে এই অশ্রুর কারণ প্রতাপাদিত্যের ব্যভিচারের প্রচেষ্ট নয়, এই অশ্রুর কারণ তিনি বুঝেছেন মাহতাব কত বড় বিপদে পড়েছে এবং এই রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়া ভিন্ন অন্য কোন উপায় তার সামনে খোলা নেই। রাণী সত্যিই মাহতাব খানকে আপন পুত্রের ন্যায় ভালোবাসেন। নিজ কন্যা অরুনাবতীকে মাহতাবের হাতে তুলে দেবেন বলে মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন। কিন্তু মাহতাব চলে গেলে সমস্ত স্বপ্ন তার ব্যর্থ হয়ে যাবে।
রাণী দুর্গাবতী কিছুতেই কান্নার বেগ আটকে রাখতে পারছেন না। অথচ এটি সম্পূর্ণ অর্থে রানীর স্বভাব বিরুদ্ধ। জগতে কিছু কিছু লোক আছে যারা তীব্র কষ্টের দিনেও লোকের সম্মুখে কাঁদতে পারে না। রাণীও ঠিক সেই প্রকৃতির একজন শক্ত সামর্থ মহিলা ছিলেন। কিন্তু সেই কঠিন মানুষটি মাহতাবের দেওয়া দুঃসংবাদ পেয়ে প্রায় মূর্ছা যাচ্ছেন- এমন অবস্থা। রানী উঠে দাঁড়িয়ে অন্য একটি ঘরে চলে গেলেন। ঘরের ভেতর ঢোকার পরতার রুদ্ধপ্রাণের উচ্ছ্বাস একেবারে গুমরে উঠল। রাণী কাঁদিতে লাগলেন। যেন সারা জীবন বানের জল আটকে রাখা এক বাঁধ আজ পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। রাণী একদিকে পুত্রকে হারানো, অন্যদিকে কন্যার কোন গতি না হওয়ার আশঙ্কায় কান্নায় অভিভূত হয়ে পড়লেন।
এদিকে অরুণাবতী কয়েকটি রুপোর বাটিতে নানা প্রকার মিষ্টান্ন এবং ফলমূল দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে এসে মহলের অতিথিদের বসার কক্ষে প্রবেশ করল। মাহতাব অনেকটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বসে ছিল। অরুণাকে দেখে একটু সপ্রতিভ হাসি হাসার চেষ্টা করল। রাজ্যের নানা কাজে এখন মাহতাবকে বেশিরভাগ সময় যশোরেই থাকতে হয়, তাই প্রায় ছয় মাস পরে আজ অরুণাবতীকে দেখল সে।
অরুণাকে দেখার পর মাহতাবের যে প্রতিক্রিয়া হল তাকে চমকিত, বিস্মিত, স্তম্ভিত সহ সকল প্রকার অবাক হওয়ার বিশেষণ দ্বারা বোঝানো যায়। প্রথমে অরুণাকে চিনতে কিছুটা কষ্ট হল মাহতাবের কিন্তু চিনতে পারার পর তার বিস্ময় মাত্রা ছাড়াল। মাত্র ছয় মাসে অরুণাবতীর রূপ যেন কয়েকশ গুন বেড়ে গেছে। এমন কমনীয়- মোহনীয় রমণীরূপে সে অরুণাকে আগে কখনো দেখেনি। পরনের নীল রঙের শাড়ি মেয়েটিকে স্বর্গের নীল অপ্সরীরূপে প্রতীয়মান করেছে মাহতাবের দৃষ্টিতে। মাহতাবের মনে হল এক নিমেষে সে যেন এক স্বপ্নের রাজ্যে উপনীত হয়েছে। সেই রাজ্যের সম্রাজ্ঞী অরুণাবতী আর মাহতাব তার গোলাম; যেন রানীর রূপ একবার দেখার বিনিময়ে সারাজীবন দাসত্ব করার শপথ নিয়েছে সে। অরুণার অনিন্দ্য সুন্দর মুখশ্রীর সাথে তুলনা চলে এমন কোন মেয়ে মানুষ এ তল্লাটে দেখেনি মাহতাব। ঐ মুখ দেখলে সহস্র পুরুষের রাত্রির ঘুম হারাম হবে নিশ্চিতভাবে। একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, মেয়েটি বহুকষ্টে বহুসাধনায় তার যৌবনের প্রভাকে নিজের আয়ত্তে রাখতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু এটা সত্যি যে অরুণার এই রূপ ছয় মাসে হয়নি। মাহতাব ছয় মাস দেখেনি বলেই হয়ত তার কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটির রূপ হঠাৎ করে বাঁধা না মেনে সমহিমায় ভাস্বর হয়েছে।
অরুণা অনেক ছোট থাকতেই দুর্গাবতী বলতেন, “মেয়েকে আমার সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হবে। এই মেয়েকে নিয়ে কপালে দুর্ভোগ আছে আমার। একে ঘরে তোলার জন্য তো অন্যান্য রাজ্যের রাজায় রাজায় যুদ্ধ বেঁধে যাবে।”
হয়ত সত্যিই তাই হত, যদি না রাজা প্রতাপাদিত্যের লোভ- লালসা পরিমাণ এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করত।
ঘরে ঢুকে মাহতাবকে দেখার পর থেকে অরুণাবতীর ডাগর চোখে লজ্জার আভাস; সমস্ত শরীরে যেন অনবরত বিদ্যুৎ খেলা করছে। অরুণাবতী পূর্বে হাজারবার মাহতাবকে চোখের সামনে দেখেছে, ছোট বেলায় মেয়েটি তার কোলেও চড়েছে অনেকবার, হাত ধরে নদীতীরে ঘুরে বেরিয়েছে। কিন্তু আজ সে যে দৃষ্টিতে মাহতাবকে দেখছে অরুণা, তা আগের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ অরুণার চোখে মাহতাব খান সুদর্শন-সুঠাম-লোভনীয় পুরুষ। তার বলিষ্ঠ বাহুগুলির সামান্য নাড়াচাড়ায় অসংখ্য পেশি কিল বিল করে ওঠে, অরুণার খুব সাধ হয় ঐ দুই বাহুর বন্ধনে নিজেকে সঁপে দিতে। মাহতাবের সপ্রতিভ হাসিতে অরুণা অস্থির চিত্ত আজ যেন খুঁজে পাচ্ছে নির্ভরতার আশ্রয়। তবে এই পরিবর্তন হঠাৎ করে নয়, একটু একটু করে হয়েছে। অরুণাবতীর মনের মন্দিরে অবশ্য মাহতাব অনেক আগে থেকেই প্রেম-দেবতা রূপে স্থান গ্রহণ করে আছে। যেদিন থেকে ভালবাসা কি- সেই ধারণা হতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই অরুণাবতী তার একান্ত আপন পুরুষরূপে মাহতাব ছাড়া আর কাউকে কল্পনা করতে পারেনি। অরুণার চোখে মাহতাব জগতের সুন্দরতম পুরুষ। রাতের শেষে ভর হলে যেমন হতশ্রী উদ্যানকেও স্বর্গীয় সৌন্দর্যে বিশোভিত বলে মনে হয়, ঠিক তেমনি জীবনে প্রেম এলো মনের মানুষটি চোখের সামনে অলৌকিক সৌন্দর্য, অসাধারণ গুণ আর অপার্থিব মহিমায় বিভূষিত হয়।
মাহতাব খান রীতিমত কষ্ট করে অরুণার মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরাল। সে প্রথমে ভাবল খাবার খেতে অস্বীকৃতি জানাবে। মনের ভেতর কোথাও একটা ঘন্টা বাজছে ঢং ঢং করে বেজে জানান দিচ্ছে যে সময় একদম ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু অরুণার মুখের পানে চেয়ে খেতে আপত্তি করল না মাহতাব। মাথা নিচু করে বিনা বাক্য ব্যয়ে খাওয়ায় মন দিলো সে। অরুণাবতী মাহতাবের কাছ থেকে একটু দূরত্ব নিয়ে বসল। অপলক চোখে ভালবাসার মানুষটিকে দেখছে।
খেতে খেতে মাঝে মধ্যে চোখ তুলে তাকাচ্ছে মাহতাব, কাজটা করা ঠিক হচ্ছে কি না জানে না সে; কিন্তু দৃষ্টিকে সামাল দেয়া খুব কঠিন হয়ে পড়েছে তার জন্য। প্রতিবার মাহতাবের তাকাতেই অরুণাবতী তার ভুবন-মোহিনী দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিচ্ছে। লজ্জায় তার মুখমণ্ডল আরক্তিম হয়ে উঠছে। আবার মাহতাব খান চোখ নামিয়ে খাবারে মনযোগী হতেই অরুণাবতীর চঞ্চল ও পিপাসাতুর চোখ দুটির দৃষ্টি মাহতাবের দিকে নিবদ্ধ হচ্ছে। চোখচোখি হতেই দুজনের হৃদয়ে প্রেমের অনুভূতি যেন টগবগ করে ফুটছে, শরীর শিহরিত হচ্ছে, মন দুলে উঠছে।
কিন্তু সেনাপতি মাহতাব খান খুব বেশিক্ষণ সেই অনুভূতিকে স্থায়ী হতে দিলনা। “পালাতে হবে” “পালতে হবে” মাথার ভেতর কেউ একজন অনবরত এই কথা বলে যাচ্ছে তাকে। নিজেকে সংযত করে খুব সামান্য কিছু খেয়েই হাত ধুয়ে ফেলতে উদ্যত হল মাহতাব,তাই দেখে অরুণাবতী চমকে উঠল। বলল, “সে কি!”
অরুণা লজ্জার বাঁধ ভেঙে এগিয়ে এল মাহতাবের কাছে। মাহতাবের হাত ধরে লাজুক সুরে বলল, “উঠা চলবেনা, অনেক দূও থেকে এসেছেন। সারাদিন খাওয়া হয়নি, সব খেতে হবে।”
অরুণাবতীর স্নেহমাখা সুকোমল স্পর্শে মাহতাব খানের সমস্ত শরীরে সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হল। কিন্তু এই অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার অবস্থায় সে নেই এখন। বলল, পারব না অরুণা। যতদ্রুত সম্ভব চলে যেতে হবে আমাকে।
অরুণাবতী আরক্তিম। চোখ নামিয়ে রেখেছে কিন্তু মাহতাবের হাত ছাড়েনি এখনো। বলল, “যেতে হলে যাবেন, কিন্তু খাবার শেষ না করে আপনাকে উঠতে দিচ্ছি না সেনাপতি সাহেব।”
মাহতাব হাত ছাড়িয়ে নিল, “তুমি বুঝবে না অরুণা। একটু কম খেলে হয়ত মরে যাব না আমি, কিন্তু এখানে থাকলে প্রাণ হারাতে হবে। এখানে একটা মুহূর্ত বেশি থাকা মানেই বিপদের আশংকা বাড়তে থাকা।”
“কী বলছেন এসব?” অরুণাবতী মুখ তুলে তাকাল মাহতাবের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে চোখে কোনে অশ্রুবিন্দু ছল ছল করে উঠেছে। “কে মারবে আপনাকে?”
“তোমার পিতা।” নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল মাহতাব খান।
“আমার পিতা?” যারপর নাই অবাক হয়েছে অরুণা। “আমার পিতা কেন আপনাকে মারতে চাইবে? আমার পিতা তো আপনাকে সন্তানের চোখে দেখেন।”
মাহতাব তিক্ত ভঙ্গিতে হাসল। বলল, “তোমার পিতা কেমন মানুষ তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয় অরুণাবতী। মহারাজ প্রতাপাদিত্য তার কার্যসিদ্ধির জন্য আপন পিতা মাতাকে খুন করতেও হয়ত দ্বিধা করবেন না। আমি তো সেখানে নস্যি।”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না সেনাপতি সাহেব। দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?”
মাহতাব এক মুহূর্ত থেমে থেকে অরুণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। খোদার সৃষ্টির বৈচিত্র্য দেখে তাজ্জব হতে হয়। অমন পাষণ্ড-বর্বর পিতার ঔরসে এমন নিষ্পাপ সন্তানের জন্ম কি করে হল? সন্তানের সামনে তার পিতার বদ চরিত্রের বর্ণনা কি করে দিতে হয় তা মাহতাবের জানা নেই। তবুও সে চেষ্টা করল যথাসম্ভব ভদ্র ভাষায় অরুণাবতীকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলার।
ভদ্র ভাষায় বলা হলেও, কথার মধ্যে অভদ্র অংশটুকু বুঝে নিতে কোন কষ্ট হল না অরুণাবতীর। পুরো ঘটনাটা শুনে মেয়েটির মনে হল বুকের ভেতরটা খুব জোওে কেউ নাড়িয়ে দিয়েছে। কষ্টের একটা বীজ দলা পাকিয়ে বুক থেকে বেয়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বাকশূন্য স্পন্দনহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে।
মাহতাব সান্তনা প্রদানের সুরে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। মেয়েটির সামনে আজ তার বাবার চরিত্রের আরও একটি কুরুচিপূর্ণ দিক উন্মোচিত হয়েছে। এই মুহূর্তে তার জন্য সান্তনার বানী কি হতে পারে তা মাহতাবের জানা নাই।
অরুণাবতীর দুই চোখ অশ্রুর ধারা ছুটল। মুহূর্তের মাঝে সে ছিন্ন লতার মত সে ন্যায় মাহতাব খানের দু পায়ের ওপর পতিত হল। মাহতাবের পায়ের উপর মুখ ঠেকিয়ে হাপুস নয়নে কান্না জুড়ে দিল। মাহতাব ব্যতিব্যস্ত হয়ে তাকে দুহাতে ধরে মাটি থেকে তুলল। “আরে করো কি? করো কি?”
এবার আর লজ্জা এসে অরুণাকে বাঁধা দিতে পারল না। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাহতাবের প্রশস্ত বুকে। দুই হাতে তাকে আলিঙ্গন করে প্রাণ ভরে কাঁদতে থাকল। মেয়েটির সমস্ত দেহ থর থর করে কাঁপছে।
মাহতাব এক মুহূর্তের জন্য কি করবে ভেবে পেলনা। কিন্তু মেয়েটি পড়ে যেতে পারে এই ভেবে শক্ত করে দুহাতে ধরল সে। অরুনাবতী নীল শাড়ির আঁচল সরে গিয়ে দুধ-সাদা পিঠ দেখা যাচ্ছে। মাহতাব অরুণাকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। নগ্ন পিঠে প্রিয়তমের হাতের স্পর্শে অরুণাবতীর শরীরের প্রতিটি অনু-পরমাণুতে যে প্রেমের তীব্র উচ্ছ্বাস প্রবাহিত হল, তা অরুণার পক্ষে সামলানো সম্ভব হল না। একে তো পিতার অসভ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এই মাত্র তার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে, তার উপরে যোগ হয়েছে পিতার সাথে প্রেমের মানুষের দ্বন্দ্বের ফলে প্রেমিকের চলে যাওয়ার ভয়, এর পর আর নগ্ন ত্বকে প্রেমিকের প্রথম ছোঁয়া তার স্বাভাবিক চেতনায় থাকার উপার রাখল না। অরুনাবতী জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাহতাবের বুকে।
মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে গেছে বুঝতে পেরে মাহতাব শঙ্কিত হয়ে উঠল। মেয়েটিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে পাজকোলা করে তুলে নীল মাহতাব। তারপর আসনে বসে অরুণার মাথা রাখল নিজের হাটুর ওপর। দ্রুত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে গগনবিদারী চিৎকার ছাড়ল রানী দুর্গাবতীর উদ্দেশ্যে, “রাণী মা! রাণী মা! কোথায় আপনি? শিঘ্রই আসেন, অরুণা মূর্ছা গেছে।”
রানী দুর্গাবতী নিজের কামড়ায় বসে বসে কাঁদছিলেন। মাহতাবের ডাক শুনে চমকে উঠে বেরিয়ে এলেন। বসারঘরে এসে দেখলেন মাহতাব অরুণাকে নিজকোলে শুইয়ে বাতাস করছে। রানী প্রায় দৌড়ে এলেন এই দৃশ্য দেখে। জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে মাহতাব? কি হয়েছে অরুণার?”
“আমি ঘটনাটা খুলে বলতেই অরুণা মূর্ছা গিয়ে লুটিয়ে পড়েছে।” বলল মাহতাব। লুটিয়ে যে তার বুকে পড়েছে এই ব্যাপারটা গোপন করে গেল সে।
রানী আতংকিত কণ্ঠে বলল, “অরুণাকে তার কামড়ায় নিয়ে চল। চোখে মুখে জলের ছিটে দিলে জ্ঞান ফিরে আসবে।”
অরুণাকে আবার পাজকোলা করে কোলে তুলে নিলো মাহতাব।
রাত বাড়ছে। অরুণার জ্ঞান ফেরার পর আরও বেশ খানিকটা সময় মহলে কাটাল মাহতাব। অরুণা শুয়ে আছে তার কামড়ার বিছানায়। ধাক্কাটা কাঁটিয়ে উঠতে পারে নি এখনও। অরুণার কামড়ার বাইরে বসে মাহতাব অরুণার ছোট ভাই শিশু রাজকুমারের সাথে কিছুক্ষণ নানান গল্প করে সময় কাঁটাল । কিন্তু মনের মধ্যে আশংকার ডামাডোল বেজেই চলেছে তার। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সারারাজ্য জেনে গেছে ব্যাপারটা। রানী দুর্গাবতী এতক্ষণ কন্যার শিয়রের কাছে বসে তার সেবা করেছেন। কামরা থেকে বেরিয়ে আসতেই মাহতাব জিজ্ঞেস করল, রানী মা, অরুণা কেমন আছে এখন?
“ভালো আছে বাবা। তেমন কিছু হয়নি”। রানী দুর্গাবতী হাসলেন। অরুণার জন্য মাহতাবের এই দুশ্চিন্তা তার ভাল লাগছে।
মাহতাব অত্যন্ত বিনীত ও কাতরভাবে বলল, এবার যে তবে যেতে হয় মা। আমাকে বিদায় দিন।
রাণীর মুখ থেকে মুহূর্তের মাঝে হাসি মুছে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তিনি বর্তমান পরিস্থিতি ভুলে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সেটাই উত্তম হবে বাবা! চলে যাও এই রাক্ষসের রাজ্য ছেড়ে, এতেই তোমার মঙ্গল। আমি আর্শীবাদ করি তুমি নিরাপদ ও দীর্ঘজীবন লাভ করবে। কিন্তু একটা কথা শুধু বলে যেতে পারবে আমায়?”
“কি কথা রানী মা?”
“আমার অরুণাবতীর কি হবে?”
মাহতাব এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না।
রাণী আর কিছু বলতে পারলেন না, কাঁদতে থাকলেন। মাহতাব খানের ভেতরটাও জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এই স্থান পরিত্যাগ করতে তার পা যেন অগ্রসর হতে চাইছে না। মাহতাবের হৃদয় পুরোপুরি অরুণাবতীতে ডুবে গেছে। এখান থেকে উঠে আসা খুব সহজ কোন কাজ নয়। তার একবার মনে হচ্ছে- “না যাব না, অরুণাবতীকে ছেড়ে কিছুতেই আমি যাব না। যা হবার তাই হোক। কিন্তু অরুণাবতীকে ছাড়া বেঁচে থাকার আমার পক্ষে সম্ভব নয়”। আবার পরক্ষণেই ভাবল,“এখানে আমি থাকবই বা কোথায়? যে কাজ করেছি তারপর কি আর প্রতাপাদিত্য আমাকে তার রাজ্যে ঠাঁই দেবে? শেষে আমার জন্য অরুণাবতীকেও করুণ পরিণতি বেছে নিতে হবে।”
মাহতাব খান বজ্রাহতের মত বেশ কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল। কোন নারীর প্রতি এমন দুর্বলতা সে জীবনে কখনও উপলব্ধি করেনি। আজ তিনি দেখলেন, হৃদয় প্রেম-সুরায় উন্মুক্ত হইয়া তাহাকে প্রশান্ত করা ভীষণ অসম যুদ্ধে জয়লাভ করা অপেক্ষাও শত কঠিন।
“অরুণাবতীর কী উপায় হবে?” এইপ্রশ্ন সারাক্ষণ মাহতাবের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকল। কিন্তু কোন সদুত্তর মাহতাব দিতে পারলনা। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল। রানী দুর্গাবতী নিরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন। মাহতাব চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দূর আকাশের কোণে গুড় গুড় করে মেঘ ডেকে ওঠার শব্দে মাহতাব চমকে উঠল।
মাহতাব রানীর উদ্দেশ্যে বলল, “মা! আমি জীবনে কখনও অরুণাবতীকে ভুলব না। এই মুহূর্তে এই রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ভিন্ন আমার সামনে কোন উপায় খোলা নেই। এখানে আমার সেনাপতি আর নেই, আমার কোন লোকবল নেই। রাজা প্রতাপাদিত্যের রোষানলের সামনে আমি টিকব না। তবে আমি কথা দিচ্ছি মা; যদি কখনো আমার সুদিন ফেরে, যদি আবার কোন রাজ্যে গিয়ে ভাল পদমর্যাদা অর্জন করে নিতে পারি, তাহলে আমি ফিরে আসব। আমি ফিরে এসে অরুণাকে বিয়ে করব। অরুণা ব্যতীত এই জীবনে কাউকে বিয়ে করব না। আমি একজন সাচ্চা মুসলিম। একজন সাচ্চা মুসলিম কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করে না মা। তবে এই মুহূর্তে আমি কিছুই করতে পারছি না।
এক মুহূর্ত থেমে থাকল মাহতাব। তারপর আবার বলতে শুরু করল,
“আমাকে এখন পথের কাঙালের সাথে তুলনা করা চলে। ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে ফেলবে আমি জানি না মা! আমি অল্প বয়সে পিতা মাতা হারিয়েছি। কান্দাহারে জন্ম নিয়ে দিল্লী হয়ে কত রাজ্য ঘুরে এসে আপনার চরণে ঠাঁই পেয়েছিলাম। আপনারা আমাকে প্রতিপালন করেছেন। আপনাদের ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস আজ আমাকে স্বার্থপর হতে বাধ্য করছে। ঘটনা যা ঘটেছে, তাতে শীঘ্রই রাজ্য ছাড়তে না পারলে প্রাণ পর্যন্ত হারাতে হবে। হয়ত এতক্ষণে আমাকে ধরার জন্য যশোরের রণতরী অর্ধেক পথে পর্যন্ত এসে উপস্থিত হয়েছে। আমাকে বিদায় দিন মা।”
রাণী দুর্গা চোখ মুছলেন। মাহতাবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “বৎস! যেতেই যখন হবে, তখন আর বিলম্ব করো না। অতিসত্বর প্রস্থান কর। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।”
রাণীকে সালাম করে আর্শীবাদ গ্রহণ করল মাহতাব। তারপর দ্রুত পায়ে রাজবাড়ি ত্যাগ করল। ঘাটে বাঁধা ছিল রাজ নৌকা। এখনও এখানে মাহতাবের পালানোর খবর এসে পৌঁছায়নি। মাহতাব নৌকায় উঠে তাড়াতাড়ি নোঙর তুলে নিয়ে মাল্লাদের দ্রুত দাঁড় ফেলতে বলল।
অরুণাবতীর কামরার বাইরে যখন মাহতাব আর রানী দুর্গাবতী কথা বলছিলেন, তখন অরুণাও চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে নেমে এসে দরজায় কান পেতেছিল দুজনের কথোপকথন শোনার আসায়।
“আমার অরুণাবতীর কী হবে?” রাণী দুর্গাবতীর এ কথায় শোনার সাথে অরুণাবতীর দুচোখ বেয়ে আবার জলের ধারা নামল। মাহতাবের উত্তর শোনার অপেক্ষায় সে দুরু দুরু বুকে কান পেতে থাকল দরজায়। মনে আশা- মাহতাব হয়ত বলে উঠবে- “আমি কোথাও যাব না। আমি এই রাজ্যেই থাকব, আমি অরুণাবতীর কাছে থাকব।”
কিন্তু মাহতাব সে কথা বলল না। মাহতাব সব কিছু ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলল।
অরুণাবতী স্পষ্ট বুঝল, মাহতাব থাকবে না। কোন কিছুই আর তাকে আটকে রাখতে পারবেনা এখানে। সে চলে যাবে। চিরতরে সব কিছু ছেড়ে চলে যাবে। আর কখনো ফিরবেনা। কেমন করে ফিরবে? সে যতই ফিরে আসার কথা বলুক না কেন, সে কখনোই ফিরে আসতে পারবেনা। তার পিতা রাজা প্রতাপাদিত্য আর কখনো মাহতাবকে ফিরে আসতে দেবেনা। ফিরে আসলেই যে তাকে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে। চন্ডিক্যানের দুর্দান্ত সেনাপতি এখন চন্ডিক্যানে অনাকাক্সিক্ষত।
অরুণাবতী প্রায় দৌড়ে এসে বিছানায় উপর পড়ে ছট ফট করে কাঁদতে থাকল। কেউ একজন যেন অরুণাবতীর মাথার মধ্যে বলে উঠল, “ওরে পোড়ামুখী এতসাধ করেছিলি কেন? জানিস না? বেশি সাধ করলে কমও মিলে না? যে চলে যাচ্ছে তার জন্য আর কেঁদে কি হবে? চোখ মুছে নে। ভুলে যা তাকে।”
কিন্তু অরুণা যতই মাহতাবের কথা চিন্তা করা থেকে নিজেকে বিরত করার চেষ্টা করল, ততই তার কাছে মাহতাব চলে যাওয়ার বিরহ অসহ্যকর হয়ে উঠল। এক সময় আর না পেরে অরুণা মস্তিষ্কের ভেতরকার সেই অদৃশ্য অস্তিত্বকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে উঠল, “না, পারব না। আমি মাহতাবকে ভুলে যেতে পারব না। মাহতাবকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসতে পারব না।”
পর মুহূর্তে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল অরুণা। উন্মাদিনীর মত বিছানা থেকে নেমে পড়নের কাপড় পরিপাটি করে নীল। মাথার চুল আচড়ে নিল। তারপর সঙ্গোপনে কামরা থেকে বেরিয়ে এল। প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে রাজবাড়ির পেছনের দরজা খুলে বাইরে বের হল। তারপর কোমরে শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে নিয়ে নদীর ঘাটের পানে ছুটল। ছোটবেলা থেকেই প্রচুর দৌঁড় ঝাপ করে বড় হয়েছে অরুণা। মাহতাবের নৌকা তখন ছেড়ে দিচ্ছে প্রায়। অরুণার বিশ্বাস মাহতাব খুব বেশিদূর যাওয়ার আগেই সে ধরে ফেলতে পারবে...