অরুণাকে দেখার পর মাহতাবের যে প্রতিক্রিয়া হল তাকে চমকিত, বিস্মিত, স্তম্ভিত সহ সকল প্রকার অবাক হওয়ার বিশেষণ দ্বারা বোঝানো যায়। প্রথমে অরুণাকে চিনতে কিছুটা কষ্ট হল মাহতাবের কিন্তু চিনতে পারার পর তার বিস্ময় মাত্রা ছাড়াল। মাত্র ছয় মাসে অরুণাবতীর রূপ যেন কয়েকশ গুন বেড়ে গেছে। এমন কমনীয়- মোহনীয় রমণীরূপে সে অরুণাকে আগে কখনো দেখেনি। পরনের নীল রঙের শাড়ি মেয়েটিকে স্বর্গের নীল অপ্সরীরূপে প্রতীয়মান করেছে মাহতাবের দৃষ্টিতে। মাহতাবের মনে হল এক নিমেষে সে যেন এক স্বপ্নের রাজ্যে উপনীত হয়েছে। সেই রাজ্যের সম্রাজ্ঞী অরুণাবতী আর মাহতাব তার গোলাম; যেন রানীর রূপ একবার দেখার বিনিময়ে সারাজীবন দাসত্ব করার শপথ নিয়েছে সে। অরুণার অনিন্দ্য সুন্দর মুখশ্রীর সাথে তুলনা চলে এমন কোন মেয়ে মানুষ এ তল্লাটে দেখেনি মাহতাব। ঐ মুখ দেখলে সহস্র পুরুষের রাত্রির ঘুম হারাম হবে নিশ্চিতভাবে। একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, মেয়েটি বহুকষ্টে বহুসাধনায় তার যৌবনের প্রভাকে নিজের আয়ত্তে রাখতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু এটা সত্যি যে অরুণার এই রূপ ছয় মাসে হয়নি। মাহতাব ছয় মাস দেখেনি বলেই হয়ত তার কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটির রূপ হঠাৎ করে বাঁধা না মেনে সমহিমায় ভাস্বর হয়েছে।
অরুণা অনেক ছোট থাকতেই দুর্গাবতী বলতেন, “মেয়েকে আমার সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতে হবে। এই মেয়েকে নিয়ে কপালে দুর্ভোগ আছে আমার। একে ঘরে তোলার জন্য তো অন্যান্য রাজ্যের রাজায় রাজায় যুদ্ধ বেঁধে যাবে”।
হয়ত সত্যিই তাই হত, যদি না রাজা প্রতাপাদিত্যের লোভ- লালসা পরিমাণ এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করত।
ঘরে ঢুকে মাহতাবকে দেখার পর থেকে অরুণাবতীর ডাগর চোখে লজ্জার আভাস; সমস্ত শরীরে যেন অনবরত বিদ্যুৎ খেলা করছে। অরুণাবতী পূর্বে হাজারবার মাহতাবকে চোখের সামনে দেখেছে, ছোট বেলায় মেয়েটি তার কোলেও চড়েছে অনেকবার, হাত ধরে নদীতীরে ঘুরে বেরিয়েছে। কিন্তু আজ সে যে দৃষ্টিতে মাহতাবকে দেখছে অরুণা, তা আগের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ অরুণার চোখে মাহতাব খান সুদর্শন-সুঠাম-লোভনীয় পুরুষ। তার বলিষ্ঠ বাহুগুলির সামান্য নাড়াচাড়ায় অসংখ্য পেশি কিল বিল করে ওঠে, অরুণার খুব সাধ হয় ঐ দুই বাহুর বন্ধনে নিজেকে সঁপে দিতে। মাহতাবের সপ্রতিভ হাসিতে অরুণা অস্থির চিত্ত আজ যেন খুঁজে পাচ্ছে নির্ভরতার আশ্রয়। তবে এই পরিবর্তন হঠাৎ করে নয়, একটু একটু করে হয়েছে। অরুণাবতীর মনের মন্দিরে অবশ্য মাহতাব অনেক আগে থেকেই প্রেম-দেবতা রূপে স্থান গ্রহণ করে আছে। যেদিন থেকে ভালবাসা কি- সেই ধারণা হতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই অরুণাবতী তার একান্ত আপন পুরুষরূপে মাহতাব ছাড়া আর কাউকে কল্পনা করতে পারেনি। অরুণার চোখে মাহতাব জগতের সুন্দরতম পুরুষ। রাতের শেষে ভর হলে যেমন হতশ্রী উদ্যানকেও স্বর্গীয় সৌন্দর্যে বিশোভিত বলে মনে হয়, ঠিক তেমনি জীবনে প্রেম এলো মনের মানুষটি চোখের সামনে অলৌকিক সৌন্দর্য, অসাধারণ গুণ আর অপার্থিব মহিমায় বিভূষিত হয়।
মাহতাব খান রীতিমত কষ্ট করে অরুণার মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি সরাল। সে প্রথমে ভাবল খাবার খেতে অস্বীকৃতি জানাবে। মনের ভেতর কোথাও একটা ঘন্টা বাজছে ঢং ঢং করে বেজে জানান দিচ্ছে যে সময় একদম ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু অরুণার মুখের পানে চেয়ে খেতে আপত্তি করল না মাহতাব। মাথা নিচু করে বিনা বাক্য ব্যয়ে খাওয়ায় মন দিল সে। অরুণাবতী মাহতাবের কাছ থেকে একটু দূরত্ব নিয়ে বসল। অপলক চোখে ভালবাসার মানুষটিকে দেখছে।
খেতে খেতে মাঝে মধ্যে চোখ তুলে তাকাচ্ছে মাহতাব, কাজটা করা ঠিক হচ্ছে কি না জানে না সে; কিন্তু দৃষ্টিকে সামাল দেয়া খুব কঠিন হয়ে পড়েছে তার জন্য। প্রতিবার মাহতাবের তাকাতেই অরুণাবতী তার ভুবন-মোহিনী দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিচ্ছে। লজ্জায় তার মুখমণ্ডল আরক্তিম হয়ে উঠছে। আবার মাহতাব খান চোখ নামিয়ে খাবারে মনযোগী হতেই অরুণাবতীর চঞ্চল ও পিপাসাতুর চোখ দুটির দৃষ্টি মাহতাবের দিকে নিবদ্ধ হচ্ছে। চোখচোখি হতেই দুজনের হৃদয়ে প্রেমের অনুভূতি যেন টগবগ করে ফুটছে, শরীর শিহরিত হচ্ছে, মন দুলে উঠছে।
কিন্তু সেনাপতি মাহতাব খান খুব বেশিক্ষণ সেই অনুভূতিকে স্থায়ী হতে দিলনা। “পালাতে হবে” “পালতে হবে” মাথার ভেতর কেউ একজন অনবরত এই কথা বলে যাচ্ছে তাকে। নিজেকে সংযত করে খুব সামান্য কিছু খেয়েই হাত ধুয়ে ফেলতে উদ্যত হল মাহতাব,তাই দেখে অরুণাবতী চমকে উঠল। বলল, “সে কি!”
অরুণা লজ্জার বাঁধ ভেঙে এগিয়ে এল মাহতাবের কাছে। মাহতাবের হাত ধরে লাজুক সুরে বলল, “উঠা চলবেনা, অনেক দূও থেকে এসেছেন। সারাদিন খাওয়া হয়নি, সব খেতে হবে।”
অরুণাবতীর স্নেহমাখা সুকোমল স্পর্শে মাহতাব খানের সমস্ত শরীরে সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হল। কিন্তু এই অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার অবস্থায় সে নেই এখন। বলল, পারব না অরুণা। যতদ্রুত সম্ভব চলে যেতে হবে আমাকে।
অরুণাবতী আরক্তিম। চোখ নামিয়ে রেখেছে কিন্তু মাহতাবের হাত ছাড়েনি এখনো। বলল, “যেতে হলে যাবেন, কিন্তু খাবার শেষ না করে আপনাকে উঠতে দিচ্ছি না সেনাপতি সাহেব”।
মাহতাব হাত ছাড়িয়ে নিল, “তুমি বুঝবে না অরুণা। একটু কম খেলে হয়ত মরে যাব না আমি, কিন্তু এখানে থাকলে প্রাণ হারাতে হবে। এখানে একটা মুহূর্ত বেশি থাকা মানেই বিপদের আশংকা বাড়তে থাকা”।
“কি বলছেন এসব?” অরুণাবতী মুখ তুলে তাকাল মাহতাবের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে চোখে কোনে অশ্রুবিন্দু ছল ছল করে উঠেছে। “কে মারবে আপনাকে?”
“তোমার পিতা”। নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল মাহতাব খান।
“আমার পিতা?” যারপর নাই অবাক হয়েছে অরুণা। “আমার পিতা কেন আপনাকে মারতে চাইবে? আমার পিতা তো আপনাকে সন্তানের চোখে দেখেন”।
মাহতাব তিক্ত ভঙ্গিতে হাসল। বলল, “তোমার পিতা কেমন মানুষ তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয় অরুণাবতী। মহারাজ প্রতাপাদিত্য তার কার্যসিদ্ধির জন্য আপন পিতা মাতাকে খুন করতেও হয়ত দ্বিধা করবেন না। আমি তো সেখানে নস্যি”।
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না সেনাপতি সাহেব। দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?”
মাহতাব এক মুহূর্ত থেমে থেকে অরুণার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। খোদার সৃষ্টির বৈচিত্র্য দেখে তাজ্জব হতে হয়। অমন পাষণ্ড-বর্বর পিতার ঔরসে এমন নিষ্পাপ সন্তানের জন্ম কি করে হল? সন্তানের সামনে তার পিতার বদ চরিত্রের বর্ণনা কি করে দিতে হয় তা মাহতাবের জানা নেই। তবুও সে চেষ্টা করল যথাসম্ভব ভদ্র ভাষায় অরুণাবতীকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলার।
ভদ্র ভাষায় বলা হলেও, কথার মধ্যে অভদ্র অংশটুকু বুঝে নিতে কোন কষ্ট হল না অরুণাবতীর। পুরো ঘটনাটা শুনে মেয়েটির মনে হল বুকের ভেতরটা খুব জোওে কেউ নাড়িয়ে দিয়েছে। কষ্টের একটা বীজ দলা পাকিয়ে বুক থেকে বেয়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বাকশূন্য স্পন্দনহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে।
মাহতাব সান্তনা প্রদানের সুরে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। মেয়েটির সামনে আজ তার বাবার চরিত্রের আরও একটি কুরুচিপূর্ণ দিক উন্মোচিত হয়েছে। এই মুহূর্তে তার জন্য সান্ত¦নার বানী কি হতে পারে তা মাহতাবের জানা নাই।
অরুণাবতীর দুই চোখ অশ্রুর ধারা ছুটল। মুহূর্তের মাঝে সে ছিন্ন লতার মত সে ন্যায় মাহতাব খানের দু পায়ের ওপর পতিত হল। মাহতাবের পায়ের উপর মুখ ঠেকিয়ে হাপুস নয়নে কান্না জুড়ে দিল। মাহতাব ব্যতিব্যস্ত হয়ে তাকে দুহাতে ধরে মাটি থেকে তুলল। “আরে কর কি? কর কি?”
এবার আর লজ্জা এসে অরুণাকে বাঁধা দিতে পারল না। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাহতাবের প্রশস্ত বুকে। দুই হাতে তাকে আলিঙ্গন করে প্রাণ ভরে কাঁদতে থাকল। মেয়েটির সমস্ত দেহ থর থর করে কাঁপছে।
মাহতাব এক মুহূর্তের জন্য কি করবে ভেবে পেলনা। কিন্তু মেয়েটি পড়ে যেতে পারে এই ভেবে শক্ত করে দুহাতে ধরল সে। অরুনাবতী নীল শাড়ির আঁচল সরে গিয়ে দুধ-সাদা পিঠ দেখা যাচ্ছে। মাহতাব অরুণাকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। নগ্ন পিঠে প্রিয়তমের হাতের স্পর্শে অরুণাবতীর শরীরের প্রতিটি অনু-পরমাণুতে যে প্রেমের তীব্র উচ্ছ্বাস প্রবাহিত হল, তা অরুণার পক্ষে সামলানো সম্ভব হল না। একে তো পিতার অসভ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এই মাত্র তার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে, তার উপরে যোগ হয়েছে পিতার সাথে প্রেমের মানুষের দ্বন্দ্বের ফলে প্রেমিকের চলে যাওয়ার ভয়, এর পর আর নগ্ন ত্বকে প্রেমিকের প্রথম ছোঁয়া তার স্বাভাবিক চেতনায় থাকার উপার রাখল না। অরুনাবতী জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাহতাবের বুকে।
মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে গেছে বুঝতে পেরে মাহতাব শঙ্কিত হয়ে উঠল। মেয়েটিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে পাজকোলা করে তুলে নীল মাহতাব। তারপর আসনে বসে অরুণার মাথা রাখল নিজের হাটুর ওপর। দ্রুত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে গগনবিদারী চিৎকার ছাড়ল রানী দুর্গাবতীর উদ্দেশ্যে, “রাণী মা! রাণী মা! কোথায় আপনি? শিঘ্রই আসেন, অরুণা মূর্ছা গেছে।”
রানী দুর্গাবতী নিজের কামড়ায় বসে বসে কাঁদছিলেন। মাহতাবের ডাক শুনে চমকে উঠে বেরিয়ে এলেন। বসারঘরে এসে দেখলেন মাহতাব অরুণাকে নিজকোলে শুইয়ে বাতাস করছে। রানী প্রায় দৌড়ে এলেন এই দৃশ্য দেখে। জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে মাহতাব? কি হয়েছে অরুণার?”
“আমি ঘটনাটা খুলে বলতেই অরুণা মূর্ছা গিয়ে লুটিয়ে পড়েছে”। বলল মাহতাব। লুটিয়ে যে তার বুকে পড়েছে এই ব্যাপারটা গোপন করে গেল সে।
রানী আতংকিত কণ্ঠে বলল, “অরুণাকে তার কামড়ায় নিয়ে চল। চোখে মুখে জলের ছিটে দিলে জ্ঞান ফিরে আসবে”।
অরুণাকে আবার পাজকোলা করে কোলে তুলে নীল মাহতাব।
রাত বাড়ছে। অরুণার জ্ঞান ফেরার পর আরও বেশ খানিকটা সময় মহলে কাটাল মাহতাব। অরুণা শুয়ে আছে তার কামড়ার বিছানায়। ধাক্কাটা কাঁটিয়ে উঠতে পারে নি এখনও। অরুণার কামড়ার বাইরে বসে মাহতাব অরুণার ছোট ভাই শিশু রাজকুমারের সাথে কিছুক্ষণ নানান গল্প করে সময় কাঁটাল । কিন্তু মনের মধ্যে আশংকার ডামাডোল বেজেই চলেছে তার। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সারারাজ্য জেনে গেছে ব্যাপারটা। রানী দুর্গাবতী এতক্ষণ কন্যার শিয়রের কাছে বসে তার সেবা করেছেন। কামরা থেকে বেরিয়ে আসতেই মাহতাব জিজ্ঞেস করল, রানী মা, অরুণা কেমন আছে এখন?
“ভাল আছে বাবা। তেমন কিছু হয়নি”। রানী দুর্গাবতী হাসলেন। অরুণার জন্য মাহতাবের এই দুশ্চিন্তা তার ভাল লাগছে।
মাহতাব অত্যন্ত বিনীত ও কাতরভাবে বলল, এবার যে তবে যেতে হয় মা। আমাকে বিদায় দিন।
রাণীর মুখ থেকে মুহূর্তের মাঝে হাসি মুছে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তিনি বর্তমান পরিস্থিতি ভুলে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সেটাই উত্তম হবে বাবা! চলে যাও এই রাক্ষসের রাজ্য ছেড়ে, এতেই তোমার মঙ্গল। আমি আর্শীবাদ করি তুমি নিরাপদ ও দীর্ঘজীবন লাভ করবে। কিন্তু একটা কথা শুধু বলে যেতে পারবে আমায়?”
“কি কথা রানী মা?”
“আমার অরুণাবতীর কি হবে?”
মাহতাব এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে ভেবে পেলনা।
রাণী আর কিছু বলতে পারলেন না, কাঁদতে থাকলেন। মাহতাব খানের ভেতরটাও জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এই স্থান পরিত্যাগ করতে তার পা যেন অগ্রসর হতে চাইছে না। মাহতাবের হৃদয় পুরোপুরি অরুণাবতীতে ডুবে গেছে। এখান থেকে উঠে আসা খুব সহজ কোন কাজ নয়। তার একবার মনে হচ্ছে- “না যাব না, অরুণাবতীকে ছেড়ে কিছুতেই আমি যাব না। যা হবার তাই হোক। কিন্তু অরুণাবতীকে ছাড়া বেঁচে থাকার আমার পক্ষে সম্ভব নয়”। আবার পরক্ষণেই ভাবল,“এখানে আমি থাকবই বা কোথায়? যে কাজ করেছি তারপর কি আর প্রতাপাদিত্য আমাকে তার রাজ্যে ঠাঁই দেবে? শেষে আমার জন্য অরুণাবতীকেও করুণ পরিণতি বেছে নিতে হবে”।
মাহতাব খান বজ্রাহতের মত বেশ কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল। কোন নারীর প্রতি এমন দুর্বলতা সে জীবনে কখনও উপলব্ধি করেনি। আজ তিনি দেখলেন, হৃদয় প্রেম-সুরায় উন্মুক্ত হইয়া তাহাকে প্রশান্ত করা ভীষণ অসম যুদ্ধে জয়লাভ করা অপেক্ষাও শত কঠিন।
“অরুণাবতীর কি উপায় হবে?” এইপ্রশ্ন সারাক্ষণ মাহতাবের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকল। কিন্তু কোন সদুত্তর মাহতাব দিতে পারলনা। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল। রানী দুর্গাবতী নিরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন। মাহতাব চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দূর আকাশের কোণে গুড় গুড় করে মেঘ ডেকে ওঠার শব্দে মাহতাব চমকে উঠল।
মাহতাব রানীর উদ্দেশ্যে বলল,“মা! আমি জীবনে কখনও অরুণাবতীকে ভুলব না। এই মুহূর্তে এই রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ভিন্ন আমার সামনে কোন উপায় খোলা নেই। এখানে আমার সেনাপতি আর নেই, আমার কোন লোকবল নেই। রাজা প্রতাপাদিত্যের রোষানলের সামনে আমি টিকব না। তবে আমি কথা দিচ্ছি মা; যদি কখনো আমার সুদিন ফেরে, যদি আবার কোন রাজ্যে গিয়ে ভাল পদমর্যাদা অর্জন করে নিতে পারি, তাহলে আমি ফিরে আসব। আমি ফিরে এসে অরুণাকে বিয়ে করব। অরুণা ব্যতীত এই জীবনে কাউকে বিয়ে করব না। আমি একজন সাচ্চা মুসলিম। একজন সাচ্চা মুসলিম কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করে না মা। তবে এই মুহূর্তে আমি কিছুই করতে পারছি না।
এক মুহূর্ত থেমে থাকল মাহতাব। তারপর আবার বলতে শুরু করল,
“আমাকে এখন পথের কাঙালের সাথে তুলনা করা চলে। ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে ফেলবে আমি জানি না মা! আমি অল্প বয়সে পিতা মাতা হারিয়েছি। কান্দাহারে জন্ম নিয়ে দিল্লী হয়ে কত রাজ্য ঘুরে এসে আপনার চরণে ঠাঁই পেয়েছিলাম। আপনারা আমাকে প্রতিপালন করেছেন। আপনাদের ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারব না। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস আজ আমাকে স্বার্থপর হতে বাধ্য করছে। ঘটনা যা ঘটেছে, তাতে শীঘ্রই রাজ্য ছাড়তে না পারলে প্রাণ পর্যন্ত হারাতে হবে। হয়ত এতক্ষণে আমাকে ধরার জন্য যশোরের রণতরী অর্ধেক পথে পর্যন্ত এসে উপস্থিত হয়েছে। আমাকে বিদায় দিন মা।”
রাণী দুর্গা চোখ মুছলেন। মাহতাবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “বৎস! যেতেই যখন হবে, তখন আর বিলম্ব করো না। অতিসত্বর প্রস্থান কর। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।”
রাণীকে সালাম করে আর্শীবাদ গ্রহণ করল মাহতাব। তারপর দ্রুত পায়ে রাজবাড়ি ত্যাগ করল। ঘাটে বাঁধা ছিল রাজ নৌকা। এখনও এখানে মাহতাবের পালানোর খবর এসে পৌঁছায়নি। মাহতাব নৌকায় উঠে তাড়াতাড়ি নোঙর তুলে নিয়ে মাল্লাদের দ্রুত দাঁড় ফেলতে বলল।
অরুণাবতীর কামরার বাইরে যখন মাহতাব আর রানী দুর্গাবতী কথা বলছিলেন, তখন অরুণাও চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে নেমে এসে দরজায় কান পেতেছিল দুজনের কথোপকথন শোনার আসায়।
“আমার অরুণাবতীর কি হবে?” রাণী দুর্গাবতীর এ কথায় শোনার সাথে অরুণাবতীর দুচোখ বেয়ে আবার জলের ধারা নামল। মাহতাবের উত্তর শোনার অপেক্ষায় সে দুরু দুরু বুকে কান পেতে থাকল দরজায়। মনে আশা- মাহতাব হয়ত বলে উঠবে- “আমি কোথাও যাব না। আমি এই রাজ্যেই থাকব, আমি অরুণাবতীর কাছে থাকব”।
কিন্তু মাহতাব সে কথা বলল না। মাহতাব সব কিছু ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলল।
অরুণাবতী স্পষ্ট বুঝল, মাহতাব থাকবে না। কোন কিছুই আর তাকে আটকে রাখতে পারবেনা এখানে। সে চলে যাবে। চিরতরে সব কিছু ছেড়ে চলে যাবে। আর কখনো ফিরবেনা। কেমন করে ফিরবে? সে যতই ফিরে আসার কথা বলুক না কেন, সে কখনোই ফিরে আসতে পারবেনা। তার পিতা রাজা প্রতাপাদিত্য আর কখনো মাহতাবকে ফিরে আসতে দেবেনা। ফিরে আসলেই যে তাকে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে। চন্ডিক্যানের দুর্দান্ত সেনাপতি এখন চন্ডিক্যানে অনাকাক্সিক্ষত।
অরুণাবতী প্রায় দৌড়ে এসে বিছানায় উপর পড়ে ছট ফট করে কাঁদতে থাকল। কেউ একজন যেন অরুণাবতীর মাথার মধ্যে বলে উঠল, “ওরে পোড়ামুখী এতসাধ করেছিলি কেন? জানিসনা? বেশি সাধ করলে কমও মিলেনা? যে চলে যাচ্ছে তার জন্য আর কেঁদে কি হবে? চোখ মুছে নে। ভুলে যা তাকে”।
কিন্তু অরুণা যতই মাহতাবের কথা চিন্তা করা থেকে নিজেকে বিরত করার চেষ্টা করল, ততই তার কাছে মাহতাব চলে যাওয়ার বিরহ অসহ্যকর হয়ে উঠল। এক সময় আর না পেরে অরুণা মস্তিষ্কের ভেতরকার সেই অদৃশ্য অস্তিত্বকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে উঠল, “না, পারব না। আমি মাহতাবকে ভুলে যেতে পারব না। মাহতাবকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালবাসতে পারব না”।
পর মুহূর্তে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল অরুণা। উন্মাদিনীর মত বিছানা থেকে নেমে পড়নের কাপড় পরিপাটি করে নীল। মাথার চুল আচড়ে নিল। তারপর সঙ্গোপনে কামরা থেকে বেরিয়ে এল। প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে রাজবাড়ির পেছনের দরজা খুলে বাইরে বের হল। তারপর কোমরে শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে নিয়ে নদীর ঘাটের পানে ছুটল। ছোটবেলা থেকেই প্রচুর দৌঁড় ঝাপ করে বড় হয়েছে অরুণা। মাহতাবের নৌকা তখন ছেড়ে দিচ্ছে প্রায়। অরুণার বিশ্বাস মাহতাব খুব বেশিদূর যাওয়ার আগেই সে ধরে ফেলতে পারবে...