খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫৬ অব্দ;
হাররান রাজ্য, মেসোপটেমিয়া।
বায়ুর ঊর্ধ্বচাপে ধোঁয়ার মেঘ কুন্ডলি পাকিয়ে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বুঝি আকাশ ছুঁতে চাইছে। মন্দিরের বাইরে চিমনি দিয়ে বের হওয়া ধুপের ধোঁয়ার পরিমাণ দেখে মনে হতে পারে হয়ত বা ভেতরে আগুন লেগেছে। কিন্তু যারা মুন-সাই প্রভুর পুজার কথা জানে, তারা বুঝতে পারবে ব্যাপারটা আসলে তেমন কিছুই নয়। মুন-সাইএরউপাসনাকক্ষগুলোতে পুজো চলে অবিরাম, কখনো থামে না। এই নিয়ম মানা বাধ্যতামূলক। কাউকে না কাউকে সারাক্ষন প্রভুর পুঁজো চালিয়ে যেতে হবে। নইলে প্রভু নাখোশ হয়ে প্রাকৃতিক অভিশাপ পাঠাবে গোটা অঞ্চলে।
মন্দিরের অভ্যন্তরে উপাসনা- কক্ষের ভেতরটাও ধূপের ধোঁয়ায় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন। তারমদ্ধে ঝাপসা ভাবে প্রধান ধর্মযাজিকা মহামাতা আদ্দাগোপ্পের অবয়ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আশে পাশে তার অনুসারীরা নিবিষ্ট মনে প্রভুর গুণকীর্তন করছে। দীর্ঘদিনের অভ্যাস তাদের এই কাজে একনিষ্ঠ করে তুলেছে। কিন্তু অনভ্যস্ত কেউ এই মুহূর্তে মন্দিরে প্রবেশ করলে ধূপের ধোঁয়ার কারণে চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়া শুরু হবে, তাছাড়া দুই চোখ নিশ্চিতভাবে রক্তবর্ণ ধারণ করবে।
পূজারীরা সবাই উপাসনার কাজে এত বেশি মগ্ন যে পেছনে কেউ একজন প্রবেশ করেছে তারা তা টেরই পায়নি। নব্য প্রবেশকারী এই ব্যাক্তি স্বয়ং নাবোনিডাস, ব্যবিলনের নতুন সম্রাট; আদ্দাগপ্পের একমাত্র সন্তান।
ধূপের ধোঁয়া থেকে কোন মতে চোখ বাঁচিয়ে রাজা নাবোনিডাস আরও কয়েক পা এগিয়ে এল। ঝাপসা দৃষ্টিতে মহামাতা আদ্দাগপ্পেকে খুঁজছে। ধোঁয়ার কারণে ইতিমদ্ধে চোখে জ্বালা ধরে গেছে।
রাজার পায়ের আওয়াজে একজন পূজারী পেছনে ফিরে তাকাল। নাবোনিডাসকে চিনতে পেরে তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শুধু হাররান কেন, গোটা মেসপটেমিয়াতে নাবোনিডাসের রাজা হওয়ার খবর পৌঁছে গেছে। পূজারী মহামাতার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠল, “মহামাতা। দেখুন আমাদের নব্য সম্রাট ‘নাবোনিডাস’ এসেছেন”।
আদ্দাগপ্পে পূজা-অর্চনায় বিরতি দিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। সন্তানকে দেখতে পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠল। প্রানের উচ্ছ্বাসে বলে উঠলেন,“নাবোনিডাস। হাররানের গৌরব। তুমি এসেছ বাছা”।
“হ্যাঁ, মাতাজি”। নাবোনিডাসের ঠোঁটেও হাসি। “আমি রাজকার্য শুরুর প্রাক্কালে আপনার সাথে একবার দেখা করতে চলে এসেছি”।
“খুব ভাল করেছ বাছা। এই সুযোগে প্রভু মুন-সাই এর আর্শীবাদ পাবে তুমি”।
মুন-সাই এর আর্শীবাদের কথা শুনে একটু তিক্ত ভঙ্গিতে নাবোনিডাস। মাতা মুন-সাই এর পূজারী হলেও, সন্তান কখনো মুন-সাই দেবতাকে মানেনি। যখনই মা মুন-সাই এর আর্শীবাদের কথা বলেন, নাবোনিডাস তা অতি সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যায়। আজও তাই করার সিদ্ধান্ত নিল মুন-সাই। “মাতাজি, যদি সম্ভব হয় তবে কি উপাসনা কক্ষের বাইরে একটু আসবেন? ধূপের ধোঁয়ায় আমার চোখে জ্বালা ধরে গেছে”।
“অবশ্যই বাছা। আমি আসছি...” বলে আদ্দাগুপ্পে নিজের অনুসারীদের দিকে তাকাল। বলল,“এই তোরা থেমেছিস কেন? উজবুকের দল। কি অনিষ্ট করছিস? পূজা চালিয়ে যা। জানিস না? মুন সাই দেবতার পূজা কখনও শেষ হবেনা? জানিস না সে কথা?”
অনুসারীরা আবার সবাই পূজায় মন দিল।
আদ্দাগুপ্পে সন্তানের হাত ধরে বেরিয়ে এলেন উপাসনা কক্ষের বাইরে।
ধূপের ধোঁয়া থেকে চোখ দুটো নিস্তার পেয়েছে নিশ্চিত হয়ে নাবোনিডাস বলল, “মাতাজি, আপনি কি জানেন আমি কেন এখানে এসেছি?”
“আমি জানি বাছা”। মহামাতার মুখে গর্বের হাসি।“তুমি তোমার যোগ্যতা দিয়ে সমস্ত ব্যাবিলনের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছ। ব্যাবিলনের ভবিষ্যৎ এখন তোমার হাতে। তুমি ব্যাবিলনের নতুন সম্রাট”।
“আমি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই আপনার কাছে সম্পূর্ণ একা ছুটে এসেছি নিজ মুখে খবরটা বলার জন্য। আমি কখনও আপনাকে না জানিয়ে কোন বড় কাজে হাত দেইনি মাতাজি। আজও আমার পক্ষে তা করা সম্ভব হল না। খবরটা নিজ মুখে না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।”
“তোমাকে হতাশ করার জন্য দুঃখিত বাছা। তোমার মুখে শোনার অনেক আগেই আমি জেনেছি কিছু। আমার সন্তানের সম্রাট হওয়ার খবর আলোর বেগে ছড়িয়ে গেছে। গতকাল রাত্রি দিপ্রহরে খবর পেয়েছি আমি”।
“সবই আপনার আর্শীবাদ মাতাজি”।
“ভুল বললে নাবোনিডাস। আমার আর্শীবাদে ইহা সম্ভব ছিলনা। একটা বিষয় তুমি হয়ত জান না নাবোনিডাস। তুমি যে রাজা হতে চলেছ, এটা আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম। এমনকি তোমার জন্মের পূর্বেই আমার জানা ছিল সেখবর”।
“কি বলছেন মাতাজি?” নাবোনিডাসের চোখ দুটোতে আজন্ম বিস্ময়।
“তুমি কি একবার ভেবে দেখেছ যে তোমার রাজা হওয়ার পেছনে কত বড় দুটো ব্যাপার আছে?”
“কোন ব্যাপার মাতাজি?”
“একে তো তুমি সম্রাট নাবাপোলাসার বংশধর নও, তার উপরে তুমি ব্যাবিলনের কেউ নয়। যেই অ্যাসিরিয়দের হারিয়ে নাবাপলাসা নব্য- ব্যাবিলনিয় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে সেই অ্যাসিরিয়ায় জন্ম নিয়েও তুমি ব্যাবিলনের রাজত্বের মালিক হতে পেরেছ”।
“জি মাতাজি। এটা নিঃসন্দেহে অসাধ্য ছিল”। বলল নাবোনিডাস।
“এই অসাধ্য তুমি সাধন করতে পেরেছ শুধুমাত্র মুন-সাই দেবতার আর্শীবাদের কারণে”। মহামাতা আদ্দাগুপ্পে এর বলার ধরণ অনেকটা এমন শোনালো যেন খুব গোপন কোন রহস্য উন্মোচন করছে।
নাবোনিডাস চুপ করে থাকল। মা আদ্দাগুপ্পে সারা জীবন তার সামনে মুন-সাই দেবতার গুণগান করে গেছেন। কিন্তু তার সন্তান হয়েও নাবোনিডাস কখনও মুন- সাই দেবতার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়নি। তার চোখে মুন-সাই এক ভন্ড দেবতার নাম। তার যুক্তি বলে- পুঁজো থামিয়ে দিলে যে দেবতা অভিশাপ পাঠিয়ে দেয়, সে সত্যিকারের কোন শক্তি হতে পারেনা।
তবে মুন-সাইকে অবিশ্বাস করার এক মাত্র সেটি নয়। নাবোনিডাস ছোট থেকেই নিজ চোখে দেখেছে কি করে তার মা মুন-সাই দেবতার নাম করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির পথ খুঁজে নিয়ে চলেছেন অনবরত। সব চেয়ে বড় আঘাত ছিল নাবোনিডাসের পিতার মৃত্যু। নাবোনিডাসের পিতা ছিল ছোট রাজ্য হাররান এর উপ-শাসক। পিতার মৃত্যুতে সেই ক্ষমতা তার মা আদ্দাগুপ্পের হাতে আসে। যতই তার পিতার মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলে মনে হোক, নাবোনিডাসের মনের কোনে সন্দেহ জাগে- এর পিছনে নিশ্চয়ই তার মায়ের ক্ষমতার প্রতি অসম্ভব লোভ দায়ী। তাই নাবোনিডাসের জন্য মুন-সাইতে বিশ্বাসের কোন কারণ কখনও ঘটেনি।
“তুমি কি আমার কথা অবিশ্বাস করছ সন্তান?”মা প্রশ্ন করলেন ছেলেকে।
নাবোনিডাস নিশ্চুপ।
“অবিশ্বাস তোমার মনের মধ্যে এমন ভাবে বাসা বেঁধেছে যে বিশ্বাসের আলো তোমার মনের দেখা পাচ্ছে না”।
“আপনার বিশ্বাসের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে মাতাজি”। নাবোনিডাস মাথা নিচু করে বলল,“কিন্তু আমার বিশ্বাস আমার নিজের কাছে। আমি মুন-সাইতে বিশ্বাস করার মত কোন লক্ষণ খুঁজে পাইনি”।
“তা ঠিক আছে বাছা”। সন্তানের কাঁধে হাত রাখলেন আদ্দাগুপ্পে।“কিন্তু আমি কি তোমার বিশ্বাসকে পথ দেখাতে একটু সাহায্য করতে পারি?”
“কি করবেন আপনি?” প্রশ্ন করল নব্য রাজা।
“তুমি নিশ্চয়ই জান যে মুন-সাই দেবতা আমার কাছে স্বপ্নে দেখা দেন। স্বপ্নে তার সাথে কথপোকথন আমি দেবতার বানী রূপে প্রস্তর ফলকে লিখে রাখি”।
“জি মাতাজি, জানি”।
“আমি বহুবার তোমাকে এসব বানী পড়ে শুনাতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি কখনও এসব বানী শুনতে চাওনি। কিন্তু আজ আমি একটি বানী তোমাকে পড়ে শুনাতে চাই। এই বানী লিখে রাখা হয়েছে তোমার জন্মেরও পূর্বে। আমি এতদিন এই বানী লুকিয়ে রেখেছি। আজ সময় এসেছে এই বানী তোমাকে শোনানোর। তোমার কি একটু সময় হবে হে সম্রাট?”
“ছি ছি মাতাজি”। দুহাতে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরল নাবোনিডাস।“আমি আপনার সন্তান। আমাকে সম্রাট সম্বোধন করার কোন কারণ নেই। জগতের সবার কাছে আমি প্রভু হলেও আপনার কাছে আপনার সন্তানরূপে থাকতে চাই। আমার সময় আছে, আপনি শোনান সেই বানী”।
আদ্দাগুপ্পে তার বানী সম্বলিত প্রস্তরফলক গুলো থেকে খুঁজে একটা পুরনো প্রস্তরফলক বের করে আনল। উপরে জমে থাকা ধুলো বালি আর ক্ষয়ে যাওয়া লেখা বলে দিচ্ছে এটা বহু বছরের পুরনো। পোশাকের ঝুল দিয়ে আদ্দাগুপ্পে সেই ধুলো বালি মুছে নিল। তারপর ভালভাবে ফুঁ দিয়ে ঝেড়ে নিল যেন লেখা গুলো স্পষ্ট দেখায়। তারপর পড়তে শুরু করল,
“তোমার হাতে আমি হাররান রাজ্যে আবার দেবতার শাসন ফিরিয়ে আনব তোমার সন্তান নাবোনিডাসের মাধ্যমে। নাবোনিডাস আমাদের হারানো সেই ইহুলহুল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। আমাদের অসমাপ্ত কাজ সে পূরণ করবে। সে হাররান শহরের হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনবে এবং একে গড়ে তুলবে আদর্শ নগরী রূপে। ব্যাবিলনের বুকে স্থিতি হবে প্রভু সিন, নিনগাল, নুসকু ও সাদারনুন্না এর শাসন ঠিক যেমনটি ছিল ইহুলহুল থাকাকালীন”।
বানী শোনার পর কিছুক্ষণ চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকল নাবোনিডাস।
“কি হল বাছা? চুপ করে গেলে যে? কিছু বলবে না?” আদ্দাগুপ্পের মুখে সন্তানের জন্য স্নেহমাখা হাসি।
হতবিহবল নাবোনিডাসের বিস্ময় কাটেনি এখনও। বলল, “মাতাজি, সত্যিই কি এমন বানী এসেছিল আমার জন্মদের পূর্বে?”
“অবশ্যই নাবোনিডাস। নিজ চোখে দেখে নাও”। বলে প্রস্তর ফলকটি সন্তানের দিকে বাড়িয়ে দিলেন মাতা।
মায়ের হাত থেকে প্রস্তরফলক নিয়ে তার উপরে হাত বুলাল নাবোনিডাস। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে অনেক অনেক বছর আগে খোদাই করে লেখা হয়েছে। কালের আবর্তনে একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছে তা। প্রস্তরের লেখাগুলোর উপর হাত বুলাতে খুব ভাল লাগছে নাবোনিডাসের, মনে হচ্ছে বিশ্বাস তার পথ খুঁজে পেয়েছে। এতদিন মুন-সাইতে অবিশ্বাস ধরে রাখার জন্য ভীষণ রকমের লজ্জা লাগছে তার। যে দেবতা তার জন্মের পূর্বেই তার সম্রাট হওয়ার খবর দিতে পারেন , তিনি আর যাই হোক, মিথ্যে হতে পারেন না। নাবোনিডাস প্রশ্ন করল, “আপনি এই বানীর কথা আগে কখনও বলেননি কেন মাতাজি?”
“কারণ আগে বললে তুমি বিশ্বাস করতে না। অবিশ্বাস তোমার বিশ্বাসের ক্ষমতা নস্যাৎ করে দিয়েছিল। তুমি দেখেছ আমি কখনও তোমাকে মুন-সাইতে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য জোর করিনি। আমি অপেক্ষায় ছিলাম কখন এই বানী সত্য হবে আর তখন তুমি নিজ থেকেই দেবতাকে বিশ্বাস করে নেবে”।
নাবোনিডাস দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “মাতাজি। আজ আমি আপনাকে আর বায়ুকে সাক্ষী রেখে প্রভু মুন-সাই এর বশ্যতা স্বীকার করে নিলাম। আজকের পর থেকে আমিও ঐ অসীম দেবতার একজন গুণমুগ্ধ পূজারীরূপে জীবন যাপন করব”।
আদ্দাগুপ্পে নাবোনিডাসের কথায় খুশি হলেও প্রবল বেগে মাথা নাড়লেন। বললেন, “বশ্যতা স্বীকার করে নিলাম বললেই তো আর নেওয়া হয়ে যায় না বাছা। এই জন্য অনেক রীতি নীতি আছে যা অবশ্য পালনীয়”।
“সকল রীতি নীতি পালন করতে আমি প্রস্তুত”।
“শুধু নিয়ম পালন করাটাই সব নয়”। আদ্দাগুপ্পে সন্তানকে বুঝাচ্ছেন।“...সেই সাথে তোমাকে মুন-সাই এর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ক্ষমতা অনুযায়ী নানান রীতিকার্য সম্পন্ন করতে হবে”।
“কি ধরণের রীতিকাজ মাতাজি?” নাবোনিডাস হাসি মুখে সব মেনে নিতে প্রস্তুত।
“তোমার ক্ষমতার উপরে তা নির্ভর করে বাছা। তুমি যেহেতু গোটা ব্যাবিলনের সম্রাট, তোমাকে অনেক বড় কাজ করতে হবে। বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করতে হবে মুন-সাই প্রভুর”।
“তা তো অবশ্যই করে দিব মাতাজি”। হ্যাঁ-বোধক মাথা ঝাঁকাল নাবোনিডাস।“আমি হাররান রাজ্যের মুন-সাই প্রভুর মন্দির সংস্কার করে উন্নতরূপ দান করব। তাছাড়াও রাজ্যের আরও বিভিন্ন জায়গায় প্রভু মুন-সাই এর উপসনালয় নির্মাণ করে দিব”।
“হাররান তো ব্যাবিলনের খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ বাছা”। আদ্দাগুপ্পে এমন ভাবে মাথা নাড়ছে যেন খুব হতাশ হয়েছে নাবোনিডাসের কথা শুনে।“এখানে মন্দির সংস্কার করে কি কাজে আসবে? তুমি গোটা ব্যাবিলনের অধিপতি হয়ে যদি এত কম উৎসর্গ করতে চাও প্রভুর উদ্দেশ্যে, তবে তো প্রভু সন্তুষ্ট হবেন না”।
“তবে আমায় কি করতে হবে তা আপনিই বলে দিন মাতাজি”।
আদ্দাগুপ্পে একটা স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন। নাবোনিডাসের মুখে এই কথাটি শুনার জন্যই তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। বললেন, “ব্যাবিলন নগরীতে প্রভু মারদুকের যে উপাসনালয় আছে তা তোমাকে মুন-সাই প্রভুর মন্দিরে রূপান্তর করতে হবে। পারবে কি?”
নাবোনিডাস এক মুহূর্ত কিছু ভাবল। তারপর বলল, “এ বড় কঠিন কাজ হবে মাতাজি। ব্যাবিলনে অধিকাংশ ব্যক্তি প্রভু মারদুকের পূজারী। তাদের মানানো খুব কষ্টকর হবে”।
আদ্দাগুপ্পে হতাশ হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “এতটুকু কষ্ট যদি না করতে চাও তবে প্রভু মারদুকের উপাসক হওয়ার যোগ্যতা তোমার নেই বলে ধরে নিতে বাধ্য হব বাছা”।
কথাটা নাবোনিডাসের আত্মসম্মানে আঘাত করেছে। তার পক্ষে অসম্ভব বলে তেমন কিছুই নেই। অনেকটা ঘোষণা দেয়ার সুরে বলল, “ঠিক আছে মাতাজি। আমি তাই করব যা আপনি করতে বলেছেন”।
“আরও একটা কাজ যে করতে হবে বাছা”।
“কি কাজ মাতাজি? আদেশ করুন”।
“ব্যাবিলনের শুন্য উদ্যান”।
“জি মাতা, শুন্য উদ্যানে কি কিছু করতে হবে?” জিজ্ঞেস করল নাবোনিডাস।
“শুন্য উদ্যানের শীর্ষে রানী অ্যামিতিসের যে মূর্তি আছে তা ভেঙে দিয়ে প্রভু মুন-সাই এর মূর্তি বসাতে হবে। আমি এখন থেকে শুন্য উদ্যান থেকেই পূজা-অর্চনা চালিয়ে যেতে চাই”।
“কিন্তু মাতাজি ঐ রক্তপাথর...”
কথাটা শেষ করতে দিলনা আদ্দাগুপ্পে। বলল, “রানী অ্যামিতিস এর মূর্তির মাথায় বসানো সেই মহামূল্যবান রক্তপাথর সরিয়ে নিয়ে প্রভু মুন-সাই এর মাথায় স্থাপন করতে হবে”।
“কিন্তু মাতাজি... ঐ পাথর যে অভিশপ্ত তা তো জানেনই”। নাবোনিডাসের কণ্ঠে আপত্তির সুর।“ব্যাবিলনে সবাই বিশ্বাস করে ঐ পাথর যে মানুষ স্পর্শ করে সে ধ্বংস হয়ে যায়”।
“কোন কিন্তু নয় বাছা, তোমাকে তা করতে হবে। ঐ মহামূল্যবান পাথর শুধু অবিনশ্বর দেবতা মুন-সাই এর গলায় মানায়। রানী অ্যামিতিসের মত নশ্বর দেহের মানুষের মাথায় এমন রত্ন কেন থাকবে?”
এক মুহূর্তের জন্য নাবোনিডাসের মাথায় আবার সেই চিন্তা এসে ভর করল। তার মাতা কি আবার মুন-সাই এর কথা বলে নিজের স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে না? কিন্তু পর মুহূর্তে চিন্তাটা বাতিল করল নাবোনিডাস। ঐ প্রস্তর ফলকের লেখা তো মিথ্যে হতে পারে না। বলল, “ঠিক আছে, মাতাজি। ধরে নিন কাজ হয়ে গেছে”।
আদ্দাগুপ্পে হাসেন খুব কম। আজ অনেক দিন পর চওড়া হাসি দেখা দিল তার ঠোঁটে, সন্তুষ্টির হাসি। মনে হল যেন অনেক্ষণ ধরে আটকে রাখা একটা নিঃশ্বাস এতক্ষণে ছাড়লেন।
গতকাল রাতে নাবোনিডাসের রাজা হওয়ার খবর শুনেই পরিকল্পনাটা মাথায় এসেছিল আদ্দাগুপ্পের। বিশ্বস্ত একজন প্রস্তর শিল্পীকে আনিয়ে তাকে দিয়ে অতি যত্ন করে প্রস্তর ফলকে এই বানী লিখিয়েছিল আদ্দাগুপ্পে। এমনভাবে লিখতে হয়েছে যেন দেখে অনেক দিনের পুরনো লেখা বলে মনে হয় যা কালের বিবর্তনে ক্ষয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। লেখা শেষে তার মন খুঁতখুঁত করছিল হয়ত ঐ শিল্পী কখনও রাজাকে সত্যি জানিয়ে দিতে পারে। তাই বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদের পাঠিয়ে শিল্পীর মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
ক্ষমতার লিপ্সা আদ্দাগুপ্পের রক্তে সবসময় একটা তীব্র নেশার অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়। একজন মাদকাশক্ত যেমন মাদক না পেলে মুমূর্ষ হওয়ার মত পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়, ঠিক তেমনটি ঘটে আদ্দাগুপ্পের ক্ষেত্রে ক্ষমতা লোভের আশায়। নাবোনিডাসকে টোপটা ভালমতোই গেলানো গেছে। এখন তার মাধ্যমে ইচ্ছে মত যা খুশি তাই করিয়ে নেওয়া যাবে।