৫ই এপ্রিল, ২০১৬;
হোটেল র্যাডিসন, ঢাকা।
পাঁচ তারকা হোটেলের মেঝেতে বিছিয়ে রাখা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আমদানিকৃত ঝকঝকে তকতকে টাইলসের ওপর ভাঙা কাঁচের টুকরো বড়ই বেমানান। কোনো ক্লায়েন্ট যদি কমপ্লেইন করে কিংবা ম্যানেজারের চোখে পড়ে, তাহলে হোটেলের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীদের চাকরী যাওয়ার সম্ভাবনা সুনিশ্চিত। অন্য সময় হলে হয়ত চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়ে বসতেন কিন্তু এই মুহূর্তে হোটেল র্যাডিসনের ম্যানেজার কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। পায়ের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাঙা কাঁচের টুকরো কিন্তু সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। সমস্ত মনোযোগ এখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠাম দেহের অধিকারী যুবকের দিকে। যুবকের নাম মনসুর হালিম।
সিগারেট ধরিয়ে একটা সুখটান দিতে খুব ইচ্ছে করছে বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ইন্সপেক্টর মনসুর হালিমের। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ কনস্টেবলের কাছে চাইবে কিনা ভেবে দেখল সে। মনসুর জানে কনস্টেবল তার প্যান্টের পকেটে একটা সিগারেটের প্যাকেট লুকিয়ে রেখেছে। এমন ভাবে কায়দা করে রেখেছে যেন বাইরে থেকে দেখে বুঝার কোন উপায় না থাকে। কিন্তু মনসুরের চোখ ফাঁকি দিয়ে সিগারেট লুকিয়ে রাখা অত সহজ নয় বাছা!
কয়েক মুহূর্ত ভেবে সিদ্ধান্তটা বাতিল করে দিল মনসুর। ক্রাইম সিনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়া মোটেও শোভনীয় হবেনা; ব্যাপারটার নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট হতে পারে তার ক্যারিয়ারের উপরে। দরকার নেই বাপু সামান্য নেশার বশে চাকরি হারানোর! আর তাছাড়া চাইলেই যে এই কনস্টেবল কাচুমাচু ভঙ্গিতে তার দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে ধরবে, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? ব্যাটার তাকানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না সে আদৌ মনসুর হালিমের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন। বাইরের দেশে ডিটেকটিভ পুলিশেরা সমাজের খুব মান্যগণ্য লোকদের পর্যায়ে পরে, অন্যান্য পুলিশেরা তাদের খুব সম্মান দেখায়। কিন্তু আমাদের দেশে সাদা পোশাকের পুলিশের তেমন কোন গুরুত্ব নেই। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী পুলিশ হতে হলে চাই খানদানি ইউনিফর্ম! জিন্স প্যান্ট আর নিউমার্কেট থেকে আটশো টাকা দিয়ে কেনা চেক চেক শার্ট পড়া একজন ব্যক্তিকে আবার পুলিশ বলা যায় নাকি!
আবোল-তাবোল ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ক্রাইম সিনের প্রতি মনযোগী হলো মনসুর হালিম। এই মুহূর্তে তার অবস্থান হোটেল র্যাডিসনের প্রদর্শনী কক্ষে। আসলে প্রদর্শনী কক্ষ বলাটা ভুল হচ্ছে, বলা উচিত ভাড়ায় খাটানো হল রুম। যে যার মতো ভাড়া নিয়ে যা কিছু করতে পারে এখানে। সকালে এক পক্ষ ভাড়া নিয়ে হয়ত কোন শখের জিনিসের প্রদর্শনী করছে, দুপুরে আর এক পক্ষ ভাড়া নিয়ে করছে ছেলের মুসলমানি, আবার বিকেলেই হচ্ছে কোনো এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নবীন বরণ অনুষ্ঠান। যে স্কুলে বাচ্চাদের এবিসিডি পড়ানোর বিনিময়ে গার্ডিয়ানদের কাছ থেকে মাসে পঁচিশ-ত্রিশ হাজার টাকা খসিয়ে নেয়া যায় সে স্কুলতো হোটেল র্যাইডিসনেই উৎসব আয়োজন করবে! তাই না? মোদ্দাকথা- এখানে সব সময় গান-বাজনা, হাসি-আনন্দ, হই-হুল্লোড় লেগেই আছে! আপনার যদি লাখ খানেক টাকা খরচ করতে গায়ে না বাঁধে, তাহলে একটা হল রুম ভাড়া করে যা খুশি করতে পারবেন!
তবে কিছুক্ষণ আগে যে প্রদর্শনী চলছিল এখানে, তাকে ঠিক “যা খুশি তাই করা” বলা চলে না। অ্যান্টিক জুয়েলারির প্রদর্শনী। এ আবার যেমন তেমন কিছু নয়! রীতিমত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী। জাতিসংঘের শিল্প- সংস্কৃতি বিষয়ক একটি অঙ্গ-সংগঠন এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। এশিয়া ও ইউরোপ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাচীন আমলের রানী-সম্রাজ্ঞীদের ব্যবহার্য গহনা আনা হয়েছে। দেশি বিদেশি দর্শনার্থীরা এসে ভিড় করে দেখছে আগে আমলের রাজা-রানীদের বিলাস বস্তুগুলি। এক একটা গহনার অ্যান্টিক ভ্যালু আকাশচুম্বী। কে জানে! হয়ত গোটা দশেক গহনার বিনিময়ে সমস্ত ঢাকা শহর কিনে ফেলা যাবে!
কিন্তু প্রদর্শনীর আয়োজকরা ভুলে গিয়েছিলেন যে ঢাকা শহরের অপর নাম হচ্ছে অঘটন ঘটন পটীয়সী নগরী। যত সাবধানতাই আপনি অবলম্বন করেন না কেন, কিছু একটা উল্টো পালটা ঘটে যেতেই পারে! খানিকক্ষণ আগে ঠিক তাই ঘটেছে এখানে! এমন কঠিন সিকিউরিটি ব্যবস্থার মধ্যেও কোন এক দুষ্টু-হতচ্ছাড়া এসে বুলেটপ্রুফ কাঁচ ভেঙে ইংল্যান্ডের রানীর সাধের গহনা নিয়ে চম্পট দিয়েছে!
চুরি হওয়ার পর খবর পেয়ে এসে জায়গাটা সিল করে দিয়েছে পুলিশ। অন্যান্য গহনাগুলো দ্রুত নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কয়েকজন পুলিশ উপস্থিত দর্শক ও কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ থেকে মনসুরকে দায়িত্বে পাঠানো হয়েছে বিষয়টা তদন্ত করার জন্য।
ভাঙা কাঁচগুলো পরীক্ষা করতে করতে মনসুর হালিম বিড় বিড় করে বলল, “মারহাবা! বাঘের বাচ্চা একটা! কী সাংঘাতিক কাণ্ড করেছে!”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবল বলল, “স্যার কি কিছু জিজ্ঞেস করছেন।”
“না... হ্যাঁ... মানে...” আমতা আমতা করছে মনসুর। সে তো খুব একটা জোরে কথা বলেনি। এই ব্যাটা কনস্টেবল কি মনের কোথাও শুনতে পায় নাকি? “জিজ্ঞেস করলাম যে চোর এই কাঁচ ভাঙল কী দিয়ে?”
“হাতুড়ি দিয়ে স্যার... অনেক মোটা হাতুড়ি।" দুহাত দিয়ে হাতুড়ি কতটা মোটা তা দেখানোর চেষ্টা করল কনস্টেবল। তারপর কাছেই একটা ট্রের উপরে প্লাস্টিক ব্যাগে মুড়ে রাখা হাতুড়িটার দিকে আঙুল তুলে ইঙ্গিত করল সে।
হাতুড়ির কথা শুনে হতাশ হল ডিটেকটিভ মনসুর হালিম। সে ভেবেছিল এমন দারুণ চোর নিশ্চয়ই বিশেষ ধরনের কোনো সরঞ্জাম ব্যবহার করে চুরি করেছে। ইংল্যান্ডের রানী এই গহনা চুরির সংবাদে যতটা না কষ্ট পাবেন, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাবেন চুরির পদ্ধতি শুনে! হার্ট ফেইলও করে বসতে পারেন বেচারি! এমন দামি জিনিস চুরি করার জন্য কি না ব্যবহার হয়েছে একটা জং-ধরা পুরনো হাতুড়ি! এ তো মাটির সানকিতে কেএফসির বার্গার খাওয়ার নামান্তর!
এগিয়ে গিয়ে গ্লাভস পড়া হাতে হাতুড়িটা ধরল হালিম। বলল, “কনস্টেবল সাহেব, নামটা যেন কী বললেন আপনার?”
“নাহিদ শেখ।"
“জনাব নাহিদ শেখ”। খুব আদুরে গলায় নামটা উচ্চারণ করল হালিম যেন তার কত দিনে চেনা আপন জন। “বিদেশ থেকে আমাদের মামারা আসতেছে। কাস্টডিতে একটু বলে রাখেন এই বস্তু যেন তাদের হাতে তুলে দেয়। যদি আন্তর্জাতিক কোন ক্রিমিনালের এই চুরির পেছনে হাত থাকে, আর সেই হাতের ছাপ যদি হাতুড়িতে পাওয়া যায়, তাহলে তো বালাই ষাট! হাতের ছাপ দেখেই সনাক্ত করে ফেলা যাবে চোরকে। কিন্তু যদি কাজটা আমাদের পুরানো ঢাকার কোন সিঁধেল চোর করে থাকে, তাহলে শুভঙ্করের ফাঁকি!”
“স্যার...” কনস্টেবল নাহিদ শেখ একটু যেন অপ্রস্তুত। “মামারা আসতেছে মানে...ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না!”
“ হো হো হো...” করে কতক্ষণ উন্মাদ শ্রেণীর হাসি হাসল মনসুর হালিম। “মামারা মানে বুঝেন নাই? বিগ বস! এখনও খবর শুনেন নাই? স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে বাঘা বাঘা টিকটিকি পাঠাচ্ছে ইংল্যান্ডের প্রশাসন, মানে গোয়েন্দা আর কি...
কনস্টেবল নাহিদ শেখ কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে আছে।
হালিম বলে চলেছে, “...এরা আমাদের মত গোয়েন্দা না, নাহিদ সাহেব! পাকা গোয়েন্দা! বড় বড় জায়গায় ট্রেনিং পাওয়া! যাকে বলে শার্লক হোমস! আপনাকে চোখে দেখেই এরা বলে দিতে পারবে আপনার কয়টা বাচ্চা আর কয়টা বউ!”
রসিকতাটা ধরতে পারলো না নাহিদ শেখ নাকি ভাল লাগল না কে জানে! একঘেয়ে সুরে বলল, “তারা বড় দেশের বড় পুলিশ, নিশ্চয়ই অনেক অভিজ্ঞ!”
“আর অভিজ্ঞতা!” মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল মনসুর। “ইংল্যান্ড থেকে শার্লক হোমস আসতেছে! এরা ইংল্যান্ডে বাঘ হতে পারে, বঙ্গদেশে এসে বিড়াল হয়ে যাবে! শার্লক হোমস ঢাকায় জন্ম নিলে বড়জোর কি হতে পারত জানেন?”
“শার্লক হোমস খুব ভালো বেহালা বাজাতে জানত। এই শহরে জন্মালে সে বড়জোর নামকরা একজন বেহালা শিক্ষক হতে পারত। কারণ তার ভয়ঙ্কর বুদ্ধি এখানে কোন কাজেই আসত না! একজন লোকের জুতোর কোনায় লাল মাটি লেগে আছে দেখে শার্লক হোমস বলে দিতে পারে যে লোকটা পশ্চিম লন্ডন থেকে এসেছে। কারণ এক মাত্র পশ্চিম লন্ডনেই লাল মাটি আছে। ঢাকা শহরে সেই সুযোগ কই পাবে? লাল মাটি, কালা মাটি, সাদা মাটি, পলি মাটি, বেলে মাটি- সব এক হয়ে মিশে গেছে! প্যান্টের নিচে কাঁদা লেগে আছে দেখে যদি আপনি ধরে নিন যে আমি ঢাকার হাজীপাড়া থেকে এসেছি, তাহলে কিন্তু ভুল করবেন! এখানে অভিজাত পাড়ায় কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হওয়া ফ্ল্যাটের সামনেও সামান্য বৃষ্টি হলে জমে যায় হাঁটু সমান কাদা!”
লেকচার দেওয়া থামিয়ে আবার কাজে মনযোগী হলো মনসুর। এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করল, “চুরিটা কি সবার চোখের সামনেই হয়েছে?”
“জি স্যার।” এবার আর কনস্টেবল নয়। উত্তরটা দিলেন হোটেল র্যাডিসনের ম্যানেজার।
চোখ তুলে ম্যানেজারের দিকে তাকাল ডিটেকটিভ মনসুর। ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যেন এতক্ষণ এই লোকটার উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিল না সে! তবে ব্যাপারটা আসলেই সত্যি। এতক্ষণ মনসুর খেয়ালই করেনি যে এখানে আর একজন দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “তাই নাকি? সবার সামনে চুরি করল আর কেউ কিচ্ছু বলল না!”
“জি না স্যার। আসলে...”
ম্যানেজারকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মনসুর বলে উঠল, “ইউরেকা! আমি মনে হয় বুঝতে পেরেছি চুরিটা কে করেছে!”
“কে করেছে স্যার?” নাহিদ শেখের প্রশ্ন।
“বারাক ওবামা!”
“ধুর আপনি মশকরা করতেছেন স্যার”। বলল কনস্টেবল নাহিদ শেখ।
“আরে না না! আমি সিরিয়াস!” মনসুর গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল। “এত দর্শনার্থী, এত সিকিউরিটি গার্ড, এত ম্যানেজমেন্ট এর লোক- কেউ কিচ্ছু বলার সাহস পেল না! এটা শুধুমাত্র বারাক ওবামা চুরি করলেই সম্ভব!”
“আসলে স্যার, আপনি যেমন ভাবছেন, ব্যাপারটা তেমন কিছু না”। বলল হোটেল র্যাডিসনের ম্যানেজার।
“তাহলে কেমন?”
“চুরির মুহূর্তে এখানে যারা উপস্থিত ছিল, তাদের কেউ মনে করতে পারছে না এখানে ঠিক কি ঘটেছে। আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম, আমারও একই অবস্থা!”
“মনে করতে পারছে না! আমাকে হাঁদারাম ভেবেছেন নাকি?” মনসুরকে দেখে মনে হল বিরক্ত হয়েছে। “যদিও আমার চেহারায় মাছুম মাছুম একটা ভাব আছে, কিন্তু আমি ঘটে যথেষ্ট বুদ্ধি রাখি মশাই! সবাই কি একযোগে গঞ্জিকা সেবন করেছিল নাকি যে কিছুই মনে নাই? ভাগে যোগে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ?”
“আমি সত্যি বলছি স্যার! না হয় আপনি উপস্থিত অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন! আমাদের এখানে ভিআইপিদের নিরাপত্তার জন্য দশজন পুলিশ ও র্যাব সদস্য ছিলেন। তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখুন! ব্যাপারটা সবার সাথেই ঘটেছে!”
“সর্বমোট কতজন ছিল এখানে?”
“ভিআইপি কিছু ডেলিকেট ছিলেন। দশজনের মত, বেশির ভাগই বিদেশী। পঞ্চাশ জন সাধারণ দর্শনার্থী ছিল, সবাই ঢাকা শহরের অভিজাত শ্রেণীর মানুষ। এছাড়া আমাদের নিজস্ব গার্ড ছিল পনেরজন। পুলিশ ও র্যাবের সদস্য ছিলেন দশজন, ম্যানেজমেন্ট এর দায়িত্বে আরও ধরেন পনেরজন”।
“পুরা কাঁটায় কাঁটায় একশ জন! একশতজন লোকের কেউ কিছুই বুঝতে পারেনি?” মনসুর হালিম হতবাক। “হাতুড়ি দিয়ে কাঁচ ভাঙা হয়েছে জনাব! এই আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি? এটা কি করে সাময়িক বয়রা রোগে ধরেনি নিশ্চয়ই সবাইকে?”
“স্যার। ব্যাপারটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে তা আমরাও জানিনা। মনে হচ্ছে উপস্থিত যারা ছিল তাদের সবার মস্তিষ্ক থেকে পাঁচ-দশ মিনিটের স্মৃতি মুছে গেছে! কেউ কিচ্ছু বলতে পারছে না”।
“এতগুলা সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। এইসব ক্যামেরার ফুটেজেও কিছু দেখা যায়নি? এইগুলা কি তবে ভাব দেখানোর জন্য লাগিয়েছেন নাকি?” মনসুরের গলায় বিরক্তি।
ম্যানেজার একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিলেন। কীভাবে বুঝিয়ে বলবেন মাথায় আসছে না। তবুও মনসুরকে ব্যাপারটা বোঝাতে চেষ্টা করলেন তিনি, “স্যার, নিরাপত্তার সমস্ত পরিকল্পনা আয়োজক সংগঠন আর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সমন্বয়ে করা হয়েছে। এই বিষয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ কোন পদক্ষেপ ছিলনা। অয়োজক কমিটি যে সিসি ক্যামেরাগুলো বসিয়েছে সেগুলা রুমের সবগুলো প্রান্ত পুরোপুরি কভার করেনি। তবে ক্যামেরাগুলো থেকে যতটুকু ফুটেজে পাওয়া গেছে তাতে দেখা গেছে মুখে কালো কাপড় পরা একজন লোক হাতুড়ি দিয়ে কাঁচ ভাঙছে। তার আশে পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, লোকটা কি করছে দেখছে সবাই। কিন্তু চুরি করে চোর পালানোর পর দেখা গেল যে উপস্থিত কারো কিছুই মনে নেই। তারা কেউ বলতে পারছে না যে এখানে তাদের সামনে ঠিক কি ঘটেছে! আমাদের কাছে অনেকটা এমন মনে হচ্ছে যে এইমাত্র আমাদের চোখের সামনে দেখলাম গহনাটা কাঁচের সেইফে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই দেখলাম গহনাটা ওখানে নেই, সেইফটা ভাঙা, নিচে ভাঙা কাঁচের টুকরো পড়ে আছে। কিন্তু এই এক মুহূর্তের মাঝে আসলে পেরিয়ে গেছে দশ মিনিট! আমরা তা টেরই পাইনি।”
মনসুর অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে ম্যানেজারের কথা শুনে। এমন অদ্ভুত চুরির কথা ইহজনমে কখনও শোনা গেছে বলে তার মনে হয় না। বলল, “কালো গর্তে ঢুকে গিয়েছিলেন নাকি সবাই?”
“কালো গর্ত... ঠিক বুঝিনি স্যার।”
“আরে ওটা ব্ল্যাকহোল।” বিরক্ত হয়েছে মনসুর। “সায়েন্স ফিকশন মুভিটুভি দেখেন না নাকি? এক মাত্র ব্ল্যাকহোলের মধ্যে সবাই ঢুকে পড়লেই এমনটা সম্ভব। এখানে আপনাদের জন্য এক সেকেন্ড পেরিয়েছে, মানে বাইরের পৃথিবীতে পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়...” একটু থেমে বিড় বিড় করে বলতে থাকল মনসুর,“...অথবা হয়ত ভুল দিক থেকে চিন্তা করছি। চোরটাই হবে কোন ভিনগ্রহের এলিয়েন। কালো গর্তে করে এসে হাজির হয়েছে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে গহনা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। কিন্তু এলিয়েনের ঐ পুরনো গহনা কেন প্রয়োজন হবে? আর এলিয়েন হলে মুখে কাপড় বাঁধবে কেন? এলিয়েনকে চিনে ফেলতে পারি এই ভয়ে? সে না হয় বুঝলাম কিন্তু এলিয়েন হাতুড়ি ব্যবহার করবে কেন... ধুর... আসলে উপস্থিত দর্শক সব কয়টা দল বেঁধে গাজা খেয়েছিল হয়ত। আমাকেও বোধহয় সেই গাঁজার রি-একশন পেয়েছে, তাই উল্টা পাল্টা ভাবতে শুরু করেছি...।”
ম্যানেজার বুঝতে পারছেন না কিছু বলা উচিত হবে কি না।
“দর্শনার্থীদেরকে কোন ধরণের আপ্যায়ন করা হয়েছিল কি? বিশেষ ধরণের কোন খাবার বা পানীয় দেয়া হয়েছিল?” মনসুর জিজ্ঞেস করল।
“না স্যার”।
“ভালো করে চিন্তা করে দেখুন ম্যানেজার সাহেব। কিছু একটা নেশা জাতীয় বস্তু হয়ত আপনাদের খাওয়া পড়েছে। তা নাহলে এতগুলো মানুষের এক সাথে কি হল? চোখের সামনে দেখা ঘটনাটা ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ? এর একটাই কারণ হতে পারে যে আপনারা সবাই ঐ মুহূর্তে অচেতন ছিলেন।”
“এখানে কোনো ধরণের খাবার সার্ভ করা হয়নি স্যার। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। তবে কোন দর্শক কোন খাবার সাথে এনেছেন কিনা আমাদের তা জানা নাই। আনলেও নিশ্চয়ই সবাই তা খায়নি। অন্তত আমি তো খাইনি।”
“ঠিক আছে, আপনাদের ব্লাড টেস্টও অন্যান্য মেডিকেল এক্সামের ব্যবস্থা করা হবে সেটার দেখার জন্য। এখন আপনি আমাকে সারাদিনের প্রদর্শনী চলাকালীন সবগুলো ক্যামেরার ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজের সিডি করে দিন। আর যারা যারা এখানে উপস্থিত ছিল তাদের প্রত্যেকের নাম- পরিচয় ইত্যাদি তথ্যের তালিকা দিন।”
“ঠিক আছে স্যার।” বলে মনসুরের সামনে থেকে চলে গেল ম্যানেজার।
“নাইদ শেখ।” ডাক দিলো মনসুর।
“জি স্যার?”
“চুরির সময় যারা যারা উপস্থিত ছিল তাদের সবাই কি এখানে আছে?”
“আছে স্যার। সবাইকে বাইরের লাউঞ্জে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স বাদে কাউকে যেতে দেওয়া হবে না। সবার নাম- ঠিকানা- মোবাইল নম্বর লিখে রাখা হচ্ছে।”
“গুড! এক কাজ করেন। আট দশজনকে গ্রেফতার করে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে চলেন। এদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যবস্থা করা লাগবে।”
“তাতে কি খুব একটা লাভ হবে স্যার?” বলল কনস্টেবল নাহিদ। “সবাই তো একই কথা বলছে! কেউ জানে না আসলে ঠিক কি ঘটেছে এখানে। আর যাই হোক স্যার, এতগুলো মানুষ একসাথে দল বেঁধে চুরিতে সাহায্য করেছে এমনটা ভাবা যায় না। এরা সবাই অবস্থা-সম্পন্ন মানুষ। চুরির কাজে সাহায্য করে পয়সা কামানোর ধান্দা কথা নয়।”
“আপনার মাথা খুব পরিষ্কার নাহিদ শেখ।” মনসুরের মুখে হাসি। “আপনাকে আসলে কনস্টেবল পজিশনে মানাচ্ছে না। দুই চারটা প্রমোশন হওয়া উচিত। আমি সুযোগ পেলে রিকমেন্ড করে দিব। আপনার কথাগুলো আমার মাথায়ও এসেছে কিন্তু কোন সম্ভাবনাই এখনই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।”
নাহিদ শেষ মুখ ব্যাজার করে বলল,“আট দশজন গ্রেফতার করাটা বেশি হয়ে যায় না স্যর? এখানে অনেক ভিআইপি আর তাদের আত্মীয় স্বজন আছে।এদের গ্রেফতার করতে গেলে না আবার বান্দরবনে ট্রান্সফার হওয়া লাগে...”
“আহা! যা বলেছি করেন তো!” মনসুর হালিম বেশ বিরক্ত, সিদ্ধান্ত পালনে অধিনস্তদের গড়িমসি তার একদম পছন্দ নয়। “পুলিশ এসেছে ক্রাইম সিনে! দুই চারটা গ্রেফতার করে রিমান্ডে না নিলে কি হয়? আমাদের একটা প্রেস্টিজ আছেনা? চুরি হওয়ার সময় একদম কাছে ধারে ছিল এমন কয়েকজনকে ধরে লকআপে ঢুকান। বাকিটা আমি দেখছি...”
“ঠিক আছে স্যার। কিন্তু এদের মধ্যে হয়ত দুই একজন পাওয়ারফুল ভিআইপি আর হোটেলের ম্যানেজারও পড়ে যাবেন।” নাহিদ শেখ মনে মনে বলল, “আপনারা তো ‘দেখছি’ বলেই খালাস। যত সব ঝড়-ঝাঁপটা আমাদের উপর দিয়েই যায়।”
“রাখেন আপনার ভিআইপি! রিমান্ডে নিলে সবই এক। আর ঐ ম্যানেজার ব্যাটা নাক উঁচা স্বভাবের। ওরেই আমার চোর বলে মনে হচ্ছে!”
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও হ্যাঁ- বোধক মাথা নাড়ল কনস্টেবল, “ওকে স্যার।”
ক্রাইম সিন মোটামুটি খুঁটিয়ে দেখেছে মনসুর হালিম। তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছে না এখান থেকে। এবার ব্লাডস্টোন নামের ওই এন্টিক গহনাটা যে সেইফে রাখা হয়েছিল সেটা একটু পরীক্ষা করে দেখা যাক। সেইফের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল মনসুর।
সেইফের কাঁচ অনিয়ন্ত্রিত ভাবে ভাঙা হয়েছে। বুঝাই যাচ্ছে চোর বেশ তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিল, কায়দা করে ভাঙার কোন উপায় ছিল না। যেভাবে কাঁচগুলো ভাঙা হয়েছে তাতে ভাঙতে গিয়ে গহনাটার ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। নিঃসন্দেহে এটা অদক্ষ চোরের কাজ। ভাঙা কাঁচগুলো সেইফের আশে পাশে পড়ে আছে। ভেতরে গহনা রাখার একটা সুদৃশ্য ক্রিস্টালের পাত্র, এই মুহূর্তে খালি। পাত্রের নিচে নিচে লোহার নেমপ্লেটে সাদা রঙে লেখা -
ইষড়ড়ফঝঃড়হব
অঢ়ঢ়ৎড়ীরসধঃব ঃরসব ড়ভ ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ: ১৪৯০ অ.উ.
“নাহিদ শেখ।” ডাক দিল মনসুর হালিম।
নাহিদ শেখ বেশ চমকে উঠল। সে গিয়েছিল সাত আটজন দর্শনার্থীদের গ্রেফতার করে থানায় নেয়ার জন্য পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিতে। কাজ শেষ করে নিঃশব্দে মনসুর হালিমের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মনসুর সেটা টের পেল কী করে?
ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল নাহিদ শেখ। এই ব্যাটা ডিটেকটিভ আবার কি উল্টা পাল্টা নির্দেশ দেয় কে জানে? ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিল। “জি স্যার?”
মনসুর হালিম ঘুরে দাঁড়াল নাহিদ শেখের দিকে। মুখে ভুবন ভোলানো অমায়িক হাসি। বলল, “ঘাবড়াবেন না নাহিদ সাহেব। আমার কোন সুপার পাওয়ার কিংবা মাথার পেছনে এক জোড়া চোখ নেই। আপনি পেছন থেকে আসছেন সেটা ব্লাডস্টোনের সেইফের ভাঙা কাঁচের টুকরোয় দেখা যাচ্ছিল।”
নাহিদ শেখ কিছু বলছে না।
মনসুর জিজ্ঞেস করল, “নাহিদ শেখ, নেকলেসটা চুরির আগে দেখেছেন নাকি?”
“না স্যার, দেখিনি।”
“মিস করেছেন। দারুণ সুন্দর দেখতে”। মনসুর আফসোসের ভঙ্গিতে মুখ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল।“আর এই বস্তুর নাম ব্লাডস্টোন রাখা হয়েছে কেন জানেন কিছু?”
“না স্যার। নামকরণের কারণ আমার জানা নাই”। মাথা নাড়ল নাহিদ শেখ।“তবে শুনেছি এর সাথে কিছু ইতিহাসের ব্যাপার-স্যাপার আছে।”
“কী আর বলব আগের আমলের মানুষের কথা! যার যা মনে চায় তাই করে ফেলত।” হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মনসুর। “এই যে দেখেন আমার মামা! কী কাণ্ডটাই না করলো!”
“কী কাণ্ড স্যার?” শোনার একদম আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করল নাহিদ শেখ। এই খোশগল্প করতে ভাল লাগছে না তার। সামনে দাঁড়ানো লোকটার কারণে খানিক আগে কয়েকজন ভিআইপি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে হয়েছে। কোন সময় যেন বান্দরবনে ট্রান্সফার হওয়ার খবর আসে- কে জানে। খুব টেনশন হচ্ছে তার।
“আর বলবেন না সেই কাণ্ডের কথা”। মনসুর হালিমের চেহারা দেখে মনে হল কষ্টে কেঁদে ফেলবে বুঝি। “আমি জন্মের সময় একটা হোটেলে বসে মামা গরম হালিম খাচ্ছিলেন। মামার বড় ছেলে দৌড়াতে দৌড়াতে হোটেলে গিয়ে তাকে খবরটা দিল। আমি হয়েছি এই খুশিতে বিষম খেয়ে গরম হালিমে মামার জিভ পুড়ে গেল! ঐ হোটেলে যে লোক হালিম বানাত তার নাম ছিল মনসুর। জিভ পুড়ে যাওয়ায় রেগে গিয়ে ঐ মুহূর্তে মামা আমার নাম রেখে দিলেন মনসুর হালিম! কি বলব দুঃখের কথা। জন্মের আগেই বাবা মারা গিয়েছেন। মা অসহায় অবস্থায় মামার আশ্রয়ে ছিল। তাই মামার এমনতর রসিকতায় কেউ বাঁধা দিতে পারে নাই...”
কথা বলতে বলতে ভাঙা সেইফের এক কোনায় দলা মোচড়া হয়ে পড়ে থাকা ছোট্ট একটা কাগজ নজরে এলো মনসুরের। সেদিকে তাকিয়ে বলল, “দেখছেন নাহিদ সাহেব? ভাঙা সেফের ভেতরে একটা কাগজের টুকরো পড়ে আছে মনে হচ্ছে! এটা কি করে এলো এখানে?”
নাহিদ শেখ উঁকি দিয়ে তাকাল। বলল, “তা তো জানি না স্যার! মনে হয় চোর ফেলে গেছে।”
তাই তো মনে হচ্ছে। গ্লাভস পড়া হাতে কাগজটা তুলে নিলো মনসুর। চারভাজ হওয়া কাগজটা দেখে তার কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল। “ঘটনা কী? চোর কি চুরি করে যাওয়ার সময় সূত্র ফেলে গেছে নাকি! এতো মনে হচ্ছে যেমন তেমন চোর নয়। ব্যাটা কি আমার সাথে ইঁদুর বিড়াল খেলছে?”
কাগজটা খুলল মনসুর হালিম। কনস্টেবল নাহিদ শেখ দেখল সারাক্ষণ খুব মজার মুডে থাকা ডিটেকটিভ এক নিমেষে সিরিয়াস রূপধারণ করল। চোখ- মুখের হাসির রেখাগুলো মুছে গেল, তার জায়গায় স্থান করে নিলো দুশ্চিন্তার ছাপ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা কোন সিঁধেল চোর বা ডাকাতের কাজ নয়। গহনাটা ব্ল্যাক মার্কেটে বেঁচে পয়সা কামানোর ধান্দা চোরের নেই। এর পিছনে লুকিয়ে আছে অন্য কিছু! অনেক গভীর কিছু! কাগজের মধ্যে পরিষ্কার বাংলায় লেখা আছে-
“অ্যামিতিস, তোমাকে ভালবাসি”
চিরকুট পড়ার পর ডিটেকটিভ মনসুর হালিমকে দেখে মনে হল ভুত দেখে চমকে উঠেছে। নাহিদ শেখ বুঝতে পারছে এক মুহূর্তের মাঝে ডিটেকটিভ মনসুরের মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে অসংখ্য প্রশ্ন-
কে এই অ্যামিতিস?
কে ভালবাসে তাকে?
কেন চোর এই চিরকুট লিখেছে?
কেন সে চুরি করে চিরকুট ফেলে গেল?