মে মাস, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ অব্দ
সম্রাট নেবুচাদনেজারের দুর্গ, ব্যাবিলন।
মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে বিশ্বজয় করে মেসিডোনিয়ার রাজা মহাবীর আলেকজান্ডার এখন ব্যাবিলনে অবস্থান করছেন। উনিশ বছর বয়সী এক তরুণ স্বপ্ন দেখেছিলেন গোটা পৃথিবীর রাজা হবেন, মাত্র তের বছরের মধ্যে সেই লক্ষ্য পূরণের চূড়ান্ত ধাপে পদার্পণ করেছেন। মানুষের জানা পৃথিবীর প্রায় সবটুকুই জয় করে ফেলেছেন । বিশ্ববাসীর কাছে তার পরিচয় দিগ¦বিজয়ী আলেকজান্ডার নামে। কেউ ডাকে মহাবীর আলেকজান্ডার, কেউ বলে ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’। ছোট্ট রাজ্য মেসিডোনিয়াকে কেন্দ্র করে চারিদিকে একের পর এক রাজ্য জয় করে তিনি গড়ে তুলেছেন এক বিশাল সাম্রাজ্য, যার বিস্তৃতি মেসিডোনিয়া থেকে গ্রিস ও পারস্য সাম্রাজ্য ছাড়িয়ে সিন্ধু সভ্যতার প্রান্ত পর্যন্ত। তার স্বপ্ন ছিল, তার বিশাল এ সম্রাজ্যের আরো বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটাবেন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই তিনি দখল করে নিয়েছেন সমগ্র মেসোপটেমিয়া অঞ্চল।
সিন্ধু ও তার আশেপাশের অনেকখানি অঞ্চল তার করায়ত্তে চলে আসে খুব সহজে। অ্যালেকজান্ডার এর ইচ্ছে ছিল এই অঞ্চল জয় করে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়া। কাবুল-কান্দাহার-মহেঞ্জদারো-হরপ্পা জয়ের পর অ্যালেকজান্ডার ঠিক যখন সামনে যাওয়ার পায়তারা কষছিলেন ঠিক তখনই কান্দাহারে ছোটখাট একটা বিদ্রোহ দেখা দিল।
অ্যালেকজান্ডার তার সেনাবাহিনীর একজন প্রধান সেনাপতিকে কান্দাহারের শাসনকর্তা হিসেবে বসিয়েছেন। কিন্তু কান্দাহারের মানুষ তাকে রাজা হিসেবে মানতে নারাজ। কান্দাহারের শাসনকর্তা যদি কাউকে বানাতে হয় তবে তাকে কান্দাহারের অধিবাসীই হতে হবে।
আলেকজান্ডারের রাজ্য জয়ের এই অভিযানের শুরু হয় হেলেসপন্ট প্রণালী দখলের মাধ্যমে। অ্যালেকজান্ডারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল পারস্য দখল করা। হেলেসপন্ট প্রণালী দখলের মাধ্যমে এই পথ অনেকটা সুগম হয়ে যায় তার জন্য। কারণ এই প্রণালীটি যুক্ত করেছে মরমরা সাগর ও এয়িজিন সাগরকে। এই অঞ্চল হাতে থাকার মানে পারস্য সাম্রাজ্য অরক্ষিত হয়ে পড়া। অতঃপর সুযোগ বুঝে অ্যালেকজান্ডার পারস্য হামলা করেন। আলেকজান্ডার আর পার্সিয়ান নেতাদের মধ্যে তিনটি বড় ধরনের যুদ্ধ করে সংঘটিত হয়। অবশেষে ৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বে পারস্য-নেতা তৃতীয় ডরিয়াসকে হত্যা করে অ্যালেকজান্ডার পারস্য জয় করে নেন।
কিন্তু এই অভিযানে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয় তার বাহিনীর। ক্ষতি পুষিয়ে উঠে অভিযান চালানোর জন্য সময়ের প্রয়োজন ছিল। সময় হয়ত ছিল, কিন্তু ধৈর্য হল না তার। তিনি ক্রমাগত অগ্রসর হলেন সিন্ধু সভ্যতার উত্তর-পশ্চিম দিকে। পথে যেই তার কর্তৃত্ব মানতে চায়নি তাকেই পরাভূত করেছেন তিনি। ম্যাসিডনের রাজা অ্যালেকজান্ডারের ভারতবর্ষ আক্রমণ ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। পারস্য বিজয়ে পর শুরু হয় তার ভারত আগ্রাসন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩১ অব্দে তিনি পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন। সে সময় সিন্ধুনদ পারস্য সম্রাজ্যের সীমানা ছিল। তার ভারতবর্ষ আক্রমণের প্রাক্কালে উত্তর-পশ্চিম ভারত পরস্পরবিরোধী অনেকগুলো রাজ্যে বিভক্ত ছিল। তাদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বহিরাক্রমণ ঠেকানো সম্ভবপর ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৮ অব্দের মধ্যে সমগ্র পারস্য এবং আফগানিস্তান অ্যালেকজান্ডারের দখলে আসে। অত:পর খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারত অভিমুখে অগ্রসর হন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে তিনি ভারত নাম ভূখণ্ডে পদার্পণ করেন। আলেকজান্ডার পুষ্কলাবতীর রাজা অষ্টককে পরাভূত করেন, অশ্বক জাতিও তার নিকট পরাভূত হয়, তক্ষশীলার রাজা তার নিকট স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে, ঝিলাম রাজ পুরু বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে বশ্যতা মানতে বাধ্য হন অত:পর আলেকজান্ডার রাভি নদীর উপকূলবর্তী রাজ্যসমূহ দখল করেন এবং বিপাশা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হন। ভারত ভূখণ্ডে আলেকজান্ডার প্রায় উনিশ মাস অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু সিন্ধু অববাহিকায় আসার পর কান্দাহারের বিদ্রোহ তার মনঃসংযোগ ব্যহত করল। ফলে মেসিডনিয়ান বীর তার দক্ষিণমুখী অভিযান বন্ধ করতে বাধ্য হল। এই স্থলে তার রণক্লান্ত সেনাবাহিনী দেশে প্রত্যাবর্তনে উন্মুখ হয়ে পড়লে আলেকজাণ্ডার ভারত অভিযান বন্ধ করে গ্রীসে প্রত্যাবর্তন শুরু করেন। প্রত্যাবর্তনের পথে তিনি বেলুচিস্তান ও পাঞ্জাব অধিগত করেন ঝিলাম ও সিন্ধু নদের অন্তবর্তী সকল রাজ্য তার অধিগত হয়।
অ্যালেকজান্ডার আপাতঃ সমস্যা কাটানোর জন্য অনেকটা বাধ্য হয়ে কান্দাহারের অধিবাসীদের মধ্যকার প্রতাপশালী কয়েজনের সিদ্ধান্তে একজনকে ক্ষমতায় বসালেন। কিন্তু তাতে কি সব সমস্যার সমাধান হল? এই সিদ্ধান্তে বিদ্রোহ হয়ত দমন করা গেছে কিন্তু নতুন এই শাসক কতদিন অ্যালেকজান্ডার এর বশ্যতা মেনে চলবে- এটাও ভেবে দেখার দরকার আছে। এই শাসনকর্তাকে যতটা সম্ভব সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে খুশী রাখতে হবে।
অ্যালেকজান্ডার আর সিন্ধু পেরিয়ে সামনে অগ্রসর না হয়ে ব্যাবিলনের দিকে যাত্রার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন এদিকে অভিযানে সঠিক পরিকল্পনার অভাব থাকলে খুব একটা এগিয়ে যাওয়া যাবে না। আলেকজান্ডারের ইচ্ছে ছিল ব্যাবিলনে ফিরে এসে কিছুদিন বিশ্রাম নেবেন এবং পরবর্তী অভিযানের জন্য পরিকল্পনা করবেন।
ব্যাবিলনে ফিরে আসার পর থেকেই নতুন অভিযানের পরিকল্পনা করা শুরু করলেন তিনি। সিন্ধু অভিমুখে নতুন করে অভিযানে যাওয়ার জন্য তাকে আগে কান্দাহারে পৌঁছানো লাগবে। দক্ষিণের দিকে অগ্রযাত্রায় কান্দাহার একটি নির্ভরযোগ্য সেতু হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু কান্দাহারের শাসক যাকে বানিয়ে এসেছেন সে যদি বিশ্বস্ত না থাকে? যদি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বশে? সেই ক্ষেত্রে পুনরায় কান্দাহার দখল করার প্রয়োজন পড়বে। এই মুহূর্তে কান্দাহার দখল করে তারপর সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার মত লোকবল জোগাড় করা সম্ভব হবেনা।
অ্যালেকজান্ডারের ব্যাবিলনে ফেরার পর প্রথম সিদ্ধান্ত হল কান্দাহারের শাসনকর্তাকে নিজের বশে রাখার উপায় খুঁজে বের করা। তিনি তার সাত সেনা প্রধানের একজন দিমিত্রিয়াসকে নির্দেশ দিলেন ব্যাবিলন থেকে মূল্যবান সম্পদ সংগ্রহ করার জন্য যা উপঢৌকন হিসেবে কান্দাহারের শাসনকর্তার কাছে পাঠানো হবে। নিয়মিত এই ধরনের বরাদ্দ পেলে নিশ্চয়ই সে বিদ্রোহ করতে আগ্রহী হবে না।
কিন্তু ব্যাবিলনে সম্পদ খুঁজে পাবে কোথায়? দুইশ বছর আগে সম্রাট সাইরাসের আগ্রাসনে সমস্ত ব্যাবিলন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। জৌলুস হারিয়ে ব্যাবিলন এখন একটি পরিত্যক্ত নগরী ব্যতিত অন্য কিছু নয়। তবে ব্যাবিলনের প্রাচীন অধিবাসী গোষ্ঠীদের মালিকানায় বেশ কিছু পুরনো শিল্প-সম্পদ রক্ষিত ছিল। দিমিত্রিয়াস তার আওতাধীন সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন এইসব গোষ্ঠীগুলোর আখড়ায় হামলা করে তাদের কাছে রক্ষিত যত মূল্যবান সম্পদ আছে তার সবই ছিনিয়ে নিয়ে আসার জন্য।
সৈন্যরা হুকুম পালন করল। এক রাতের মধ্যে ব্যাবিলনের মানুষের শেষ সম্বল হিসেবে যা ছিল তা আরও একজন স্বৈরাচারী রাজার সিদ্ধান্তের কারণে হস্তচ্যুত হল। এই ঘটনা ছোটখাট একটা বিদ্রোহের জন্ম দিল ঠিকই, কিন্তু কোন বিদ্রোহ দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই তা ঝিমিয়ে গেল। বার বার স্বাধীনতার স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়া ব্যাবিলনের অধিবাসীরা স্বপ্ন দেখতেই ভুলে গেছে। যে জাতির স্বপ্ন নেই, স্বপ্নদ্রষ্টা নেই, স্বপ্ন দেখানোর মত কেউ নেই- সে জাতি প্রতিবাদ করার পুঁজি কই পাবে? তাই তো ব্যাবিলনবাসী নিরবে তাকিয়ে তাকিয়ে কেবল দেখল-তাদের বাঁচিয়ে রাখা শেষ স্বপ্নগুলো কান্দাহারের অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে।
এদিকে মেসিডোনিয়ান রীতি অনুযায়ী ঐশ্বরিক বলিদানগুলো সম্পন্ন করার সময় চলে এল। পরপর দশদিন বলিদান করতে হয় প্রাচীন গ্রিক দেবতাদের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। যাজকরা এই বলিদানের পরামর্শ অ্যালেকজান্ডারকে দেন তার সৌভাগ্য অর্জনের লক্ষ্যে।
প্রথম দিনঃ
যাজকেরা বলিদানের পর পূর্ণ বিশ্রামে যাওয়ার জন্য বলেন তাকে। কিন্তু ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর আমন্ত্রণে ভোজসভায় যোগ দিলেন মহাবীর অ্যালেকজান্ডার। দিনব্যাপী এ আয়োজনে আলেকজান্ডার প্রচুর মদ পান করলেন। রাতেও তিনি কয়েকজন বন্ধুর সাথে হৈ-হুল্লোড় করে মদোৎসব পালন করলেন। এরপর কিছু সময়ের জন্য বিরতি নিয়ে উঠে গেলেন। গোসল করে বন্ধুর মহলের অতিথিশালায় গিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি আবার ফিরে এলেন রাতের খাবার খেতে। গভীর রাত পর্যন্ত প্রচুর মদ পান করলেন। পান শেষে আবার গোসল করে সামান্য খাবার খেয়ে শুতে যাবেন বলে মনঃস্থির করলেন। কিন্তু লক্ষ্য করলেন তার শরীরে প্রচন্ড জ্বর উঠেছে। ভোজসভার সবাইকে “ভালো লাগছে না” বলে ঘুমুতে চলে গেলেন মেসিডোনিয়ার রাজা। গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। তিনি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে, ঠিকমত হেটে বিছানায় যেতেও পারছিলেন না।
দ্বিতীয় দিন :
পরদিন সকালে অ্যালেকজান্ডারের ঘুম ভাঙল তীব্র জ্বর নিয়ে। সেনাপতিরা তাকে এই শরীরে বের হতে নিষেধ করলেন। কিন্তু তিনি তা শুনলেন না। তাকে কোচে করে বহন করে নিয়ে যাওয়া হল ঐশ্বরিক বলিদানের জন্য। বলিদান সম্পাদনের পর তিনি সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি শুয়ে থাকলেন দরবার সংলগ্ন শয়নকক্ষে। এই সময় তিনি তার সেনাপ্রধানদের আগামী অভিযান ও সমুদ্রযাত্রা সম্পর্কে নির্দেশনা দিলেন। স্থলবাহিনী প্রস্তুত করতে বললেন এবং পরদিন থেকেই দক্ষিণ দিকে নৌযাত্রা শুরুর জন্য আদেশ করলেন। এরপর তাকে কোচে করে নদী তীরে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে তিনি একটি নৌকায় উঠলেন। নৌকা করে চলে গেলেন প্রাসাদ সংলগ্ন বাগানের কাছে। সেখানে তিনি গোসল করে নিয়ে আবার বিশ্রামে গেলেন। এর মধ্যে শরীরে জ্বর কেবল বেড়েই চলেছে, কমছে না কিছুতেই।
তৃতীয় দিন :
তৃতীয় সকালে আবার গোসল করলেন জ্বর নেমে যাওয়ার আশায়। এরপর নির্দেশিত বলিদান সম্পন্ন করলেন। এরপর নিজের কক্ষে ঢুকলেন। শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ কথা বললেন তার সৎভাই এবং অন্যতম সেনা প্রধান টলেমির সাথে। টলেমিকে নির্দেশ দিলেন যেন সমস্ত সেনাপ্রধানদের নিয়ে পরদিন সকালে তার সাথে দেখা করে, আগামী সম্ভাব্য অভিযান নিয়ে পরামর্শ করতে হবে। সামান্য খাবার খেলেন রাজা। তারপর সারা রাত শুয়ে থাকলেন জ্বর নিয়ে।
চতুর্থ দিন :
শরীর দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। জ্বর কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শরীরের উত্তাপ কমাতে বার বার গোসল করতে হচ্ছে তাকে। গ্রীক চিকিৎসকদের আনা হয়েছে তার চিকিৎসার জন্য। চতুর্থ দিন সকালে উঠেই গোসল করলেন এবং বলিদান সম্পাদন করলেন। নিয়ারকাস ও অন্যান্য সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন দু’দিন পর সমুদ্র অভিযানের জন্য তৈরি হতে। রাজা আশা করছেন এই দু দিনের মধ্যেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।
পঞ্চম দিন :
মহামতি আলেক্সান্ডারের দেহে অব্যাহত জ্বর থাকছে। কোন ওষুধে কাজ হচ্ছে না। তারপরও তিনি টলেমি ও সেনাপতিদের ডেকে আনলেন এবং অভিযানে যাওয়ার জন্য সব কিছু তৈরি করতে বললেন। সুস্থ হয়েই অভিযানে বেরোতে হবে। বিকেলে গোসলের পর তিনি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
ষষ্ঠ দিন :
এই দিন শরীর প্রচণ্ড খারাপ সত্ত্বেও ঊর্ধ্বতন সেনাপতিদের নিজের কক্ষে ডেকে আনলেন অ্যালেক্সান্ডার এবং অভিযানের ব্যাপারে নতুন করে নির্দেশনা দেন। এদিকে গ্রীক চিকিৎসকরা উপস্থিত হলেন ব্যাবিলনে। রাজার চিকিৎসায় মনোনিবেশ করল তারা।
সপ্তম দিন :
দুর্বল থাকা সত্ত্বেও কোনোমতে বলিদান সম্পন্ন করলেন। তিনি সেনাপতিদের দরবারে থাকতে বলেন। তাদের কাছ থেকে বিচার-আচার, শাসন ও অন্যান্য দরবারের কাজের খোঁজ খবর নিলেন। এই করতে গিয়ে এবার তিনি খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে বাগান থেকে ফিরিয়ে নেয়া হয় ব্যাবিলনের দুর্গে। নিজের কক্ষে ঢুকে শোয়ার পর অ্যালেক্সান্ডারের নিকট আত্মীয়রা তাকে দেখতে এল। রাজা তাদের সাথে একটি কথাও বললেন না।
অষ্টম দিন:
সকাল বেলায় ব্যাবিলনের দুর্গে হৈচৈ পড়ে গেল। এই হৈচৈ এর কারণ হচ্ছে গ্রীক চিকিৎসক সিডন এর মতামত। সিডন জানালেন- অ্যালেক্সান্ডারের এই জ্বরের কারণ হচ্ছে বিষক্রিয়া। ঐ দিন ঐ ভোজসভার খানাপিনার সাথেই কেউ একজন অ্যালেকজান্ডারের খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে তাকে খাইছে দিয়েছে। সেই বিষের প্রভাবে রাজা জ্বরাক্রান্ত হয়েছেন।
সেনাপতি টলেমি নির্দেশ দিলেন অ্যালেক্সান্ডারের যে বন্ধু ভোজসভার আয়োজন করেছিল তাকে ধরে আনার জন্য। সল্প সময়ের মধ্যে বন্ধুটি হাজির। অভিযোগ শুনে বন্ধু কাচু মাচু ভঙ্গিতে বললেন, “আমরা উপস্থিত সকলেই সেই খাবার খেয়েছি। যদি খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সেই বিষক্রিয়া আমাদের শরীরেও হওয়ার কথা”।
টলেমি জিজ্ঞেস করলেন, “ভাল করে ভেবে দেখুন তো? এমন কি কোন খাবারের উপাদান ছিল যা শুধুমাত্র মহাবীর অ্যালেকজান্ডার খেয়েছেন, অন্য কেউ খায়নি?”
বন্ধু কয়েকমুহূর্ত ভাবলেন, তারপর হঠাৎ তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, “হ্যাঁ আছে। ব্যাবিলনের স্থানীয় এক ঐতিহ্যবাহী পানীয়। অল্প বানানো হয়েছিল বলে শুধু মাত্র অ্যালেক্সান্ডার তা খেয়েছেন। অন্য কেউ খেতে পারেনি”।
“কে বানিয়েছে ঐ পানীয়?”
“আমার মহলের রান্না বান্নার দায়িত্ব পালন করেন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা, নাম তার সাইক্রোয়া। উনিই বানিয়েছেন”।
অবিলম্বে সাইক্রোয়াকে ধরে আনা হল। টলেমি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করার আগেই সাইক্রোয়া হাসতে হাসতে স্বীকারোক্তি দিল- “হ্যাঁ, আমিই বিষ প্রয়োগ করেছি রাজার খাদ্যে”।
“কিন্তু কেন?”
এই প্রশ্নের জবাবে সাইক্রোয়া আবার উন্মাদের মত হাসতে থাকল। হাসি থামতে বলল, “রাজার নির্দেশে সৈন্যরা আমাদের রক্ষিত সকল সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। দীর্ঘ দুইশ বছর যাবত আমরা আগলে রেখেছি যে মহামূল্যবান রত্ন ‘রক্তপাথর’, তাও লুটে নিয়েছে ওরা। আমার স্বামী আর সন্তান ঐ সম্পদ রক্ষা করার চেষ্টা করতে গিয়ে সৈন্যদের হাতে মরেছেন। আমি রাজাকে হত্যার মাধ্যমে স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিচ্ছি”।
টলেমি দ্রুত নির্দেশ দিলেন সাইক্রোয়াকে প্রকাশ্য দিবালোকে ক্রুশবিদ্ধ ঝুলিয়ে রাখার জন্য। নির্দেশ শুনে সাইক্রোয়া আবার উন্মাদের হাসি হাসতে থাকল। টলেমি বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “নিজের মৃত্যুর পরোয়ানা জারি হতে দেখে খুব আনন্দ পাচ্ছ নিশ্চয়ই? হাসছ কেন?”
“হাসছি তোমাদের বোকামি দেখে”।
টলেমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। তিনি বুঝতে পারছেন না বোকামিটা কোথায় হচ্ছে।
“ তোমাদের কি ধারণা আমাকে মেরে ফেলার পর তোমরা রাজাকে বাঁচাতে পারবে? রাজার শরীরে যে বিষ কাজ করছে তা বিশেষভাবে আমার বানানো। ঐ বিষক্রিয়া কাটাতে হলে আমার বানানো ওষুধ লাগবে। পৃথিবীর কোন চিকিৎসকের কোন ওষুধে কাজ হবে না”।
“তবে তুমি রাজাকে ঐ ওষুধ খাইয়ে সুস্থ করে দাও। আমরা তোমাকে মুক্ত করে দেব”।
“তোমার কি মনে হয় নিজের জানের পরোয়া আমার আছে। তাই যদি থাকত তবে বিষ প্রয়োগের পরই রাজ্য ছেড়ে পালাতাম। আমি অপেক্ষায় ছিলাম কখন তোমরা আমাকে ধরে আনবে আর আমি আমার চাওয়া উত্থাপন করতে পারব”।
“কি চাও তুমি?” জিজ্ঞেস করলেন টলেমি।
“চার টুকরো মহামূল্যবান রত্ন রক্তপাথর। আমার পরিবারের ঐতিহ্য। রাজার সৈন্যরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। ঐ রত্ন হাতে পেলে আমি রাজাকে বাঁচিয়ে তুলব”।
এই দাবি শোনার পর টলেমি আর দেরি করলেন না। তাৎক্ষনিক সবচেয়ে শক্তিশালী ঘোড়া দিয়ে কয়েকজন সৈন্যকে কান্দাহার পাঠানো হল ঐ মূল্যবান রত্ন ব্যাবিলনে ফিরিয়ে আনার জন্য। তবে অ্যালেক্সান্ডারে শরীরে বিষক্রিয়ার ব্যাপারটি টলেমি খুব বেশি মানুষকে জানতে দিলেন না। সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যেতে পারে ভেবে সম্পূর্ণ গোপন রাখলেন।
নবম দিন :
রাজার শরীরে খুব বেশি জ্বর। আরেকটা দিন কাটল এভাবেই। কান্দাহারের উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী সৈন্যরা তখনো পৌঁছেছে কিনা বলা যাচ্ছে না। এর মধ্যে টলেমি কয়েকবার সাইক্রোয়ার সাথে দেখা করে রাজাকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু সাইক্রোয়া নিজের অভিমতে অটল। রক্তপাথর হাতে না পেলে সে ওষুধ বলবে না।
দশম দিন:
পরদিনও জ্বর থামল না অ্যালেক্সান্ডারের। এখন আর বিছানা থেকে মাথা উঁচু করতে পারেন না তিনি। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। সবাই বুঝতে পারছে রাজা আর খুব বেশিক্ষণর টিকবেন না। সাধারণ সৈনিকরা মৃত্যুর আগে তাকে একবার দেখতে চাইল। কিন্তু সেনাপতিরা অ্যালেকজান্ডারের কষ্ট হবে ভেবে নিষেধ করলেন। দেখতে দেওয়া হল না বলে কিছু সৈন্য রটিয়ে দিল যে ইতিমধ্যে রাজা মারা গেছেন। তাদের ধারণা, রাজার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা তার মৃত্যুর ব্যাপারটা গোপন করছে।
সৈনিকদের অনেকেই দুঃখে-ক্ষোভে জোর করে তার কক্ষে ঢুকে পড়ল এবং আলেকজান্ডারকে দেখতে থাকল। অ্যালেকজান্ডার তখনো বেঁচে আছেন। নিজের অনুসারী, বিশ্বস্ত সৈন্যদের সবাইকে তিনি স্বাগত জানানোর চেষ্টা করলেন। কখনো মাথা নাড়লেন, কখনও চোখের ইশারা করলেন। হাসার চেষ্টা করলেন রাজা কিন্তু তা হল কান্নার নামান্তর।
এদিকে কান্দাহার যাত্রাকারী সৈন্যদের কোন খবর নেই। টলেমি শেষ বারের মত বন্দীশালায় গিয়ে সাইক্রোয়াকে অনুরোধ করলেন রাজাকে বাঁচানোর। সাইক্রোয়া কিছুতেই রাজি হল না। তার একটাই দাবি। সে আগে রক্ত পাথর হাতে পাবে, তারপর রাজাকে বাঁচানোর ওষুধ দেবে। টলেমি প্রচণ্ড ক্রোধে জল্লাদকে হুকুম দিলেন সাইক্রোয়ার মাথা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলার জন্য।
এদিকে পিথন, অ্যাটালাস, ডেমোফোন, পিউসেন্টাস, ক্লিওমেনসেস, মেনডিয়াস ও সেলিউকাস আগের রাত থেকেই প্রার্থনায় সময় কাটান সেবাপিস মন্দিরে। তারা ঈশ্বরের কাছে প্রশ্ন রাখলেন আলেক্সান্ডারকে তার রোগ নিরাময়ের প্রার্থনার জন্য মন্দিরে আনলে ভালো হবে কিনা। যাজকেরা বললেন, ঈশ্বরের জবাব হল- আলেক্সান্ডারকে মন্দিরে আনা ঠিক হবে না। বরং তিনি যেখানে আছেন, তাকে সেখানে রাখাই ভালো। কিন্তু সাথীরা এই কথা মানতে চাইলেন না। অ্যালেক্সান্ডারকে মন্দিরে নেওয়ার জন্য লোক খবর নিয়ে এলো কিন্তু তারা রাজাকে কক্ষ থেকে বের করার আগেই আলেক্সান্ডার মারা গেলেন।
বিশ্ববিজয়ী মহাবীর অ্যালেকজান্ডার দশ দিনের জ্বরে ভুগে মারা গেলেন। তার সেনাপতিরা বিষক্রিয়ার ব্যাপারটি গোপন রাখল। কারণ ব্যাপারটা জানাজানি হলে অনেকেই হয়ত ভাবতে পারে ক্ষমতার লভে সেনাপতিরা মিলে রাজার খাদ্যে বিষ দিয়ে তাকে মেরেছে। আবার এদিকে বিষক্রিয়ার ফলে সম্রাটের মৃত্যু জানা গেলে সেনাপতিদের গাফিলতিকে দায়ী করা হতে পারে।
অ্যালেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য খণ্ড খণ্ড করে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিলেন তার সেনাপতিরা। শীঘ্রই ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তার গড়া বিশাল সাম্রাজ্য।