২৭ এপ্রিল, ২০১৬;
পুলিশ হেডকোয়ার্টার, ঢাকা।
গুরুত্বপূর্ণ মিটিং বসেছে। রাউন্ড টেবিল ঘিরে বসে আছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান, পুলিশের মহাপরিচালক, র্যাবের মহাপরিচালক, কয়েকজন সরকারী গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও পুলিশ ও র্যাবের কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা।
পুলিশ মহাপরিচালক কথা বলছেন, “আপনারা জানেন অত্যন্ত জরুরী এক পরিস্থিতির উদ্ভবের কারণে আজকের এই মিটিং এ আমরা সমবেত হয়েছি। ঢাকার এক হোটেলে আয়োজিত দেশ-বিদেশের অ্যান্টিক জুয়েলারির আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বেশ কিছু প্রাচীন অলঙ্কার সামগ্রী আনা হয়েছিল। ব্রিটিশ জুয়েলারি ‘ব্লাডস্টোন’ ছিল এই প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ গুলোর মাঝে একটি। এই অমূল্য জুয়েলারিটি সবার চোখের সামনে থেকে চুরি হয়ে গেছে। আমি পুলিশ কমিশনার সাহেবকে অনুরোধ করছি সমগ্র চুরির ঘটনাটি আমাদের সামনে খুলে বোলার জন্য”।
“ধন্যবাদ স্যার”। দুবার খুক খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন ঢাকা সিটির পুলিশ কমিশনার।“ ব্লাডস্টোন বা ‘রক্তপাথর’ ব্রিটেনের রানীর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার অংশ। ধারনা করা হয় এই অলংকারটি মূলত আফগান সম্পদ। ব্রিটিশ শাসনামলের পূর্বে এই দামী অলংকারটি বাংলার কোন এক অঞ্চলের রাজার হস্তগত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে এটি ব্রিটিশদের হাতে পরে এবং নেকলেসটি ইংল্যান্ডে চলে যায়। বর্তমানে এর মালিকানা ইংল্যান্ডের রানীর। ঢাকার আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী থেকে লাল রঙের অমূল্য হীরের আর দুষ্প্রাপ্য নিখাদ সোনার তৈরি এই নেকলেসটি সবার চোখের সামনে থেকে আচমকা চুরি হয়ে যায়। ভারী কোন বস্তুর আঘাতে বুলেট প্রুফ কাঁচ ভেঙে নেকলেসটা নিয়ে চোর পালিয়ে গেছে। পঞ্চাশ-ষাট জন দর্শনার্থী, দশ-পনের জন গার্ড, পাঁচ-ছয় জন গাইডসহ প্রায় একশ জন সেখানে উপস্থিত ছিল। এত্তগুলো মানুষের কেউই বলতে পারছেনা তাদের চোখের সামনে ঠিক কি ঘটেছে! সবাই বলছে ঐ সময়টার কথা তাদের কিছুই মনে নেই, সাময়িক সময়ের স্মৃতি তাদের মস্তিষ্ক থেকে মুছে গেছে। এমন অদ্ভুত ঘটনার কথা কেউ কোনদিন শোনেনি। প্রাথমিক অবস্থায় মনে হয়ে ছিল উপস্থিত সবাইকে কোন বিশেষ ড্রাগ দেওয়া হয়েছে যার ফলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত যা ঘটেছে তার কিছুই তাদের মনে নেই। কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় তেমন কিছু ধরা পড়েনি। পুলিশ ও র্যাবের বেশ কয়েকটা টিম তদন্তের কাজ করছে। চুরির সময় আশেপাশে যারা ছিল তাদেরকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই জানা যায়নি”।
পুলিশ কমিশনার বসে পড়লেন। এতক্ষণে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মুখ খুললেন। “ব্রিটেন থেকে আমাদের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে হারিয়ে যাওয়া এই জুয়েলারি”।
“কিন্তু স্যার, এটাতো একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার আয়োজিত প্রদর্শনী। বাংলাদেশ সরকারের এখানে কোন ভূমিকা ছিল না। তাহলে আমাদের উপরে কেন চাপ সৃষ্টি করবে তারা ?” একজন সিনিয়র কর্মকর্তা প্রশ্ন করল।
“আপনি সবল হলে দুর্বলকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নিতে পারবেন। আমাদের হাত পা বাঁধা, প্রতিবাদের উপায় নেই”। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিদ্রুপের ভঙ্গিতে হাসলেন। “তাছাড়া আমরা উদ্ধারের কাজে সফল না হলে ব্রিটেন সমস্ত তদন্ত নিজের হাতে তুলে নেবে। তারা ক্রমাগত নিজেদের লোক পাঠাতে থাকবে। আমরা নিশ্চয়ই আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করতে পারিনা”!
পুলিশ মহাপরিচালক বললেন, “তদন্তের এ পর্যন্ত অগ্রগতি নিয়ে কেউ একজন রিপোর্ট করুন”।
র্যাবের সিনিয়র কর্মকর্তা মাহফুজ খন্দকার উঠে দাঁড়ালেন। “স্যার, চুরির সাথে জড়িত সন্দেহে দুইজন গার্ড, একজন গাইড ও কয়েকজন দর্শনার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের জিজ্ঞাসা বাদ করে তেমন কিছুই জানা যায়নি। সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে একজন মুখোশধারী লোক এসে হাতুড়ী দিয়ে কাঁচ ভেঙে নেকলেস নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আটককৃত কেউ তাকে সাহায্য করেছে বলে মনে হচ্ছেনা। আমরা তাদের ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু বলে দেয়া হয়েছে যেন কেউ পরবর্তী নির্দেশনা দেয়া পর্যন্ত সবাই ঢাকার ভেতরে অবস্থান করে। আমরা ছোট ছোট টিমে ভাগ হয়ে গিয়ে তদন্ত করছি এবং সবসময় টিমগুলো নিজেদেও মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য আদান প্রদান করে চলেছে”।
পুলিশ মহাপরিচালক বললেন, “আপনাদের কারো কোন সাজেশন আছে কীভাবে আমরা আরও প্রপার ওয়েতে তদন্তের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি? কারণ এখন পর্যন্ত তদন্ত যেভাবে আগাচ্ছে তাতে করে আমরা কোন কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিনা।”
ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের সিনিয়র এজেন্ট মনসুর হালিম হাত তুলল।
পুলিশের মহাপরিচালক মনসুর হালিমকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। ভাল ডিটেকটিভ হিসেবে অল্প বয়সে সুনাম কুড়িয়েছে ছেলেটি। হাসি মুখে বলল, “মনসুর”।
“স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক ড. রুদ্র রাশেদ আমাদের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের সাথে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। ভদ্রলোক কানাডা থেকে হিস্টোরিকাল মিস্ট্রির উপরে পিএইচডি করেছেন এবং ঐতিহাসিক ঘটনা পঞ্জির উপর তার অগাধ জ্ঞান। তাছাড়া সে আমার ইমিডিয়েট বস এসপি ফিরোজ শিকদার এর কলেজ ফ্রেন্ড। যেহেতু ব্লাডস্টোন এর সাথে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি জড়িত আছে। তাই আমরা কি তাকে ‘ ব্লাডস্টোন’ চুরির কেসে আমাদের সাথে কাজ করতে আমন্ত্রন জানিয়েছিলাম। উনি ইতিমধ্যেই ব্লাডস্টোনের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ঘাটন করেছেন। এই মুহূর্তে ভদ্রলোক এই কামরার বাইরে অবস্থান করছেন। উনি ব্লাডস্টোনের ইতিহাস নিয়ে দুই চারটা কথাবার্তা আপনাদের সামনে বলতে চান। আপনারা অনুমতি দিলে তাকে আমি ভেতরে আমন্ত্রন জানাতে পারি।”
“অবশ্যই! অবশ্যই! আমাদের সর্বস্ব নিয়োগ করতে হবে এই কেস সমাধানের জন্য..ডাকুন তাকে। সবগুলো সম্ভাবনা আমরা খতিয়ে দেখতে চাই।”বললেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
রুদ্র রাশেদকে ডাকা হল।
রাশেদ ভেতরে ঢোকার পর একবার সবার উপরে চোখ বুলাল। গলা খাঁকারি দিয়ে একটু পরিষ্কার করে নিল। তারপর বলল-
“আমরা কেউ একটা বিষয় জানিনা। তা হচ্ছে- ব্লাডস্টোনের প্রকৃত মালিকানা বাংলাদেশের প্রাপ্য। ব্রিটেন এটা জোর করে দখল করে রেখেছে”।
কক্ষের ভেতর যেন বোমা ফাটিয়েছে রুদ্র রাশেদ। সবাই হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পিন-পতন নিরবতা।
রাশেদ বলতে শুরু করল আবার-
ব্লাডস্টোনের সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, ব্যাবিলনে। বর্তমানে যা আমাদের কাছে বাগদাদ নামে পরিচিত। পারস্যের সম্রাট সাইরাস ব্যাবিলন দখল করে নেয়ার পর তার সৈন্যরা সমস্ত শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তখন ব্লাডস্টোন নামের পাথরটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। ব্যাবিলনের স্থানীয় লোকেরা ব্লাডস্টোনের কয়েক টুকরো নিজেদের মাঝে সংরক্ষণ করে রেখেছিল। এর প্রায় দুইশ বছর পর সম্রাট অ্যালেকজান্ডার তার মৃত্যুর আগে ভারত আক্রমনের পরিকল্পনা সরূপ আফগানিস্থানের কান্দাহার শহরের শাসককে খুশি রাখার জন্য ব্যাবিলন থেকে প্রচুর উপঢৌকন পাঠান। তার সাথে ব্লাডস্টোনও ছিল। এর পর প্রায় দুই হাজার বছর ধরে বংশ পরম্পরায় ব্লাডস্টোন আফগান রাজ বংশের লোকদের কাছে গচ্ছিত ছিল। পনেরশ শতকে হুমায়ূন বাদশা দিল্লীর সিংহাসন থেকে বিতাড়িত হন শের খানের দ্বারা। পরাজিত হুমায়ূন পারস্যের সাহায্যে কান্দাহার- কাবুল দখল করে নেয়। আরও শক্তি সঞ্চয় করে এক সময় এসে দিল্লীও পুর্নদখল করেন। সেই সময় কান্দাহার থেকে প্রচুর দাস দাসী আনেন তিনি দিল্লীতে কাজ করার জন্য। তাদের সাথে মাহতাব খান নামের এক বালক চলে আসে দিল্লীতে, যার মায়ের কাছে ব্লাডস্টোন গচ্ছিত ছিল। খুব সম্ভবত তার পিতা ব্লাডস্টোন পাথরগুলো লকেট আকারে ব্যবহার করে গলার হার নির্মাণ করেন। মাহতাব এক সময় ওই হার সাথে নিয়ে দিল্লী থেকে পালিয়ে বাংলায় চলে আসেন, আশ্রয় নেন চন্ডিক্যান রাজ্যে। চন্ডিক্যান মানে যশোর রাজ্যের রাজা প্রতাপাদিত্য মাহতাবের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে সেনাপতি পদে নিয়োগ দেন। সেনাপতি মাহতাব খানের সাথে রাজার কন্যা অরুণাবতীর প্রেম হয়। তারা পালিয়ে গিয়ে সুন্দরবনে আশ্রয় নেয়। এই সময় মাহতাব ঐ অমূল্য গলার হার ব্লাডস্টোন বা রক্তপাথর অরুণাবতীকে উপহার দেন। পরবর্তীতে নানা হাত ঘুরলেও বংশ পরম্পরায় ব্লাডস্টোন বাংলাদেশেই ছিল। দুইশ বছর ব্রিটিশরা ভারত বর্ষ শাসন কালে এখান থেকে অনেক সম্পদ সরিয়ে নিয়েছে। তার মধ্যে লর্ড মিন্টোর সময় তারা ঐ ব্লাডস্টোন আত্মসাৎ করে নিয়ে যায় ব্রিটেনে। তাই এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়- ব্লাডস্টোনের মালিকানা বাংলাদেশের প্রাপ্য। কোন বাংলাদেশি নাগরিক যদি সেটা চুরি করে থাকে তাহলে এটা চুরি হয়নি, এটা ছিল নিজ সম্পদ নিজের কাছে রাখার প্রচেষ্টা”।
কিছুক্ষণ নিরবতা। একটু পর প্রতিরক্ষামন্ত্রী মুখ খুললেন, “আপনি যা বললেন তার সবই কি পরীক্ষিত সত্য?”
“পরীক্ষিত সত্য নয়। গবেষণালব্ধ”। বলল রাশেদ।
“কিন্তু গবেষণালব্ধ কিছু থিওরি কি বিশ্ববাসী বিশ্বাস করবে?” এবার প্রশ্ন করলেন পুলিশ মহাপরিচালক।
রাশেদ জবাব দিল- “স্যার, গবেষণাটা সত্য ঘটনাবলীর উপর বিশ্লেষণ পূর্বক করা হয়েছে স্যার। আমি আমার গবেষণার সমস্ত পেপার যদি সাবমিট করি তাহলে পৃথিবীর যেকোনো গবেষক এক বাক্যে মেনে নেবেন যে আমার কথাই সত্য। আমি এটা প্রমাণ করে দিতে পারব”।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “তাহলে আমি আজই একটি আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বাংলাদেশ থেকে ব্লাডস্টোনের মালিকানা দাবী করব। ব্রিটেন জাতিসংঘের কাছে বলছে বাঙ্গালী চোরের জাতি। চুরি করাই আমাদের স্বভাব। প্রমাণের ওভাবে আমরা চুপ করে আছি। তাদের এইসব অপপ্রচারে বাইরের দুনিয়ায় আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে চাই যে বাঙ্গালী চোর নয়, বাঙ্গালী বীরের জাতি। তারা নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে জানে। আমাদের কাছে গচ্ছিত আমানত আমরা কোন অবস্থাতেই হরণ হতে দিব না”।
রুদ্র রাশেদের মুখে হাসি দেখা দিল। এই না হলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। এই মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনে যাই হন না কেন- দেশকে ভালবাসেন গভীর ভাবে। মুখে হাসি নিয়ে বলল,“অবশ্যই স্যার। আমি এই ব্যাপারে সব রকমের সাহায্য করব আপনাকে স্যার”।
“কিন্তু আমার একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার আছে স্যার”। বললেন পুলিশ চীফ। “জিনিসটার মালিকানা আমাদের হোক, কিন্তু চুরি যেহেতু করেছে চোরকে তো আমাদের পাকড়াও করতেই হবে। আমরা নিশ্চয়ই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না”।
“অবশ্যই, চোরকে ধরার ব্যাপারে যা কিছু করা লাগে, সব করুন আপনারা। আমার পূর্ণ অনুমতি দেয়া থাকল। আর এদিকে ব্লাডস্টোনের মালিকানা আদায়ের জন্য যা করা লাগে তা আমি করব”।
আশার আলো দেখতে পাচ্ছে রাশেদ। ব্লাডস্টোনের অচেনা চোরের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করছে সে। একটা বিষয় সত্যি- এই সমস্ত সব কিছু জানা সম্ভব হয়েছে চোরের একটা চিরকুটের কারণে। যাতে লেখা ছিল কেবল একটি লাইন- অ্যামিতিস, তোমাকে ভালবাসি।