২৯ এপ্রিল, ২০১৬;
বাংলাদেশ পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের অফিস, ঢাকা।
বারবার ঘুরেফিরে সবগুলো সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ দেখেছে ড. রুদ্র রাশেদ আর ইন্সপেক্টর মনসুর হালিম। চোর সুচতুর,আগে থেকেই সে চুরির পরিকল্পনা করেছিল। সম্ভবত সিসি ক্যামেরাগুলোর অবস্থান জানাই ছিল। একটাতে ও তার চেহারা স্পষ্টভাবে দেখা যায়নি।
ভিডিও দেখছে আর এরই ফাঁকে আনমনে কাগজে আকিঝুকি করছে রাশেদ। কিছু একটা হিসেব মিলানোর প্রচেষ্টা। ব্লাডস্টোনের ইতিহাস উন্মোচনের পর এখন মনসুর হালিমের উৎসাহে রুদ্র চেষ্টা করছে পুলিশকে সরাসরি চোর ধরার কাজে সহযোগিতা করার জন্য।
মনসুর বলল, “সকাল থেকে প্রদর্শনী শুরু হয়েছিল। সারাক্ষণই মানুষজন ঢুকেছে, বেরিয়ে গেছে। এত্ত মানুষের ভিড়ে নির্দিষ্ট একজনকে খুঁজে বের করা কি সম্ভব?”
“কেন? হোটেল কর্তৃপক্ষের দেয়া দর্শনার্থীদের তালিকা থেকে কার পরিচয় ভুয়া- সেটা বের করার কথা বলেছিলাম না আমি? সেখান থেকে কোন উপকার হয়নি?”রাশেদ প্রশ্ন করল।
মাথা ঝাঁকাল মনসুর। “প্রায় আড়াইশ টিকিট বিক্রি হয়েছিল। হোটেল কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছিল তাদের রেজিস্টার বুকে লিখে রাখা সকল দর্শনার্থীর নাম ঠিকানা দেওয়ার জন্য। সেই তালিকা থেকে প্রায় সকলকে আইডেন্টিফাই করা গেছে, দুই তিনজন বাদে। র্যাব এদের মধ্যে থেকে বুলবুল আহমেদ নামে একজন ব্যক্তিকে চোর বলে সন্দেহ করছে। লোকটি টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশের সময় রেজিস্টার বুকে ঠিকানা ভুল লিখেছে, ফোন নম্বর যেটা দিয়েছে সেটা একটা পরিত্যক্ত নাম্বার। সম্ভবত নামটাও ভুয়া”।
“প্রবেশ পথে চেকপোস্টে যারা ছিল তারা কি ঐ লোকের দর্শনার্থীদের ব্যাগ চেক করেনি? একটা হাতুড়ী ব্যাগে নিয়ে কেউ একজন ঢুকে পড়ল আর তা কারো চোখে পড়লনা?”
“ব্যাপারটা আমার কাছেও অবাক লেগেছে”। বলল মনসুর। “হয়ত তারা দায়িত্বে ঢিলেমি করেছে, হয়ত চোরবাবাজী খুব কায়দা করেও তা নিয়ে ঢুকেছে যেন টেরনা পাওয়া যায়, এমনকি এটাও হতে পারে যে হোটেল কর্তৃপক্ষের কেউ লোকটাকে সহায়তা করেছে চুরির কাজে”।
“আমার তা মনে হয় না”। না বোধক মাথা নাড়ল রাশেদ।
“লোকটা একা কাজ করতে ভালবাসে”। রাশেদের কণ্ঠে প্রশংসার সুর। “নিজের কাজের কোন সাক্ষী রাখা তার পছন্দ না। আমার মনে হয় আগে থেকেই ভেতরে কোথাও একটা হাতুড়ি লুকিয়ে রেখে এসেছিল সে। দ্বিতীয়বার ঢুকে সেটা বের করেছে। যে লোকের কাছে এমন কোন ম্যাজিক আছে যা দ্বারা সমস্ত মানুষকে স্মৃতি ভ্রষ্ট করে দেয়া সম্ভব সে কারো সাহায্য নেবেনা”।
“ঠিক বলেছেন স্যার”। মনসুরের কণ্ঠে হতাশা। “সব প্রশ্নের উত্তর ঐ এক জায়গাতেই এসে থেমে যাচ্ছে! কীভাবে এতগুলো মানুষকে ঘোরের মধ্যে ফেলে লোকটা চুরি করে পালিয়ে গেল? এটা ম্যাজিক নয়ত আরকি?”!
“আসুন সিসি ক্যামেরার ফুটেজগুলো দুজনে আর একবার দেখি”। বলল রাশেদ। “আমার কেন যেন মনে হচ্ছে বার বার কিছু একটা চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে”!
“হুম, চলেন দেখি”। সায় জানাল ইকবাল।“এ ছাড়াতো আর কোন পথ দেখছিনা”!
বড় মনিটরে একসাথে অনেকগুলো ছোট ছোট উইন্ডোতে সব গুলো সিসি ক্যামেরার ফুটেজ একই টাইমে দেখানো হচ্ছে। আবার নতুন করে প্রথম থেকে ফুটেজগুলো দেখা শুরু করল।
রাশেদ বলল, “চুরি হয়েছে দুপুর তিনটা পনের মিনিটে। আমরা এখন যে ফুটেজটা দেখছি এটা তিনটা দশ মিনিটের সময় ধারণ করা হয়েছে। এখানে দেখেন ব্লাডস্টোনের ঠিক পেছনের সিসি ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে মিসেস মিলি আর তার ভাবি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, দুজনেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে অলংকারটি দেখছে। দেখা যাক- এরপর কি হয়!”
ভিডিও ফুটেজে নিচের দিকে সময় দেখাচ্ছে ঠিক তিনটা বারো বাজে। হঠাৎ করেই হল ঘরের একপ্রান্তের দিকে তাকিয়ে ঘুরে গেল দুজনে। রাশেদ ভিডিওটা পজ করল। বলল, “ঠিক তিনটা বারো মিনিটে এমন কিছু ঘটেছে যাতে সমস্ত দর্শকের মনোযোগ হলঘরের দক্ষিণ প্রান্তের দিকে চলে গেছে। বাকি সিসি ক্যামেরাগুলোর ফুটেজ দেখেন! সবাই ঐ একই দিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, পুরো হলঘরে যতগুলো ক্যামেরা আছে তার একটাও ঐ প্রান্ত কভার করেনি। লোকটা এই ব্যাপারে আগে থেকেই জানত। সম্ভবত আগে একবার এসে ঘুরে গেছে সে। কিন্তু প্রশ্ন হল ঠিক তিনটা বারো মিনিটে সে কি এমন করেছে ,যার ফলে সমস্ত মনোযোগ তারদিকে ঘুরে গেছে?”
“হতে পারে সে হঠাৎ খুব জোরে চিৎকার করে উঠেছে সবার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য”।
“হতে পারে”। মাথা ঝাঁকাল রাশেদ। “এরপর কি হয় দেখেন”!
পজ করা ভিডিওটা আবার প্লে করল রাশেদ। এইবার দেখা যাচ্ছে দর্শনার্থীরা সবাই একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই, তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে। নড়তে চড়তেও ভুলে গেছে যেন! ভিডিও ফুটেজের নিচে সময় দেখাচ্ছে তিনটা চৌদ্দ মিনিট। রাশেদ আবার পজ করল।
“কি মনে হয়? কি হচ্ছিল ঐ প্রান্তে?” রাশেদ প্রশ্ন করল।
মনসুর হালিম একমুহূর্ত চিন্তা করল। তারপর বলল, “লোকটা কি পিস্তল বের করে একজনের মাথায় ধরে সবাইকে চুপ হয়ে যেতে বলেছে বলে মনে হয়?”
“ মোটেও তা না”। আপত্তি জানাল রাশেদ। “তেমন কিছু ঘটলে উপস্থিত সবার মাঝে চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু হয়ে যেত। কেউ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতনা”!
আরও কিছুক্ষণ চিন্তা করল ইকবাল। বলল, “হতে পারে যে লোকটা বক্তৃতায় পটু। চমৎকার ভাষায় কথা বলে সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়েছে”!
“হতে পারে, কিন্তু কোথাও একটা গড়মিল মনে হচ্ছে আমার। বাকিটা দেখি আসুন”।
ভিডিও ফুটেজ প্লে করা হল আবার। তিনটা পনের মিনিটের সময় দেখা গেল ব্লাডস্টোনের সামনে এসে দাঁড়াল একজন স্যুট-টাই পরা লোক, মুখটা মুখোশে ঢাকা। সম্ভবত মুখোশটা সাথে নিয়ে ঢুকে ছিল সে। সবাইকে সম্মোহিত করার পর মুখোশ পরে এগিয়ে এসেছে যেন সিসি ক্যামেরায় দেখে চেনা না যায়। হাতে মাঝারি আকৃতির একটা হাতুড়ি। মিসেস মিলি আর তার ভাবি চোখে মুখে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে! নড়াচড়ার শক্তি ও যেন হারিয়ে ফেলেছে। লোকটা হাতুড়ি হাতে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে বেশ কয়েকবার আঘাত করে ভেঙে ফেলল বুলেট প্রুফ কাঁচ। তারপর ভাঙ্গা অংশ দিয়ে হাত গলিয়ে ব্লাডস্টোন হাতে নিল। সময় নষ্ট না কওে পালানোর পথ ধরল। রুদ ্ররাশেদ দ্রুত অন্য সিসি ক্যামেরাগুলোর ফুটেজে চোখ বুলাল। লোকটা লোকজন ঠেলে জায়গা করে এক্সিট পথের দিকে এগোচ্ছে। কেউ তাকে বাঁধা দিচ্ছেনা। সবাই যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। এক্সিট পথের সামনে দাঁড়িয়ে মুখোশ ফেলল সে, তারপর ভালমানুষের মত বেরিয়ে গেল প্রদর্শনী ছেড়ে। দুর্ভাগ্য যে এক্সিট ব্লকের সামনে কোন সিসি ক্যামেরা নেই। থাকলে একনজর হয়ত চেহারাটা দেখা যেত।
মনসুর ভিডিওটা পজ করল। পরের অংশটুকু আর গুরুত্বপূর্ণ না। এরপরও মিনিট পাঁচেক দর্শনার্থীরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে আছে। তারপর আস্তে আস্তে সবার চেতনা ফিরে আসতে থাকল।
রাশেদ গভীর ভাবে চিন্তা করছিল। খুব আস্তে করে বলল, “ফুটেজগুলো পেছনে টানুন তো! কি যেন একটা চোখে পড়ে ছিল বলে মনে হচ্ছে”!
মনসুর ভিডিও ফুটেজটা টেনে নিয়ে গেল তিনটা পনের মিনিটে। রাশেদ বলল, “থামেন থামেন, এখানেই”।
ঠিক তিনটা ষোল মিনিটের সময় একটা ক্যামেরা দেখে হঠাৎ পরিস্থিতি ভুলে স্বভাব সুলভ শীষ দিয়ে উঠল রুদ্র রাশেদ।
“কি হল?”
“ভিডিওটা পজ দিন”। রাশেদ বলল।
“দিলাম”।
“মিলি সুলতানার পেছনের দিকে খেয়াল করুন”!
“কি?” মনসুর বুঝতে পারছেনা কি খেয়াল করতে হবে।
“দেখছেন কি? মিসেস মিলির ঠিক পেছনেই আরেক জন দর্শনার্থীকে দেখা যাচ্ছে”।
“হুম দেখছি”!
“লোকটা কি করছে বলুন তো?” রাশেদের গলায় রহস্যের সুর।
আরও কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল মনসুর। তারপর বলল, “কানে মোবাইল ফোন ধরে রেখেছে। সম্ভবত কথা বলছিল। কিন্তু এখন আর কিছু বলছেনা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে হল ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে”।
“তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে?”
“কি দাঁড়াচ্ছে?” মনসুর হালিমকে অসহায় দেখাল। এখনও বিষয়টা ধরতে পারছে না সে।
রাশেদ কিছু বলছে না। চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করছে আর নিরবে হাসছে।
“ওহ মাই গড! লোকটা ঐ মুহূর্তে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল”। হঠাৎ করেই ব্যাপারটা মাথায় ঢুকেছে মনসুর হালিমের। উত্তেজিত হয়ে গেল। “তার মানে চোর যা বলে সবার মনোযোগ আকর্ষিত করেছে, তা ঐ মুহূর্তে হলঘরের ভেতরে যারা ছিল তারাবাদে আরও একজন শুনতে পেয়েছে। সে হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যার সাথে মিসেস মিলির পেছনের লোকটা ফোনে কথা বলছিল! তাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে আসলে সবাই কি শুনতে পেয়েছে!”
“তাকে জিজ্ঞেস করা লাগবেনা। আরও ভাল উপায় আছে”। রাশেদ হাসল।
“আরও ভাল উপায়? সেটা কি?”
“আগে জানা প্রয়োজন ঐ ব্যক্তি কোন অপারেটরের সিম কার্ড ব্যবহার করে। তারপর পুলিশ কমিশনার এর অনুমতি নিয়ে সেই অপারেটর কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করতে আপনাকে। আমাদের দেশের মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। আমাদের সমস্ত কথাবার্তা খুব স্পষ্ট রেকর্ড হয় বলে শুনেছি। খুব সম্ভবত আমরা একটা অডিও ক্লিপ পেতে যাচ্ছি”!
“ওহ স্যার! ইউ আর রিয়েলি জিনিয়াস”! হাসিতে মনসুর হালিমের মুখের সব কয়টা দাঁত যেন বেরিয়ে পড়ল। “ইউ আর দা গ্রেট প্রফেসর ডাবল আর”।
মনসুরের কথার বলার ভঙ্গি দেখে রাশেদও না হেসে পারল না।