১ এপ্রিল, ২০১৬;
আড়াইহাজার উপজেলা, নারায়ণগঞ্জ।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে একটা প্রাইভেট কার। ড্রাইভ করছে অঞ্জন পাল, পাশে বসে আছে কবির। স্পিড মিটারে কাটা দেখা যাচ্ছে একশত পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। কবিরের হাতে একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স। এর ভেতরেই রাখা আছে অমূল্য সেই অলংকার- রক্তপাথর।
“আমরা কোথায় যাচ্ছি অঞ্জনদা?” প্রশ্ন করল কবির। “এখনও কি বলবে না?”
“সিলেটে”। অঞ্জনের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
“কোথায় লুকাবে এই ব্লাডস্টোন?”
অঞ্জন বলল, “আমার ঠাকুরমা মৃন্ময়ী দেবীর কবরের মাটিতে পুঁতে রাখব, ওনাকে আমি সেই কথাই দিয়েছিলাম”।
কবির ভয় ভয় কণ্ঠে বলল, “তোমার কি মনে হয়? এতক্ষণে পুলিশ টের পেয়ে যায়নি যে আমরা পালাচ্ছি?”
খুব সম্ভবত পেয়েছে। হাতঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল অঞ্জন। ড. রাশেদ তো বলেছিলেন ঘন্টাখানেক পরে পুলিশকে জানাবেন। সুতরাং এর আগে পুলিশ কোন রিএকশনে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। আমি বেরিয়েছি দুই ঘণ্টা হল, এতক্ষণে নিশ্চয়ই টের পেয়ে গেছে।
“তাহলে নিশ্চয়ই চারিদিকে ইতিমধ্যে সতর্ক পাহাড়া বসানো হয়ে গেছে”।
অঞ্জন হাসল, “ তোমার কি ভয় পাচ্ছে কবির? ভয় পেলে নেমে যাও ভাই। কেন খামাখা নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাকে সাহায্য করছ? তোমার স্ত্রী-সংসার আছে। এত বড় ঝুঁকি নেয়াটা তোমার অনুচিত”।
“না না, ভয় পাব কেন?” কবির আপত্তি জানাল। “তাছাড়া ব্লাডস্টোনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমারও দায়িত্ব। আমি মোটেও ভয় পাচ্ছিনা দাদা”।
আর কোন কথা নেই। ফুল স্পিডে গাড়ি চলছে। সামনের রাস্তায় মনোযোগ অঞ্জনের। ব্লাডস্টোনের বাক্সতে পরম যত্নে হাত বুলাচ্ছে কবির।
আরও মিনিট বিশেক কেটে গেল। কেউ কোন কথা বলেনি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কবিরের ঘুম ঘুম লাগছিল। হঠাৎ সামনের দিকে কিছু একটা দেখে আঁতকে উঠল সে। “দাদা! মনে হচ্ছে সামনে ব্যারিকেড! চেকপোস্ট বসিয়েছে পুলিশ, সব গাড়িতে চেক করা হচ্ছে। এই রাস্তায় চেক পোষ্ট থাকার তো কথা নয়। ওরা কীভাবে জেনে গেল আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“আমি জানিনা”। গাড়ির গতি কমিয়ে আনল অঞ্জন।
“আর এগোনো যাবেনা। গাড়ি ঘুরাও”। কবিরের কণ্ঠে তাগাদা।
“ফিরে যাওয়ার কোন পথ নেই কবির”। অঞ্জন শান্ত থাকার চেষ্টা করছে। “তুমি খেয়াল করনি। পেছনেও দুটো পুলিশের গাড়ি ধাওয়া করে আসছিল। কিন্তু আমার গতির সাথে পারেনি। ওরা বড় জোর দুই মিনিট পিছিয়ে আছে। এখন আমরা থেমে থাকলেও আমাদের ধরে ফেলবে”।
“কি করব এখন আমরা?” কবিরের কণ্ঠে আতংক।
“শক্ত হয়ে বসে থাক আর মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাক”। গাড়ির গতি বাড়াচ্ছে অঞ্জন। চোখে মুখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ভাব, “প্লাস্টিকের ব্যারিকেড, আশা করছি ভেঙে বের হয়ে যেতে পারব”।
কবির আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে। শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে ব্লাডস্টোনের বাক্সটি। গাড়ির গতি বাড়ছে। পুলিশ হাত নেড়ে থামতে বলছে। একদম কাছে চলে এসেছে ব্যারিকেড... গাড়ির স্টিলের দেহের সাথে প্লাস্টিকের ব্যারিকেডের বাড়ি খাওয়ার প্রচণ্ড শব্দ হল যা হয়ত এক মাইল দূর থেকেও শোনা যাবে। কবির চোখ বন্ধ করেছিল। শব্দের পর চোখ খুলে দেখল ওদের গাড়িটা ব্যারিকেড ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। মুখে উল্লাসের হাসি ফুটল, “ইয়াহুউউউ”!
অঞ্জনের মুখেও স্বস্তির হাসি।
হঠাৎ গাড়ির পেছনে খট খট আওয়াজ পাওয়া গেল।
“মাইগড! ওরা গুলি করছে”। এবার অঞ্জনের কণ্ঠেও আতংকের ঢেউ উঠল, “মাথা নামাও কবির”।
“এসব কি হচ্ছে অঞ্জনদা?” মাথা নিচু করে রাখল কবির, “পুলিশকে গুলি করার অনুমতি দিল কে?”
“ওদের ওপর হয়ত নির্দেশ আছে যেকোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে আমাদের”। অঞ্জন গুলি এড়াতে দ্রুত গাড়িটা একবার ডান দিকে একবার বা দিকে ঘুরাচ্ছে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ একটা গুলি গাড়ির পেছনের কাঁচ ভেদ করে এসে অঞ্জনের কাঁধে বিঁধল। প্রচণ্ড ব্যথায় চোখে অন্ধকার দেখল অঞ্জন। বন বন করে ঘোরাচ্ছে স্টিয়ারিং, গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে সে। রাস্তার পাশে একটা গাছের গায়ে গিয়ে আঘাত করল গাড়িটা, আবারো প্রচণ্ড শব্দ। গাড়ি থেমে গেছে।
অঞ্জনের কপাল গাড়ির স্টিয়ারিং এর সাথে ভীষণ ভাবে ঠুকে গেছে। ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। কাঁধের কাছে যেখানে গুলি বিঁধেছে সেখান থেকে রক্ত বেরিয়ে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত বুক। কবিরের খুব একটা ক্ষতি হয়নি। সামনের কাঁচ ভেঙে এসে হাত আর মুখের কয়েক জায়গায় আঁচর লেগেছে শুধু। সে অঞ্জনের দিকে ফিরে ডাক দিল, “অঞ্জন দা”।
প্রচণ্ড আঘাতেও অঞ্জন জ্ঞান হারায়নি। আস্তে করে মাথা উঁচু করে বলল, “তুমি... তুমি ব্লাডস্টোন নিয়ে পালাও কবির। ও... ওরা চলে আসার আগেই পালাও”।
“তোমাকে এখানে ফেলে আমি পালাব না দাদা”। আপত্তি জানাল কবির। “এখানে ফেলে গেলে তুমি বাঁচবে না দাদা! এক্ষুনি তোমাকে হাসপাতালে নিতে হবে”।
“দুজনে পালাতে গেলে... ধরা খেয়ে যাব কবির। আমার বাঁচার চেয়ে রক্তপাথর রক্ষা করাটা বেশি জরুরী”। এক মুহূর্ত থেমে থাকল অঞ্জন, কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। “তু... তুমি পালাও, আমি ওদের ঠেকাচ্ছি”।
“কীভাবে ঠেকাবে তুমি পুলিশকে?” কবিরের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামছে। বড়ভাইয়ের মত আপন মানুষটাকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ফেলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না।
প্রচণ্ড ব্যথার অনুভূতি ছাপিয়ে অঞ্জনের ঠোঁটে হাসি দেখা গেল। বলল, “আ... আমার ব্যাগের ভেতর থেকে বেহালাটা বের করে দিয়ে যাও... শেষ একটা বারের মত পাগানিনির... পাগানিনির ২৪ নম্বর ক্যাপ্রাইসটা বাজাব... শেষ একবার বেহালায় অপার্থিব সুর তুলে... নিজেও চলে যাব... চলে যাব সেই অপার্থিব জগতে...”
১৫৯২ খ্রিষ্টাব্দ;
কপোতাক্ষ নদীর মোহনা, যশোর।
তীরের দেখা মিলেছে। মুখে হাসি ফুটল অরুণাবতীর। কতদিন পর পিতার বাড়িতে বেড়াতে আসছে সে! পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার স্বামী ফটিক সওদাগর। সওদাগরের মুখেও হাসি। তার চোখ মুখ দেখলেই বলে দেওয়া যায় খুব সুখী একজন মানুষ তিনি। হবে না কেন? অরুণাবতীর মত একজন স্ত্রী যার রয়েছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের একজন হবেই।
ফটিক সওদাগর বলল, “অরুণা, তোমার পিতার মহল আর খুব বেশি দূরে নয়”।
অরুণাও ফটিক সওদাগরের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল। সওদাগর সে হাসি দেখে মুগ্ধ। কিন্তু ব্যবসায়ীর চোখ টের পেলনা যে সেই হাসিতে প্রাণের ছোঁয়া নেই। দীর্ঘ বারো বছর যাবত একজন সুখী মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছে অরুণাবতী। কেউ জানেনা একজন পতিভক্ত স্ত্রী আর স্নেহভাজন মায়ের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে কাঁদছে একজন প্রিয় মানুষ হারানো প্রেমিকা। সেদিন সুন্দরবনে রাজার সৈন্যদের দ্বারা অপহৃত হওয়ার পর থেকে মাহতাবকে কখনও এক মুহূর্তের জন্য ভুলে থাকতে পারেনি অরুণাবতী।
“মা মা, দেখ। ঐ যে একটা নৌকা”। আঙুল দিয়ে দূরে একটা অগ্রসরমান নৌকা দেখাল অরুণাবতীর বড় ছেলে অর্জুন।
ফটিক সওদাগর দেখল নৌকাটা এদিকেই এগিয়ে আসছে। আরও কাছে চলে আসার পর সে হঠাৎ ব্যাপারটা টের পেল। নৌকায় কঙ্কালের খুলি আঁকা কালো পতাকা উড়ছে। ফটিক চিৎকার করে বলল, “বিপদ... বিপদ আসছে! অরুণা, তাড়াতাড়ি অর্জুনকে নিয়ে নৌকার ভেতরে ঢুকে যাও। ওটা একটা জলদস্যুদের নৌকা!”
অরুণা ভয় পেয়ে ছেলেকে নিয়ে দ্রুত নৌকার ভেতরে ঢুকে পড়ল। ছোট ছেলেটা নৌকার ভেতর শুয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছে অরুণা। সওদাগর মাঝিদের নির্দেশ দিল, “দ্রুত বৈঠা চালাও। ওরা যেন কাছে আসতে না পারে”!
কিন্তু দস্যু দলের নৌকার গতিবেগ অনেক বেশি। তারা খুব দ্রুত একেবারে কাছে চলে আসল। সওদাগর তাদের উদ্দেশ্য করে বলল, “কি চাও তোমরা?”
দস্যুরা সবাই মুখে কাপড় বেঁধে আছে। সামনের দিকের একজন দস্যু দাঁড়িয়ে গেল। সম্ভবত সেই এই দলটার সর্দার। সওদাগরের উদ্দেশ্যে বলল, “তোদের সাথে যা আছে সব চাই”।
সওদাগর বলল, “দেখ, তোমাদের সময়ের অপচয় হচ্ছে। আমার কাছে এই মুহূর্তে কিছুই নাই”।
“এত বড় সওদাগরের কাছে কিছুই নাই? এটা তো হতে পারে না”। বলেই সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করল জলদস্যুদের সর্দার।
ফটিক বুঝল এরা খোঁজ খবর নিয়েই হামলা করেছে। লোকগুলো তাকে চেনে। সম্ভবত তার কর্মচারীদের কেউ একজন বেঈমানি করেছে। গোপনে খবর দিয়েছে সওদাগর দেহরক্ষীদের ছাড়াই ভ্রমনে বেরিয়েছে। সে বলল, “দেখ, আমি এই মুহূর্তে কোন সওদা নিয়ে ব্যবসা করতে যাচ্ছি না। আমার স্ত্রীর পিতার বাড়িতে যাচ্ছি। আমার সাথে তেমন কিছুই নেই”।
“বলিস কি রে? তোর স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়েছিস? তবে তো তোর স্ত্রীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত গহনা দিয়ে ভর্তি থাকার কথারে। ওই গুলা দিয়ে দে। আর যদি তাও না থেকে, তবে তোর ওই রূপসী স্ত্রীকেই আমাদের হাতে দিয়ে দে। আমরা একটু আমোদ-ফুর্তি করব”। বলেই আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সর্দার।
“জান থাকতে দেবনা”। বলে কোমরের খাপ থেকে তলোয়ার হাতে নিল সওদাগর।
“বটে! এত বড় কথা! জান থাকতে দিবি না? তবে তোর জানটাই আগে নিব”! গর্জে উঠল দস্যু সর্দার।
নৌকা দুটো কাছাকাছি আসতেই দস্যুদের কয়েকজন সওদাগরের নৌকায় লাফিয়ে চলে এলো। মাঝি মাল্লাদের সাথে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ বেঁধে গেল। কিন্তু দক্ষ দস্যুদের সাথে আনাড়ি মাঝিরা পারছে না। এদিকে দস্যু সর্দার খোলা তলোয়ার হাতে এগিয়ে এলো ফটিক সওদাগরের দিকে। সওদাগরও তলোয়ার বাগিয়ে ধরে প্রস্তুত।
ওদিকে নৌকার ভেতরে অরুণা ছেলেকে আকড়ে ধরে গীতার বানী আউরাচ্ছে। মা দুর্গার কাছে সাহায্য প্রার্থণা করছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার স্বামী এই দস্যুদের সাথে পেরে উঠবে না। আজ হয়ত মৃত্যু নিশ্চিত। মৃত্যুকে অরুণা ভয় পাচ্ছে না কিন্তু একজন মানুষের আমানত আছে তার কাছে। সেটা কোন অবস্থাতেই খোয়ানো যাবেনা। সে অর্জুনকে বলল, “বাবা অর্জুন। একটা জিনিস নিয়ে সাঁতরে গিয়ে তীরে উঠতে পারবে?”
অরুণার ছোট্ট অর্জুন খুব ভাল সাঁতার জানে। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “পারব মা”।
“তাহলে তোমাকে একটা জিনিস দিচ্ছি। তুমি এটা নিয়ে সাঁতরে তীরে উঠবে”।
অরুণা তার গহনার বাক্স থেকে রক্তপাথর বের করল। মাহতাবের দেয়া এই আমানত খুব যত্ন করে আগলে রেখেছে অরুণাবতী। শত কষ্টের মাঝেও এর কোন ক্ষতি হতে দেয়নি। দ্রুত হাতে অর্জুনের পোশাকের সাথে সেটা বেঁধে দিল অরুণাবতী। তারপর বলল, “নৌকার পেছন দিক দিয়ে নদীতে ঝাপ দাও বাছা। খেয়াল রেখ যেন কোন শব্দ না হয়। প্রথমে ডুব সাঁতার দিয়ে নৌকা থেকে দূরে সরে যাবে। তারপর সাঁতরে গিয়ে তীরে উঠবে। তোমার নানা রাজা প্রতাপাদিত্য, এ তল্লাটের সম্রাট তিনি। তুমি তার মহলে গিয়ে নিজের পরিচয় দেবে। পারবে তো?”
“পারব মা”। আবারো একই উত্তর দিল ছোট্ট অর্জুন।
অর্জুন নৌকার পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে ছোট্ট করে ঝাপ দিল নদীতে। আর ঠিক তখনই হঠাৎ নৌকার বাইরে সওদাগরের আর্ত চিৎকার শুনে অরুণাবতী কেঁপে উঠল। মেরে ফেলেছে ঐ দস্যুরা! মেরে ফেলেছে ওরা তার স্বামীকে!