১০ এপ্রিল, ২০১৬;
সময়ঃ সকাল ১০টা ৩০ মিনিট।
গুলশান-২, মাহবুব ম্যানশন।
একটা পুলিশ ভ্যান ত্বরিত গতিতে এসে মাহবুব ইকবালের বাড়ির সামনে ঘ্যাস করে ব্রেক কষে থামল। মিলি তখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবনায় মশগুল ছিল, বাড়ির সামনে গাড়ি থামার কর্কশ আওয়াজে সংবিৎ ফিরে পেল। দেখল পুলিশ ভ্যান থেকে টপ টপ করে সাত আট জন পুলিশ সদস্য নামছে, সবাই সশস্ত্র। তারা নেমে পড়ার আগেই আরও দুটো পুলিশ কার এসে ব্রেক কষলো ভ্যানের পাশে। একটা গাড়ি থেকে নামল দুজন পুলিশ, অপর গাড়ি থেকে দুজন স্বাভাবিক ড্রেস পড়া মানুষ নামল। তাদের দুজনকে মিলি চেনে, একজনের সাথে আগেও বেশ কয়েকবার তার কথা হয়েছে সে লোকটা ডিবি ইন্সপেক্টর মনসুর হালিম। অপরজনের সাথে কেবল একবার দেখা হয়েছে তার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর ড. রুদ্র রাশেদ।
আশংকায় কেপে উঠল মিলি। এমনিতেই তো বাড়ির সামনে সারাক্ষণ পুলিশী পাহাড়া বসিয়ে রাখা হয়েছে। তার উপর আবার হঠাৎ করে এত পুলিশের আগমনের কারণ কি হতে পারে? তবে কি ওরা টের পেয়ে গেছে যে গতরাতে কবির এসেছিল এখানে, ব্লাডস্টোন রেখে গেছে!
কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দিল মিলি। সামনে দাঁড়িয়ে আছে ডিটেকটিভ মনসুর হালিম আর তার পাশে দাঁড়ানো রুদ্র রাশেদ। পেছনে এক গাঁদা পুলিশ সদস্য। মিলিকে দেখেই এক গাল হাসল মনসুর, “কেমন আছেন মিসেস কবির?”
মনসুর হালিমকে একদম সহ্য হয়না মিলির। সব বিষয় নিয়েই এই অদ্ভুত লোকটা ঠাট্টা-মশকরা করে। মিলি শ্লেষ মাখা কণ্ঠে বলল, “আপনারা যেমন রেখেছেন ঠিক তেমনই আছি”।
“বাব্বাহ, বেশ চটে আছেন দেখছি”!
“বাহ! আপনারা যখন তখন ভদ্রলোকের বাড়িতে অতর্কিত অভিযানে আসবেন আর আমরা সামান্য একটু রাগ করতেও পারব না? আপনাদের আইনে রাগ করলে কোন শাস্তি আছে নাকি? কত বছরের জেল দেবেন?”
“এমনি এমনি তো আর আসিনা মিসেস কবির”! গলায় আন্তরিকতা ঢেলে বলার চেষ্টা করল মনসুর। “অভিযানের পেছনে যথেষ্ট কারণ থাকে”।
“বলুন তবে কি কারণ? কেন এই সাত সকালে আপনি এত পুলিশ ফোর্স নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছেন? আপনাকে নিশ্চয়ই দাওয়াত করা হয়নি”!
মনসুর হালিম আবার এক গাল হাসল, “হে হে হে! নেমতন্ন লাগেনা, আমরা এমনিতেই মানুষের উপকার করতে হাজির হয়ে যাই। আজও আপনার উপকার করতেই এসেছি”।
“তারমানে? কিসের উপকার?”
“শুনলাম আজ ভোরে নাকি অচেনা একটা লোককে আপনাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে! ভাবলাম হয়ত চোর- ছ্যাঁচোর হবে। দেখতে চলে এলাম কিছু চুরি টুরি হল কিনা! আফটার অল পুলিশ তো জনগনের সেবক, ঠিক কিনা?”
ভেতর ভেতর ভয় পেলেও চেহারায় সেটা প্রকাশ পেতে দিলনা মিলি। বলল, “এখান থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছে? কই না তো! আমাদের বাড়িতে ভোর বেলা কেউ আসেনি। হয়ত কোথাও ভুল হচ্ছে আপনাদের”।
“ভোরবেলা এসেছে তা তো আমি বলিনি মিসেস কবির! চোরকে ভোরবেলা বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে। হতে পারে যে চোর রাতেই এসেছিল! সারারাত এখানে কাঁটিয়ে ভোরবেলা বেরিয়ে গেছে!” মনসুরের চোখে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি।
“মিথ্যা কথা!” প্রায় চিৎকার করে উঠল মিলি।
“ঠিক বলছেন? মিথ্যা কথা? একটু ভাবনা চিন্তা করে দেখুন, পুলিশকে ভুল তথ্য দেওয়াও কিন্তু শাস্তিযোগ্য অপরাধ।”
“ভাবনা চিন্তা করেই বলছি। কেউ আসেনি”।
“কিছু চুরি টুরি হয়েছে কি না একটু খুঁজে দেখবেন কি?”
“কিচ্ছু চুরি হয়নি”। মিলির দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে পারলে মনসুর হালিমকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। “আমি বলছি না বার বার? আপনার কানে কি কথা যায় না?”
“স্ট্রেঞ্জ! কিছু চোর এসেছিল, অথচ চুরি হয়নি! এটা কেমন করে হয়? তাহলে চোর কি চুরি করার বদলে উল্টা কিছু রেখে গেল নাকি?” মনসুর তার স্বভাবসুলভ হাসি দিল- “হে হে হে! ব্যাটা তো আজব চোর!”
“কি বলতে চাচ্ছেন আপনি?”
“কিছুই বলতে চাচ্ছিনা”। এতক্ষণ বেশ মজার মুডে ছিল মনসুর। মিলির ক্রমাগত বাজে ব্যবহারের কারণে এবার খোলস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল মনসুরের ভেতরকার সিরিয়াস ডিটেকটিভ পুলিশ। চোয়াল শক্ত করে বলল, “জায়গা ছাড়ুন, আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। আপনাদের বাড়িতে তল্লাসি করা হবে। বাঁধা দিতে চেষ্টা করলে গ্রেফতার করতে বাধ্য হব। আমরা এখানে আপনার সাথে খোশগল্প করতে আসিনি”।
“কি... কিসের সার্চ ওয়ারেন্ট?” মনসুরের এমন পরিবর্তনে এবার ঘাবড়ে গেছে মিলি। “কি... কি...কি জন্য সার্চ করবেন আপনারা?”
এতক্ষণ চুপ চাপ শুনছিল রুদ্র রাশেদ। এবার মুখ খুলল, “দেখুন মিসেস মিলি, যদি আপনাদের লুকানোর কিছু না থাকে তাহলে প্লিজ আমাদের একটু সার্চ করে যেতে দিন। খামাখা কথা বাড়িয়ে কি লাভ বলুন?”
এরই মধ্যে হৈচৈ শুনে মিলির বড় ভাই আর ভাবীও চলে এসেছে। মিলির বড়ভাই বলল, “কি হয়েছে অফিসার? কি চান আপনারা? চোর ধরা আপনাদের মাথা ব্যথা, মাঝখান থেকে এই সব হ্যারাসমেন্ট কেন করছেন আমাদের? আমার বোনের লাইফটা হেল করে দিচ্ছেন আপনারা”।
“করতে বাধ্য হচ্ছি কারণ আপনার বোন জামাই একটা হাই প্রোফাইলের চোরের খেতাব পেয়ে বসে আছে”। বলল মনসুর। “সে গতরাতে এখানে এসেছিল, সারারাত থেকে ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। আমাদের বিশ্বাস যে সে চুরি করা ঐ ব্লাডস্টোন এখানেই রেখে গেছে”।
“ইমপসিবল!”
“পসিবল কি ইমপসিবল সেটা সার্চ করলেই বুঝা যাবে”।
রুদ্র রাশেদ খেয়াল করল- মনসুর এখন আর স্বভাবসুলভ হাসছে না। আর দশজন ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরা জ্ঞান করা পুলিশ ইন্সপেক্টরের মতই লাগছে এখন তাকে। এই লোকটার ভেতরে এমন একটা শক্ত মানুষ রয়েছে এটা কখনও ভাবতেও পারেনি রাশেদ।
পুলিশের দলটা বাসার ভেতরে ঢুকে পড়ল। মনসুর হালিম বলল, “তোমরা সবাই দুই তিনটা দলে ভাগ হয়ে প্রত্যেকটা রুমের তল্লাসি নাও। একটা ইঞ্চিও যেন বাদ না পড়ে। আমি আর প্রফেসর সাহেব ড্রয়িং রুমটা দেখছি”।
প্রায় এক ঘন্টা ধরে চলল খোঁজ- দা সার্চ। প্রতিটা জিনিস তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। বিশেষ ধরনের মেটাল ডিটেকটর দিয়েও খোঁজা হল বাড়ির প্রতিটি কোন, কিছুতেই কিছু হল না। পাওয়া গেলনা কাঙ্খিত ব্লাডস্টোন।
শেষে বাধ্য হয়ে মনসুর হালিম বলল, “দুঃখিত মিসেস কবির। আমরা বোধ হয় ভুল খবর পেয়েছি”।
“না না! আপনারা ভুল খবর কেন পাবেন?” মিলির কণ্ঠে টিটকারির সুর।
“আপনি দেখি এখনও রেগে আছেন মিসেস কবির”।
“না না না... আমরা রাগব কেন মশাই? খুব খুশি হয়েছি আপনারা এসেছেন। থাকুন, ভাল ভাল রান্না বান্না করি। দুপুরে খেয়ে যান...”
“আহ... এভাবে বলছিস কেন মিলি?” মিলির বড় ভাই বাঁধা দিল।
“কেন বলব না ভাইয়া?” মিলির কণ্ঠে জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ। “গত একটা মাস যাবত কি করছে এরা? আমি আর পারছি না...”
মনসুর হালিম আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু দ্রুত মধ্যস্থতা করল ড. রুদ্র রাশেদ। সামনে এগিয়ে এসে বলল, “একটা ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে মিসেস কবির। এটার জন্য সত্যিই আমরা দুঃখিত। আশা করি মনে কিছু করবেন না। আর এরপর থেকে আর আপনাকে কেউ ডিস্টার্ব করবে না। ব্যাপারটা আমি দেখছি...”
১০ এপ্রিল, ২০১৬;
সময়ঃ বেলা ১১টা ৪০ মিনিট।
গুলশান-২, ঢাকা।
মাহাবুব ম্যানসন থেকে বেরিয়ে এল পুলিশের গোটা দলটা। মনসুর হালিম আর রুদ্র রাশেদ সামনে হাঁটছে। মনসুর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাল। আর একটা অফার করল রুদ্র রাশেদকে। রাশেদ ইশারায় মানা করল। এই মুহূর্তে তার সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে না।
দুজনে খানিক দূর হেঁটে এসে পার্ক করে রাখা পুলিশ ভ্যানের সামনে দাঁড়াল। এবার অবশ্য রাশেদ নিজ থেকেই একটা সিগারেট চাইল মনসুরের কাছে। মুখের ভেতরটা কেমন যেন পানসে লাগছে তার।
রাশেদ সিগারেট ধরাচ্ছে। মনসুর বলল, “এখন কই যাবেন প্রফেসর?”
সিগারেটে এক বড় করে টান দিয়ে বেশ আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়ল রুদ্র রাশেদ। বলল, “আমার আর আজ তেমন কোন কাজ নেই। আবহাওয়াটা ভালই লাগছে। ভাবছি শহরের রাস্তায় একটু উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি করব”।
“তাই?” মনসুর হালিম হাসল। “আমারও কোন কাজ নাই। চলেন হাঁটি”।
মনসুর তার সাথে আসা পুলিশ সদস্যদের দ্রুত কিছু নির্দেশ দিল। পুলিশ ভ্যান আর গাড়ি নিয়ে তাদের থানায় ফিরে যাওয়ার বলল। আরও বলল- পুলিশ সুপারকে বলার জন্য যে আজকের অভিযানের রিপোর্ট সে থানায় ফিরে এসে করবে।
পুলিশের গাড়ি গুলো চলে যেতেই মনসুর হালিম আর রুদ্র রাশেদ গুলশান-২ এর একটা নিরিবিলি শান্ত রোড ধরে হাঁটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ শুধু নিরবে হাঁটা আর সিগারেটে সুখটানের মধ্যে সময় কাটল দুজনের। কারও মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই যে দুজনের মাথায়ই এই মুহূর্তে সমস্ত ব্লাডস্টোন কেইসের আদ্যোপান্ত নিয়ে চিন্তা চলছে।
“আমাদের জুটিটা বেশ ভাল মানিয়েছে! কি বলেন প্রফেসর সাহেব?” সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার ফাঁকে নিরবতা ভাঙল মনসুর।
“কোন ক্ষেত্রে জুটির কথা বলছেন আপনি?” রুদ্র রাশেদ জিজ্ঞেস করল।
“এই যে... ক্রাইম সল্ভ করার ক্ষেত্রে”। মনসুরের ঠোঁটের কোনে মিটি মিটি হাসি। “হলিউডের মুভিতে যেমনটা দেখা যায়! দুজন দু’ধরনের পুলিশ এজেন্ট পার্টনার হয়ে কাজ করে বিভিন্ন ধরণের ক্রাইম সল্ভ করে। ঠিক তেমন, তাই না?”
ড. রুদ্র রাশেদ কিছু বলল না। নিরবে সিগারেটে টান দিচ্ছে। এই মুহূর্তে কথা বলতে ভাল লাগছে না তার। আগে সিগারেটটা শেষ করা যাক। মনসুরের হাঁটার গতির সাথে পা মিলিয়ে ছোট ছোট পদক্ষেপে হাঁটছে সে ।
অতি উৎসাহী গলায় মনসুর বলছে, “আমরা হচ্ছি অনেকটা ব্যাকেট আর ক্যাসেলের মত”।
“এরা কারা?” রাশেদ জিজ্ঞাসা করল।
“আপনি ইংলিশ টিভি সিরিজ ‘ক্যাসেল’ দেখেন না?” মনসুরকে দেখে মনে হল বেশ অবাক হয়েছে। তার প্রশ্ন করার ধরণে মনে হচ্ছে যেন টিভি সিরিজ “ক্যাসেল” না দেখাটা বিরাট কোন অপরাধের আওতায় পড়ে।
“না”। সংক্ষেপে জবাব দিল রুদ্র। তারপর একটু যোগ করল। “আমি টেলিভিশন খুব একটা দেখিনা”।
“ওহ হ! এই জন্য বুঝতে পারেন নাই। ক্যাসেল সিরিজের নায়কের নাম ক্যাসেল আর নায়িকার নাম বেকেট। আমরা হচ্ছি অনেকটা ঐ ক্যাসেল আর বেকেটের মত। ক্যাসেল হচ্ছে রাইটার তার সাথে আপনার অনেক মিল। আর আমি হচ্ছি বেকেটের মত, বেকেটের সাথে আমার...” আরও কিছু হয়ত বলত মনসুর কিন্তু রুদ্র রাশেদের চেহারাটা বাংলার পাঁচের মত হয়ে যাচ্ছে দেখে থেমে গেল।
রাশেদ অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে দেখে মনসুর আমতা আমতা করছে, “ইয়ে... মানে... না না! আসলে সব কিছু মিলেনা আমাদের। এই যেমন বেকেট মেয়ে, আর আমি ছেলে!”
রুদ্র রাশেদ এখনও সেই ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে।
হোম ওয়ার্ক না করে স্কুলে যাওয়ার পর শিক্ষকের হাতে ধরা খাওয়া বাচ্চারা যেভাবে মাথা চুলকায়, ঠিক সেভাবেই মাথা চুলকাচ্ছে ডিটেকটিভ মনসুর হালিম। “ইয়ে... আসলে... আসলে আরও অমিল আছে। এই যেমন ক্যাসেল আর বেকেটের মধ্যে প্রেম হয়ে গেছে। কিন্তু আপনার আর আমার মাঝে এখনও...”
এবার রাশেদের চেহারায় রাগের আভাস। মনসুর জিভে কামড় দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, “দুঃখিত প্রফেসর! আসলে.. বুঝতে পারছি এটা একটা স্টুপিডের মত উদাহরণ দেয়া হয়ে গেছে! তাই বলে আপনি যেন উল্টা পাল্টা আমার সম্পর্কে কিছু ভেবে বসবেন না। আমার কোন সমস্যা নেই, বাড়িতে আমার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে।”
রুদ্র রাশেদের চেহারায় এখনও রাগ রাগ ভাব।
“মেয়ে...” ব্যাপারটা আরও একটু পরিষ্কার করার চেষ্টা করল মনসুর। “মেয়েই দেখা হচ্ছে আমার জন্য। অন্য কিছু না স্যার...”
রেগে উঠার বদলে হো হো করে হেসে ফেলল রুদ্র রাশেদ। রাশেদের সাথে মনসুর হালিমও গলা মিলাল। দুজনে এতই উচ্চ শব্দে হাসছে যে রাস্তা ঘাটের লোকজন অবাক হয়ে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে তাদের দিকে।
হাসি একটু থামতে রাশেদ বলল, “মনসুর হালিম! আপনি মানুষও একটা! কি করে পারেন সব সময় সব সিচুয়েশনে এমন মজা করে বেড়াতে?”
হাসিতে মনসুরের সব কটা দাঁত যেন বেরিয়ে গেছে।
রাশেদ বলছে, “আমার মাঝে মাঝে আপনার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হয় একজন কমেডিয়ানকে ডেকে এনে ডিটেকটিভ মুভিতে অভিনয়ের জন্য বসিয়ে দেয়া হয়েছে!”
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে মনসুর হালিম বলল, “কমেডির কথা আর বলেবেন না প্রফেসর! একবার ছোট বেলায় হয়েছে কি...”
“থাক থাক!” বাঁধা দিল রুদ্র। “আর না। আপনার ঐ ছোটবেলার কাহিনী অন্য কোন দিনের জন্য তুলে রাখুন! আজকের জন্য ঢের হয়েছে ব্রাদার!”
“আচ্ছা ঠিক আছে, অন্য দিন হবে”। মনসুর বলল, “তবে যাই বলেন প্রফেসর ডাবল আর! আপনার বুদ্ধি আর আমার শক্তি- দুই মিলিয়ে খেলাটা আমরা বেশ ভালই খেলেছি বলতে হবে!”
“খেলা তো এখনো শেষ হয়নি ডিটেকটিভ। ক্রাইম সল্ভড হল কই?” রুদ্র রাশেদের প্রশ্ন।
“ক্রাইম তো সল্ভড হয়েই গেছে!” মনসুর অবাক হয়েছে। দুজনের হাঁটার গতি আরও শ্লথ হল এবার। “ ব্লাডস্টোন কার হাত থেকে কিভাবে এসেছে তা আমরা জানি এখন। আর কে চুরি করেছে, কেন চুরি করেছে- এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্যাস! আমার দায়িত্ব এখানেই শেষ। এখন চোরকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব অন্য কেউ নেবে। আর চোর যদি খালি একবার ধরা পড়ে তাহলেই হল! সমস্ত কেইস ফিনিশড! তাছাড়া ইতিমধ্যে আমরা ব্লাডস্টোনের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেছি বিশ্ববাসীর সম্মুখে। জাতিসংঘ থেকে বলা হয়েছে ব্লাডস্টোন দখল করে রাখার কোন অধিকার ব্রিটেনের নেই। এর উপরে পূর্ণাঙ্গ অধিকার বাংলাদেশের। ব্যাপারটার একটা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলেই কবিরকে আর পালিয়ে বেড়াতে হবেনা। আন্ডার গ্রাউন্ড ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারবে প্রকাশ্যে- স্বাভাবিক জীবনে। আর আমাদের ঐতিহ্য ঐ ব্লাডস্টোন শোভা পাবে আমাদের দেশের জাদুঘরে। এখানে আর তো কোন রহস্য রইল না স্যার!”
“ব্যাপারটা এত সহজ নয় মনসুর। একটা রহস্যের এখনও সমাধান হয়নি”। রাশেদ ডানে- বায়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
“কোন রহস্য প্রফেসর?”
“এই কেসের সঙ্গে আমার জড়িয়ে পড়ার রহস্য!”
“ওমা। এখানে আবার রহস্য কিসের?” মনসুর যেন আকাশ থেকে পড়েছে। “আমাদের এই কেইসে একজন ইতিহাসবিদের সাহায্য দরকার ছিল, আপনি করেছেন। এখানে রহস্য কেন থাকবে?”
“ভাল করে চিন্তা করে দেখুন তো মনসুর সাহেব? আমি ঠিক কি কারণে এই কেইসে জড়িয়ে গেছি?”
মনসুর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বুঝতে পারছি না। কারণ তো ঐ একটাই- আমরা সাহায্য চেয়েছি। আপনারও এসব ঐতিহাসিক রহস্য জড়ানো বিষয়ে গবেষণা করতে ভাল লাগে। তাই হয়ত...”
“আপনি ব্যাপারটা খেয়াল করছেন না মনসুর”। রুদ্র রাশেদ কিছুটা যেন হতাশ হয়েছে। “আমি এই কেইসে জড়িয়ে গেছি ছোট্ট একটা চিরকুটের কারণে। ‘অ্যামিতিস, তোমাকে ভালবাসি’- রি কথাটা লেখা ছিল সেই চিরকুটে। চোর এই চিরকুট চুরির সময় ফেলে না গেলে এই কেইসের দৃশ্যপটে আমার আসার সম্ভাবনা খুব কম ছিল”।
“হুম এটা অবশ্য আপনি ঠিক বলেছেন”। মনসুর হালিম একমত হল।
রাশেদ বলল, “এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে- চিরকুটখানা ঐ ক্রাইম সিনে কে রাখল?”
“যে চোর সেই রেখেছে! ওটা তো নিশ্চয়ই ঐ বেটা অঞ্জন দত্তের কাজ”।
“আমি অঞ্জনকে ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করেছিলাম”। বলল রুদ্র। “সে বলেছে ক্রাইম সিনে সে কোন চিরকুট ফেলে আসেনি”।
“অঞ্জন হয়ত মিথ্যা বলেছে।” মনসুর হালিমের সহজ জবাব।
“কেন মিথ্যা বলবে সে?” রুদ্র রাশেদ মনসুরের যুক্তি মানতে নারাজ। “অঞ্জন দত্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয়টি আবিষ্কার করেছে- এত বড় সত্য যখন প্রমানিত হয়ে বেরিয়ে এসেছে, তখন কেন সে এই সামান্য একটা বিষয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেবে?”
“তাহলে নিশ্চয়ই পলাতক কবির হোসেন এই কাজটা করেছে”। মনসুর বলল। “চুরির আগেই সে যখন জায়গাটা ঘুরে ফিরে দেখতে গিয়েছিল, তখনই ক্রাইম সিনে চিরকুট ফেলে এসেছে”।
“আপনার থিওরি আমি মানতে পারছি না জনাব”। রাশেদের সিগারেট শেষ হয়েছে। রাস্তার পাশে একটা ‘ইউজ মি’ লেখা ময়লা বিন দেখে সিগারেটের ফিল্টারটা ফেলে দিল সে। “আপনি যা বলছেন তাই যদি হবে, তাহলে চিরকুটটা ব্লাডস্টোন রাখা সেইফের আশে পাশে কোথাও পড়ে থাকত। ব্লাডস্টোন চুরি হয়ে যাওয়ার পর ভাঙা সেইফের ভেতরে চিরকুট পাওয়া যাওয়ার কথা নয়। অবশ্যই চুরি হওয়ার পর চিরকুট ফেলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে ব্লাডস্টোনের সেইফের আশে পাশে স্পষ্ট সব কিছু দেখা যায় এমন কোন সিসি ক্যামেরা ছিলনা। ফলে চোর নিজে চুরি করার পর কোন চিরকুট ফেলছে কি না তা বুঝার উপায় নেই। তবে আমি এতটুকু শিওর যে চিরকুট ফেলার কাজটা অঞ্জন কিংবা কবির করেনি”।
মনসুরের গলায় অবিশ্বাসের সুর। “তাহলে কাজটা কে করেছে বলে আপনার মনে হয়?”
প্রফেসর রুদ্র অনেকটা যেন আপন মনে বলল, “এমন কেউ কাজটা করেছে যে চাইছিল আমি বা আমার মত কোন ইতিহাসবিদ এই কেইসে ইনভল্ভড হোক। চিরকুটটা যে ফেলেছে সে চাইছিল ব্লাডস্টোনের আসল ইতিহাস বেড়িয়ে আসুক। পৃথিবীর মানুষ যেন জানতে পারে এই অলংকার জোর করে কব্জা করে রেখেছে ব্রিটিশ প্রশাসন। এই পাথরের উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার বাঙ্গালীর। আমি নিশ্চিত বলতে পারি যে কবির বা অঞ্জন- কারোই উদ্দেশ্য ছিল না ব্লাডস্টোনের ইতিহাস তুলে আনার। দুজনেই ওটা চুরি করে নিজের কব্জায় লুকিয়ে রাখতে চাইছিল”।
“কিন্তু যদি অঞ্জন বা কবির এটা না করে থাকে, তবে কে হতে পারে সেই ব্যক্তি?”
“সে কথায় পরে আসছি”। বলল রাশেদ। “তবে তার আগে কিছু বিষয়ে একটু ক্লিয়ার করে নেই...”
রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান দেখে থামল রাশেদ। ইতিমধ্যে গুলশানের ভেতর দিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে দুজনে। বলল, “চা খাবেন? আমার মুখের ভেতরটা কেমন যেন পানসে লাগছে আজ সকাল থেকেই। সিগারেটেও কাজ হলনা”।
“হুম, খাওয়া যায়”। বলল মনসুর।
দুজনে বসল চায়ের দকানের সামনের একটা কাঠের বেঞ্চিতে। মনসুর হাক ছাড়ল চা-বিক্রেতার উদ্দেশ্যে। “মামা! চা হইব নাকি?”
“চায়ের দোকানে চা- হইব না তো কি সরবত হইব মামা?” চা- বিক্রেতার কণ্ঠে বিরক্তি। সে অন্য দিকে ফিরে আছে। মনসুরদের দিকে তাকাচ্ছে না।
মনসুর তাকাল রাশেদের দিকে। চোখে মুখে হতভম্ব দৃষ্টি। বলল, “দেখলেন প্রফেসর সাহেব? আপনারা বাঙালীরা সাদা পোশাকের ডিটেকটিভদের কোন দামই দিলেন না। এখন আমার জায়গায় যদি ইউনিফর্ম পড়া কোন হাবিলদার থাকত, এই বেটা চা-ওয়ালা চা না থাকলে বাপ বাপ করে অন্য দোকান আনিয়ে দিত। বিল চাওয়ারও সাহস করত না! আর আমার কথার কি জবাব দিল?”
রুদ্র রাশেদ ঠোঁট টিপে হাসছে।
“একটা কাজ করি বস?” জিজ্ঞেস করল মনসুর হালিম। “ব্যাটার কানের নিচে দুইটা ঠাটিয়ে থাপ্পড় দেই?”
রুদ্র রাশেদ আটকাল মনসুরকে। “আরে না না মনসুর সাহেব। তা করবেন কেন? আপনার ক্ষমতা দুর্বলকে রক্ষা করার জন্য। দুর্বলের উপর হাত তোলার জন্য নয়”।
“কিন্তু দুর্বল তো আমার সাথে দুর্ব্যবহার করল!”
রাশেদ গলা খাঁদে নামিয়ে বলল, “মনে হচ্ছে বেচারা আগে থেকেই কোন কারণে চটে আছে। সেই রাগ আপনার উপরে ঝেড়েছে। চেপে যান মশাই। রি-অ্যাকশন নেয়ার দরকার নাই”।
মনসুর চুপচাপ রোবটের মত বসে থাকল। রুদ্র রাশেদের কথা মানতে ইচ্ছে করছে না তার। এই মুহূর্তে কয়েকটা ঘুষি মেরে চা-ওয়ালার চেহারার নকশা পাল্টে দিতে পারলে আরাম পেত সে।
রাশেদ চা-ওয়ালার উদ্দেশ্যে গলা উচু করে বলল, “ভাইজান, দুইটা দুধ-চা বানান। একটাতে চিনি একটু কম দিয়েন”।
চা-ওয়ালা হ্যাঁ বা না কিছু বলল না। চা বানানোতে মনযোগী হল।
মনসুর কিছু বলছে না। রুদ্র রাশেদ কি বলবে সে শোনার অপেক্ষা করছে।
“তো যা বলছিলাম মনসুর সাহেব... কয়েকটা বিষয় একটু ক্লিয়ার করে নেয়া প্রয়োজন”। বলল রুদ্র রাশেদ। “এই প্রদর্শনীর আয়োজন শুরু হওয়ার পূর্বেই কতৃপক্ষ বাংলাদেশ পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েছিল নিরাপত্তার জন্য। বাংলাদেশ পুলিশের একটা টিম সমস্ত নিরাপত্তা আয়োজনের পরিকল্পনা করেছিল। কত জন সদস্য নিরাপত্তা দানের কাজ করবে, কতজন ডিউটি দিবে, কখন শিফট চেঞ্জ হবে, কোথায় কোথায় সিসি ক্যামেরা বসানো হবে ইত্যাদি ইত্যাদি... ঠিক কিনা?”
“জি ঠিক”।
রাশেদ বলল, “আপনি একটা জিনিস নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে ব্লাডস্টোনের ধারে কাছে একটাও এমন সিসি ক্যামেরা ছিলনা যা দিয়ে এর আশেপাশের দর্শনার্থীদের স্পষ্ট দেখা যায়। লক্ষ্য করেছেন?”
“হ্যাঁ, করেছি”। সংক্ষেপে উত্তর দিচ্ছে মনসুর। চা-ওয়ালার ব্যবহারের কারণে এখনও মেজাজ গরম হয়ে আছে তার।
“আমি এটাকে পুরোপুরি কো-ইন্সিডেন্স ভাবতে নারাজ”। রুদ্র রাশেদ বলে চলেছে। “কারণ আয়োজনের সমস্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা একটু গভীরভাবে স্টাডি করলে দেখলে বোঝা যাবে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এমন সব ফাঁক ফোঁকর ছিল যা দিয়ে অনায়াসে একজন ব্যাক্তি ব্লাডস্টোন চুরি করে পালাতে সক্ষম হবে। যদি অঞ্জন পালের বেহালা বাজিয়ে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার মত ক্ষমতা না থাকত, তবুও সে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে কৌশলে ব্লাডস্টোন চুরি করে নিয়ে পালাতে পারত। কেউ তাকে ধরতে পারত না”।
“হতে পারে”। আবারও সংক্ষেপে জবাব দিল মনসুর।
“তারমানে দাঁড়াচ্ছে- কেউ একজন চাচ্ছিল যে ব্লাডস্টোন চুরি হোক, তাই এমন একটা হাই-প্রোফাইল আয়োজনের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ফাঁক রেখেছে ইচ্ছ করে। অর্থাৎ অঞ্জন না চাইতেও অদৃশ্য থেকে তার কোন এক শুভাকাঙ্খি তাকে সাহায্য করছিল ব্লাডস্টোন চুরির ব্যাপারে। আর সেই অদৃশ্য বন্ধুটি হচ্ছে প্রদর্শনীর নিরাপত্তা প্রোটকলে যারা ছিল, তাদেরই একজন”।
মনসুর কাঁধ ঝাঁকাল। “বলে যান।”
“কিন্তু ঐ অদৃশ্য বন্ধু শুধু চুরির কাজে সাহায্য করেই ক্ষান্ত হননি। তার খুব ইচ্ছে ছিল যেন ব্লাডস্টোন এর সত্যিকারের ইতিহাস বেরিয়ে আসে। তাই সে চিরকুটটা সঙ্গোপনে ক্রাইম সিনে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে- এই চিরকুট এর সুত্র ধরেই ব্লাডস্টোনের সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে আনার কাজ সবার পক্ষে সম্ভব নয়। এই জন্য চাই এমন কাউকে যার আছে ঐতিহাসিক রহস্যের প্রতি অসম্ভব রকমের আকর্ষণ। বাংলাদেশে এমন মানুষ হাতে গোনা যে কয়জন আছেন, তাদের মধ্যে আমিও একজন। আর খুব সম্ভবত সবচেয়ে কম বয়সী। তাই হয়ত সেই অদৃশ্য সাহায্যকারী ব্যক্তি চাচ্ছিলেন কেইসটা যেন আমার হাতেই পড়ে, এজন্য সে আমার বন্ধু এসপি ইকবাল ফিরোজ কে অনুরোধ জানায় যেন সে আমাকে এই কেইসে নামার জন্য রাজি করায়”।
মনসুর কিছু বলছে না। চুপ করে আছে।
“কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানেন মনসুর সাহেব? আমার বন্ধু এসপি ফিরোজকে সেদিন কথায় কথায় ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল- এটা নাকি আপনার ইচ্ছায় হয়েছে। আপনিই আমার বন্ধুকে রাজি করিয়েছিলেন আমাকে এই কেইসে ইনভল্ভ করার জন্য। ফিরোজ আপনার ইমিডিয়েট বস। দুজনে অনেক সময় গল্প করে কাটিয়েছেন। সে আপনার সামনে আমার কথা প্রায়ই বলত। ফিরোজের মুখ থেকেই আপনি জেনেছেন- আমি একটু পাগলাটে টাইপের মানুষ। ঐতিহাসিক রহস্য দেখলেই নাওয়া খাওয়া ভুলে লেগে পড়ি”।
মনসুর কিছু বলছে না। নার্ভাস হাসি তার ঠোঁটের কোনে।
রদ্র রাশেদ অবশ্য থামেনি, বলে চলেছে- “আরও একটা মজার ব্যাপার কি জানেন? আমি জানতে পারলাম যে ঐ প্রদর্শনীর নিরাপত্তা প্রোটকলে যারা ছিল, তাদের মধ্যে আপনিও ছিলেন একজন। তাই কেইসের ভারটাও আপনার উপরে বর্তাল। তারপর কি ঘটেছে আন্দাজ করা খুব একটা কঠিন কিছু না। আপনি ক্রাইম সিনে গেলেন। খুব সঙ্গোপনে সবার চোখের অলক্ষে একটা চিরকুট ফেলে দিলেন ব্লাডস্টোনের সেইফের ভিতর। তারপর মানুষ জনের চোখের সামনে সেটা ভেতর থেকে তুললেন। ব্যাস!”
এবার মনসুর মুখ খুলল, “থিওরিটা ভালই ফেঁদেছেন প্রফেসর। বুঝা যাচ্ছে সারাটা সময় আপনি শুধু ইতিহাস নিয়ে মশগুল ছিলেন না! মুল কেইস নিয়েও মাথা ঘামিয়েছেন। এমন কি আমার পেছনে গিয়ে আমার বিরুদ্ধেও তদন্ত করেছেন!”
“আপনার ব্যাপারে আমার প্রথম দিন থেকেই খটকা লেগেছিল মনসুর সাহেব”। বলল রাশেদ। “কিন্তু আপনার বোকা বোকা আচরণের কারণে সন্দেহটা গাঢ় হতে সামান্য সময় লেগেছে। আপনার সব কিছু নিয়েই মজা করার প্রচেষ্টার ফলে লোক জন খুব সহজে ধোঁকা খেয়ে যায় মনসুর সাহেব। আপনার একচুয়াল চিন্তা-ভাবনা সব সময় সবার অজানাই থেকে যায়। তাছাড়া আমি ব্লাডস্টোনের ইতিহাস নিয়ে এতটাই মশগুল ছিলাম যে মনে হচ্ছিল- চিরকুট কে ফেলেছে তাতে আমার কিছুই যায় আসেনা, আগে এর ইতিহাস খুঁজে বের করি।”
মনসুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এত আগেই যখন সবটা বুঝে গিয়েছিলেন, তখনই বলেন নি কেন?”
“বলিনি কারণ আমি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না। আপনাকে দেখে মনেই হয়নি যে আপনি ইতিহাস নিয়ে এত বেশি আগ্রহী। অবশ্য আমার মত আপনিও যে ব্লাডস্টোনের ইতিহাস পুরোটা উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছেন, এটাও আমি মনে করিনা। কিছু তথ্য আগে থেকেই হয়ত জানতেন, কিছু পড়াশুনা করেছেন, আর বেশিরভাগই ছিল আপনার অনুমান। তবে এটা ঠিক যে আপনি একশত ভাগ নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন যে ব্লাডস্টোনের উপর লিগ্যাল অধিকার আছে বাংলাদেশের। কিন্তু চিরকুটের ব্যাপারটা আপনি এমন ভাবে সাজিয়েছেন যে মনে হয়েছে চোর চুরি করেছে এবং চাইছে কেউ চোরের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করুক। তাই চিরকুটটা চোর নয়- অন্য কেউ ফেলেছে- এমন কিছু চিন্তার অবকাশ আমার ছিলনা। তবে সম্ভাবনাটা আমি একদমই উড়িয়ে দেইনি, কিছুটা ধারণা করতে পারছিলাম। কিন্তু যখন অঞ্জনের কাছে জানলাম চিরকুটটা সে ফেলে আসেনি, তখন থেকেই আমার ধারণাটা বিশ্বাসে পরিণত হল”।
মনসুর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তখন চা- ওয়ালা দুই কাপ চা নিয়ে হাজির। তাকে দেখে রুদ্র রাশেদ জিজ্ঞেস করল, “চিনি কম দিয়েছেন কোনটায়?”
চা-ওয়ালা তার ডান হাতে ধরা চায়ের কাপের দিকে ইঙ্গিত করল। সেটা হাতে নিল রাশেদ। চা-ওয়ালা অপর কাপটা মনসুরের হাতে ধরিয়ে দিল।
দুজনেই ওরা চায়ের কাপে চুমুক দিল। কিন্তু চা-ওয়ালা এখনও যায়নি। সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ জিজ্ঞেস করল, “কি হল? দাঁড়িয়ে আছেন যে? কিছু বলবেন আপনি?”
চা-ওয়ালা মনসুর হালিমের দিকে ফিরে বলল, “স্যার। আমারে মাফ কইরা দেন। আপনার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার কইরা ফালাইছি। আমারে মাফ কইরা দেন। আমার দোকানে একটা পিচ্চি রাখছিলাম। হারামির বাচ্চা ক্যাশ বাক্স থেইকা অনেক গুলা টাকা চুরি কইরা পলাইছে। এই জন্য মনডা বড় খারাপ। মাফ করেন আমারে স্যার”।
মনসুর কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাখিয়ে থাকল চা-বিক্রেতার দিকে। তারপর মুখে ছোট একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “আরে না না। ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করি নাই”।
চা-ওয়ালা চলে যেতেই মুখ ঘুরিয়ে রাশেদের দিকে তাকাল মনসুর। রাশেদের ঠোঁটের কোনে মিটি মিটি হাসি। সেই হাসি বলছে- দেখলেন ডিটেকটিভ? লোকটাকে ভয় দেখিয়ে- মারধোর করে যে সম্মান আদায়ের চিন্তা করছিলেন, একটু ধৈর্য ধারন করে সেটা এমনিতেই পেলেন। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে- আপনি সম্মান আদায়ের যে উপায়ের কথা ভাবছিলেন সেটা আসত ভয় থেকে, এখন নিজের মন থেকেই দিয়েছে।
চা-ওয়ালা ফিরে যাওয়ার পর কয়েক মিনিটের নিরবতা। দুজনে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। চা-টা ভাল বানিয়েছে। খেতে মনে হচ্ছে অমৃতসম।
রাশেদের দিকে মুখ তুলে মনসুর বলল, “এখন কি করবেন স্যার? এখন কি আপনি সব কিছু আমার ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে বলে দেবেন?”
রাশেদ এক মুহূর্ত সময় নিল মুখ খোলার আগে। বলল, “বলে লাভ কি? প্রমাণ কই? আপনি যদি বলেন ঐ চিরকুট অঞ্জন ফেলে এসেছে, আপনি কিছুই করেননি, তাহলে সবাই সেটাই মেনে নিবে। আর অঞ্জন মারা গেছে, সুতরাং আমার পক্ষে এই ব্যাপারে আপনার জড়িয়ে থাকাটা প্রমাণ করা সম্ভব নয়।
“আমার কেন যেন মনে হয় প্রমাণ রাখলেও আপনি তা বলতেন না”! না-বোধক মাথা নাড়ল মনসুর। মুখে মৃদু হাসি। “পুরো ব্যাপারটা ভালয় ভালয় ঘটার পেছনে আপনারও হাত ছিল প্রফেসর। অঞ্জন আর কবির আপনাকে এত সহজে আপনাকে ওভাবে বেঁধে রেখে পালিয়ে গেল কি করে? ব্যাপারটার মধ্যে একটা ‘কিন্তু’ আছে বলে আমার মনে হয়েছে, অবশ্য আপনার খাতিরে আমি তা চেপে গেছি।”
রুদ্র রাশেদও হাসল। “এটাও আপনার প্ল্যানের অংশ ছিল মনসুর হালিম। আপনি একজন পুলিশ অফিসার, আপনার সাথে অস্ত্র আছে। আপনাকে কাবু করে ওদের পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না। আপনি তো চাইলেই এভাবে ওদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মঞ্চস্থ করতে পারতেন না। তাই তো আমাকে কবিরের সাথে একলা যেতে দিতে রাজি হয়েছিলেন। কারণ আমার হাত থেকে পালিয়ে যাওয়া ওদের জন্য খুব সহজ হবে। তাছাড়া আমি হয়ত নিজেই তাদের পালিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ করে দিব। এখন আমার পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে খুব আজব লাগছে। পুরোটা প্রথম থেকেই আপনার প্ল্যান ছিল। এমনকি আমিও আপনার প্ল্যানের ক্রীড়নক ছিলাম”।
মনসুরের মুখেও হাসি। বলল, “এবার তো নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন স্যার? আমরা খেলাটা ভালই খেলেছি!”
“হ্যাঁ, তা খেলেছেন বটে”। রাশেদ স্বীকারোক্তির ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল। “কিন্তু একটা প্রশ্ন তো তারপরও থেকে যাচ্ছে মনসুর”।
“কি প্রশ্ন?”
“কেন মনসুর? এই খেলাটা কেন খেললেন আপনি?”
“কেন খেলেছি সেটা বলতে গেলে একটা গল্প শুনাতে হয় আপনাকে স্যার”। বলল মনসুর। “কিন্তু আপনি তো আজ আর গল্প শুনার মুডে নেই”।
রাশেদ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকেই বলল, “এই গল্পটা শুনতে পারি। আগ্রহ হচ্ছে খুব”।
“শুনবেন সেই গল্প?” মনসুর উৎসাহী হয়ে উঠল, “অবশ্য ঠিক গল্প নয়। এটা গল্প হলেও সত্যি।”
“শোনান। এমনিতেই এই কেইসে গল্প হলেও সত্যি- এমন অনেক গুলো ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। না হয় আরও একবার হলাম”। রুদ্র রাশেদের মুখে হাসি।
মনসুর একটু কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করে নিল। দীর্ঘক্ষণ কথা বলার প্রন্তুতি। রুদ্র রাশেদ প্রস্তুত এই ব্লাডস্টোন কেইসের শেষ টুইস্টটি হজম করার জন্য...