১৮ই এপ্রিল, ২০১৬;
মাহাবুব ম্যানশন, গুলশান-২, ঢাকা।
“মিলি?” আলতো করে ডাকল কবির।
“মাদার তেরেসার এই মোমের মূর্তিটা তোমার বাবা কেন বানিয়েছিলেন যেন?”
“এই প্রশ্নটার উত্তর তোমাকে অনেকবার বলেছি কবির।" বলল মিলি। কণ্ঠে বিরক্তির সুর স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে।
“বলেছ তো! আরও একবার বলো না!” কবিরের কণ্ঠে আবদার।
পুলিশের কাস্টডি থেকে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্য মিলির ঠোঁটে হাসি দেখেনি কবির। সব সময় কি এক বিষণ্নতা যেন ঘিরে রেখেছে তাকে। ঠিক মত খায় না, ঘুমায় না, কোথাও যায় না। সারাক্ষণ চুপ চাপ বসে থাকে।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু সন্দেহ করছে এখনও। তাই জুড়ে দিয়ে বেশ কিছু শর্ত। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ব্লাডস্টোনের প্রকৃত চোর ধরা না পড়া পর্যন্ত ঢাকা শহরের ভেতরেই থাকতে হবে। যদি একান্তই বাইরে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হয় তবে পুলিশের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে। বাবা-মায়ের আদরের মাঝে বেড়ে ওঠা যে মেয়েটিকে কেউ কখনও কঠিন গলায় একটা ধমক দেয়নি, সেই মেয়ের পক্ষে এমন একটা ব্যাপার মেনে নেয়া খুব কষ্টের হওয়াটাই স্বাভাবিক।
কবিরের বাবা- মা মারা যান, যখন কবিরের বয়স ছিল ১৬ বছর। কবিরের বাবা আর মিলির বাবা বাল্যবন্ধু ছিলেন। তাই কবিরের বাবার মৃত্যুর পর মিলির পিতা মাহাবুব ইকবাল তার অভিভাবকের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। কাছাকাছি বয়স হওয়ায় কবির আর মিলির মাঝেও ছোটবেলা থেকেই সুন্দর একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কখনো সেটা ভালবাসার দিকে গড়ায়নি।
মিলির বাবা মাহাবুব ইকবাল গত বছর হঠাৎ দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে তার একটা ইচ্ছে ছিল যেন মিলির সাথে কবিরের বিয়ে হয়। মিলি কবিরকে পছন্দ করত, কিন্তু কখনও নিজের স্বামীরূপে তাকে কল্পনা করতে পারেনি। বাবার ইচ্ছা রাখতে গিয়ে অনেকটা অমতেই বিয়ে হয়ে যায় কবিরের সাথে। কিন্তু বিয়ের দুদিন না যেতেই মিলি বুঝতে পারল কবিরের প্রতি নিজের অজান্তেই একটা টান ছিল তার, যা সে আগে কখনও টের পায়নি।
ছোটবেলা থেকেই কবিরের মিউজিকের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। বেহালা, তবলা, গীটার, পিয়ানো, ড্রামস- সবই বাজানো শিখেছে একে একে। লেখাপড়া শেষে চাকরীর পেছনে না ছুটে পৈত্রিক সম্পত্তি যৎসামান্য যা ছিল সব বিক্রি করে দিয়ে একটা রেকর্ডিং স্টুডিও করেছে কবির। বেশ কিছু নাটক সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করে ইতিমধ্যে নাম করেছে মিডিয়া জগতে। কিছু টাকা জমিয়ে কম দামী একটা ফ্ল্যাট কিনেছে রামপুরা এলাকায়। সেই সাথে করেছে বাচ্চাদের মিউজিক শেখানোর জন্য ছোট খাট একটা মিউজিক্যাল স্কুল।
কবির এমনিতে বেশ মজার মানুষ, সব সময় খুব মজা করে বেড়ায়। কিন্তু কোন ভাবেই সে মিলির বিষণ্নতাটুকু কাটানোর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। মিলির এই বিষণ্নতা কাঁটাতে হলে প্রথমে তার একাকীত্ব ঘুচাতে হবে। কবির যখন স্টুডিও কিংবা মিউজিকের স্কুলে যায় তখন মিলি খুব একলা হয়ে পড়ে। থানা থেকে ফেরার পর মিলির এই কষ্টটুকুই কবির টের পাচ্ছিল। একা একা বাড়িতে মিলির সময়গুলো বড় দুর্বিষহ কাটছে দেখে সে মিলিকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে এসেছে কিছুদিন থাকার জন্য। গত কদিন যাবত দুজনে এখানেই রয়েছে।
বাবা মারা গেলেও বাড়িতে মা, ভাই-ভাবী, ভাতিজা সহ আরও আত্মীয় স্বজন আছে। কবির ভেবেছিল সেখানে গেলে মনটা ভাল থাকবে তার। কিন্তু দুজনে গুলশানে মিলির বাবার বাড়িতে এসে উঠার পরও কোন কাজ হয়নি। সবাই সারাক্ষণ মিলির মনটাকে ভাল রাখার প্রাণান্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু ফল হচ্ছে না।
মাহাবুব ম্যানসনের বিশালাকার লিভিং রুমে মাদার তেরেসার একটা মোমের মূর্তি আছে। মিলি খুব আগ্রহ নিয়ে এই মূর্তি তৈরির পেছনের কাহিনী বলে বেড়ায় সবাইকে। কখনও আগ্রহের কমতি হয় না। এমন কি কবিরের কাছে কমপক্ষে বিশ বার মহা উৎসাহে ব্যাপারটা বলেছে মিলি। কিন্তু এই প্রথম কাহিনীটা বলতে বলায় মিলির কণ্ঠে অনীহা প্রকাশ পেল।
“কী হলো? বলবে না?” অভিমানের ভান করল কবির।
মিলি কষ্ট করে একটু হাসার চেষ্টা করল। বলল, “আমি ঠিক আছি কবির। এসব করে আমার মন ভাল করার চেষ্টা করতে হবে না!”
“আহা বলো না! কাহিনীটা শুনতে ইচ্ছে করছে খুব। একদম শুরু থেকে বল, ঐ যে তোমার বাবার ছেলেবেলার বন্ধু নিতাইয়ের কাহিনী থেকে।”
কবিরের আরও কিছুক্ষণ টানাটানিতে অবশেষে বলতে শুরু করল মিলি, কিন্তু প্রতিবার বলার সময় মিলির চোখে মুখে যে উৎসাহ দেখতো কবির, এবার আর তার ছিটে ফোঁটাও দেখা গেল না।
“নিতাই নামে বাবার খুব কাছের এক বন্ধু ছিল। নিতাই এর বাবা- মা, আত্মীয় স্বজন কেউ ছিলনা। ইয়াতিম খানা থেকে পালিয়ে এসেছিল। রাতের বেলা রাস্তার ধারে কিংবা পার্কের বেঞ্চে ঘুমাত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ছেলেটির পড়াশুনার প্রতি ছিল ব্যাপক আগ্রহ। কে যেন তাকে বাবাদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। সেখানেই বাবার সাথে নিতাই এর পরিচয়। সে সকালে স্কুল শেষে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত একটা বস্তা হাতে। রাস্তায় হেঁটে হেঁটে কাগজ আর প্লাস্টিক কুড়োত। তারপর দিনশেষে সেগুলো বিক্রি করে যা পেত তা দিয়ে খাবার কিনত আর কিছু টাকা জমিয়ে রাখত। জমানো টাকাগুলো দিয়ে সে গল্পের বই কিনত। তার যেহেতু থাকার কোন জায়গা ছিলনা। তাই নিতাই তার জমানো টাকায় কেনা বইগুলি বাবার কাছে রাখতে দিত।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! একদিন নিতাই অসুস্থ অবস্থায় স্কুলে আসার পথে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যায়। বাবা খবরটা জানার পর খুব কেঁদেছিল। সেদিন বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিল যদি কখনও সুযোগ হয় তাহলে বাবা এই সব পথ শিশুদের আবাসনের জন্য কিছু করবেন। তাই তো ছোটবেলা থেকেই বাবার আদর্শ ছিল মাদার তেরেসা।
বাবার সেই সুযোগ একসময় আসল। বাবা পথশিশুদের উন্নয়নে একটা সংগঠন সৃষ্টি করলেন। বাবা মাদার তেরেসার আদর্শ নিয়ে কাজ করতেন সব সময়, কিন্তু কখনও মাদার তেরেসার সাথে দেখা করার সুযোগ মেলেনি তার। এই সুযোগটাও চলে এল বাবার জন্য। কলকাতায় মাদার তেরেসার সংগঠনের আয়োজনে দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা মিটিং হচ্ছিল। সেখানে বাবাও আমন্ত্রণ পেলেন...
৬ জুলাই, ১৯৯৬ সাল।
কোলকাতা, ইন্ডিয়া।
সকাল সকাল বিমানে করে কোলকাতার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করলেন মাহাবুব ইকবাল। মিটিংটা হওয়ার কথা ছিল উইলিয়াম কেরির শ্রীরামপুর থিওলজিকাল কলেজে। প্লেন থেকে নেমে একটি ট্যাক্সি নিয়ে তিনি এসে উঠলেন কোলকাতার বিশপস কলেজের কাছেই একটা হোটেলে। দুপুরের খাওয়ার পর্ব শেষ করেই আবার ট্যাক্সি নিয়ে আবার ছুটলেন হাওড়া রেলস্টেশনে। ট্রেনে চেপে সন্ধ্যার আগেই মাহাবুব পৌঁছে গেলেন শ্রীরামপুর কলেজে। কিন্তু পৌঁছে দেখেন সমস্ত এলাকা প্রায় নিরব হয়ে গেছে,এদিকটাতে আর তেমন কেউ নেই। কলেজের ক্যাম্পাসটা অনেকটা গোলক ধাঁধার মত লাগল তার কাছে। কোন দিক থেকে ঢুকেছেন আর কোন দিক দিয়ে বেরিয়ে যাবেন তা বুঝতে পারছেন না। জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে খুঁজেও পাচ্ছেন না। শেষে ভাবলেন একটু এদিক ওদিক ঘুরে দেখা যাক।
এভাবে ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে একসময় মাহাবুব ইকবালের সাথে এক বয়স্ক লোকের দেখা হয়ে গেল। ভদ্রলোকের কাঁচা পাকা ভ্রু নেড়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী মশাই? কলেজ টাইম তো শেষ। এখন কলেজ বন্ধ হয়ে যাবে। আপনি এই সময়ে এখানে কাকে খুঁজছেন?”
মাহাবুব ইকবাল বললেন, “জি... আমি তো বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এখানে কাউকে চিনি না।”
আরও দুই চার কথা হওয়ার পর মাহাবুব ইকবাল জানলেন এই ভদ্রলোক শ্রীরামপুর কলেজের প্রিন্সিপাল। তার মুখে ঐ বিশেষ মিটিং এর কথা শুনতেই প্রিন্সিপাল দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, “আহা মশাই। আপনাকে বোধ হয় জানানো হয়নি। সেই মিটিং এর স্থানতো পরিবর্তন করা হয়েছে। মিটিংটা এখন হবে কোলকাতার এ.জি.সি বোস রোডের ‘হোটেল সার্কুলার’-এ।"
মাহাবুব ইকবাল হতবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেন।
প্রিন্সিপাল বললেন, “এদের যে কি হয়েছে কে জানে? মিটিং এর সময় ও স্থান পরিবর্তন হয়েছে- এই কথা কাউকেই জানায়নি। বিকেল থেকে অনেক মানুষ এসে এসে ফিরে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে আপনার আগে ফ্রান্সিস বালা নামের এক ভদ্রলোক এসে ফিরে গেছেন।”
মাহাবুব ইকবাল কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। তার সমস্ত আশা কি তবে মাটি হয়ে গেল? মাদার তেরেসার দেখা পাবেন না?
প্রিন্সিপাল অভয়দানের হাসি হেসে বললেন, “চিন্তা করবেন না মশাই। মিটিং আজ নয়, আগামীকাল হবে। তবে ঐ মিটিং ধরতে হলে আপনাকে এক্ষুণি রওনা দিতে হবে। রাতের ট্রেন ধরে কলকাতার হোটেলে ফিরে যেতে হবে, নইলে আপনি সময় মত মিটিং এর আগে পৌঁছুতে পারবেন না যে। তাছাড়া আপনি একা মানুষ, এদিকে প্রায়ই নানান অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে ইদানিং, কাজেই রাত হলে পথে অসুবিধা হতে পারে।”
প্রিন্সিপালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত কলেজ ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে এলো মাহাবুব । প্রধান গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এমন সময় গেটের কাছে এক ব্যক্তির সাথে তার দেখা। লোকটা লম্বা চওড়া, নাকের নিচে মোটা গোঁফ। মাহাবুবকে দেখে ডাকল, “দাদা একটু শুনবেন?”
“জি বলুন।” মাহাবুব ইকবাল জোর করে মুখে একটু হাসি টেনে ধরতে চেষ্টা করল। তার ভয় করছে, দেরি হয়ে যাচ্ছে খুব বেশি।
“দাদা, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। এখানে একটা বিশেষ মিটিং হওয়ার কথা ছিল আজ। এখানে তো কাউকেই দেখছি না। আপনি কি বলতে পারেন মিটিংটা কোথায় হবে?”
মাহাবুব ইকবাল বলল, “ভাই, আপনিও তো দেখছি আমার মত ভুল করে ফেলেছেন। আমিও বাংলাদেশ থেকে এসেছি। মিটিং এর স্থান আর সময় পরিবর্তন হয়েছে ভাই। মিটিংটা হবে আগামিকাল বিকেলে কলকাতার এ.জি. বোস রোডের হোটেল সার্কুলার এ।”
“বলেন কী ভাই?” লোকটার কণ্ঠে রাগ প্রকাশ পেল।“এদের কি কাণ্ড জ্ঞান নেই? আমাদের ব্যাপারটা আগে থেকে জানাবে না? আমরা সেই দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছি মিটিং এ যোগ দেব বলে।”
আরও দুই এক কথায় দুজনের মধ্যে পরিচয় পর্ব হয়ে গেল। মাহাবুব ইকবাল জিজ্ঞেস করে জেনে নিল- গোঁফ ওয়ালা ভদ্রলোকের নাম জাকির হোসেন হাওলাদার, এসেছেন ঢাকার বাড্ডা থেকে। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট এর বিজনেস করেন। পাশাপাশি তিনি একটি মিউচুয়াল ট্রাষ্ট বোর্ডের সভাপতি যারা ইয়াতিম শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য ফান্ড কালেকশন করে। এই জন্যই তাকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে মিটিং এ। কিন্তু আয়োজকদের এমন বেহাল দশার কারণে ভুক্তভোগী সবাই।
দুজনে আর দেরি না করে তখনই শ্রীরামপুর ত্যাগ করল। শ্রীরামপুর থেকে একটা হাতে টানা রিক্সা নিয়ে রেল স্টেশনে চলে আসল। রিক্সার ভাড়া মিটাতে গিয়েই দেখল কলকাতাগামী ট্রেনটি হুইসেল দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। কলকাতার ট্রেন ষ্টেশনে ট্রেন ধরার জন্য ঝেড়ে দৌড় লাগাল দুই বাংলাদেশি। জাকির হোসেন শক্ত সামর্থ মানুষ, বেশ দৌড়-ঝাপ করেছেন জীবনে। অনায়াসেই দৌড়ে গিয়ে ট্রেন ধরে ফেলল সে। কিন্তু মাহাবুবের চর্বি সর্বস্ব শরীরে ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়ান খুব কষ্টের হল। জাকির উঠে গিয়ে এক হাত বাড়িয়ে টান দিয়ে মাহবুবকে ভেতরে উঠিয়ে নিল। লোকটার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল মাহাবুব, এই লোকের সাথে দেখা না হলে হয়ত আজ আর কলকাতার হোটেলে ফেরা হত না তার। কি বিপত্তি ছিল কপালে কে জানে? ট্রেনে ওঠার পর পাশাপাশি দুইটা কম্পার্টমেন্ট দেখে একটার ভেতরে ঢুকে পড়ল দুজন।
কিন্তু ভেতরে ঢুকে তারা তো দেখেন- সর্বনাশ, একি! ভিতরের সবাই তো মহিলা! ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হল না তার কাছে। এই এক কম্পার্টমেন্টে কেবল মহিলাই উঠেছে কেন? ব্যাপারটা কি কাকতালীয় নাকি ইচ্ছেকৃত? যাইহোক,লজ্জা ভেঙে মাহাবুব আস্তে করে গিয়ে একটি মেয়ের পাশের খালি সিট দেখে বসে পড়ল। জাকির হোসেন অবশ্য কম্পার্টমেন্ট এর প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে থাকল। তার লজ্জা কাটছে না।
পাশের আরেকজন মহিলা মাহাবুবকে বলল, “দাদা, আপনারা কি বাংলাদেশের লোক?”
মাহাবুব বলল, “হ্যাঁ।”
মহিলা বলল, “আপনাকে দেখেই বুঝেছি। কারণ আপনি এখানকার নিয়ম কানুন জানেন না।”
“কীসের নিয়মের কথা বলছেন?”
“এখানে পাশাপাশি যে দুটি কমপার্টমেন্ট দেখছেন এগুলো মহিলাদের বসার জন্য। ট্রেন সামনের স্টেশনে গিয়ে থামার পর আপনারা দ্রুত নেমে অন্য একটা কম্পার্টমেন্টে চলে যান। কারণ পুলিশ যদি আপনাকে এখানে দেখতে পায় তাহলে জরিমানা তো করবেই, এমনকি জেলেও চালান করে দিতে পারে।”
কথাটা শুনে ভয়ে সমস্ত শরীরে কাঁপন ধরে গেল মাহাবুবের। ইন্ডিয়ান কয়েদগুলোতে শুনেছেন প্রচুর বাংলাদেশি নাগরিক আটকা পড়ে আছে। তাদের ব্যাপারে কেউ কোন খোঁজ খবরও রাখেনা। ওদিকে মাহাবুবের বেগতিক অবস্থা লক্ষ্য করে জাকির মুচকি মুচকি হাসছে।
সামনের স্টেশনে ট্রেন থামতেই তাড়াতাড়ি নেমে অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়ল দুজন। যেমনিভাবে শ্রীরামপুর গিয়েছিল, ঠিক একইভাবে আবার বিশপস কলেজে ফিরে আসল মাহাবুব। তবে যাওয়ার সময় গিয়েছিল একা, এখন সাথে জাকির আছে। হোটেল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে একটা ট্যাক্সি নিল মাহাবুব আর জাকির।
রাত বাজে নয়টা। ‘হোটেল সার্কুলার’-এ পৌঁছে গেল দুজন ট্যাক্সি নিয়ে। ভেতরে ঢুকে ম্যানেজারের সাথে কথা বলল মাহাবুব। ম্যানেজার তাকে জানালেন যে- এ মুহূর্তে মাদার তেরেসা কোলকাতায় আছেন এবং তাঁর বাসভবন হোটেল থেকে মাত্র দশ মিনিটের পথ পায়ে হেঁটে গেলে।
ম্যানেজারের কাছ থেকে মাহাবুব ইকবাল মাদারের ফোন নাম্বার নিয়ে তক্ষুণি পে- ফোন বুথ থেকে ফোন করল। অপরপ্রান্ত থেকে এক সিস্টার ফোনের রিসিভার উঠাবার সাথে সাথেই সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “সিস্টার আমার নাম মাহাবুব ইকবাল। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি বিশেষ মিটিং এর জন্য। এবং আমি মাদার তেরেসার সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি।”
সিস্টার অতি বিনয়ের সাথে বলল, “জি, আপনি তো মিটিং এ যোগ দিলে মাদারের দেখা পাবেনই। মাদার স্ব শরীরে সেখানে উপস্থিত থাকবেন।”
“কিন্তু সিস্টার আমি মাদারের সাথে একটু আলাদা কথা বলার সুযোগ চাইছি। মিটিং এক’খানেক মানুষের ভিড়ে তো তা সম্ভব নয়।”
সিস্টার বিনয় বজায় রেখে বলল, “আপনি যদি আগামীকাল সকালে গির্জায় আসেন, তবে উপাসনার পর আপনাকে সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে।”
মাহাবুব প্রশ্ন করল, “উপাসনা কখন শুরু হবে?”
উত্তরে সিস্টার বললেন, “সকাল সাতটায়। আপনি যদি উপাসনায় আসেন, তবে সেখানেই মাদারকে দেখতে পাবেন। কারণ তিনিও উপাসনায় থাকবেন।”
কথা না বাড়িয়ে সিস্টারকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোনের রিসিভার রেখে দিল মাহাবুব।
জাকির হোসেন জিজ্ঞেস করল, “তোমার তো দেখি মাদারের সাথে দেখা করার ভালই তাড়া। সকালেই মাদারের সাথে দেখা করা লাগবে? মিটিং এ তো তার দেখা পাচ্ছই।”
সমবয়সী হওয়ার কারণে ইতিমদ্ধে তাদের দুজনের সম্বোধন “তুমি” তে চলে এসেছে। ভাল বন্ধুত্ব হয়েছে দুজনের মাঝে। মাহাবুব বলল, “সে তুমি বুঝবে না বন্ধু।”
দুজনে হোটেল সার্কুলার এ উঠল। দুইবেডের একটা রুম। জাকির তো শুয়েই নাক ডাকা আরম্ভ করল কিন্তু রাতে আর ঘুম হলো না মাহাবুবের, পাছে ছয়টা বেজে যায় সে আশঙ্কায়। কত্ত দিনের স্বপ্ন তার, এক নজর মাদার তেরেসা কে দেখবে।
ভোর চারটায় বিছানা থেকে উঠেই বাথরুমের কাজ সেরে হাল্কা নাস্তা খেয়ে নিল মাহাবুব। কিন্তু বের হওয়ার আগে একটা চিন্তা ঢুকল মাথায়; মাদারকে দেখতে যাবে সে, এতদূর থেকে এসেছে। মাদারের জন্য তো একটা উপহার নিয়ে যাওয়া লাগে। কিন্তু কি উপহার নেবে মাহাবুব? কিছুক্ষণ ভাবতে প্রথমেই মাথায় এল একটা গহনা নিয়ে যাবে মাদারের জন্য। এত কিছু থাকতে গহনা কথা কেন তার মাথায় এল কে জানে? কিন্তু গহনা ভাল- মন্দ সে বুঝে কম। জাকিরকে সঙ্গে নিতে পারলে ভাল হয়।
ভোরবেলাই ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙিয়ে দিল সে জাকিরের। জাকির ঘুমের ঘোরে বলল, কী? ভোর বেলাতেই কী হয়েছে তোমার? ঘাড়ে ভুত চেপেছে? নামাতে হবে?
“আরে ভুত না। আর বড় কিছু চেপেছে”। বলে জাকিরকে একপ্রকার ঠেলেই উঠিয়ে দিল মাহাবুব।
“আরে কি যন্ত্রণা।” উঠে বসে দু হাতে চোখ ডলছে জাকির।
তাগাদা দিল মাহাবুব, “দ্রুত রেডি হয়ে নাও। আমাকে মহিলাদের একটা সুন্দর গহনা কিনে দেবে। তুমি তো এসবের ব্যবসা কর। ভাল মন্দ বুঝবে, আমি খুব একটা ভাল বুঝি না।”
জাকির বলল, গহনা কার জন্য দরকার? বউয়ের জন্য শপিং করে নিয়ে যেতে চাও নাকি? সে তো মিটিং এর পরেও করতে পারবে।
“আরে ধুর পাগল। গহনা তো কিনতে চাচ্ছি মাদারের জন্য।”
এক ঝটকায় ঘুম চলে গেল জাকির চোখ থেকে, “কি বললে? মাদারের জন্য গহনা কিনবে? তবে কি তুমি মাদারকে... ইন্নালিল্লাহ।”
“ফাজলামি করো না তো জাকির। জলদি রেডি হও, খুব একটা সময় নেই। মাদারকে কী উপহার দেয়া যায় চিন্তা করতে করতে মাথায় এটাই প্রথমে এল। ‘কাউকে উপহার দিতে হলে প্রথমেই মাথায় যা দেয়ার চিন্তা আসে, সেটাই দিতে হয়’।- এটা আমার দাদিজান বলতেন।”
অগত্যা আর কি করা? দুজনে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ল গহনার দোকানের খোঁজে। মজার ব্যাপার হচ্ছে কোলকাতার বড়বড় রাস্তার পাশে অনেক জুয়েলারি শপের দোকান দেখা যায়, এদের কিছু কিছু দোকান প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই খোলা থাকে। এখানে কি মধ্যরাতে মানুষের গহনার প্রয়োজন হয় নাকি? অতরাতে গহনার দোকান খুলে রেখে কি লাভ-কে জানে?
মাহাবুব আর জাকির যখন রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছে তখন বাজে ভোর পাঁচটা। একটা নাম করা গহনার দোকানে গিয়ে ঢুকল দুজনে। মাহাবুব জিজ্ঞেস করল, “গহনা কী দেয়া যায় বল তো?”
“উনি তো মনে হয় না নাক বা কানের কিছু পড়বেন”। জাকির একটু থেমে চিন্তা করে বলল, “তুমি ওনাকে গলার কিছু দাও। একটা নেকলেস দিতে পারো।”
গহনার দোকানের সেলসম্যানকে বলা হল কিছু ভাল নেকলেস দেখাতে। লোকটা কিছু নতুন মডেলের নতুন ডিজাইনের নেকলেস বের করল। মাহাবুব বলল, “দেখ তো জাকির কোনটা ভাল লাগে।”
জাকির কিছু বলছে না। তার চোখদুটি নেকলেসগুলোর উপর কেবল ঘুরছে।
“কী হলো জাকির? বল? হাতে সময় নেই রে ভাই। খুব বেশি বাছাইয়ের দরকার নেই”।
জাকিরের চোখ লেগে আছে একটা নেকলেস এর উপরে। চোখ সরাতে পারছে না।
“আরে তুমি কী দেখছ এমন করে?”
“একটা নেকলেস”। বলল জাকির। আঙুল দিয়ে দেখাল। “ঐ যে লাল রঙের পাথরের লকেট বসানো নেকলেসটা... ওটার কথা বলছি। সুন্দর না অনেক?”
“তোমার ভাল লেগেছে? কী মনে হয়? এই গহনাটা দেয়া ভাল হবে?” একাধারে প্রশ্ন করে যাচ্ছে মাহাবুব।
“হুম হবে। জাকির চোখ সরাচ্ছে না, গহনাটা যেন তাকে সম্মোহিত করে রেখেছে।”
জাকিরের পছন্দ অনুযায়ী পছন্দ কওে বড় আকৃতির লাল রঙের রত্ন পাথরের লকেট বসানো নেকলেসটা কিনে নিল মাহাবুব। জাকির ফিরে গেল হোটেল রুমে, এদিকে নেকলেস নিয়ে ছয়টা বাজার পনেরো মিনিট আগেই ৫৪/এ এজিসি বোস রোডের মাদার তেরেসার বাসভবনে উপস্থিত হল মাহাবুব।
গেট দিয়ে ঢুকতেই সে দেখল দুজন সিস্টার দাঁড়িয়ে আছেন। মাহাবুব তাঁদের বলল, “সিস্টার, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। গতকাল বিকেলে এখানকার একজন সিস্টারের সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যদি আজ আমি সকাল ছয়টায় গির্জায় প্রার্থনার সময় আসি তাহলে তিনি আমাকে মাদার তেরেসার সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেবেন।”
সিস্টারদের একজন বললেন, “জি আপনার কথা আমরা জানি। আপনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিশেষ মিটিং এর জন্য। মিটিংয়ে তো মাদার থাকছেন। আপনিতো দেখা করতে পারবেনই।”
“কিন্তু আমি একটু আলাদা করে ওনার সাথে দেখা করতে চাই যে।” মাহাবুব অনুনয় করল।
“সেটা আপনি মিটিং এর পরও করতে পারবেন”।
“সিস্টার প্লিজ একটু দেখুন না, আমার তর সইছে না মাদারের সাথে দু দণ্ড কথা বলার জন্য।”
“ঠিক আছে, আসুন।” বলেই সিস্টার দুজন সিঁড়ি দিয়ে বাবাকে দোতলায় নিয়ে যাচ্ছিল। সিস্টারদ্বয় মাহাবুবকে নিয়ে গেলেন মাদার তেরেসার নিজস্ব চ্যাপেলে। যেখানে তিনি প্রতিদিন অন্যান্য সিস্টারদের নিয়ে ধ্যান প্রার্থনা করতেন। চ্যাপেলের ভিতর ঢুকে মাহাবুব দেখল বেদীর উপরে দেওয়ালে টাঙানো আছে যীশু খ্রিস্টের আর একটি ক্রশবিদ্ধ মূর্তি। সেখানে আশেপাশে নীল পাড়ের সাদা শাড়ি পরিহিত সিস্টারগণ গভীর ধ্যানে মগ্ন। মাহাবুবের একটু ভয় ভয় করতে লাগল। লজ্জাও লাগছে এই ভেবে যে, এমনপুণ্যাত্মা মানুষের মাঝে তার মতো একজন পাপী এসে ঢুকেছে কোন সাহসে?”
সবাই হাঁটু পেতে প্রার্থনা করছে। মাহাবুব দেখল সেখানে কিছু বিদেশী ব্যাক্তিও উপস্থিত আছে। তাদের সাথে একটি বেঞ্চে বসে পড়ল সে।
ছয়টা বাজতে আরও পাঁচ মিনিট বাকি। মাহাবুবের চোখ সমস্ত চ্যাপেলব্যাপী সিস্টারদের উপর। কোথায় মাদার তেরেসা? তাঁকে তো দেখা যাচ্ছে না।
আরও তিন মিনিট কেটে গেল।
ঠিক ছয়টা বাজার এক মিনিট আগে মাদার তেরেসা সিস্টার নির্মলাসহ আরও কয়েকজন সিনিয়র সিস্টারদের নিয়ে চ্যাপেলে প্রবেশ করলেন এবং মাহাবুবরা যেখানে বসেছে সেখান থেকে কাছেই বসলেন।
উপাসনা শুরু হলো। সবাই সুরে সুর মিলিয়ে গান গাচ্ছে, প্রার্থনা করছে। মাহাবুব ইকবাল শাস্ত্র পাঠ শুনছে আর তারই ফাঁকে ফাঁকে প্রাণভরে মাদারকে দেখছে।
উপাসনা শেষ হতেই সকল সিস্টাররা চলে গেলেন। মাদার চ্যাপেল থেকে বের হয়ে তাঁর প্রাইভেট রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিদেশি বেশ কয়েকজন দর্শনার্থীও তাঁর সামনে দাঁড়ালো। এক ব্যক্তিকে দেখা গেল মহা উৎসুক হয়ে মাদারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভদ্রলোক তার নাম বলল, ফ্রান্সিস বালা। ইনিই মাহাবুবের আগে শ্রীরামপুর কলেজে গিয়ে ফিরে এসেছিলেন। বাংলাদেশে একটা মিশনারিতে তিনি কাজ করেন। ফ্রান্সিস নিজের লেখা ও সুর করা ধর্মীয় গানের একটা সিডি উপহার দিলেন মাদারকে।
এমন সময় যে সিস্টাররা মাহাবুবকে সিঁড়ি দিয়ে চ্যাপেলে এনেছিলেন, তাদের একজন মাহাবুবকে মাদারের সামনে আনলেন। মাহাবুব মাদারকে প্রণাম দিয়ে বলল, “মাদার, আমি বাংলাদেশের মানুষ। আপনার স্পর্শ ও আশীর্বাদ নিতে আপনার কাছে এসেছি।”
মাদার অপলক দৃষ্টিতে মাহাবুবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। একটু পরে বললেন, “বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষকে আমি খুব ভালোবাসি। তাই বিভিন্ন সময়ে মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে বেশ কয়েকবারই আমি বাংলাদেশে গিয়েছি। আরও যেতে চাই।"
মাদার মাহাবুবের নাম এবং সে কি করে তা জিজ্ঞেস করলেন। মাহাবুব নিজের কাজ সম্পর্কে সংক্ষেপে বলল। বাংলাদেশি ইয়াতিম শিশুদের পুর্ণবাসন নিয়ে কি পরিকল্পনা করছে তা বুঝিয়ে বলল।
শুনে মাদার ভীষণ খুশি হলেন। মাহাবুবকে আশীর্বাদ দিলেন। কখনও সময় হলে তার ইয়াতিম আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শনে আসবেন বললেন। তারপর মাহাবুব বের করল সেই উপহার। লাল পাঁথরের লকেট বসানো নেকলেস।
মাদার উপহারটা দেখে প্রথমে কিছু বললেন না। দুসেকেন্ড পরে বললেন, “একবার একটি ভিখারি ছেলে তার সারাদিনের ভিক্ষার অর্থ জোরপূর্বক আমায় দিয়েছিল-যাতে সে টাকায় রোগিদের সেবা হয়। এ দান আমার কাছে অনেক বড় দান ছিল। আজ তুমি আমাকে যা দিচ্ছ আমি মনে করি এ দানও অনেক বড় দান। ঈশ্বর তাঁর গৌরবের কাজে তোমায় ব্যবহার করছেন-তুমি আরো কিছু সৃষ্টি করো, এ আশীর্বাদ করি। কিন্তু বাছা, আমি এই দান যে নিতে পারব না।”
“মাদার, না করবেন না। ভক্তের কাছ থেকে এই সামান্য উপহারটুকু গ্রহণ করুন।” মাহাবুব আকুতি জানাল।
“কিন্তু আমি যে গহনা ব্যবহার করিনা বাছা।”
“ব্যবহার করতে হবে না মাদার। আপনার শোয়ার ঘরে এক কোনায় রেখে দেবেন কেবল। তাতেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। মনে করুন ছেলে তার মাকে দিচ্ছে। ছেলেকে ফিরিয়ে দিবেন না মা। আমার মাথায় আপনাকে দেওয়ার মত আর কোন উপহারের কথা আসেনি মাদার। প্রথমেই যা মাথায় এসেছে তাই নিয়ে এসেছি। নিয়ত পরিবর্তন করিনি মাদার।”
মাদার তবুও বললেন, “আমায় ক্ষমা করো বাছা। যে জিনিস আমি ব্যবহার করিনা, তা আমার শোয়ার ঘরে রাখাটা শোভা পায়না। আমি এই উপহার নিতে পারব না।”
“তাহলে অন্য কোথাও রাখবেন মাদার...” মাহাবুব দুহাত জড়ো করে অনুনয় করল।
মাদার না-বোধক মাথা নাড়ল, “আমি দুঃখিত বাছা, তুমি এক কাজ করতে পার। এই হার বিক্রি করে দিও। বিক্রিকৃত অর্থ তুমি তোমার দেশের গরীব দুঃখী মানুষের মাঝে দান করে দিও। এতেই আমি খুশি হব বাছা। দামী উপহার আমায় টানে না, মানুষের মুখের হাসি আমায় টানে...”
“মাদার, প্লিজ মাদার...”
মাহাবুব হয়ত আরও কিছু বলত কিন্তু সেই সুযোগ সে আর পেল না। এক নার্স এসে চিৎকার করতে করতে সব দর্শনার্থীদের সরিয়ে দিতে থাকল। “দয়া করে আপনারা এখন যান। কারণ গত রাতে মাদার একটুও ঘুমাননি। সারারাত তিনি কুষ্ঠাশ্রমে রোগিদের সেবা করেছেন। মাদার এখন খুব ক্লান্ত এবং অনাহারী। তাঁর এখন বিশ্রামের প্রয়োজন আছে...।”
“তারপর কী হলো?” প্রশ্ন করল কবির।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল মিলি। বলল, “বাবা আর মাদার তেরেসার দেখা পাননি। ঐদিন বিকেলে মিটিং হয়েছিল, কিন্তু অসুস্থতার কারণে মাদার মিটিং এ আসতে পারেননি। ঐ মূল্যবান গলার হার পকেটে নিয়ে বাবা মন খারাপ করে দেশে ফিরে আসেন।”
“তারপর?”
মিলি হেসে বলল, “এমন মহিয়সি নারীকে এক বার দেখে কি আর মন ভরে বল? বাবা সেই থেকে চিন্তা করতেন কি করা যায়? শেষে বুদ্ধি করলেন যে একটা মোমের মূর্তি বানাবেন মাদার তেরেসার। দক্ষ কারুশিল্পিদের একটা গোটা টিম ভাড়া করেছিলেন বাবা এই মূর্তি তৈরির জন্য।”
“আর মূর্তির গলায় এই হার? এটা কি ঐ হার যা মাদার তেরেসাকে বাবা উপহার দিতে চেয়েছিলেন?” বলল কবির। আঙুল দিয়ে মাদার তেরেসার মোমের মূর্তির গলায় লাল রঙের পাথরের লকেট বসানো হারটা দেখাল সে।
“হ্যাঁ, এটা ঐ হারই।”
“কিন্তু মোমের তৈরি মূর্তির গলায় আসল হার কেন?” কবিরের কণ্ঠে অবাক হওয়ার সুর। “মূর্তিটা যেহেতু মোমের, হারটাও নিশ্চয়ই মোমের হতে পারত? এত দামী একটা হার মূর্তির গলায় পরিয়ে রাখা হয়েছে কেন? তাছাড়া মাদার তেরেসা তো বলেছিলেন হারটা যেন বিক্রি করে দিয়ে সেই অর্থ গরিবের মাঝে দান করে দেওয়া হয়।”
“বাবা তা করেছিলেন। তবে অন্যভাবে”।
“কীভাবে? একটু বুঝিয়ে বলো না”। কবির অভিমানের ভঙ্গী করল। “তুমি এমন কেন? অর্ধেক কথা বলো, আর বাকি অর্ধেক পেটে রেখে দাও?”
মিলির ঠোঁটে হাসিটা এখনও লেগে আছে, “আসলে বাবা এই হারটা তো কিনেছিলেন মাদার তেরেসাকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু মাদার তেরেসা গহনা ব্যবহার করেন না বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এতে করে বাবার মন খারাপ হয়েছে দেখে মাদার তেরেসা বলেছিলেন ঐ হার বিক্রি করে টাকা দিয়ে গরীবদের উপকার করতে। বাবা অবশ্য ঐ হার বিক্রি করেননি ঠিকই। কিন্তু মাদার তেরেসার কথাও বাবা রেখেছিলেন। হারের মূল্যের সম পরিমান অর্থ দিয়ে তিনি গরীব দুঃখীদের সেবার ব্যয় করেছিলেন। আর হারটা বিক্রি না করে স্থাপন করে দিলেন মোমের মূর্তির গলায়।”
“ওহ, নিঃসন্দেহে চমৎকার বুদ্ধি।” হাততালি দিয়ে উঠল কবির। “সত্যিই দারুণ একটা ঘটনা মিলি! বারবার শুনেও মনে হয় যেন প্রথম শুনলাম।”
সুন্দর করে হাসছে মিলি। নিজেকে সামলে নিতে পেরেছে অনেক খানি। বাবার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে নিজের বর্তমান সমস্যার কথা বেমালুম ভুলে গেছে।
“আফা, আপ্নের ফোন।” বলে মিলির দিকে কর্ডলেস টিএন্ডটি ফোনটা এগিয়ে দিল মিলিদের বাড়ির কাজের মেয়ে শেফালি। এই মেয়েটা কেমন যেন বিড়ালের মত নিঃশব্দে হাঁটা চলা করে। কখন আসে কখন যায় টেরই পাওয়া যায় না।
মিলি আরও কিছু বলতে যেত, কিন্তু থামতে হল তাকে। ফোন হাতে নিয়ে কানে ঠেকিয়ে বলল, “হ্যালো।”
ওপাশ থেকে এক নাগাড়ে কিছু কথা বলে গেল কেউ।
মিলি শুধু হু হা করল কিছুক্ষণ। তারপর ফোন রেখে কবিরের দিকে তাকাল সে। চোখে মুখে ফিরে এসেছে আবার সেই বিষণ্নতা। বলল, “থানায় হাজিরা দেয়ার আদেশ হয়েছে, ওরা নাকি আবার নতুন করে কি সব আমাকে জিজ্ঞেস করতে চায়!”
কবির নিরুপায় হয়ে বসে থাকল। তার আসলে এখানে কিছুই বলার নেই!