(প্রথম পর্বের পর)
পুলিশের কয়েকজন সদস্য দাঁড়িয়ে ছিল হাসপাতালের দরজায়। তারা ওমর সাহেবকে আটকাল। জানাল যে, নাবিলাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খুলে বলল তাকে কীভাবে পাওয়া গেছে। পুলিশের কোনো ক্রেডিট নেই অবশ্য। শহরের কিনারায় এক নদীর কাছে কয়েকজন লোককে দেখে সন্দেহ হয় একজন জেলের। কিছু একটা বয়ে নিয়ে এসেছিল তারা। সেই জেলে জোরে হেঁকে উঠলে তাড়াতাড়ি তারা সেটা ফেলে পালিয়ে যায়।
লোকজন তারপর ঘটনাস্থলে গিয়ে চাদর মোড়ানো একটা দেহ দেখতে পায়। খুলে দেখে এক তরুণীর ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহ। ওরা ভেবেছিল মেয়েটা মৃত। সাথে সাথেই পুলিশে খবর দেয়া হয়। পুলিশ তরুণীকে নাবিলা বলে সনাক্ত করে, তারপর উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
ডাক্তার দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায় ওকে। অপারেশন চলছে এখন। ভালো কিছু শোনার আশা-ভরসা এই কয়দিনে যা ছিল তা দপ করে নিভে গেল ওমর সাহেবের। বসে পড়লেন মেঝেতে। সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্নটাই শেষ পর্যন্ত জ্বলজ্যান্ত বাস্তব হয়ে উঠল!
দুইজন পুলিশ তাকে ধরে ওয়েটিং রুমে নিয়ে বসাল। অজস্র টুকরো টুকরো স্মৃতি এসে ভিড় করছিল ওমর সাহেবের মনে। নাবিলার কথা, হাসি, কান্না, শাসন। কখনো হাসছিলেন, আবার কখনো কাঁদছিলেন তিনি। কেমন একটা ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছেন। যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে। চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নাবিলার হাসি আর বাবা ডাক। তাকে যেন বলছে, ‘পারলে না বাবা। তুমি ব্যর্থ হয়ে গেলে।’
নাবিলা বলে এক চিৎকার দিয়ে বেহুশ হয়ে গেলেন ওমর সাহেব। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলেন হাসপাতালের এক বেডে শোয়া তিনি। তাকে ঘিরে আছে দুইজন পুলিশ আর কয়েকজন লোক, উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে। তিনি বুঝতে পারলেন না, এভাবে দেখার কী আছে! অ্যাপ্রোন পরা একজনকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘নাবিলা কেমন আছে?’ মনে হচ্ছিল, এই লোকটার কাছে উত্তর পাওয়া যাবে।
একটু ইতস্তত করল লোকটা, ‘এখনো জ্ঞান ফেরেনি। আই সি ইউ তে আছে।’
‘আমার মেয়েকে দেখব আমি।’
‘সেটা সম্ভব না। এমনিতেই দেখতে দিতাম না। আর আপনার এই শারীরিক কন্ডিশনে দেখতে দেবার তো প্রশ্নই আসে না।’ বলে চলে যেতে উদ্যত হল অ্যাপ্রোনধারী।
‘আমার মেয়ে ভালো হয়ে যাবে তো ডাক্তার?’
‘ওপরওয়ালার কাছে দোয়া করুন,’ তার দিকে না তাকিয়ে বলল সে।
ওমর সাহেবকে পাক্কা সাত ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো নিজের মেয়েকে দেখার অনুমতি পেতে। নাবিলার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি এখনো। দরজা ঠেলে আস্তে করে নাবিলার কেবিনে প্রবেশ করলেন তিনি।
ভেতরটা দেখে বোঝা যাচ্ছে যত্ন-আত্তির কোনো ত্রুটি করা হয়নি তার। বেডের চারপাশে বিভিন্ন মেডিক্যাল এপারাটাস। অপরিচিত সেই যন্ত্রগুলোর মনিটরে বিভিন্ন ধরনের সংখ্যা আর গ্রাফ দেখা যাচ্ছে।
সাদা একটা চাদরে গলা পর্যন্ত ঢাকা নাবিলার। চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ করে আছে। চাদরের নিচ থেকে একটা ক্যানুলা করা হাত বেরিয়ে আছে, সংযুক্ত নলের আরেক প্রান্তে স্যালাইন ব্যাগ।
জন্মের পর থেকে একদিনের জন্যও যে মেয়েকে চোখের আড়াল করেননি, আজ সেই মেয়েকে চারদিন পর এই অবস্থায় দেখে ওমর সাহেবের মনের অবস্থা কেমন হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। ধীরে ধীরে মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন তিনি। ঠোঁটের কোনায় আর চোখের নিচে কালশিটে দাগ দেখতে পেলেন। পাশবিক অত্যাচারের চিহ্ন।
ডাক্তারের সাথে কথা হয়েছে তার। জানেন যে নাবিলার সারা দেহে এরকম এবং এর থেকে খারাপ আরও অজস্র চিহ্ন রয়েছে। ডাক্তার সরাসরিই বলেছে তাকে। অনেক বার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে নাবিলা, সাথে শারীরিক অত্যাচার।
অনুভূতিশক্তি আরও অনেক আগেই লোপ পেয়েছে ওমর সাহেবের। দুঃখ-কষ্ট-রাগ কিছুই অনুভব করতে পারছেন না তিনি। শুধু কয়েকটা কথাই বারবার ঘুরেফিরে মনের মধ্যে আসছে। কতটা মানসিক আর শারীরিক কষ্টের মধ্য দিয়ে গত কয়েকটা দিন পার করেছে তার আদরের মেয়েটা।
বদ্ধ ঘরে না জানি কতবার বাবা বাবা বলে চিৎকার করেছে! না জানি কতবার অনুনয় বিনয় করেছে তার অত্যাচারকারী কে তাকে ছেড়ে দেবার জন্য। যৌন নির্যাতনের সময় না জানি কতটা ঘৃণায় শরীরটা কুঁকড়ে উঠেছে ওর!
মেয়ের কপালে একটা হাত রাখলেন ওমর সাহেব। চোখ খুলল নাবিলা। আস্তে আস্তে ঘুরে বাবার দিকে তাকাল। মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বুক কেঁপে উঠল বাবার। ওই চোখগুলো তিনি চেনেন না! তার চিরচেনা মেয়ে নয় সামনের ওই চোখধারী নাবিলা!
এই কয়দিনে অনেক কিছু দেখে ফেলেছে ওই চোখ যা সারা জীবনে কোনদিন দেখেনি আর দেখার কথাও ছিল না। মেয়ের দৃষ্টিটা সহ্য করতে পারলেন না তিনি। ফিরিয়ে নিলেন নিজের চোখ।
‘বাবা,’ মলিন কণ্ঠে বলল নাবিলা।
‘কী মা?’
‘কোথায় ছিলে তুমি?’
ছাত্রজীবনে একসময় ব্রিলিয়ান্ট হিসেবে খ্যাতি ছিল ওমর সাহেবের। জীবনে অনেক কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর অবলীলায় লিখে এসেছেন উত্তরপত্রে। কিন্তু আজ মেয়ের এই ছোট আর জানা উত্তরের সামনে হেরে গেলেন তিনি। উত্তরপত্র সাদা রয়ে গেল। জীবন খাতায় যেন শুন্যই পেলেন তিনি।
‘কতবার তোমাকে ডাকলাম,’ নিচুস্বরে বলে চলেছে নাবিলা, ‘তুমি সাড়াও দিলে না।’ চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল তার। এই পৃথিবীতে সে আর নেই যেন। মনের মাঝে নতুন যে অন্ধকার পৃথিবীর নষ্টজন্ম হয়েছে, তার অন্ধকারে নিজেকে লুকিয়ে অজানা এক পথে ভ্রমন করছে সে। এই পৃথিবীর সুর্য আর ফ্লুরোসেন্ট-নিয়নের আলোয় নিজেকে নগ্ন মনে হচ্ছে।
মুখ ঘুরিয়ে আবার শুয়ে রইল সে। রাতে ডাক্তারের অনুমতিক্রমে নাবিলার জবানবন্দী টুকে নিল পুলিশ। সেই বখাটে ছেলে রনিই তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল আরও কয়েকজন বন্ধুর সহায়তায়। এক রুমে তাকে আটকে রেখে নির্যাতন চালায় সে। রাগে পাগল হয়ে গিয়েছিল রনি তাকে লাথি মারার জন্য।
কেউ যেন তাকে সন্দেহ না করে তাই ঘটনাটার পর চুপ করে ছিল সে। এমনকি নাবিলাকে তুলে নেবার সময় নিজে ছিল না । শক্ত একটা এলিবাই তৈরি করেছিল সে বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিয়ে। কারণ তাকে যে সন্দেহের তালিকায় প্রথমে রাখা হবে বুঝে গিয়েছিল।
পুলিশ এরপর আর দেরি করল না। রনিকে গ্রেফতারের জন্য বেরিয়ে গেল। বাসায় তাকে না পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় খবর নিয়ে এক বস্তি থেকে পরেরদিন তাকে গ্রেফতার করল পুলিশ। ওমর সাহেবের ওদিকে মন নেই এখন। তিনি এখন নাবিলাকে নিয়ে ব্যস্ত। বাসা আর হাসপাতাল করেই দিন কাটছে তার। খাবার নিয়ে আসেন বাসা থেকে। নিজ হাতে খাইয়ে দেন, যদিও খেতে চায় না নাবিলা। কথাও একদম বলে না বললেই চলে।
একদিন বিকেলে মেয়ের কেবিনে কিছু খাবার নিয়ে ঢুকলেন ওমর সাহেব। ওর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি এই কয়দিনে। বেডের পাশে খাবারগুলো রেখে কেবিনের পশ্চিম দিকের জানালা খুলে দিলেন তিনি।
‘দ্যাখ মা, আকাশটা কি সুন্দর আবির রঙের মেঘে ছেয়ে গেছে! তোর খুব পছন্দের এই রকম বিকেল,’ নিজের মনে বলে চলেছেন তিনি। ‘মনে নেই, এইরকম বিকেলে আমাকে বলতি ছাদে যেতে আর তুই চা বানিয়ে নিয়ে আসতি দুজনে মিলে খাব বলে। আমাকে মিষ্টি বিস্কিট খেতে দিতি না। তুই খেলে আমারও খেতে ইচ্ছা হতে পারে বিধায় তুইও ডায়া বিস্কিট খাইতি।’
আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল নাবিলা। ‘আমার আকাশে এখন শুধু কালো রঙ বাবা। আবির রঙের মেঘ দিয়ে কী হবে!’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ওমর সাহেব। নাবিলা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে চাইছে না। তার বেডে এসে বসলেন তিনি। ‘রনিকে জেলে চালান দেয়া হয়েছে।’ বললেন তিনি মেয়েকে। ‘কিছুদিনের মধ্যেই বিচার শুরু হবে। উকিল ঠিক করেছি ভালো একজন।’
কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না মেয়ের। ‘কিছু বল মা,’ তিনি বললেন।
মেয়ের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। নাবিলা বলল, ‘জীবনে মাত্র দুইজন পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেছে। কিন্তু কত পার্থক্য তাদের ভেতর, তাই না বাবা? একজন পৃথিবীর সব সুখ এনে দিল আমাকে আর আরেকজন সবটুকু নিয়ে গেল আমার কাছ থেকে।’
‘উপযুক্ত বিচার হবে ওর, দেখিস তুই’, টলমল চোখে বলল ওমর সাহেব।
‘কিন্তু আমার কী হবে বাবা? আমি আর কোনোদিন স্বাভাবিক হতে পারব না। গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতাকে দুঃস্বপ্ন বলে ভুলে থাকতে পারব না। প্রতি মুহূর্তে আমাকে কুরে কুরে খাবে ওগুলো। দেখেছ মানুষের মন কি জিনিস! তোমার দেয়া এত বছরের আদর-স্নেহের স্মৃতিগুলো মাত্র তিনদিনের নিচে চাপা পড়ে গেল। কী আশ্চর্য!’
‘সব ঠিক হয়ে যাবে মা।’
‘কিছুই ঠিক হবে না। আমি স্বার্থপর হয়ে গেছি বাবা। অনেক স্বার্থপর! শুধু নিজের কথাই চিন্তা করছি এখন। তোমার কথা চিন্তা করছি না যে, আমাকে হারালে তুমি কী নিয়ে বাঁচবে। আমার এই অবস্থা থেকে সেরে উঠতে অনেক ইচ্ছাশক্তির দরকার, কিন্তু আর কোনো ইচ্ছাশক্তিই যে অবশিষ্ট নেই আমার। সব হারিয়ে ফেলেছি। শুধু নিচের দিকেই তলিয়ে যাচ্ছি আমি।
তোমার দোহাই লাগে বাবা, আমাকে টেনে রেখ না। তোমার স্বার্থপর মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। আমাকে মরে গিয়ে বাঁচতে দাও, বাঁচাতে গিয়ে মেরে ফেল না।’ বাবার গলা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল নাবিলা।
‘তোমার সাথে আরও অনেক দিন বাঁচার ইচ্ছা ছিল, বাবা।,’ কাঁদতে কাঁদতে ফিসফিস করে বলতে লাগল নাবিলা। ‘অনেক কিছু দেখার বাকি ছিল জীবনের। কিন্তু এই অন্ধ চোখ দিয়ে আর কিছুই দেখতে পাব না আমি। তোমাকেই ঝাপসা লাগছে এখন। মাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। কী সুন্দর সাদা পোশাক পরে থাকে সবসময়। আমাকে কাছে ডাকে শুধু। আমি মায়ের কাছে যাব। আমাকে মায়ের কাছে যেতে দাও, বাবা। প্লিজ।’
নাবিলাকে ওষুধ খাওয়াতে এক নার্স এসেছিল। বাবা আর মেয়ের এই কথোপকথন শুনে চোখ মুছে নীরবে বেরিয়ে গেল। সেদিন রাতের দিকে নাবিলার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে লাগল। কেবিন থেকে ওমর সাহেবকে বের করে দিল ডাক্তার। বাইরে দাঁড়িয়ে গ্লাস লাগানো দরজা দিয়ে ভেতরের সব কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল তার সামনে সব কিছু কেমন ধীরে ধীরে নড়ছিল। নাবিলাকে ঘিরে পাঁচজন মানুষ তার জীবন বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। একজন ডাক্তার ডিফিব্রিলেটর দিয়ে বারবার বুকে চাপ দিচ্ছিল আর নাবিলার সারা শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠছিল। কিন্তু যার নিজেরই বাঁচার কোনো ইচ্ছা নেই, তাকে আটকাবে কে!
ডাক্তারের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নাবিলা চলে গেল। যমে মানুষে টানাটানিতে অবশেষে মানুষের পরাজয় ঘটল। ওমর সাহেব মেয়ের মৃত্যুতে আর নতুন করে কাঁদলেন না। অল্প সময়ের ভেতর অনেক কিছু বুঝতে পেরেছেন যেন তিনি।
কোথায় যেন শুনেছিলেন, ÔDeath is just another path, one that we all must take.’ নাবিলা এখন সেই পথের যাত্রী। নিজের ইচ্ছাতেই সে যাত্রী হয়েছে এই পথের। তার মা দাঁড়িয়ে আছে সেই পথের শেষ মাথায় তার অপেক্ষায়। হয়ত এতক্ষণে সে খুঁজে পেয়েছে তার মাকে। খুঁজে পেয়েছে তার হারিয়ে যাওয়া কোল!
নাবিলাকে সমাহিত করার সকল কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করলেন ওমর সাহেব। পিতামাতার কাছে সবচেয়ে ভারী নাকি নিজের কাঁধে সন্তানের লাশ। কিন্তু তার সেরকম মনে হলো না কেন জানি। নিজের ছোট বাড়িটার আঙিনায় মায়ের কবরের পাশেই কবর দিলেন মেয়েকে। সাদা কাফনের মোড়কে আবৃত হয়ে কবরের অন্ধকারে রয়ে গেল সাদা মনের মেয়েটা।
ওমর সাহেবের এখন একটাই চিন্তা। তার মেয়ের যারা এই অবস্থা করেছে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা। কিন্তু এখানে তিনি বড় একটা ধাক্কা খেলেন। পুলিশে গ্রেফতার করা এক জিনিস আর কোর্ট যে আলাদা জিনিস তা বুঝলেন নতুন করে।
রনির বাবা প্রচুর টাকা দিয়ে ডাকসাইটে এক উকিল ভাড়া করেছে। কোর্টে মাত্র কয়েকটা কথা বলে ব্যাপারটাকে প্রায় নিজের পক্ষে নিয়ে নিল সে। ভিক্টিম এর জবানবন্দী অনুযায়ী রনি অপরাধী। কিন্তু এবার যুক্তি আর প্রমানের ওপর নির্ভর করছে শাস্তি।
নাবিলাকে কোথায় আটকে রাখা হয়েছিল জানত না সে। কাজেই পুলিশ সেই জায়গা খুঁজে পেল না। রনিরা পুরোপুরি অস্বীকার করল নাবিলাকে অপহরণের ঘটনা। বলল হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছে তাদের নামে। অনেকে সাক্ষ্য দিল ঘটনার কয়েকদিন রনি বাড়িতেই ছিল।
নাবিলার শরীরে কোনো আলামত পাওয়া যায়নি, যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় রনি অপরাধী। স্পার্ম কিংবা ফিঙ্গারপ্রিন্ট কিছুই না। খুব সাবধানে কাজটা করা হয়েছে। প্রমাণের অভাবে ধোপে টিকল না ভিক্টিম-এর জবানবন্দী আর তার পিতার সন্দেহ। বিচারক জামিন মঞ্জুর করলেন অপরাধীদের। কোর্ট সন্তান হারানো পিতার মন বোঝে না, প্রমাণ খোঁজে।
এবার একরাশ হতাশা আর দুঃখ ছেঁকে ধরল ওমর সাহেবকে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে তার মেয়ের অত্যাচারকারীরা। এমনকি হুমকিও পেলেন তিনি কেস তুলে নেবার। কয়েকদিন থানা আর কোর্ট দৌড়াদৌড়ি করে ক্ষান্ত দিলেন তিনি। উপলব্ধি করতে পারলেন রুঢ় সত্যটা। তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ীরা সাজা না পেলে থানা বা কোর্টের কারও কিচ্ছু আসবে কিংবা যাবে না।
রাতে এখন তিনি শুয়ে শুয়ে ভাবেন, তবে কি নাবিলার মৃত্যু বৃথা যাবে? এত ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে যার মৃত্যু হয়েছে তার অপরাধীদের কিছুই হবে না? তাহলে তো পিতা হিসেবে তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না কোনোদিন।
মেয়েকে বখাটে ছেলেদের কাছ থেকে রক্ষা করতে পারেননি তিনি, এবার যদি তাদের শাস্তিরও ব্যবস্থা করতে না পারেন, তাহলে তিনি কেমন বাবা? তিনি অনেক কথাই ভাবলেন মনে মনে। তারপর ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব করে একটা সিদ্ধান্ত নিলেন।
ভালো হয়ে থাকার দিন শেষ! যার জন্য ভালো হয়ে গিয়েছিলেন এবং যাকে নিয়ে ভালো ছিলেন তাদের দুইজনের কেউই নেই এখন। বাস্তবতা যদি তাকে ইট ছুঁড়ে মারে, তবে তার দিকে পাটকেল ছুঁড়ে মারার সক্ষমতা তার আছে, কিন্তু সেপথে তিনি হাঁটতে চাননি। এখন হাঁটতে হবে তার। অনেক কাজ পড়ে আছে সামনে।
(পড়ুন তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব)