এক
সত্তর দশকের গোড়ার দিকে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের হোস্টেলে থেকে বিএসসি পড়ার সময় গরুর গোশত খাওয়া নিয়ে বদরের সাথে আমার গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। বদরের পুরো নাম বদরুদ্দিন ওমর। বাড়ি মেহেরপুরের মুজিবনগরের কাছে বর্ডার ঘেঁষা হৃদয়পুর গ্রামে। হৃদয়পুরের আদ্দেক বাংলাদেশে, বাকিটা ব্রহ্মনগরের কাছে ভারতে। যাহোক, ঘটনাটা বলি।
ইংরেজি ‘এইচ’ অক্ষরের মতো দোতলা হোস্টেলের উত্তর-দক্ষিণ লম্বা দু’টো উইংয়ে ওপর-নিচ মিলিয়ে মোট শ’দেড়েক ছাত্র থাকার ব্যবস্থা। সামনে পোয়া-মাইল লম্বা খেলার মাঠ, একপাশে ইয়া বড় পুকুর, মসজিদ, আর ফিজিক্স- কেমেস্ট্রি ল্যাবের সাথে প্রশাসনিক ভবন। সকাল ন’টা থেকে থিয়োরি ক্লাস শুরু, ল্যাব দুপুরের পর। সব শেষ করে হোস্টেলে ফিরতে ফিরতে বিকেল।
বেলা বারোটায় রান্না করা ভাত-তরকারি, ডাল-ভাজি ততক্ষণে হিম ঠাণ্ডা। স্বাধীনতার পরপর সব জিনিস আকড়া। ঠিকমতো পাওয়া যায় না কোনকিছুই। যা-তা ধরনের রান্না। গরম খাবার-ই মুখে রোচে না, তার ওপর ঠাণ্ডা! ফল হলো এই, মাস খানেকের ভেতর রোগ বাধিয়ে ফেললাম। শিগেলা ধরনের কঠিন আমাশা। মলদ্বারে অসহ্য ব্যথা, ঘন ঘন বাহ্যি। উইংয়ের একেবারে শেষ মাথায় বাথরুম। হেঁটে যেতে যেতে ভগবানের নাম স্মরণ করতে হয় শতবার। হে ঈশ্বর, গন্তব্য অব্দি ধরে রাখার শক্তিটুকু দাও!
আমাশা’র প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু হলো হোস্টেলের নাইট গার্ড খালেক মিয়াকে দিয়ে। বাথরুমে যেতে হতো বদনা নিয়ে। করিডোর দিয়ে পুরো পথ বদনা হাতে হেঁটে যাওয়া দৃষ্টিকটু। এই জিনিস থাকার কথা শৌচাগারে। সেই চেষ্টা বেশ ক’বার করাও হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে দু’দিনের মাথায় বদনা উধাও।
বদনা নামক বাসনটার ব্যবহার শৌচাগারেই সীমাবদ্ধ এ কথা ঠিক, কিন্তু গুরুত্ব সীমাহীন। ঝুঁকি এড়ানোর জন্যে প্রত্যেক ছাত্রেরই একটা করে নিজস্ব বদনা আছে। যাহোক, রাত-বিরেতে আমাকে বদনা হাতে হেঁটে যেতে দেখে নৈশ প্রহরী খালেকই প্রথম কৌতূহলী হলো। নিদেন-ও দিল সে-ই। থানকুনির লকলকে সবুজ পাতা ছেঁচে আখের গুড় মিশিয়ে সেই রস পান। ফলও কিছুটা পাওয়া গেল। তবে এক সপ্তাহ পর যে কে সেই।
কলেজ থেকে মাইলটাক দূরে লালন শাহ মাজারের কাছে রাজার হাট। হাটে নবীন মাধব ডাক্তারের চাঁদসী ক্ষত চিকিৎসালয়। পরবর্তী চিকিৎসাটা করালাম এই নবীন মাধবকে দিয়ে। কাগজের দাগকাটা কাঁচের শিশিতে লাল রঙের ওষুধ। কোন উপকার পেলাম না, মাঝখান থেকে বেরিয়ে গেল দু’টাকা বারো আনা।
এরপর গেলাম সুকুমার কুণ্ডু এমবিবিএস’র কাছে। মল-মূত্র-রক্ত পরীক্ষা, এন্টিবায়োটিক চলল।
ফলাফল একই। রোগ আছে রোগের জা’গাতেই। দিনে দিনে আমি কাঁকলাস। চল-টল ভেঙে ন্যাড়া মাথা সুরেণ মুচি।
মাথায় উঠল পড়াশুনা। আমার পাশের রুমেই মেস ম্যানেজার বদর থাকে। হাই-হ্যালো সম্পর্ক। মাস-কাবারি টাকা দিতে হয় তার হাতে।
বদর দেখল আমি দিনের পর দিন মেসে অনুপস্থিত। খাবার পড়ে থাকছে টেবিলেই। ছুঁয়েও দেখছি না। একদিন জিজ্ঞেস করল, 'দাদা। মেসে খাবার খাচ্ছেন না যে। সমস্যা কী? টাকা তো ফেরত পাবেন না!'
'পেটের অসুখে ভুগছি ভাই। মেসে যাওয়া সম্ভব না। দু’বেলা শুধু খাই। তা-ও দই-চিঁড়ে।'
'অসুখটা কী?'
'আমাশা।'
'কতদিন হলো?'
'তা দু’মাস তো বটেই।'
'চিকিৎসা করাননি?'
'কবিরাজি, চাঁদসি, এ্যালাপেথি─সবই করিয়েছি। কিছুতেই ভালো হচ্ছে না।'
'শরীরটা তো একেবারে গেছে মনে হচ্ছে!'
'কী আর করব বলেন। চেষ্টা তো কম করলাম না।'
'বাড়ি থেকে না হয় একবার ঘুরে আসতেন?'
'সামনেই ষান্মাসিক পরীক্ষা। পুরোদমে ল্যাব চলছে। কেমেস্ট্রির তাহের স্যার আর ফিজিক্সের তৈয়ব বিদ্যাসাগরী স্টাইলের অধ্যাপক। পাঠদান এঁদের কাছে ধর্মচর্চার মতো। পড়া আদায়ে বদ্ধপরিকর। এখন বাড়ি গেলে নির্ঘাত ফেল হবে।'
'ভালো ঝামেলায় পড়েছেন দেখছি। সুপারকে জানিয়েছেন আপানার অসুখের কথা?'
'সুপার স্যারের সাথে আমার তেমন যোগাযোগ নেই। রাশভারী মানুষ। তাঁর সামনে যেনো না পড়ি সেই প্রচেষ্টা থাকে সব সময়।'
'আচ্ছা, ঠিক আছে। স্যারের সাথে আলাপ করে দেখি কী বলেন। জ্ঞানী লোক। কিছু একটা বুদ্ধি বাতলে দিতে পারবেন। '
দুই
পরদিন ছিল রোববার। কলেজ বন্ধ। বেলা এগারটার দিকে প্র্যাকটিক্যাল খাতায় চিত্রাঙ্কন করছি এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে আমার রুমে বদর এসে হাজির। বললাম, 'বদর ভাই যে! আসেন আসেন।'
'দাদা, আসা-আসি বাদ দেন এখন। চলেন আমার সাথে। সুপার স্যার ডেকে পাঠিয়েছেন। জরুরি।'
'দাঁড়ান একটু। প্যান্ট-শার্ট পরে নেই।'
'আরে রাখেন প্যান্ট-শার্ট। গেঞ্জি-পা’জামাতেই চলবে।'
'আরে নাহ্। তা কী করে হয়! দাঁড়ান, আলনা থেকে একটা শার্ট অন্তত নেই। হেঁটে যেতে যেতে পরে ফেলা যাবে।'
সুপারের বাসা হোস্টেলের পাশেই। মাজা সমান উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বড় আঙিনাওয়ালা বাড়ি। তিনফুটি মোরাম বিছানো রাস্তার দু’পাশের বাগানে জবা আর কলাবতি ফুলের ঝাড়। বাড়ির সামনে চওড়া গাড়ি বারান্দা।
এই বাসা পাকিস্তান সরকার বানিয়েছিল বিদেশি অধ্যাপকদের জন্যে। এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের অধীনে এদেশের নানান কলেজে তাঁদের এসে পড়ানোর কথা। বিদেশি শিক্ষকরা আসেননি। সেই দালান এখন সুপারের বাসভবন।
বারান্দার সামনে শানের ওপর কলাপাতা বিছানো। তেঁতুল কাঠের খেটো নিয়ে ঘাড়ে গামছাওয়ালা মাঝবয়েসি মোটা মতন একটা লোক বসে আছে। হাতে দাঁড়াশ।
খেটোর একপাশে হাঁটুর নিচ থেকে কাটা গরুর চারটে পা। অন্যপাশে কালো রঙের মাথা। ছোট ছোট শিং, নীলচে আধ বোজা চোখ, দাঁতের ফাঁকে ইঞ্চিখানেক বেগুনি রঙের জিব বেরিয়ে আছে। কলাপাতার এখানে সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত, হাড়ের টুকরো। মাংস প্রায় নেই বললেই চলে।
তিন সিঁড়ি ওপরে টানা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন সুপার। বদর সোজা স্যারের কাছে গিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল। বলল, 'স্যার এর নাম অমিত আঢ্য। বিএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। শৈলকুপা বাড়ি। হোস্টেলে থাকে। এর কথাই বলেছি আপনাকে।'
আগেই বলেছি হোস্টেল সুপার আব্দুল মজিদ স্যার রাশভারী মানুষ। ঝাড়া ছয়ফুট লম্বা, টকটকে ফর্সা। পশ্চিমা ধাঁচের চেহারা। কণ্ঠস্বর শুনলে মনে হয় আষাঢ়ে মেঘ ডাকছে। ফিলসফির ডাকসাইটে প্রফেসর। ইনি কেন যে দর্শন শাস্ত্র পড়াতে এসছেন কে জানে? সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেই বেশি মানাতো।
চোখ তুলে আমাকে দেখলেন স্যার। বললেন, 'অমিত। তুমি নাকি দুরারোগ্য আমাশায় ভুগছ? ওষুধ-পত্রে কাজ হচ্ছে না!'
'জ্বি স্যার।'
'আমাশার বহু পুরনো এক ওষুধের কথা জানি। অনেকেই নাকি উপকার পেয়েছি। তবে সবই শোনা কথা। নিজে কখনও পরীক্ষা করে দেখিনি। আসলে প্রয়োজনই হয়নি। চাইলে চেষ্টা করে দেখতে পারো।
'আপনি বললে অবশ্যই করব স্যার।'
'গতানুগতিক কোন ওষুধ না এটা। ব্যবহারের আগে ভালো মতো ভেবে দেখতে হবে তোমাকে।'
'ওষুধটা কী স্যার?'
'গরুর মাংস খেতে হবে। এমনিতে ব্যাপার কিছুই না। তবে তোমাদের ধর্মে গো-মাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ। সমস্যাটা ওখানেই। ওষুধ হিসেবে খাওয়া যায় কিনা ভেবে দেখতে পারো।'
'স্যার, ধরা যাক মাংস খেলাম। কিন্তু তাতে যে রোগ ভালো হবে সেই নিশ্চয়তা কোথায়? এসব গুরুপাক খাবার। চর্বি, মশলা, তেলে বোঝায়। রোগ দমন করতে যেয়ে সম্প্রসারণের সম্ভাবনাই বেশি!
'ঘটনা ওখানেই। বিষে বিষক্ষয়। প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে এতে কাজ হয় বলে শুনেছি। এখানে সের খানেক মাংস বাঁচিয়ে রেখেছি। আগে থেকে টাকা দিয়ে রেখেছিল লোকে। প্রায় সবই বিলি-বন্টন হয়ে গেছে। গরু জবাই হয় কালে-ভদ্রে। আবার কবে হবে কে জানে? বদরের কথা শুনে মনে হলো তোমার কাজে লাগতে পারে। কালো রঙের বকনা, চর্বি বোঝাই। ওষুধ হিসেবে এর মাংস আদর্শ। দেখো, কী করবে এখন?'
তিন
স্যারের কথা ফেলতে পারলাম, হাজার হলেও শিক্ষাগুরু।
বদর আমাকে কাঁচা মাংস ধরতেই দিল না। নিজ থেকেই বয়ে এনে মেসের বাবুর্চিকে দিয়ে তেল-মশলা দিয়ে কষিয়ে রাঁধাল।
খাওয়া হলো বদরের রুমে। আমার রুমের চারজন ছাত্রই হিন্দু। তারা যদি জানতে পারে, ধুন্ধুমার লেগে যাবে।
চিনামাটির গামলায় টকটকে মাংস।
বদরের প্লেটে ভাত, আমার প্লেট খালি। বদর বলল, 'দাদা। স্যার বলেছেন ঠেসে মাংস খেতে। ভাত খেয়ে পেট বোঝাই করার কোন মানে হয় না। মনে রাখতে হবে এটা আসলে ওষুধ। আনন্দ-ফুর্তির খাওয়া না। নেন, শুরু করেন। পেট না ভরা পর্যন্ত খেয়ে যাবেন।'
গো-মাংস আমার তিনকূলে কেউ কখনও খায়নি। প্রথম দিকে গা গুলিয়ে উঠলেও, খেয়ে বুঝলাম এর স্বাদের কোন তুলনা নেই। মনে মনে গো-মাংস খাওয়ার ইচ্ছে বহুদিনের। এইবার সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, দান মেরে নেই। বেশিরভাগ আমিই খেলাম, বদর সামান্য।
মাংস খেয়ে রুমে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি। খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে। না গরম, না ঠাণ্ডা আবহাওয়া। ঘুমে ঢলে পড়ল চোখের পাতা।
ঘুম ভাঙল বিকেল পাঁচটার দিকে। পেটের ভেতর বাঁদর নাচছে। ভুট-ভাট শব্দ। পেছন ফেরা অতি জরুরি। বদনা হাতে বাথরুমে ছুটলাম।
বসা মাত্র চক্কর দিয়ে উঠল মাথার ভেতর। মনে হলো অনন্ত কাল ধরে বসে আছি। একেবারে খালি হয়ে গেল পেট। এমন দুর্বল লাগল, খাড়া হয়ে উঠতেই পারি না। ধুঁকতে ধুঁকতে রুমে ফিরে, জল খেয়ে, শুয়ে পড়লাম বিছানায়। এক ঘণ্টা পর আবারও আগের মতো। এভাবে চলল পরপর তিনবার। শেষমেশ মিশে গেলাম বিছানার সাথে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
একেবারে ভোরে উঠলাম। চনমন করছে শরীর। ব্যথা-বেদনা নেই, নেই অস্বস্তি। খেলার মাঠে আধ-ঘণ্টা হেঁটে, পুকুরে স্নান করে, রুমে ফিরে চিঁড়ে ভিজিয়ে আখের গুড় দিয়ে খেলাম। এরপর গেলাম ক্লাসে। বহুদিন পর অনুভব করলাম পূর্ণ সুস্থতা! এর পর থেকেই বদরের সাথে আমার খাতির হলো গলায় গলায়। আপনি থেকে তুমিতে নেমে গেল পারস্পারিক সম্বোধন।
চার
এইবার রমজান আর গরমের ছুটি পড়ল একসাথে। তিনদিন পরেই বাড়ি ফিরব। আর একটা মাত্র পরীক্ষা বাকি।
সারাদিন পড়াশুনা করে বিকেলের দিকে বদরকে নিয়ে গড়াইয়ের ধারে হাঁটতে যাওয়া নিত্য দিনের অভ্যেস।
কাপড়-চোপড় পরে বদরের রুমে গিয়ে দেখি বিছানায় শুয়ে আছে বদর। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। বিষয় কী? বাঁ হাতে মাঝের আঙুলের ডগায় অসহনীয় ব্যথা। সারাক্ষণ টনটন করে, থেকে থেকে বিজলীর ঝলক। বললাম, 'বদর। একে বলে আঙুলহারা। ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে হবে। এমনিতে সারবে না।'
'চিকিৎসা করাতে হলে, এমবিবিএস ডাক্তার দিয়ে করাতে চাই। আছে নাকি তোমার পরিচিত কেউ?'
'আছে একজন, সুকুমার কুণ্ডু। চলো যাই একবার। সন্ধ্যের দিকে চেম্বারে অবশ্যই পাওয়া যাবে।'
আঙুল দেখে সুকুমার কুণ্ডু বলল, 'আঙুলহারা হচ্ছে আঙুলের ডগায় মাংসের নিচে এক ধরনের সংক্রমণ। ভীষণ কষ্টদায়ী অসুখ─ব্যথা, পুঁজ, জিলকানি এর অনুসঙ্গ। অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সারাতে হয়। এতে ভালো না হলে সার্জারি!'
পাঁচ
পাঁচ দিনের এন্টিবায়োটিক ডোজ দিয়ে শুরু করল বদর। খোঁজ-খবর নেই প্রতিদিন। খাওয়ায় রুচি নেই, ঘুসঘুসে জ্বর, অবশ পুরো হাত।
কী করব বুঝতে পারছি না। এ অবস্থায় তাকে ফেলে বাড়ি যাওয়া সম্ভব না।
ওদিকে খালি হতে শুরু করেছে হোস্টেল। ট্রাঙ্ক বোঝাই বই-খাতা নিয়ে দলে দলে হৈ হৈ করে বাড়ি ফিরছে ছেলেরা। তাদের ধারণা বাড়ি গিয়ে জমিয়ে পড়বে। সত্যি হলো এই, ঐ ট্রাঙ্কের একটা বইও খোলা হবে না কখনও! কষ্ট করে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ায় হবে শুধু। না নিলে মনে হবে, আহা বই আনলাম না কেন? কত পড়তে পারতাম! ওদিকে নেয়ার পর পড়া হবেনা এক লাইন-ও।
ছয় দিনের মাথায় বদর সিদ্ধান্ত নিল সে-ও বাড়ি ফিরবে। বললাম, 'সেটা কী ঠিক হবে? এখানে ভালো চিকিৎসা পাবে। হৃদয়পুরে কী আছে?'
'হলে, ওখানেই হবে। ছুটি না হলেও যেতাম। কাল সকালেই রওনা দেবো। তুমি কবে যাবে?'
'যেতে তো চেয়েছিলাম গত পরশু। এদিকে তোমার যে অবস্থা ফেলে যাই কী করে?'
'সর্বনাশ! আমার জন্যে বাড়ি না গিয়ে এখানে বসে আছ তুমি! পাগল নাকি? আগে বলোনি কেন? যাও, কালই রওনা হয়ে যাও।'
'কিন্তু এত পথ এই শরীর নিয়ে একা যাবে কীভাবে? আমি বরং যাই তোমার সাথে। পৌঁছে দিয়ে আসি গিয়ে।'
'হৃদয়পুর এখান থেকে সাতচল্লিশ মাইল। অর্ধেক পথে মাথাভাঙা নদী। কোন ব্রিজ নেই ওটাতে। নৌকো করে নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে ফের বাস ধরতে হয়। সারাদিনের পথ। এত কষ্ট করার কোন মানে হয় না। যা হয় হবে, এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।'
'তা হয় না বদর। কষ্ট হোক আর যাই হোক, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে তারপর ফিরব। কাল সকালেই রওনা হচ্ছি তাহলে। আর হ্যাঁ, হৃদয়পুরে ভালো চিকিৎসা আছে এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত তো?'
'অবশ্যই নিশ্চিত। যেতে যখন চাচ্ছ, চলো। গেলেই দেখতে পাবে।'
ছয়
পরদিন সকাল সাতটায় বদরের সাথে রওনা হলাম।
গন্তব্য মেহেরপুর বাস স্ট্যান্ড।
জাহাঙ্গীর হোটেলে নাস্তা সেরে যে বাসে উঠলাম তার নাম ‘স্বাধীন বাংলা এক্সপ্রেস।’ এই বাস বানানো হয়েছে হাঙরের মতো মাথাওয়ালা ঊনিশশো ষাট মডেলের তিন-টনি ডজ ট্রাক কেটে। এই ট্রাক ব্যবহার করতো পাক আর্মি।
পঁয়ষট্টি’র পাক-ভারত যুদ্ধের পর নিলামে যেখানে যা ছিল পাবলিকের কাছে বেচে দিয়েছে স-ব। ভেতরে দু’পাশের দেয়ালে লাগানো কাঠের বেঞ্চের ওপর তুলো দিয়ে রেক্সিনে মোড়া। এখানে-সেখানে কভার ছিঁড়ে তুলো বেরিয়ে পড়েছে। যাত্রীরা বসে মুখোমুখি। মাঝখানে পুরোটায় খালি, যাতে বিস্তর লোক দাঁড়াতে পারে।
বাস যাবে মাথাভাঙা ঘাট অব্দি। ঘাট পার হয়ে অন্য বাসে মেহেরপুর (যদি পাওয়া যায়)।
বাস চলছে সর্বোচ্চ গতিতে। অর্থাৎ ঘণ্টায় পনের মাইল। প্রতি তিন মাইলে খালের ধারে গরম ইঞ্জিনকে জল খাওয়ানোর জন্যে বাস দাঁড় করাচ্ছে ড্রাইভার। হেল্পারের অন্যতম কাজ কচুরিপানা সরিয়ে বালতি বালতি পরিষ্কার জল সংগ্রহ আর সেই সাথে ড্রাইভারের লাগাতার গালি হজম করা।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাত তুললেই থেমে দাঁড়াচ্ছে বাস। ভেতরে লোক ভর্তি থাকলেও ছাদ এখনও খালি! ছাদের ভাড়া কালেক্ট করার জন্যে সেখানে আলাদা কন্ডাকটর। যত্র-তত্র লোক উঠতে-নামতে যতখানি সময় ব্যয় হচ্ছে তার থেকে ঢের বেশি হচ্ছে কূল-বধূরা যখন উঠছে। এদের জন্যে ড্রাইভারের বাঁ পাশে বেঞ্চের ওপরে বাসের দেয়ালে লেখা ‘মহিলা ৬ সিট।’
আমাদের মাথার ওপর ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়,’ ওল্টোদিকে, ‘পকেট সাবধান!’ বাস পরিচালকদের ব্যবহারকে মানদন্ড হিসেবে ধরলে তারা যে উচ্চ বংশজাত সে পরিচয় অবশ্য খুব কমই পাওয়া যাচ্ছে। যে রকম খিস্তি-খেউড় আর চেঁচা-মেচি!
যাহোক, ‘মহিলারা’ বাসে ওঠার আগে তাদের বাবা-মা ভাইবোনদের ধরে বিদায় কান্না কেঁদে, দাদা-দাদি, চাচা-চাচিদের সালাম করে তারপর উঠবে। ওদিকে বউ উঠলেও তার চিঁড়ে-মুড়ি, চাল-ডাল, ওল-মানকচু, পাতিহাঁস, আর টিনের ট্রাঙ্ক তখনও ওঠেনি। ওগুলোর কিছু ভেতরে, কিছু ওপরে।
ছিট কাপড়ের কাভার পরানো তিন-ব্যান্ডের ট্র্যানজিস্টর রেডিও হাতে গলায় পাউডার মাখা স্বামীর সাথে মালের ভাড়া নিয়ে মুলামুলি। সব মিলিয়ে আধ ঘণ্টা শেষ।
স্টার সিগারেট মুখে নিয়ে অপেক্ষা করছে ড্রাইভার।
সময় কোন সমস্যা না! বিশ মাইল দূরে খলিসাকুণ্ডিতে মাথাভাঙার তীরে যখন পৌঁছলাম তখন স্থানীয় মসজিদে যোহরের আযান হচ্ছে। নদীর ওপারে এখনও সাতাশ মাইল পথ বাকি!
নদী পার হয়ে বদরকে নিয়ে ওপাড়ে উঠলাম। বাসের অপেক্ষায় অনেক লোক দাঁড়ানো। ধুঁকতে ধুঁকতে এলও একটা। রে রে করে তেড়ে গেল সবাই। ধাক্কা-ধাক্কি করে বাসে উঠছে। এখন উঠলে দাঁড়ানোর জায়গা হয়তো পাওয়া যাবে। আমার কাঁধে বদরের আর নিজেরটা সহ দুই ব্যাগ।
দাঁড়িয়ে যেতে গেলে পুরো রাস্তা টাল খেতে হবে। হাতের যে অবস্থা, বদর হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কিনা কে জানে? এরপরও কথা আছে। বাসের ড্রাইভার-হেল্পার-কন্ডাকটর এখন টং দোকানে চা-নাস্তা খাবে। ততক্ষণে ভেতরে তিল পরিমাণ জায়গাও থাকবে না। যদিও আষাঢ় মাস, তবুও গরম ভাদ্রের।
বদর টিকবে না এক মিনিটও। এখন কী করব এই কথা যখন ভাবছি সেই সময় হঠাৎ চোখে পড়ল কিছুদূরে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। এ-ও ডজ। তবে মাল-পত্র টানে।
বদরকে নিয়ে দেখা করলাম ট্রাক ড্রাইভারের সাথে। হ্যাঁ, মেহেরপুর যাবে ওটা, তবে দেরি হবে। কাপড়ের গাঁট বোঝাই হলে, তারপর ছাড়বে। এখন ওপারে মাল খালাস হচ্ছে, ঘণ্টা খানেকের ভেতর লোড হয়ে যাবে। ড্রাইভারের পাশে কেবিনে দু’জন বসা সমস্য না।
আসার সময় মোট ভাড়া ছিল তিন টাকা। এখন দশ! ড্রাইভার বলল, দোকানে গিয়ে চা-নাস্তা খান। মাল লোড হলে হেল্পার গিয়ে ডেকে আনবে।
সাত
এবারের যাত্রাটা ভালো হলো। একটানা চলে মেহেরপুরে এসে পৌঁছলাম সন্ধের মুখোমুখি। আরও সাত মাইল ভেতরে যেতে হবে।
রিক্সা ছাড়া অন্য কোন বাহন নেই এখন। আবারও তিনগুণ পয়সা দিয়ে রিক্সা ভাড়া করতে হলো।
একে রাত, তার ওপর আসার সময় রিক্সাওয়ালাকে খালি মেরে আসতে হবে। সরু রাস্তা, দু’পাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে আকাশ ছোঁয়া ভীম মোটা গাছের সারি। বদর জানাল সেই সিরাজুদ্দৌলার আমল থেকে আছে ওগুলো।
বহু ওপরে আকাশের গায়ে ক্ষয়া চাঁদ। হু হু করে বাতাস বইছে। যতদূর দৃষ্টি যায় রাস্তা একদম ফাঁকা। কোথায় গেল সারাদিনের শ্রান্তি! এমন ভালো লাগতে লাগল, মনে হলো, আহ্ ‘এই পথ যদি না শেষ হয়!’
ঘণ্টা দুই চলে বিশাল এক ফসলের মাঠের সামনে এসে থামলাম। মাঠ না বলে প্রান্তর বলাই ভালো। সেই প্রান্তরের বুক চিরে আরও পশ্চিমে চলে গেছে চওড়া বেলে মাটির রাস্তা।
ভেবেছিলাম রিক্সা নিয়ে সরাসরি হৃদয়পুর গ্রামে যাব। কিন্তু না। এখন হেঁটে যেতে হবে মাটির রাস্তা ধরে। আরও ক’মাইল তা শুধু বদরই বলতে পারবে।
সারাদিন খাওয়া নেই, মাইলের পর মাইল জার্নি। চরম সীমায় পৌঁছে গেছে ক্লান্তি। কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না। অবস্থা বোধহয় কিছুটা আঁচ করতে পারল বদর। বলল, 'এই চলে এসেছি প্রায়। আর মাইলটাক পথ। ব্যাস, তারপরেই বিশ্রাম!'
'আমার কথা বাদ দাও, তুমি ঠিক আছ নাকি সেইটে দেখ। নাও চলো এখন।'
গ্রাম-গঞ্জ এলাকা। সকাল সকাল খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েছে সবাই। রাত দুপুরে কারও বাড়ি গিয়ে ঘুম থেকে তুলে সেবা-যত্ন আশা করা এক বিরাট বিড়াম্বনা।
আমার ছোট মামা দিনাজপুর শহরে সাব-রেজিস্ট্রার। মামা বলতেন, 'শোন অমিত। কখনও সীমান্ত এক্সপ্রেসে রাতের বেলা আমার এখানে আসবি না। কাকা-ডাকা ভোরে স্টেশনে গিয়ে আনতে পারব না বাপু। বিকেলের ট্রেনও ধরবি না। রাত দুপুরে মেহমানদারি করা এক বিরাট ঝামেলা। তোর মামী রাগ করবে। সব সময় বেলাবেলি আসার চেষ্টা করবি। ফেরার সময়ও ঐ একই নিয়ম, ঠিক আছে?'
দু’পাশে এক হাঁটু নিচে কোমর সমান পাটের ক্ষেত। কিছুদূর পরপর তাল গাছ। ভুতুম ভুতুম করে হুতুম পেঁচা ডাকছে। বিশাল চরাচরে জন-মানুষের চিহ্নও নেই। মরে এসেছে চাঁদের আলো। গা ছমছমে ভুতুড়ে পরিবেশ। পাশে বদরকে নিয়ে চুপচাপ হাঁটছি। কতক্ষণ হয় পথ চলছি হিসেব নেই।
হঠাৎ করেই ডানে বাঁক নিল রাস্তা।
বাঁকের কাছে আদ্যিকালের এক বাবলা গাছ। এত মোটা আবার বাবলা গাছ হয় নাকি!
গাছের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি এমন সময় দমকা বাতাসের সাথে ভেসে এল অনেক লোকের চাপা হাসির শব্দ। যেমন হঠাৎ এসেছিল, থেমেও গেল তেমন হঠাৎই। আবার যে কে সেই। সুনশান চারদিক। যার পর নেই অবাক হয়ে বদরকে কিছু বলতে যাব, ঠিক সেই সময় গায়ের কাছে ঘেঁষে এসে কাঁপা কাঁপা স্বরে বদর বলল, 'কথা বলো না অমিত। পা চালাও। আর আধ মাইল গেলেই গ্রামের সীমানা। মেলা দেরি হয়ে গেছে।'
(পড়ুন দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম পর্ব)