(প্রথম পর্বের পর)
কিছুক্ষণ পরেই গ্রামে ঢুকে বিরাট এক ধাক্কা খেলাম। ছবির মতো প্রতিটা বাড়ির সামনে আঙিনায় বাগান, গোল বারান্দা। এখানে-সেখানে প্রকান্ড সব ফলের গাছ। বহু পুরানো না হলে গাছ এত বড় হওয়ার কথা না। সীমানা প্রাচীরের কাজ ঐ গাছগুলোই করছে।
কাঁচা বাড়ি নেই একটাও। মন-কাড়া টিনের হাফ বিল্ডিং আছে কিছু। বাকিগুলো আদ্যিকালের ইঁটে তৈরি পাকা বাড়ি। সবকিছু ঝকঝকে তকতকে।
বাংলাদেশের কোনো গাঁয়ে সব লোক সম্পন্ন গৃহস্থ যে হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। বদরদের বাড়ি কেমন সেইটেই এখন দেখা বাকি। খুব বেশি বড় গ্রাম না, পোয়া মাইল লম্বা রাস্তার দু’ধারে দু’সারিতে সব বাড়ি। পুরো গ্রাম জুড়ে অসীম নীরবতা, একটা কুকুরও ডাকছে না কোথাও। জ্বলছে না কোন হ্যারিকেন কিংবা কুপি।
এ গাঁয়ের সাথে তুলনা চলতে পারে শুধুমাত্র উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার বডি স্টেট হিস্টোরিক পার্কের। নামে পার্ক হলেও আসলে গোস্ট টাউন। এক সময় সোনার খনি ছিল। দলে দলে ভাগ্যন্নেষীরা এসে সোনা তুলে শেষ করে বিদেয় নিয়েছে, পেছনে ফেলে গেছে আস্ত একটা শহর।
ঊষর এলাকায় নির্জন প্রান্তরে চওড়া রাস্তার দু’পাশে বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, হোটেল-রেঁস্তোরা, গির্জা-বার-জুয়ার আড্ডা, আস্তাবল-হাসপাতাল, হুইল ব্যারো, কলকারখানা─সবই আছে। শুধু নেই কোন প্রাণী।
শতাব্দী ধরে দিনে-রাতে হু হু করে হাওয়া খেলছে সবখানে! সেই সঙ্গে উলু-খাগড়ায় ভরা ভেঙে পড়া গোরস্থানে মাতম করছে অপঘাতে কিম্বা অসুখে পড়ে ভুগে ভুগে মারা যাওয়া গাদা গাদা অতৃপ্ত আত্মা। এদের কবরে কেউ কখনও মোমবাতি জ্বালেনি, দেয়নি ফুল, স্মরণ করে ফেলেনি দু’ফোঁটা চোখের জল। আসলে কে কোত্থেকে এসছে, তা-ই জানা নেই কারও!
সোনা যে পেয়েছে টিকে গেছে, যে পায়নি ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। বাড়ি আর ফেরা হয়নি। পরিবারের লোকেরা জানতেও পারেনি কী ঘটেছে কপালে!
আট
বদরদের বাড়ি গাঁয়ের একেবারে শেষ মাথায়। বাড়ি পেরিয়ে সুতোর মতো মরা নদী। ওপারে ভারতে হৃদয়পুরের বাকি অংশ।
এটাও গোল বারান্দাওয়ালা ইঁটের বাড়ি। কোন এক সময় চুনকাম করা হয়েছিল। এখন ছোপ ছোপ কালো ফাঙ্গাসে ঢেকে গেছে সাদা রঙ। বারান্দার পাশে গায়ে অসংখ্য গজাল মারা কাঠের দুই পাল্লার দরজা দিয়ে উঠোনে ঢোকার পথ। তবে দরজার কাছে যেতে হলে বড়বড় আম গাছের সারির ভেতর দিয়ে বিঘেটাক জমি পার হয়ে তারপর পৌঁছতে হবে।
পুরো গ্রামের সব বাড়ি ছায়া ছায়া অন্ধকারে ডুবে থাকলেও এ বাড়ি ব্যতিক্রম। লোক যে আছে ভেতরে বোঝা যাচ্ছে। গোল বারান্দার দরজা-জানালা খোলা। হ্যাজাক জ্বলছে ভেতরে। সাদা নরম আলো ঠিকরে পড়েছে জানালা-দরজার গলে বাইরের জমিনে।
দরজার কাছে গিয়ে বদর চেঁচিয়ে বলল, 'এই ছদর রাত জেগে পড়ছিস নাকি? আমি বদর।'
ছদর, বদরের ছোট ভাই। পুরো নাম ছদরুদ্দিন ওমর। ক্লাস টেনে পড়ে। সামনেই মেট্রিকের টেস্ট পরীক্ষা। রাত-জেগে পড়াশুনা করছে।
নয়
গোল বারান্দার পাশের ঘরে দুটো বিছানায় আমার আর বদরের শোবার ব্যবস্থা হলো। উঠোনের মাঝে ইয়া বড় ইঁদারায় কপিকলের সাথে বালতি লাগানো।
ঘপাঘপ জল তুলে স্নান সেরে ফেললাম। আঁজলা ভরে খেলাম। ঠান্ডা হলো শরীর, ক্লান্তিও কমলো কিছুটা। এখন চিঁড়ে-মুড়ি কিছু একটা খেয়ে কোন রকমে শুতে পারলে বাঁচি।
কিন্তু ঘটনা ঘটলো উল্টো। মেঝেতে মাদুর পেতে কাঁসার থালা-বাটিতে খাওয়া পরিবেশন করলো ছদর। ধোঁয়া-ওঠা সরু চালের ভাত, খাসির মাংস, মসুরির ডাল।
এত রাতে এই আয়োজন কীভাবে হলো সেটা বুঝলাম না। গ্রামে-গঞ্জে মাছ-মাংস র্দুলভ। মেলে শুধু হাটবারে। ধরে নিলাম আজকে এই এলাকায় হাট ছিল। মাংস কিনে এনে রান্নাও হলো। তবে সেই মাংস সন্ধ্যে রাতেই খেয়ে শেষ করে ফেলার কথা। বাঁচিয়ে যদি রাখাও হয়, তা-ও এত ফ্রেশ থাকবে না। ডালটাও বেশিক্ষণ হয়নি রান্না করা।
এদিকে এসে পৌঁছেছি মেরে-কেটে ঘণ্টা খানেক আগে। স্বীকার করতেই হবে এদের প্রস্তুতি শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরও হার মানাবে। কী মসলা দিয়ে রেঁধেছে জানিনা, তবে মাংসের স্বাদ ভুবন ভুলানো। ডাল খাওয়ার পর মনে হলো শুধু ডাল হলেই চলতো, মাংসের দরকারই ছিল না!
বদরের বাবা-মা’র সাথে দেখা হলো না। বয়স্ক মানুষ। সকাল সকাল শুয়ে পড়েছেন। খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে পড়লাম আমি আর বদর। ঘরের এক কোনায় খুব কম সলতের আলোয় হ্যারিকেন জ্বলছে। রাত-বিরোতে বাথরুমে যেতে হলে কাজে লাগবে।
শোয়ার পর নৈঃশব্দ যেন জেঁকে ধরলো। এত ক্লান্তির পর ভর পেট খেয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকানো মাত্র ঘুমে চোখ বুজে আসার কথা। কিন্তু ঘুম আসছে না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছে বদরও। সম্ভবত আঙুলের যন্ত্রণা। এত ভালো রান্না অথচ ঠিকমত খেতেও পারেনি বেচারা। ভাবলাম এটা-ওটা নিয়ে বরং কথা বলি। জিজ্ঞেস করলাম, 'বদর। জেগে আছো?'
'উম। জেগেই আছি। যন্ত্রণাটা বেড়েছে। সারাদিনে ধকল তো আর কম যায়নি।'
'তুমি না বলেছিলে গ্রামে গেলেই সেরে যাবে অসুখ! কই কিছুই তো করলে না।'
'এখন কিছু হবে না। যা করার কাল সকালে। কোনমতে রাতটা পার করতে পারলেই হয়।'
'তা না হয় হলো, কিন্তু চিকিৎসাটা কী ধরনের?'
'সকাল হলেই বুঝতে পারবে।'
'ও আচ্ছা। একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?'
'কী কথা?'
'রাস্তার বাঁকে পুরনো বাবলা গাছটার কাছে চাপা হাসির শব্দ শুনেছিলাম। ওদিকে জন-মানুষের চিহ্নও নেই কোথাও। মনে হলো ভয় পেয়েছো তুমিও। বললে, ‘জলদি পা চালাও।’ ঘটনা কী?'
'আজ থাক ওসব। কাল বাবার কাছে শুনো। নাও ঘুমাও এখন।'
দশ
ঘুম থেকে যখন উঠলাম, তখন সকাল আটটা। হাত-মুখ ধুয়ে সোজা রান্নাঘরের দাওয়ায়। খিচুড়ি, ডিম ভাজি, ঝাল-পেঁয়াজ ভর্তা।
খাবার বেড়ে দিলো মাঝ বয়েসি 'কমলার-মা' ধরনের এক স্বাস্থ্যবতী মহিলা। ভেবেছিলাম এইবার অন্তত বদরের মাকে দেখবো। হাজার হলেও ছেলের বন্ধু। এতদূর কষ্ট করে এসেছে তাকে পৌঁছে দিতে। কিন্তু হলো না।
উঠোনের উল্টোদিকে পূব-পশ্চিম লম্বা উঁচু-চওড়া বারান্দাসহ ইয়া মাটা পিলারওয়ালা আলাদা দুটো ঘর। এরই একটাতে বদরের বাবা-মা থাকেন। বারান্দায় কাপড় লাগানো ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন বদরের বাবা। লম্বা একহারা ক্লিন-শেভ ফ্যাকাসে চেহারা, ভীষণ ফর্সা গায়ের রঙ। পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি, সাদা থান, পায়ের নিচে পানাই।
পানাই হলো স্থানীয়ভাবে তৈরি কাঁচা চামড়ার স্যান্ডেল। খুব মজবুত, পরতেও আরাম। গ্রাহকের পায়ের মাপ নেয়ার পরেই কেবল বানানো হয়। ভদ্রলোকের বয়স আন্দাজ করা কঠিন। পঁয়তাল্লিশও হতে পারে, আবার পঁচাশিও হতে পারে। চোখের চারদিকে আর কপালে অসংখ্য ভাঁজ।
মাথায় ফকফকে সাদা চুল। শাল-প্রাংশু শরীর।
সিঁড়ি ভেঙে দাওয়ার ওপর উঠতেই আমাকে দেখে মধুর হাসলেন। ঝকঝকে দাঁত। পাশে হাতলওয়ালা পুরনো আমলের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, 'বসো বাবা বসো। বদরের মা বাড়ি নেই। অসুস্থ ভাইকে দেখতে বাবার বাড়ি গেছে। এতো কষ্ট করে এলে, অথচ মেহমানদারি করতে পারছি না।'
'কী যে বলেন চাচা! এর থেকে ভালো আতিথেয়তা আর কী হতে পারে!'
'তা বেশ বেশ। তুমি খুশি থাকলেই আমরা খুশি। বদরের কাছ থেকে সব শুনেছি। এত কষ্ট করে এলেই যখন, থেকে যাও ক’টা দিন। ঘুরে ফিরে দেখো জায়গাটা। ভালো লাগতেও পারে।'
কী বলব এখন সেইটে ভাবছি এমন সময় বদর এসে হাজির। একটা মোড়া টেনে বসতে বসতে বলল, 'আব্বা। কাল রাতে আসার সময় মাঠ পাড়ার ঐ পুরনো বাবলা গাছটার কাছে অমিত চাপা হাসির শব্দ শুনেছে। ঘটনা কী জানতে চায় এখন।'
'ও, ঐ চেঁচানির বাবলা? সে অনেক কাহিনি। বলছি শোনো।'
'কিন্তু বদর তোমার না চিকিৎসার জন্যে যাওয়ার কথা? এখানে বসে গল্প করলে সময় নষ্ট হবে। এ কাহিনি তো পরেও শোনা যাবে,' আমি বললাম।
'ও নিয়ে ভোবো না। ঠাকরুণ বেওয়াকে খবর দেয়া হয়েছে। দুপুরের পর যেতে বলেছে। আব্বা আপনি বলেন।'
'আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। তখন কোম্পানি আমল। দেশের সব জমি-জমা বড়বড় জমিদারদের হাতে। জমি-চাষীরা সবাই প্রজা। ফি বছর খাজনা আদায় হয়।
চৈত্র মাসে পেয়াদাদের নিয়ে ভুঁড়ি মোটা গোমস্তারা গ্রামে গ্রামে ঘোরে। সাথে দশ-বারোটা মোষের গাড়ি। ফসল বেচা টাকা দাও, নাহয় ফসল। না দিতে পারলে, ঘরের চাল খুলে নিয়ে যাবে। সেই সাথে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, তৈজসপত্র। ফসল প্রকৃতির দান। হতেও পারে, না-ও পারে। তবে এসব নিয়ে কোন মাথা-ব্যথা নেই─না জমিদারের, না পেয়াদার! মরো-বাঁচো খাজনা দিতেই হবে। ঐ যে ছড়া আছে, শোননি? -বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে!
যাহোক, আমাদের এলাকার জমিদার ছিল মুর্শিদাবাদের জগৎবন্ধু মিত্র। নামেই জগৎবন্ধু, আসলে জগৎশত্রু। মিত্র তো না-ই। যেমন মালিক, তেমন তার কর্মচারী।
পরশুরাম প্রামাণিক ছিল এর গোমস্তা। নবদ্বীপের ওদিকে কোথায় যেন বাড়ি। এর মতো পাষণ্ড দুনিয়াতে খুব কম জন্মেছে। অনেক সময় এমন হতো থালা-বাসন, গবাদি পশু আগের বছরই নেয়া হয়ে গেছে। মূল্যবান তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই প্রজার ঘরে। পরশুরাম তখন নজর দিতো যুবতী বৌ, ঝি’র দিকে। পেয়াদা দিয়ে জোর করে উঠিয়ে নিতো তাদের।
দু’দশ গ্রাম মিলিয়ে সবকালেই একটা দু’টো বড় হাট থাকতো। সেই সব হাটে জমিদারের মোকাম, অর্থাৎ বিরাট বিরাট গুদাম ঘর। ওখানে খাজনার সব ফসল জড়ো করা হয় মুর্শিদাবাদে পাঠানোর জন্যে।
তো এইসব গুদামে মেয়েদের নিয়ে গিয়ে আটকে রাখতো পরশুরাম। এমনি আটকে রাখলে তা-ও মেনে নেয় যেতো। এদেরকে রাখা হতো গায়ের সব কাপড়-চোপড় খুলে। অপমানের চূড়ান্ত।
ধার-কর্য করে খাজনা পরিশোধ করার পরই কেবল পরনের কাপড় সমেত মুক্তি পেতো তারা। এ সব বৌ, ঝি’রা ঘরে ফিরলেও, সমাজে মুখ দেখানোর উপায় থাকতো না। অনেকে আত্মহত্যাও করতো।
খাজনা আদায়ের এ এক অভিনব ধন্বন্তরী পদ্ধতি। ব্যর্থ কখনই হয়নি। শুধু এই ভয়েই, যে করেই হোক দিনের পর দিন উপোষ থেকে খাজনা জোগাড় করতো প্রজারা। অবস্থা এমন দাঁড়ালো, পরশুরামের কোথাও আর যাওয়ারই দরকার পড়ে না। শুধু মোকামে বসে টাকা গুনলে আর দাঁড়িপাল্লায় লোক দিয়ে ফসল কাঁটা করালেই হয়।
আমাদের এই গ্রাম বহুকাল ধরে বর্ধিষ্ণু। খাওয়া-পরার অভাব নেই কারও। প্রত্যেকের নিজস্ব জমি-জমা, বাড়ি-ঘর আছে। সেই সুলতানী আমল থেকে কোনদিন কাউকে খাজনা দেয়নি এ গাঁয়ের লোক।
হঠাৎ খবর এলো এ গাঁ এখন জগৎবন্ধু মিত্রের জমিদারীর তালুক। তিন বছর আগে কোম্পানি বাহাদুরের কাছ থেকে পুরো মৌজার বন্দোবস্ত নিয়েছে সে।
যেহেতু এ গাঁয়ের প্রজারাই জমির মালিক, সেহেতু পাট্টার কাগজপত্র নিয়ে ঝামেলা হচ্ছিলো। এখন শেষ হয়েছে সে ঝামেলা। একাধিকবার কোলকাতা কোর্টের সমন পেয়েও গাঁয়ের কোন গৃহস্থ হাজির হয়নি। এক তরফা রায় হয়ে গেছে!
আসলে পাজি জগৎবন্ধু আদালতের সমন আসতেই দেয়নি। মাঝ পথে নিজেরাই সই করে পাঠিয়ে দিয়েছে। যাহোক, গত তিন বছরের খাজনা বাকি পড়েছে এখন। এক সপ্তাহ পর পেয়াদাসহ পরশুরাম আসছে। এই সময়ের ভেতর বকেয়া খাজনা যা আছে সব রেডি রাখতে হবে। আর হ্যাঁ, এটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম। কারও কোন অভাবে নেই এখানে। সে কারণে, নরমালের তিনগুণ খাজনা ধার্য করা হয়েছে! কোন দেন দরবার চলবে না।
আমার দাদার আমল সেটা। তাঁর পূর্ব পুরুষ দিল্লির সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবনের সময়ে বসতি গড়েছে এখানে। গত সাড়ে পাঁচশো বছরে কেউ আঙুল তুলতে সাহস করেনি। এখন কোথাকার কোন পরশুরাম এসে যা ইচ্ছে তা-ই করবে! অর্থনীতিক বুনিয়াদ যেমন শক্ত, গাঁয়ের লোকেদের ঐক্যও তেমনি। পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে দু’দিন ধরে সলা-পরামর্শ হলো।
সিদ্ধান্ত হলো খাজনা হিসেবে তিন বছরে যতো ফসল জমিদারের পাওনা হয়েছে তার সবটা এনে জড়ো করা হবে আমাদের বাড়ির আঙিনায়। সেই সঙ্গে প্রস্তুত রাখা হবে দশটা বস্তা-মাপা দাঁড়িপাল্লা, বিশটা মোষের গাড়ি। পরশুরামের কাজ সহজ হবে এতে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাজনা তৌল করতে হবে না।
সময়, শ্রম দু’টোই বাঁচবে। নিজেদের খাজনা নিজেরাই তুলে গাড়ি বয়ে মোকামে তুলে দিয়ে আসাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। দু’দিন ধরে খালি করা হলো ইয়া বড় বড় গোলা। ধান, রবিশস্য, তিল-তিশি─বাদ পড়লোনা কোনটাই। সে এক এলাহি কান্ড! চৈত্র মাসের শুকনো খটখটে দিন, ঝড়-বৃষ্টি নেই।
বাড়ির সামনে পাহাড়ের মতো উঁচু হলো ফসলের ডাঁই। ওদিকে লোক মারফত সব খবরই রাখছে পরশুরাম। ঠিক সাত দিনের দিন এক গরুর গাড়ি বোঝাই খালি বস্তা নিয়ে ছয় বেহারার পাল্কিতে চড়ে উপস্থিত হলো আমাদের বাড়ির সামনে।
পেয়াদা এনেছে মাত্র দু’জন, না আনলেও চলতো। তারপরেও আনতে হয়েছে স্রেফ নিয়ম রক্ষার জন্যে। আম গাছের নিচে ছায়ায় বসলো গ্রামের যতো গৃহস্থ। গোল বারান্দায় টেবিল-চেয়ার পেতে পরশুরাম, আমার দাদা, আর গাঁয়ের মুরুব্বিরা।
শুরু হলো ফসল তৌল করা। খেরো খাতায় লেখা হতে লাগলো গৃহস্থের নাম, আদায়ী খাজানার পরিমাণ। এর ভেতর চলছে এনার পানাহার─টক দই, মিষ্টি দই, ঘোল, মাঠা, মুড়কি, খৈ, রসগোল্লা, গুড়ের সরবত। যেন হালখাতার উৎসব হচ্ছে! পরশুরামের মুখে তেলতেলে হাসি। প্রাণখুলে উপভোগ করছে নিজ ক্ষমতার দাপট। পুরো বছরের মোট খাজনার আদ্দেক এই এক মৌজাতেই উসুল। এইবার বুঝবে জগৎবন্ধু পরশুরাম কী জিনিস!
ফসল-পাতি তৌল করে, বস্তায় ভরে, মোষের গাড়ি বোঝাই হতে হতে বিকেল। এইবার উঠতে হয়। গাঁয়ের শেষ মাথা অব্দি পরশুরামকে এগিয়ে দিলো সবাই মিলে। বলল, 'একেবারে ভুলে যাবেন না আমাদের। মাঝে-মধ্যে এদিকে আসলে অতিথি হতে হবে কিন্তু।' খাতিরের একশেষ!
ওদিকে গাড়িতে অতিরিক্ত মাল লোড হয়েছে। চলছে টেনে-হিঁচড়ে। চেঁচানির বাবলা গাছটার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে। গৃহস্থরা সবাই ফিরে গেছে যে যার বাড়ি। এমন সময় ঘটলো ঘটনাটা।
কেটে নেয়া ফসলের মাঠ পেরিয়ে ভেসে এলো অনেক লোকের হৈ চৈ, চিৎকার। 'মেরে ফেললো রে। বাঁচাও, বাঁ-চা-ও।' যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল চিৎকার, তেমনি থেমেও গেল আচমকা। কিছুক্ষণ পর দমকা বাতাসের মতো ভেসে এলো অদ্ভুত এক ক্র্যাকাও ক্র্যাকাও শব্দ। গাঁয়ের প্রাতিটি নারী-পুরুষ শুনলো সেটা। পুরো রাস্তা জুড়ে বাড়ির দেয়ালগুলোতে প্রতিধ্বনি তুলতে তুলতে হারিয়ে গেলো হিসনা নদীর ওপারে। এরপর সব চুপচাপ, সুনসান।
ঘটনা জানা গেল পরদিন সকালে। ছয় বেহারা পড়ে আছে গাছের নিচে। জ্ঞান প্রায় নেই বললেই চলে। প্রত্যেকের গালে পাঁচ আঙুলের লাল দাগ। রাম চড় খেয়ে মাথা ঘুরে সেই যে পড়েছে আর উঠতে পারেনি।
কিন্তু বিষয় কী?
মাথায় জল ঢেলে, লবণ-পানি খাইয়ে স্বাভাবিক করা হলো বেহারাদের। উড়িষ্যার প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোক। বাংলা ঠিকমত বলতেও পারেনা।
যাহোক, ঘটনা যা জানা গেলো তা মোটামুটি এই: পরশুরামের কাফেলা গাছের কাছে পৌঁছতেই বেহারাদের কানে এলো চাপা হাসির শব্দ। যেন অনেকগুলো লোক হাসছে। তবে এই হাসি মজার হাসি না। এই হাসি অশুভ আর ভীষণ নিষ্ঠুর।
হঠাৎ বিরাট লম্বা-চওড়া কিছু একটা বেহারাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। একবার মনে হয় রক্ত-মাংসের, আরেকবার মনে হয় শুধুই ছায়া। এই কিছু একটার ওপরের অর্ধেক পাখির মতো। ইয়া লম্বা তীর-বাঁকা ঠোঁট, গোল গোল চোখে নীলচে বিদ্যুতের ঝলক আর সীমাহীন নিষ্ঠুরতা। চোখে চোখ পড়লে হিম হয়ে যায় কলজের পানি, কাঁপুনি উঠে যায় শরীরে।
পিঠের ওপর ডানে-বাঁয়ে ছড়ানো কুচকুচে কালো বিশাল দুই পাখা। পা মানুষেরই, তবে হাত দু’টো যেন সিংহের থাবা।
পরশুরামের পাল্কি থেমে যেতেই দরজা দিয়ে মুখ বের করে হেঁড়ে গলায় জানতে চায় ‘ব্যাপার কী?’
তৎক্ষণাৎ তার দিকে এগিয়ে যায় ছায়া আগন্তুক। চুল ধরে এক হাতের হ্যাঁচকা টানে বের করে আনে পাল্কির বাইরে। রাস্তায় ফেলে পা তুলে দেয় পেটের ওপর। মুখ থেকে কোন আওয়াজ বের হওয়ার আগেই এক ঠোকরে বুকের হাড়-পাঁজর ভেঙে বের করে আনে হৃদপিন্ড, আছড়ে ফেলে গাছের গোড়ায়।
তারপর অমানুষিক শক্তিতে টেনে ছিঁড়ে ফেলে মাথা। পাল্কির পাশেই হেঁটে যাচ্ছিল পেয়াদা দু’জন। কান্ড দেখে ভয়ে জান উড়ে যায় তাদের। ঝেড়ে দৌড় দেয় কেটে নেয়া ফসলের ক্ষেতের ভেতর। তবে বেশিদূর যেতে পারেনি বেচারারা।
এক রকম উড়ে গিয়ে তাদের ধরে ফেলে সেই অদ্ভুত প্রাণী। একই অবস্থা করে তাদেরও। কান্ড দেখে ভয়ে জমে গিয়েছিল বেহারার দল। হুঁশ ফিরতেই পালানোর চেষ্টা করে তারা। আগন্তুক এবার এগিয়ে আসে তাদের দিকে। কষে চড় হাঁকায় প্রত্যেকের গালে। সিংহের থাবার থাপ্পড়। গাল যে উড়ে যায়নি এ-ই ভাগ্য! তবে মাথার মগজ উল্টেছে ঠিকই। মাড়ির দাঁত পড়ে গেছে বেশ ক’জনের।
বোঝাই যায় গরীব বেহারাদের প্রাণে মারতে চায়নি ঐ জিনিস। রাস্তার ওপর গাড়ি ভর্তি মাল নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে মোষের দল।
তিরতির করে কাঁপছে প্রতিটির শরীর। চওড়া পিঠে হাত দিলেই বোঝা যায়, মারাত্মক ভয় পেয়েছে ওগুলো। এ জন্যেই যায়নি কোথাও, সারারাত দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে কখন ভোর হয়।
পড়ে আছে খালি পাল্কি। একপাশে ছোপ ছোপ রক্ত। অনেক খুঁজেও মিললো না হৃদপিন্ড কিম্বা দেহাবশিষ্ট। ভোর থেকেই গাছের ওপর খ্যা খ্যা করছে পাল কে পাল কাক। সম্ভবত তারাই সাবড়ে দিয়েছে স-ব। উঠিয়ে আনা হলো পাল্কি, সেই সাথে হিসেবের খেরো খাতা আর নগদ টাকা যা আদায় হয়েছিল।
সব টাকা ভাগ করে দেয়া হলো বেহারাদের ভেতর। দেখা গেলো তিন বছরে যা বেতন পেতো তার থেকেও ঢের বেশি একবারে পেয়েছে তারা। এখন উড়িষ্যায় নিজ গ্রামে ফিরতে কোন বাধা নেই।
খেরো খাতা আর পাল্কি নিয়ে রওনা হলো বেহারারা। আর কখনও দেখা মেলেনি তাদের।
ঘটনার তিনদিন পর এক অদ্ভুত সংবাদ এলো গ্রামে। কোলকাতায় লছমি বাঈজির কোঠা থেকে ভোর রাতে একা গাড়িতে বাড়ি ফিরছিলো জগৎবন্ধু। গড়ের মাঠ পার হওয়ার সময় উধাও হয়েছে সে।
কোলকাতা তখন গড়ে উঠছে কেবল। চারদিকে যোজন যোজন ফাঁকা প্রান্তর। প্রায় সবই গড়ের মাঠ। চোর-ডাকাত হামলে পড়তেই পারে। সকাল বেলা শুধু ঘোড়া আর গাড়ি পাওয়া গেছে। জগৎবন্ধু, তার মোসাহেব, আর কোচোয়ান পুরোপুরি গায়েব! তবে খটকা একটা রয়েই গেলো। গাড়িতে আরও একটা জিনিস পাওয়া গিয়েছিল─জগৎবন্ধুর সোনার মোহর ভরা থলে!'
'ঘটনা কী এখানেই শেষ?'
'এটা কেন মনে হচ্ছে তোমার?'
'কারণ, ঘটনা ঘটেছে বহুদিন হয়। বদরকে যেভাবে ভয় পেতে দেখলাম, আমার তো মনে হয় ঐ অশরীরীকে এ গাঁয়ের অনেকেই দেখেছে। শুধুমাত্র একবার দেখা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। শতাব্দী ধরে মানুষের মনে রয়ে গেছে ওটা। জনতার স্মৃতি দুর্বল। একই ঘটনা বার বার না ঘটলে তা এতদিন উপকথা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই, ভয়টা জাঁকিয়ে বসেছে সবার মনে। এ কিংবদন্তি জীবন্ত।'
'বাছা, মানতেই হবে বেড়ে বুদ্ধি তোমার। স্বীকার করছি যুগে যুগে দেখা দিয়েছে ওটা। দেখে ভয়ও পেয়েছে অনেকে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। তবে কারোরই মারাত্মক কোন ক্ষতি করেনি জিনিসটা। ক্ষতি না করলে কী হবে, দেখামাত্র যে আতঙ্ক গ্রাস করে সবাইকে, সে স্মৃতি ভুলে যাওয়া সম্ভব না কিছুতেই। এক ভয়ঙ্কর প্রেতাত্মার সাথে দেখা হোক কে চায় বলো? বদরও চেয়েছে পালিয়ে বাঁচতে।'
'আর প্রতিবার আবির্ভাবের আগে অদ্ভুত এক গা শিরশিরে হাসির শব্দ শুনতে পেয়েছে লোকে, তাই না?'
'ঠিক তাই। ঐ খলখলে হাসিই হলো তার আর্বিভাবের লক্ষণ। আশা করি এখন সবকিছু পরিষ্কার হয়েছে তোমার কাছে?'
'না, এখনও সবকিছু পরিষ্কার হয়নি।'
'আর কী জানতে চাও, বলো?'
'আমার ধারণা পরশুরামকে মারার জন্যেই ডেকে আনা হয়েছিল ওটাকে। আর যে ডেকে এনেছিল, সে এ গাঁয়েরই কেউ। আপনার কাহিনিতে মেলা ফাঁক-ফোঁকর। পুরোটা আমাকে এখনও বলেননি আপনি।'
বদরের বাবা আমার কথা শুনে কিছুটা মনে হয় অসন্তুষ্টই হলেন। বললেন, 'ফাঁক-ফোঁকর কোথায় দেখলে তুমি?'
'গাঁয়ের মোড়লেরা দু’দিন ধরে মিটিং করলো, তারপর শুরু করে দিলো খাজনা দেয়ার উৎসব। বিশ-বিশটা গাড়ি বোঝাই ফসল। কম কথা তো না! এরপর গ্রাম থেকে বেরই হলো না ফসল। পড়ে থাকলো গাছতলাতেই। গাড়ি ফেরত এনে যে যার মতো ফের বুঝে নিলো সবাই। অর্থাৎ, গ্রামবাসী জানতো সব ফসল নিজেদের কাছেই থাকবে।
গোমস্তা আর পেয়াদা খুন হওয়ায় জগৎবন্ধু যে কোন ব্যবস্থা নেবে, থাকলো না সে উপায়-ও। কারণ, দুনিয়ার মায়া কাটাতে হলো তাকেও। প্রশ্ন হলো, ‘সিদ্ধান্ত’ আসলে কী হয়েছিল? তাছাড়া, জগৎবন্ধু মিত্রের মৃত্যুতেই চিরকালের জন্যে সব খাজনা মওকুফ হয়ে যাবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। জমিদারি তালুক এক হাত থেকে আরেক হাতে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এক পরশুরাম যাবে, আরেক ঘনশ্যাম আসবে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, খাজনা আদায়ের পথ চিরকালের জন্যে রুদ্ধ হলো কীভাবে? এক মাঘে তো শীত যাবে না!'
প্রশ্ন শুনে বদরের বাবা মুখ খুলতে যাবেন এমন সময় ছদর এসে হাজির। ঠাকরুণ বেওয়া যেতে বলেছে। সাথে সাথে মোড়া থেকে উঠলো বদর। বলল, 'অমিত, আঙুলহারার চিকৎসা করাতে যাবো। যদি দেখতে চাও, তো চলো এখন। নাকি বাবার সাথে বসে গল্প করবে?'
'নাহ্, গল্প পরেও করা যাবে। চিকিৎসা কীভাবে করে সেটাই আগে দেখি।'
(পড়ুন তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম পর্ব)