(তৃতীয় পর্ব থেকে)
বহুকাল আগে সেই সুলতানি আমলে খুব খারাপ কিছু একটা হয়েছিল ওখানে। সেই থেকেই নাকি অভিশপ্ত। আগে, মানে সিরাজউদ্দৌলার আমলে ঠগিরা থাকত। নিরীহ মানুষ মেরে ঝুলিয়ে রাখত মোটা মোটা সব গাছের ডালে। তবে সবই গল্প-কাহিনি।
'আপনি গেছেন কখনও?'
'আমি? নাহ্। ওসব পুরনো জায়গা। সাপ-খোপের আড্ডা। আর যেয়েই বা কী হবে? লুকোনো গুপ্তধন-টুপ্তধন যদি থাকতও তবুও বহুকাল আগে তা লুটে নিয়েছে ঠগিরাই। আর ঠগিরা যদি না-ও নেয়, তাহলে কোম্পানি’র সাহেবেরা নিশ্চিত সাবড়ে দিয়েছে। ঠগিদের বারোটা তো ওরাই বাজিয়েছিল। ঠিক কিনা?'
'খুবই ঠিক। তবে আপনার যদি দেখা থাকত, তাহলে জানা যেত খান্ডালাটা দেখতে কেমন'
'এ আর এমন কী কঠিন। তুমি নিজেই গিয়ে দেখে আসতে পারো।'
'আমি! আমি কীভাবে যাব? ওদেশে যাইনি কখনও। চেনা-জানা নেই, নেই পাসপোর্ট-ভিসা।'
'আরে পাসপোর্ট-ভিসার কথা নিয়ে ভাবতে হবে না। কেউ না আটকালেই তো হলো। আর চেনা-জানা নেই বলছ কেন? এই হাক্কানি হাকিম রয়েছে না! নাকি ওপারের বলে আপন ভাবতে পারছ না আমাকে?'
'না, আসলে তা ঠিক না . . .।'
'তবে আর কথা কী? কালই রওনা হই চলো। বদরও যাক সাথে। দু’দিন থেকে ফিরে আসবে আবার। বদর বলল, তোমাদের কলেজ খুলতে এখনও এক মাস বাকি। অফুরন্ত সময় হাতে।'
'কিন্তু ও যদি যেতে রাজি না হয়?'
'কি! মামাবাড়ি যেতে চাইবে না বদর! যাওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকে সব সময়। বলতে যতক্ষণ। ব্যাগ অব্দি গোছানোর তর সইবে না। থাকল ঝোলা, চলল ভোলা। ও নিয়ে ভেব না। তুমি যাবে কিনা বলো?'
'শুনেছি আপনার ভাই অসুস্থ। অসুখ বাড়িতে উপযাচক হয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে?'
'আরে ভাইয়ের কথা ভেব না। ভাবীকে নিয়ে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে গেছে। ফিরতে ফিরতে মাস-দু’মাস।'
'ঠিক আছে চলেন। তবে খান্ডালা দেখাতে হবে কিন্তু। পাকা কথা চাই।'
'আরে বাবা সে হবেখন। যাওয়াই হলো না এখনও, তার আবার খান্ডালা। গাছে নারকোল, ওদিকে বাড়িতে পিঠে-পুলি! তবে হ্যাঁ, আমার একটা প্রশ্ন আছে। পুরনো মন্দিরের কথা কেন বললে? বিশেষ কোনো কারণ আছে?'
'এখানে হাজার বছর আগের একটা মন্দির আছে। জানেন?'
'হুমম, ঠাকরুণ বেওয়া। তাই তো?'
'জানলে কীভাবে ওটার কথা? গিয়েছিলে নাকি ওখানে?'
'জ্বি, গিয়েছিলাম গতকাল। ভারী অদ্ভুত জায়গা।'
'অদ্ভুত কেন বলছ? কিছু ঘটেছে নাকি?'
'বদরের আঙুলহারা হয়েছিল। তার চিকিৎসা হয়েছে।'
'এর ভেতর আবার অদ্ভুতের কী দেখলে! নানান সমস্যা নিয়ে মানুষ যায় ওখানে। অসুখ-বিসুখ একটা বড় সমস্যা। এসবের অজ পাড়াগাঁয়ে চিকিৎসা কোথায়? বিয়ের পর ছেলে-পুলে না হলেও ঠাকরুণ বেওয়া, জন্মানোর পর অসুখ হলেও ঐ ঠাকরুণ বেওয়া। ঠাকরুণ বেওয়াকে তুলে দাও, অচল হয়ে যাবে গ্রাম।
এখন বুঝতে পারছি আমাদের গাঁয়ে এরকম কিছু আছে কিনা একথা কেন জানতে চাইছিলে। বলি শোনো, আমাদের গাঁয়ে কোনো ঠাকরুণ বেওয়া নেই। তবে যা আছে তা ঠাকরুণ বেওয়ার বাবা। হাতিশালের খান্ডালা!'
চৌদ্দ
পরদিন সকালে হাক্কানি হাকিমের সাথে রওনা হলাম আমি আর বদর। হেঁটে শুকনো হড়হড়ে নদী পেরিয়ে ওপারে পৌঁছলাম। এপাড়ের ঢাল অনেক চওড়া। নিচ থকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে উঠে গেছে ওপরে। দারুণ উর্বর জমি। ট্র্যাকটর দিয়ে চাষাবাদ হয় এদিকটায়। বিরাট বিরাট সব জমির প্লট একেক জনের। যেদিকে তাকাই শুধু অড়হরের গাছ। এ ডাল মাড়োয়ারীরা খুব খায়। দামও অনেক।
ছ’ফুট লম্বা এক একটা গাছ। বছর লাগে ফল ধরতে। যে রকম জোর গাছের, দুর্দান্ত ফলন হওয়ার কথা। একবারেই সংবৎসরের পয়সা উসুল। নাহ্, এ গাঁয়ে ভগবান মনে হচ্ছে একেবারে উজাড় করে দিয়েছেন।
ঝকঝকে বেলেমাটির পেল্লায় আকারে কৃষ্ণচূড়া গাছে ঢাকা চওড়া রাস্তা। সামান্য দূরে বিএসএফের টিনের ছাউনি চোখে পড়ল। নদীর দিকে তাকিয়ে কাঠের বেঞ্চে বসে আছে তিনজন। মনে হলো দেখতেই পায়নি আমাদের।
আধ মাইলের মতো চলার পর ঘর-বাড়ির দেখা পেলাম। ওপারের মতোই পুরনো, তবে বাড়িগুলো আরও জমকালো। প্রতিটা বাড়ির সামনে দেড়-দু’বিঘে জায়গা নিয়ে অজস্র আম-কাঁঠালের গাছ। গাছের গোড়ায় শুয়ে জাবর কাটছে বাঁকানো শিংওয়ালা ছ’ফুট উঁচু দানবের মতো সিন্ধি ষাঁড় আর গাভী। যে পরিমাণ গাছ, তাতে ফি বছর ফল বেচেই সংসার খরচ উঠে যাওয়ার কথা। দুধ-গরু এসব নাহয় ছেড়েই দিলাম। প্রকৃতি একেবারে ঢেলে দিয়েছে এদের!
গাঁয়ের শুরুতেই বদরের নানাবাড়ি। এখানে মাত্র বিশ ঘর মুসলমান। বাংলাদেশের দিকটাতেই পাশাপাশি বাড়িতে থাকে সবাই। বদরদের বাড়ির থেকেও বেশি জায়গা নিয়ে হাক্কানিদের বাড়ি। বারান্দায় ধুতি পরে টাকমাথা এক বুড়ো বসে আছে। তাকে দেখে হাক্কানি বলল, 'সালাম আব্বাজান।'
'ওয়ালেকুম। তোর সাথে কারা এরা? দেখি কাছে আয় তো। ওহ্ বদর! কেমন আছ ভাই?'
'ভালো নানাজান।'
'তোমার সাথে এই ছেলে কে? আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।'
'এ আমার বন্ধু অমিত। একই কলেজে পড়ি আমরা।'
'ও আচ্ছা। যাও, ভেতরে গিয়ে বিশ্রাম নাও এখন। অনেক পথ হেঁটে আসতে হয়েছে।'
;অনেক পথ আর কোথায়? এপাড়া-ওপাড়া। শুধু খালের মতো হিসনা নদী পার হলেই হলো।'
'তা-ও ভিনদেশ ভাই। এভাবে যাওয়া-আসা আর কতদিন করতে পারবে কে জানে? কালে কালে কত কী যে ঘটল! সেই সব দিন কী আর আছে!'
হাক্কানি বলল, 'চলো ভেতরে গিয়ে বসি বরং। এখানে থাকলে পুরনো দিনের কেচ্ছা-কাহিনি শুনতেই দফা শেষ হয়ে যাবে।'
ভেতর বাড়িতে প্রকাণ্ড উঠোন, ইঁদারা, ফসলের গোলা। একপাশে বারান্দাওয়ালা সারিসারি ঘর। মোটা দেয়াল, ছোট ছোট জানালা, সরু দু’পাল্লার দরজা। একেবারে শেষ মাথায় ডালিম গাছের পেছেনে হাক্কানির ঘর। বারান্দার ওপর পাটি বিছানো তক্তপোশ। একপাশে ব্যাগ রেখে ওখানেই বসলাম আমি আর বদর।
মিনিট পাঁচেকের ভেতরই চেকচেক ফ্রকপরা ছোট একটা মেয়ে লেবু দেয়া গুড়ের সরবত এনে দিল। এরপর দই, চিঁড়ে, রসগোল্লা। এ দেখি পৌঁছতে না পৌঁছতেই খাতিরের একশেষ! খাওয়া শেষ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে পা মেলে কেবল বসেছি, এমন হাক্কানি এসে বলল, 'চলো বেড়িয়ে আসি।'
'কোথায় মামা? হাতিশালা?'
'আরে পাগল হাতিশালা না। ও আর আজ হবে না। ওখানে যেতে হলে রওনা দিতে হয় খুব ভোরে। পনের কিলো পথ। তিন তিন ছ’ঘণ্টা যেতে আসতেই শেষ। মাঝে দু'-তিন ঘণ্টা বিশ্রাম, ঘোরাঘুরি। নাও, পেরিয়ে গেল ন’ ঘণ্টা । আপাতত গাঁ-টাই ঘুরে দেখো। এখানে খুব বড় একটা আম বাগান আছে। হৃদয়পুর আম্রকানন। মুজিবনগরের ওটা যদি পুকুর হয়, তো এ হ্রদ। পথে পড়বে হৃদয়পুর গির্জা। সেই ওরঙ্গজেব আমলের। ভেঙেচুরে গেছে।
বুড়ো মতন উড়ে চাকর নিয়ে এক পাগলা গোছের মাদ্রাজি পাদ্রী থাকে এখন। গির্জা থেকে বেরও হয়না, কারও সাথে মেশেও না। উড়ে চাকরটাই বাজার-সদায়, রাঁধা-বাড়া যা করার করে। এখানে খ্রিস্টান নেই। আগে হয়তো ছিল কোনো এক সময়। এখন একজনও নেই। বুড়ো ভামটা বহুকাল হয় পড়ে আছে এখানেই। বলে, ঈশ্বরের গৃহ। মায়া পড়ে গেছে।
আসলে, মাস কাবারি মাইনে পায়। ছ’মাসে, ন’মাসে শহরে গিয়ে তুলে তুলে আনে। এখান থেকে গেলে এই বুড়ো বয়সে খাবে কী করে?'
'ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজনের কাছে গিয়েও তো থাকতে পারে।'
'এরা ক্যাথলিক পাদ্রী। এদের ঘর-সংসার নেই।'
হাক্কানির কথা কেমন যেন কঠোর শোনাল। মনে হলো যে কারণেই হোক পাদ্রীকে খুব একটা পছন্দ করে না সে। মুখে বললাম, 'বেশ তো। চলেন তাহলে দেখি কেমন আম্রকানন আপনাদের।'
পনের
পূর্ব হৃদয়পুরের মতোই পশ্চিম হৃদয়পুরেও রাস্তার দু’দিকে সারিসারি বাড়ি। একেবারে শেষ মাথায় ছোট ছোট ইঁট দিয়ে বানানো একটা মন্দির। বেশ পুরনো, ধসে গেছে ছাদ আর তিনদিকের দেয়াল। শুধু সামনের অংশটাই টিকে আছে কোনোমতে। আটকে রেখেছে আগাছার শেকড়-বাকড়। এ মন্দিরে পুজো-আচ্চা হয়না বহুদিন।
গ্রামের পরেও মাইলটাক হাঁটার পর হাতের ডানে গির্জা দেখতে পেলাম। এক সময় সাদা ছিলো, এখন ঢেকে গেছে শেওলা আর লতা-পাতায়। অজস্র ছোপছোপ কালো শ্যাঁওলা পড়া হলুদ-কমলার মিশেল দেয়া পর্তুগীজ ধাঁচের স্থাপত্য। তিনকোনা মাথাওয়ালা শাল কাঠের জানালা-দরজা। ওপরে প্রকাণ্ড ত্রিভুজের মতো কপালি। তার উপর ধাতব ক্রস।
কপালির ঠিক মাঝখানটায় পেল্লাই বৃত্ত। বৃত্তের ভেতর ষোলোটা ফুলের পাপড়ির কেন্দ্রে নিম্বাস ক্রস অর্থাৎ বৃত্তের মাঝে গ্রীক ক্রস।
কাঠের টুকরোই পেরেক মেরে পার্মানেন্টলি আটকে রাখা হয়েছে জানালা-দরজা, যাতে খুলে না পড়ে।
গির্জার পেছনে আদ্যিকালের ছোট্ট একটা বাড়ি। পাদ্রীর বাসভবন। গির্জার সামনে না আছে সিঁড়ি, না বারান্দা। দরজার সাথে এক চিলতে সান-বাঁধানো চাতলের এপাশে টাইমফুলের ঝাড়। আঙিনা জুড়ে এখানে-সেখানে ছোট ছোট সবজি-ক্ষেত। পুরো অঙিনা খালি। কোথাও কেউ নেই। গির্জার পেছনের চিমনি দিয়ে হালকা ধোঁয়া উড়ছে। দুপুরের রান্না হচ্ছে সম্ভবত।
আরও মাইলটাক পথ চলার পর আম বাগানে পৌঁছালাম। বাগানকে দু’ভাগ করে এগিয়ে গেছে পথ। যেদিকে দৃষ্টি যায় শুধুই আমের গাছ। লম্বা-বেঁটে-মোটা-চিকন হরেক রকমের। এ এক হুলস্থূল ব্যাপার। মাঝে-মধ্যে ফাঁকা জমিনে কচি সবুজ ঘাস। বাগানের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে লম্বা লেকের মতন। গাছ যখন ছোট ছিল, তখন গাছে গাছে জল দেয়ার সুবিধের জন্যে কাটা হয়েছিল সম্ভবত।
গাছের ডালে ইয়া বড় বড় মৌমাছির চাক। এসব চাক ভাঙলে মণকে মণ মধু হওয়ার কথা। আমের ফলনের কথা না-ই বা বললাম।
অনেকক্ষণ ধরে হাঁটলাম আম বাগনে। হঠাৎ চোখে পড়ল খুব লম্বা ঝাঁকড়া মতোন একটা গাছ। এ-ও আমের গাছ, তবে দেখে মনে হয় কৃষ্ণচূড়া। খাম্বার মতো লম্বা, মসৃণ গোল কাণ্ড। অনেক ওপরে নিখুঁতভাবে ছড়ানো ডাল-পালা। রামছাগলের কানের মতো কালচে সবুজ পাতা।
গাছটার সৌন্দর্য দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। খুব কাছে গিয়ে দেখি গায়ের বাকল চিরে এক জোড়া পাখনার ছবি আঁকা। নিচে হিন্দিতে কী যেন লেখা, সংস্কৃতও হতে পারে। এ দুই ভাষার অক্ষর দেখতে একই রকম। হাঁটতে গিয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল বদর আর হাক্কানি। আমাকে গাছের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাক্কানি বলল, 'ওহ্। পেয়ে গেছ তাহলে! এখানেই আসতে চাচ্ছিলাম।'
'ভারী অদ্ভুত তো এই আমগাছটা!'
'অদ্ভুত হবে না আবার। এ হলো রাজা গাছ। বিশেষ যত্ন নেয়া হয় এ গাছের। ধারণা করা হয় এ গাছ যতদিন আছে, বাগানও ততদিন থাকবে।'
'কী ধরনের আম হয় এটাতে?;
'সোনালি রঙের লম্বাটে আম ধরে। তখন সুন্দর গন্ধ ছড়ায় বাতাসে।'
'খেতে কেমন?'
'এ গাছের আম কেউ কখনও পাড়েও না, খায়ও না।'
'তাহলে কী হয়? পেকে নিচে ঝরে পড়ে নষ্ট হয়?'
'না, তা-ও হয়না। ধীরে ধীরে কমতে থাকে আমের সংখ্যা। এক সময় নেই হয়ে যায়।'
'হুঁ, বুঝেছি। পাহারাদারেরই সাবাড় করে সব।'
'পাহারার দরকার কী? রাজা গাছই তো আছে! সে নিজেই পাহারাদার!'
আমি আর কথা বাড়ালাম না। এ গাঁ যেমন অদ্ভুত, লোকেরাও তেমন পাগলাটে। এদের সাথে তর্ক করা বৃথা।
ষোল
ফেরার সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। পথে আবারও সেই গির্জা। তবে আঙিনা এবার আর জনশূন্য না।
কালো চিমসে মতন বুড়ো একটা লোক তদারকি করছে সবজি-ক্ষেতের। টাইমফুলের ঝাড়ের কাছে পাকা চাতালে ফোল্ডিং চেয়ারে অন্য আর এক বুড়ো। হাই-পাওর্য়াড লেন্সের চশমা, টাক-মাথা, ক্লিন শেভ, পরনে হাতওয়ালা গেঞ্জি-লুঙ্গি, স্পঞ্জের স্যান্ডেল। পাদ্রী সাহেব। গির্জার ফাদাররা সাদা কিংবা কালো গলা-বন্ধ আলখাল্লা পরে, পায়ে কালো জুতো, গলায় লম্বা চেনের সাথে কাঠের ক্রশ।
এঁর গৃহী-টাইপ চেহারা, দেখে মনে হয় স্কুল শিক্ষক। পাদ্রী একেবারেই না। একমনে সবজিক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আছেন পাদ্রী মশাই। রাস্তা দিয়ে কে যাচ্ছে খেয়ালই নেই। কেন যেন মনে হলো এঁর সাথে কথা বলি একটু। এখানে বেড়াতে এসে কথা হয়নি দু’গাঁয়ের কারো সাথেই। সুযোগ যখন পাওয়াই গেল, কাজে লাগাই।
হাক্কানিকে বললাম, 'মামা। আপনারা এগুতে থাকেন। আমি গির্জাটা একটু ঘুরে দেখি। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরব।'
'ঘুরে দেখতে চাও, দেখো। তবে একা একা বাড়ি চিনে ফিরতে পারবে তো?'
'কী যে বলেন! একটাই তো রাস্তা। সোজা গেলেই বাঁ দিকে আপনাদের বাড়ি। ছোট একটা বাচ্চাও খুঁজে বের করতে পারবে।'
'আমরা বরং দাঁড়াই এখানটায়। তুমি ঘুরে এসো', বলল বদর।
'না, এটা করা যাবে না। ঐ পাদ্রী বেটা ক্ষ্যাপাটে গোছের। কখন কী করে বসে তার নেই ঠিক। বরং একাই যাও। তুমি ওপারের। নতুন লোক দেখে কিছু না-ও বলতে পারে। আমরা এগুই তাহলে।', বলল হাক্কানি।
আঙিনার চারপাশ বাখারির বেড়া দিয়ে ঘেরা। মাঝে হেলেপড়া কাঠের গেট। গেট পেরিয়ে আঙিনায় ঢুকতে যাব, ঠিক সেই সময় চোখ তুলে তাকাল চিমসে মতন কামলা লোকটা। খ্যানখেনে গলায় জিজ্ঞেস করল, 'কেয়া চাহিয়ে আপকো?'
মনে পড়ল এ আসলে উড়ে, বাঙালি না। বললাম, 'ফাদারসে মিলনা হ্যায়।'
'কাঁহাসে আনা হুয়া?'
'ওপার সে।'
'জারা ঠাইরিয়ে ইঁহা। পাদ্রী সা'বকো পুছনা হ্যায়।'
পুরো ঘটনা বসে বসে দেখছে ফাদার। শুনতেও হয়তো পাচ্ছে। কোনো ভাবান্তর নেই। ধীরে ধীরে হেঁটে ফাদারের কাছে গিয়ে কিছু একটা বলল লোকটা। উত্তরে ওপর-নিচে মাথা দোলাল ফাদার। ফিরে এল বার্তাবাহক। বলল, 'আপ ফাদারসে মিল সাক্তে হেঁ। আইয়ে হামারা সাথ।'
ফাদারের কাছে পৌঁছাতেই ফাদার বললেন, 'সুখিরাম। আন্দারসে আরও এক কুরসি লাও।'
চলে এল আরও একটা ফোল্ডিং চেয়ার। পরিষ্কার বাংলায় ফাদার বললেন, 'বসেন। চেয়ারে বসেন। আমি ফাদার ইয়োহ্যান আয়ার। হৃদয়পুর চার্চের প্যাস্টর। বাংলাদেশ থেকে এসছেন আপনি?'
'নাম কী আপনার?'
'অমিত আঢ্য।'
'কিছু মনে নেবেন না। হৃদয়পুরে বাইরের কেউ আসেনা বললেই চলে। এপারে এলেন, বিষয় কী? এ গাঁয়ে কোনো আত্মীয় আছে আপনার?'
'নাহ্। আত্মীয় কেউ নেই। এক বন্ধুর মামাবাড়ি বেড়াতে এসছি।'
'নাম কী আপনার বন্ধুর মামার?'
'হাক্কানি হাকিম।'
'ওহ্। বুঝেছি আপনি ওপারের হৃদয়পুরেরও কেউ নন। আসল বাড়ি কোথায় আপনার?'
'কুষ্টিয়ার শৈলকুপা থানায়।'
'আপনার বন্ধুর সাথে পরিচয় হলো কীভাবে?'
'আমরা একই হোস্টেলে থেকে পড়ি।'
'হুঁ, বুঝতে পেরেছি। তা এসছেন কবে?'
'আজ সকালেই।'
'এদিকে কোথায় গিয়েছিলেন?'
'তেমন কোথাও না। হৃদয়পুর আম বাগান দেখতে।'
'তা ফিরবেন কবে?'
'কাল যাব হাতিশালায়। পরশু ফিরব।'
'হাতিশালায় কী ব্যাপার?'
'ওখানে নাকি জলঙ্গী নদীর ধারে বহু প্রাচীন এক খান্ডালা আছে। ঐ খান্ডালা দেখতেই যাওয়া।'
'খান্ডালার বিষয়ে জানলেন কীভাবে?'
'হাক্কানি মামার কাছ থেকে।'
'সে কি নিজ থেকেই খান্ডালার কথা বলেছে আপনাকে?'
'না। নিজ থেকে বলেনি। ওপারের হৃদয়পুরে বহু পুরনো একটা মন্দির আছে। নাম ঠাকরুণ বেওয়া। আমার বন্ধুর সাথে গিয়েছিলাম ওখানটায়। সেই কথা বলতে গিয়েই খান্ডালার প্রসঙ্গ উঠে আসে।'
আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন ফাদার। তারপর বললেন, 'অমিত। খুব বড় ধরনের বিপদের ভেতর আছেন আপনি। হাতিশালার খান্ডালা মোটেও কোনো ভালো জায়গা না। আপনার উচিত পত্রপাঠ এখান থেকে বিদেয় হওয়া। সম্ভব হলে আজ-ই।'
আমার মনে হলো ফাদার কিছু বলতে চান। কিন্তু চেপে যাচ্ছেন। রহস্যময় পরিবেশ তৈরি এঁর স্বভাব। একা একা থাকেন, ভালো শ্রোতা আর পাবেন কোথায়! জিজ্ঞেস করলাম, 'বিপদ কেন হবে ফাদার?'
'সে কথা পরে বলব তার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। ঐ পুরনো মন্দিরে কিছু কী দেখেছিলেন?'
আবারও মনে পড়ল আগের সবকথা। সেই সাথে এ-ও মনে হলো, যা দেখেছিলাম তা বোধহয় আসলেও ঘটেছিল!
'ঠাকরুণ বেওয়াকে দেখেছিলাম। সেই সাথে খুব সুন্দরী এক মহিলাকে। একই সাথে একটা হ্যলুসিনেশানের মতোও হয়েছিল। এই ঠাকরুণ বেওয়ার ঘটনা কী আসলে?'
'ঠাকরুণ বেওয়ার বাস্তব অস্তিত্ব আছে কিনা এইটে বলা খুব শক্ত। তবে অনেকেই দেখেছে তাকে। সেই সাথে তার মেয়ে ঘৃতাচীকেও। এখানে প্রথম আসি যুবক বয়সে, চল্লিশ বছর আগে। কয়েক ঘর খ্রিস্টান কোনোমতে টিকে ছিল তখনও। একবার বোশেখ মাসে ঘুরতে বেরিয়ে কাল বৈশাখীর হাত থেকে বাঁচার জন্যে আশ্রয় নিয়েছিলাম ঐ মন্দির চাতালে।
তখনই দেখা পেয়েছিলাম। সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। এরপর আর ওপথ মাড়াইনি কখনও। তবে গাঁয়ের লোকে খুব মান্য করে তাকে। সে-ই নাকি সবরকমের বিপদ-আপদ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে হৃদয়পুরকে।'
'ফাদার, আমি কেন বিপদে আছি সেকথা কিন্তু এখনও বলেননি আপনি। যদি তা-ই হয়, তাহলে জানা দরকার বিপদটা কেন এবং কী ধরনের? সবথেকে বড় প্রশ্ন এসব কথা আগ বাড়িয়ে আমাকে বলছেনই বা কেন? আমি তো আপনার ঘনিষ্ঠ কিংবা পরিচিত কেউ না। একটা অপরিচিত ভিনদেশী ছেলের সাথে পরিচয় হওয়ামাত্র বলছেন, 'বাছা। তুমি বিপদে আছ!'- এর কারণ কী?'
'কারণ, আপনি সত্যিই বিপদে আছেন এবং সময় অতি স্বল্প। পরিচয়কাল দীর্ঘ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই এখানে। দ্বিতীয়বার আর দেখা হবে না। যা বলার বলেছি, শুনলে শুনবেন, না শুনলে, না শুনবেন। আপনার সিদ্ধান্ত। জীবনের ঝুঁকি ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছে এমন কাউকে সাবধান করার ক্ষেত্রে পরিচয়কাল দীর্ঘ হওয়া কোনো পূর্বশর্ত হতে পারে না। কথায় বলে আগ বাড়িয়ে উপকার করতে নেই কারও। কারণ, তাতে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনাই বেশি। তার পরেও কর্তব্য বলে কথা।'
অকাট্য যুক্তি। না মেনে উপায় নেই। জিজ্ঞেস বললাম, 'ঠিক আছে। এখন বিপদটা কী শুনি?'
'এই হৃদয়পুরের একটা জিনিস খেয়াল করেছেন?'
'কী জিনিস?’
'এদের সমৃদ্ধি।'
'উর্বর জমি, দিনরাত পরিশ্রম করছে সবাই। সাহায্য করছে একজন আরেকজনকে। হানাহানি, কাটাকাটি নেই নিজেদের ভেতর। সমৃদ্ধ হওয়ারই কথা।'
'উঁহু, কথা না। জমিনের ফসল প্রকৃতির দান। যতই উর্বর হোক আর চেষ্টা থাকুক, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল মার খেতে বাধ্য। খরা, বন্যা, শিলাবৃষ্টি, পোকমাকড়ের আক্রমণ, বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়া, জমির উর্বরতা কমা, ফলন ভালো না হওয়া─হাজারো সমস্যা। দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার কোথাও এমন গ্রাম নেই।'
'তো কী হলো? এক্সেপশন থাকতেই পারে।'
'পারে না। শতশত বছর ধরে এক্সেপশন থাকতে পারে না, যদি না . . . ।'
'-যদি না কী?'
'এর পেছনে অতিলৈাকিক কোনোকিছুর হাত থাকে।'
কথাবার্তার এ পর্যায়ে আমার মনে হলো, একা থেকে থেকে মাথা নষ্ট হয়ে গেছ এই বুড়োর। ইংরেজিতে কন্সপিরেসি থিওরি বলে একটা কথা আছে। কতিপয় লোক আছে যারা সবকিছুর ভেতর ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়। ভালো কিছু দেখলেই ভাবে, এর পেছনে মন্দ কোনো উদ্দেশ্য না থেকেই পারে না। গুটিকয় অত্যন্ত প্রভাবশালী, মেধাবী লোক আড়ালে বসে কলকাঠি নাড়ছে। বোকা-হাবা জনগণ যার কিছুই জানে না।
মনে যাই-ই ভাবি বুড়োকে থামালাম না। দেখাই যাক না কী বলতে চায়। জিজ্ঞেস করলাম, 'কার অলৌকিক হাত?'
আমার কথার সরাসরি কোনো উত্তর দিলেন না ফাদার। বললেন, 'লক্ষ্য করেছেন এ গাঁয়ে কোনো মন্দির-মসজিদ নেই?'
'নেই আবার কোথায়! ওপারে ঠাকরুণ বেওয়া, এপারে গাঁয়ের এ মাথায় ঐ যে ভাঙা দেউলটা? তাছাড়া মুসলমানের সংখ্য খুবই কম। অন্য কোথায় গিয়ে হয়তো জুম্মার নামাজ পড়ে।'
'দু’টো মন্দিরের কোনোটাই আসলে ব্যবহার হয়না। তাছাড়া, পূব-পশ্চিম এই দুই পাড়া একসাথে ছিল হাজার বছরেরও বেশি। একটাও মসজিদ হলো না এতদিনে!'
ভালো যুক্তি। কিন্তু গির্জার ক্ষেত্রেও তো এটা প্রযোজ্য হওয়ার কথা। অথচ, বাস্তব হলো, এ মুর্হূতে গির্জার আঙিনায় বসে কথা বলছি খোদ যাজকের সাথে!
'ভেবে দেখেন, একজন উপাসকও নেই, ভেঙে পড়ছে গির্জা, কোনোমতে টিকে আছে বুড়ো পাদ্রী আর তার কাজের লোক! মারা যাবে যেকোনো সময়। এরপর বিরাণ হয়ে যাবে এই গির্জাও। এটা কি স্বাভাবিক? খোদ ঠাকরুণ বেওয়াকে চাক্ষুস করেছেন আপনি। দেখেছেন তার ক্ষমতা। তবে এই ঠাকরুণ বেওয়াই সব না। এ হলো গাঁয়ের মোড়লদের যোগাযোগের মাধ্যম মাত্র। আসল নাটের গুরু আন-ইম-ধুগুধ। সে-ই সব ঐশ্বর্যের মূল।'
'আন-ইম-ধুগুধ! এ আবার কী ধরনের নাম? জীবনেও শুনিনি।'
'না শোনারই কথা। জনে জনে জানলে তো সবাই ধনবান হয়ে যেত, নির্ধন আর থাকত কোথায়?'
'কে এ? তিব্বতের কোনো সাধু-সন্ন্যাসী?'
(পড়ুন পঞ্চম তথা শেষ পর্ব)