এক
বিজ্ঞানী ড. মামুন খন্দকার ঘুমের ভেতর থেকেই টের পেলেন তার কোমরের খাপে গুঁজে রাখা চাকুটা সন্তর্পণে কেউ টেনে বের করছে। প্রাণপণে তাকে রোধ করতে চাইলেও ঘুমের জগত থেকে বের হয়ে আসতে কিছুটা সময় লেগে গেল তাঁর। সেই সময়েই বুঝে গেলেন চাকুটা ইতোমধ্যেই বের হয়ে গেছে।
বিজ্ঞানী ততক্ষণে পুরোপুরি জেগে উঠেছেন। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দেওয়ার কথা ভাবতেই জ্বলে উঠল ওটা। ঝলমলে আলোতে ভরে উঠল তাঁর শয়নকক্ষ। চোখের সামনে হন্তারককে দেখে ভীষণ চমকে উঠলেন। অথবা মোটেও চমকালেন না; কারণ, কয়েকদিন ধরে তিনি তার ভয়েই কোমরে চাকু গুঁজে ঘুমাচ্ছেন।
আতঙ্কে ড. মামুন গলাফাটা চিৎকার দেওয়ার জন্য মুখ হাঁ করতেই তার মুখের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল আততায়ীর হাত। তীব্র যন্ত্রণায় শরীর মোচড়ানোর চেষ্টা করতে গেলেন বিজ্ঞানী। কিন্তু তার আগেই তাঁর পেটে ঘচাং করে ঢুকে গেল চাকুটা। কোঁৎ করে কেবল সামান্য একটা শব্দ বেরুলো তাঁর মুখ দিয়ে। এরই মধ্যে প্রচণ্ড জিঘাংসায় বার তিনেক ঢোকানো-বের করা হয়ে গেছে চাকুটা। পুনর্বার ওটা পেটের ভেতর প্রবেশ করতেই বন্ধ দরজায় করাঘাতের আওয়াজ পাওয়া গেল।
ধাম ধাম করে ভেতর থেকে লক করা দরজা ধাক্কাচ্ছে প্রফেসরের একমাত্র কন্যা নিবেদিতা খন্দকার, 'বাবা! বাবা! দরজা খোলো! বাবা . . . বাবা . . .!'
'দুত্তোর! জেগে গেছে শালি! নইলে কুচিকুচি করে কাটতাম তার বাপকে!' মনে মনে গাল দিল খুনি।
তারপর ঘরের এদিক-ওদিক তাকিয়ে পালানো অথবা লুকানোর রাস্তা খুঁজতে লাগল।
দুই
'হ্যালো, নিবেদিতা! হ্যা-লো!' নিবেদিতার ফোনটা ধরে বলল শাহেদ।
ওপাশে দীর্ঘ নীরবতা। কথা বলছে না অথবা বললেও শোনা যাচ্ছে না। কানের সাথে ফোনটা সজোরে চেপে ধরে ওপাশ থেকে শব্দের আলামত খোঁজার চেষ্টা করল শাহেদ। ফোনটা করেছে নিবেদিতাই, অথচ কথা বলছে না। শাহেদ যখন নেটওয়ার্কের সমস্যা ভেবে ফোনটা কেটে আবার ফোন করার কথা ভাবছে ঠিক তখনই তার কানে এলো সামান্য ফোঁপানোর শব্দ।
তার বান্ধবী নিবেদিতা কাঁদছে! মেয়েটা খুবই হাসিখুশি এবং সবাইকে মাতিয়ে রাখতে ভালোবাসে। সে যে কাঁদতে পারে বা কাঁদলেও তার কান্না কেমন হতে পারে সেসব নিয়ে কোনোদিন কোনো ধারণাও করেনি শাহেদ।
শশব্যস্ত কণ্ঠে সে বলল, 'নিবেদিতা! নিবেদিতা! কী হয়েছে?!'
এবার ফোঁপানির স্বর বেড়ে গেল। সাথে যুক্ত হলো চাপা গোঙানি।
এই মাঝরাতে নিবেদিতার কেঁদে কেঁদে ফোন করার কারণ কী হতে পারে ভেবে অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠল শাহেদের মন। ততক্ষণে মেয়েটার কান্নার মাত্রা আরো বেড়েছে। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে সে বলল, 'বাবা আর নেই! একটু আগে ঘরের মধ্যে কে যেন বাবাকে খুন করেছে!'
খবরটি শোনার সাথে সাথে শাহেদের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। গতকালকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একসাথে বাড়ি এসেছে দুই ক্লাসফ্রেন্ড। নিবেদিতা এসেছে তার বাবা খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছিলেন তাই, তার সাথে কোনো প্রয়োজন হতে পারে ভেবে শাহেদও রিকোয়েস্ট করে নিয়ে এসেছে।
নিবেদিতাকে আর কষ্ট করে কথা বাড়ানোর সুযোগ দিল না সে। বলল, 'ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন! শামস ভাইকে নিয়ে আমি এক্ষুণি আসছি!'
তিন
প্রফেসর মামুন খন্দকারের লাশটা দেখে চমকিত শাহেদের মুখ দিয়ে একটি শব্দই বেরিয়ে এলো, 'ভয়ঙ্কর!'
সুমন শামসও চোখ কুঁচকে বিড়বিড় করে কিছু বলল। পেটে একটা চাকু পুরোটাই সেঁধিয়ে আছে, শুধু প্লাস্টিকের চ্যাপ্টা হাতলটা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। পেটে তিনটা গর্ত দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে খুনি মৃত্যু নিশ্চিত করতে কয়েকবার ছুরিকাঘাত করেছে। লাশের কোমরে বাঁধা চামড়ার তৈরি চাকুর খাপ। ধীরে ধীরে মুখের দিকে চোখ পড়তেই আরেকবার শিউরে উঠল তারা।
মুখ হাঁ করে আছেন প্রফেসর, ঠোঁটে নখের পাতলা আঁচড়ের মতো দাগ। রক্ত জমে গেছে সেই দাগ বরাবর। মুখের ভেতর থেকে সামান্য রক্ত মিশ্রিত লালা ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে গলার ওপর পড়েছে। জিহ্বা ও গালের ভেতরের অংশ সামান্য রক্তমাখা।
সুমন শামস লাশের মুখের ভেতর তর্জনী ঢুকিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে আনতে আনতে বলল, 'মুখের হাঁ-টা অস্বাভাবিকভাবে বড়।'
তারপর টেবিলে রাখা টিস্যুবক্স থেকে একটা টিস্যু ছিঁড়ে রক্তমাখা আঙুল মুছে টিস্যুটা পকেটে রেখে দিল। পরক্ষণেই তার নজর পড়ল টেবিলে রাখা একটা হাফপ্লেটে কিছু বরইয়ের বিচি ও আধখাওয়া বরইয়ের দিকে।
'মনে হচ্ছে বরই-ই ছিল প্রফেসরের জীবনের শেষ খাওয়া,' আপন মনে মন্তব্য করল শামস।
ঘরটা আঁতিপাতি করে খুঁজে এমন কিছু পাওয়া গেল না যা খুনির পরিচয় উদঘাটনের কাজে আসতে পারে। শাহেদকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে গেল সুমন শামস। দেখল, খাটের ওপর বসে মাতম করছে নিবেদিতা, তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে কাজের বুয়া। ড্রয়িং রুমে এসে নিবেদিতাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল শাহেদরা।
তাদেরকে দেখে ব্যগ্রভাবে বলল নিবেদিতা, 'কে আমার বাবাকে খুন করেছে বলে দাও প্লিজ!'
শাহেদের বহু প্রচেষ্টা ও প্রবোধের পর কিছুটা শান্ত হলো সে।
তাকে কিছুটা শান্ত হতে দেখে সুমন শামস বলল, 'মনে হচ্ছে, বাঁচার জন্য খুনির সাথে প্রচুর ধস্তাধস্তি করেছিলেন প্রফেসর। সম্ভবত খুনি প্রথমে তাঁর নাকমুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে দুর্বল করে ফেলে। বাতাসের অভাবে তাই বড় করে মুখ হাঁ করেন। তিনি দুর্বল হয়ে গেলে খুনি চাকুটা সহজেই বাগিয়ে নিয়ে পেটে ঢুকিয়ে দেয়।'
শাহেদের কাজিন সুমন শামস ক্রিমিনোলোজিতে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে উচ্চতর শিক্ষা নিতে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শাহেদ জামান আর নিবেদিতা খন্দকার দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী। দুজনের বাড়িই রাজশাহীতে হলেও পরস্পরকে তারা আগে থেকে চিনত না। পরিচয় হওয়ার পর ওদের মধ্যে বন্ধুত্বটা বেশ গভীর। ক্যাম্পাসে ছুটি-ছাটা থাকলে একইসাথে বাড়ি আসা-যাওয়া করে।
নিবেদিতার বাবা ড. মামুন খন্দকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের একজন প্রফেসর এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বোটানিস্ট। সম্প্রতি তিনি জেনেটিক সিমিলারিটির ওপর ভিত্তি করে উদ্ভিদের নতুন শ্রেনীবিন্যাসের পদ্ধতি আবিষ্কার করায় সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
অবশ্য মানুষ ও কলার মধ্যে ৬০% জিনগত সাদৃশ্য থাকায় তিনি মানুষ ও কলাগাছকে একই গোত্রভুক্ত করেছেন বলে কারো কারো সমালোচনারও শিকার হয়েছেন।
নিবেদিতার বয়স যখন বারো তখন ব্লাড ক্যান্সারে তার মাকে হারায়। সেই থেকে বাবাই তার মা। আজ বাবাকে হারিয়ে তাই সব হারানোর যন্ত্রণায় বড় বেশি মুষড়ে পড়েছে মেয়েটা। দুচোখ ফুলিয়ে ফেলেছে কেঁদে কেঁদে।
'পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে?' জানতে চাইল শামস।
'হ্যাঁ। সব আগে আপনাদেরকেই খবর দিয়েছি তারপর পুলিশকে।'
'আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী?' জানতে চাইল শাহেদ।
'প্রতিবেশীদের এখনো জানানো সমীচীন মনে করিনি। কিছু আত্মীয়-স্বজনকে ডেকেছি।'
'পুলিশ কখন আসবে কিছু জানিয়েছে?' জানতে চাইল শামস।
'যখন ফোন করি তখন বলল—এখনই রওনা দিচ্ছি।'
'তার আগে মিস নিবেদিতা আমাকে কি খুন হওয়ার আগ-পরের ঘটনা একটু ব্যাখ্যা করতে পারবেন?' সবিনয়ে বলল সুমন শামস।
ধীর কণ্ঠে শুরু করল নিবেদিতা, 'মৃত্যুর দুই দিন আগে বাবা আমাকে ফোন করে বললেন, 'তুই বাড়ি আয় মা। আমার ভয় করছে।''
'ভয়! কীসের ভয়?' কৌতূহলে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল সুমন শামস।
'সে কথাই বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বাবা বললেন তাকে জানে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে! আমি বললাম– 'বাবা, কীসের হুমকি? কে দিচ্ছে?' বাবা বললেন, 'সেই কথা বলে লাভ নেই, তুই আমাকে বিশ্বাস করবি না! মাঝে থেকে নিজেও বিপদের মধ্যে পড়ে যাবি!''
'হুম, কোনো অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল না তাঁর?' গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো শাহেদ।
'বাবা ছয়মাস আগে তাঁর তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্টকেই বিদায় করে দিয়েছিলেন।'
'কেন?' অবাক হলো সুমন শামস।
'কী জানি! হয়তো কোনো গোপন গবেষণা চালাচ্ছিলেন, তথ্য লিক হওয়ার ভয়ে এই কাজ করেছেন!'
'তারমানে রান্নাবাড়া করার জন্য একজন কাজের মহিলা ছাড়া আর কেউই ছিল না এই বাড়িতে?' নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার জানতে চাইল শামস।
'ঠিক তাই। বাবা কেন জানি মৃত্যুর আগের সময়গুলোতে কাউকেই বিশ্বাস করতেন না। বাড়িতে বসে নিভৃতে গবেষণা করার জন্য ভার্সিটি থেকে ছয়মাসের ছুটিও নিয়ে ফেলেছিলেন। টেস্টটিউব ধোয়া থেকে শুরু করে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের আইপিসে চোখ রাখা পর্যন্ত প্রতিটা কাজ একাই করতেন। তিনি চাইতেন আমি তাঁর কাছে এসে থাকি। কিন্তু আমাকে তো ক্লাস করতে হয়, পরীক্ষা দিতে হয়। এসব বাস্তবতা তিনি বুঝতেন বলে মুখে কিছু বলতেন না। আর আমিও বুঝতাম যে তিনি আমার সঙ্গ কামনা করছেন, তা সত্ত্বেও নিরুপায় ছিলাম। কিন্তু তখন কি আর জানতাম যে তিনি এত তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন? নাহলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে হলেও তাঁর জীবনের বাকি দিনগুলো একসাথে কাটাতাম!'
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা বুজে এলো নিবেদিতার। অন্তর্বাষ্প বের হয়ে এলো দুই চোখের কোণা দিয়ে।
রুমাল দিয়ে চোখ মুছে আবার বলা শুরু করল নিবেদিতা, 'সেদিনই বাবার কথা শুনে প্লেনে করে চলে এলাম। তাঁর চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ দেখলাম; কথাবার্তাও অসংলগ্ন। কোমরে চামড়ার খাপে ভরা একটা বড় নাইফ দেখে বললাম– 'নাইফ কেন বাবা?' বাবা বললেন– 'আত্মরক্ষার জন্য।' ভাবলাম, একাকিত্বের কারণে তাঁর মনোবিকার ঘটেছে। সকালেই তাঁকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাব। অথচ রাত পোহানোর আগেই . . . !' দুহাতে মুখ চেপে হু হু করে কেঁদে ফেলল নিবেদিতা।
তাকে কিছুক্ষণ কাঁদার সুযোগ দিল ওরা। তারপর নিবেদিতা আবার বলা শুরু করল, 'বাবার চিৎকার শুনে তার ঘরে ঢুকে দেখি তার পেটের মধ্যে চাকু ঢোকানো। ততক্ষণে তিনি মারা গেছেন। আমি আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কাজের বুয়া মিনু খালা আমাকে ধরে রেখেছিল। পরে আমি আপনাদের ফোন করলাম।'
হঠাৎ দরজার কলিং বেল বেজে উঠল। কাজের মহিলা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভেতরে ঢুকে পড়ল তিনজন ঊর্দিপরা পুলিশ।
শামসকে দেখে একজন পুলিশ সবিস্ময়ে বলে উঠল, 'দোস্ত তুই!'
'আরে রিয়াজ! বন্ধু, তুই এখানে!' বলে শামস রিয়াজের সাথে করমর্দন করল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অন্যসময় হলে দুজনে কোলাকুলি করত; কিন্তু শোক-সন্তপ্ত পরিবেশ দেখে আবেগ সংবরণ করল তারা।
'হ্যাঁ, আমি ডিবিতে আছি একবছর হলো। প্রফেসর মামুন খন্দকার একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সায়েন্টিস্ট বলে পুলিশ প্রশাসন আমাকে পাঠাল। আমার এসআই দুজনের সাথে পরিচিত হ।' বলে রিয়াজ মাহমুদ তার এসআই দুজনের সাথে সুমন শামসের পরিচয় করিয়ে দিল। শাহেদের সাথেও সৌজন্য করমর্দন শেষ করে তারা দ্রুত কাজের কথায় ফিরে আসল।
রিয়াজ মাহমুদ সুমন শামসের সাথে ঢাকা ভার্সিটিতে ক্রিমিনোলজিতে পড়াশোনা করে বিসিএস দিয়ে এএসপি হিসেবে যোগদান করে। ওদিকে বিদেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার ঝোঁক থাকায় সুমন শামস চাকুরিতে যোগদান না করে সেই পথে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
রিয়াজ মাহমুদ তার এসআইদের নিয়ে তদন্ত করতে শুরু করল। ততক্ষণে নিবেদিতার আত্মীয়-স্বজন আসা শুরু করেছে। শাহেদ নিবেদিতার হয়ে আরো কিছু আত্মীয়-স্বজনকে ফোন করে জানিয়ে দিল। একপর্যায়ে নিবেদিতার সাথে কয়েকদিন পর আবার দেখা করবে বলে বিদায় নিয়ে চলে এলো শাহেদ ও সুমন শামস।
বাসায় এসে শাহেদ ক্যাম্পাসের ফেসবুক গ্রুপে নিবেদিতার পিতৃবিয়োগের খবরটা জানিয়ে দিল। অবশ্য তা না করলেও চলত। কারণ, ইতোমধ্যে অনলাইন পেপার ও টিভি চ্যানেলে ছড়িয়ে পড়েছে খবরটি।
চার
আট দিন পর ডিবি ব্রাঞ্চের ইয়াং অফিসার রিয়াজ মাহমুদ ফোন করল সুমন শামসকে, 'দোস্ত, কেমন আছিস? দেশে না বিদেশে?'
হেসে ফেলল সুমন শামস। তার বিদেশ যাওয়ার জোর প্রচেষ্টার কথা বন্ধুমহল সবিশেষ অবগত।
'দেশের নাম্বারে যেহেতু রিং ঢুকছে তারমানে দেশেই আছি! তুই কোথায়?' হাসতে হাসতে বলল শামস।
'আর বলিস না দোস্ত। সরকারি চাকরির যে প্যাড়া . . . তুই-ই ভালো করেছিস। আমার ট্রান্সফার অর্ডার হয়ে গেছে ঢাকায়!'
'ভালো তো! ভালো পারফর্ম্যান্স দেখাবি আবার ঢাকায় পোস্টিং হলে কান্নকাটি করবি তা তো হবে না বন্ধু!'
'আরে দূর! ভালো পারফর্ম্যান্স আর দেখাতে পারলাম কই? আট দিন হয়ে গেল এখনো প্রফেসরের খুনির টিকিটির নাগালও পেলাম না!'
'ও হ্যাঁ, কেসটার কী খবর এখন? নিবেদিতা মেয়েটা এখন কেমন আছে?'
'দোস্ত! যেটা বলার জন্য ফোন করেছি বুঁজে তদন্তটা তুই কর!' সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে বসল রিয়াজ।
'তদন্ত? আমি কি পুলিশ নাকি?'
'না, ই ফুলিশ! কিন্তু তোর মাথা শার্প আছে।'
'তা ঠিক বলেছিস! নাহলে এত ঘন ঘন বালিশ ফেড়ে তুলো বের হয়ে যায় কেন?'
সুমনের রসিকতায় হাহা করে অট্টহাসি হেসে রিয়াজ বলল, 'আমি কিন্তু জানি তুই কয়েকটা কেস প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসেবে হ্যান্ডেল করে সলভ করেছিস!'
'কে বলল তোকে?' অবাক হয়ে জানতে চাইল সুমন শামস।
'নিবেদিতাই বলেছে!'
'নিবেদিতা! সে কীভাবে জানল?'
'সে জানছে তার ফ্রেন্ড শাহেদের কাছ থেকে। ভুলে যাস না তোর কাজিন কিন্তু তার ক্লাসফ্রেন্ড!'
'ওহ! ছোঁড়াটা দেখি সব যায়গাতেই আমাকে হিরো বানানোর তালে থাকে!'
'হুম, বিশেষ করে তার মেয়ে বন্ধুদের সামনে। যাকগে, নিবেদিতার সাথে আমার তদন্তের খাতিরে অনেক কথা হয়েছে। সে জানিয়েছে, কেসটা মূলত তোকে পাইয়ে দেবার জন্য তার বাবার মৃত্যুর পর সে সবার আগে শাহেদকে ফোন করে। কিন্তু একইসাথে একটা মার্ডার কেসের যাবতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশ ডাকতেও বাধ্য হয়।'
'তারপর?'
'তারপর ভিআইপি মার্ডার ফ্যাক্ট বলে উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে মামলার তদন্তের জন্য আমাকে পাঠানো হয়। আর তুই আমাকে তদন্ত করতে দেখার পর নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিস। আমার হাইপোথিসিস ঠিক?'
'আমি যদি ছোটখাট গোয়েন্দা হয়ে থাকি তাহলে তুই একজন গোয়েন্দার ওপরও গোয়েন্দাগিরি করলি!'
সুমন শামসের কথা শুনে হেসে ফেলল ডিবি পুলিশের তরুণ অফিসার। বলল, 'তুই যদি পুলিশে আসতি তাহলে আমার চেয়ে বড় মাপের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার হতে পারতি। এবার কাজের কথায় আয়, আমি যদি জানতাম তুই তলে তলে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরগিরি করিস তাহলে সেদিনই তোকে সাথে নিয়ে তদন্তে নামতাম। দুই গোয়েন্দা একসাথে মাঠে নামলে খুনি কোথায় লুকাবে? কিন্তু যা হবার হয়েছে। তুই যে মুখচোরা মামা, নিজে থেকে কিছু বলবিও না! আর আমি তোর ক্লোজ ফ্রেন্ড হয়ে এই কেসটা হ্যান্ডেল করছি দেখে নিবেদিতাও তোকে বিব্রত করা হবে ভেবে কিছু বলেনি। কিন্তু আমি কালকে চলে যাচ্ছি দেখে নিবেদিতা আজ আমাকে বলল তোর কাছে কেসটা হ্যান্ডেল করতে চায়। সব শুনে আমার মনে হলো কাজটা তুই পারবি।'
'কিন্তু তুই চলে যাচ্ছিস তো কী হয়েছে? তোর বদলে আর কেউ নিশ্চয় আসছে?'
'দুঃখজনক হলেও সত্য আমার বদলে যার আসার কথা তিনি দুইদিন আগে সিরাজগঞ্জে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে ট্রিটমেন্টের জন্য সিঙ্গাপুর গেছেন।'
'ও! আরমান মুন্তাজির না কী যেন নাম? সেদিন পেপারে পড়লাম তো! তিনিই নাকি?'
'হ্যাঁ, আরমান স্যার আমার তিন ব্যাচ সিনিয়র। অর্ডার হওয়ার পরদিনই বেচারা আহত হন, আগামী কালকেই যোগদান করতে আমি গাজীপুর যাব, গাজীপুরের জন যাবে আরমান স্যারের জায়গায় আর আরমান স্যার সুস্থ হলে এখানে এসে জয়েন করবেন। ততদিন থানা পুলিশ কেসটা হ্যান্ডেল করবে।'
'তাহলে তো হয়েই গেল! থানা পুলিশ কেসটা হ্যান্ডেল করুক?'
'তা তো অফিসিয়ালি করবেই। কিন্তু তুই-ই বল, কেসটা কি একজন ওসির পক্ষে তল পাওয়ার মতো? এত্ত সোজা কিছু হলে নিশ্চয় আমি এমন নাকানি-চুবানি খেতাম না! আর আমার যাওয়ার কথা শুনে ভিক্টিমের ফ্যামিলি আই মিন নিবেদিতা খুব ভেঙে পড়েছে। কেসটার ভবিষ্যত নিয়ে সে শঙ্কিত। সে আমার রিপ্লেসে তোকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে পেতে চাইছে। তার তাই প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তোর কোনো আপত্তি না থাকলে তোকে দিয়ে তদন্তটা করানোর।'
'আপত্তি করে কী করব! নিয়তি মনে হচ্ছে নিয়ত করে ফেলেছে আমাকে এই কাজে ব্যবহার করার!' সহাস্যে বলল সুমন শামস।
'হা হা, ভালো বলেছিস।'
'আমেরিকার এক ঝানু প্রফেসরকে মেইল করেছিলাম তারঁ অধীনে পিএইচডি করতে চাই বলে। এফবিআই, ইন্টারপোলে পর্যন্ত ক্রিমিনোলজিস্ট নিয়োগে তাঁর সুপারিশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। তাঁর সাথে কাজ করতে পারলে . . .' তুড়ি মেরে বাকি কথাটি অসম্পূর্ণ রেখে ফের বলল শামস, 'ভদ্রলোক আমার সিভি দেখেও ইম্প্রেসড!'
বুকের ভেতর সহজাত ঈর্ষার সূক্ষ্ম খোঁচা অনুভব করল রিয়াজ মাহমুদ। তবু বন্ধুর অনাগত সাফল্যের শুভাকাক্ষী হতে দ্বিধা করল না, 'আরে বাহ! তাহলে তো কেল্লা ফতে!'
'এত্ত সহজ না বন্ধু! তিনি আমাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন দুইবছর নতুন স্টুডেন্ট নেওয়ার ভ্যাকেন্সি নেই। দুইবছরের মধ্যে একবছর গেছে, আর একবছর চলছে। স্যার আমাকে বলেছেন কিছু প্র্যাক্টিক্যাল কেস-স্টাডি এটাচ করে পাঠাতে। কাজ পছন্দ হলে বা আমাকে পটেনশিয়াল মনে হলে ফাইনাল করবেন। সেই থেকে আমি গায়ে পড়ে কিছু খুচরো টিকটিকিগিরি করে আসছি। এখন পর্যন্ত তিনটা কেস পেয়েছি, তিনটাই সলভ করতে পেরেছি। জানি না, তাঁর মনে ধরবে কিনা!'
'বাহ! তোর ওপর আস্থা আরো বেড়ে গেল, তুই-ই পারবি এটা। শোন দোস্ত, কাজটা নে।'
'তা না হয় নিলাম। একে তো নিজের গরজ, তার ওপর তুই বলছিস। কিন্তু কথা হলো, আমি প্রাইভেট লোক হিসেবে কীভাবে তোর রিপ্লেসে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করব?'
'আরেহ! এই রিপ্লেস সেই রিপ্লেস না। অফিসিয়ালি দায়িত্বটা রিপ্লেস হয়ে যাচ্ছে আরমান স্যারের কাঁধে। তাঁর সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে এখানে জয়েন করতে কতদিন লাগে কে জানে! আর এই মুহূর্তে রাজশাহী জেলা পুলিশের ডিবি ব্র্যাঞ্চের আদার্স ইনভেস্টিগেটিং অফিসাররা সবাই একেকটা ইম্পর্ট্যান্ট কেস নিয়ে বিজি।
কিন্তু এই কেসটির তদন্ত পজ করে রাখা যাবে না বলে মতিহার থানার ওসিকে দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে। সোজা কথায় যার অর্থ– ওসি সাহেব কিছুই করবে না! শুধু তদন্তটা রানিং আছে বোঝানোর জন্য এই দাপ্তরিক ব্যবস্থা! তারমানে, সরকারের দক্ষ অফিসারেরও অভাব আবার কাজটা দ্রুত সারারও তাগাদা আছে।
এমতাবস্থায় আউটসোর্সিং না করে উপায় কী? আমার সুপারিশে থানা তোকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে। কাজটা তুই পুরোটাই করবি, কনসালট্যান্ট হিসেবে মোটামুটি ভালো একটা অঙ্কও পাবি। কিন্তু অল ক্রেডিট উইল গো টু মতিহার থানার ওসি!'
'হা হা হা!' রিয়াজের বলার ধরণে হেসে ফেলল সুমন শামস।
'তুই বেসরকারি লোক, তোকে এরচেয়ে ভালোভাবে রিকগনাইজ করার সরকারি উপায় দেখছি না। পুলিশ তো আর কোনোদিন বলবে না যে আমরা পারিনি বলে কাজটা তাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছি। পুলিশ বলবে আমরা তার সহায়তায় কাজটা করেছি!'
'তা হোক, আমার পোর্টফোলিওতে কাজটা যোগ করতে পারলেই চলবে। কিন্তু আমি ভাবছি, এর মধ্যে আরমান স্যার চলে আসলে কী হবে?'
'চলে আসলে স্যার চাইলে তুই স্যারের সাথে যৌথভাবে তদন্ত করবি। না চাইলে তোর গবেষণার সমস্ত অগ্রগতি স্যারের হাতে তুলে দিয়ে বিল নিয়ে বিদায় নিবি! তবে স্যার খুব ভালো মানুষ, তিনি অবশ্যই তোকে শেষ পর্যন্ত কাজটার সাথে রাখবেন।'
'ওকে ডান!' দাবার শেষ চাল দেওয়ার মতো করে সুমন শামস বলল।
'এখানে সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ পুলিশের এই সিদ্ধান্তে ভিক্টিমের ফ্যামিলি খুব খুশি। নিবেদিতা তোকে ফোন করে কেসটা নিতে রিকোয়েস্ট করবে। তার আগেই তোকে দ্বিধামুক্ত রাখার জন্য আমি সব জানিয়ে দিলাম। কেসটা নিয়ে খুব ভাবিস দোস্ত! কারণ, সরকার খুব ইমেজ সঙ্কটে পড়ে গেছে।
জানিস কিনা, নিবেদিতার বাবা অরাজনৈতিক মানুষ হলেও খুব সাহসী ভাষায় পত্রিকায় কলাম লিখতেন। সরকারের সমালোচনা করতেও ভয় পেতেন না, এই কারণে তাঁর মৃত্যুকে বিরোধী দল গভমেন্ট কিলিং হিসেবে প্রচার করে পলিটিক্যাল ইস্যু বানানোর চেষ্টা করছে। তাই কেসটা চলমান রাখা সরকারের ঐকান্তিক ইচ্ছা। তুই এক কাজ কর, আজকেই বিকেল চারটার সময় চলে আয় থানায়। তোর সাথে থানার লিখিত এগ্রিমেন্ট করে নেব। আর দুজনে চা খেতে খেতে তোকে আমার অগ্রগতিটুকু ব্রিফ দিয়ে নেব।'
'ওকে বন্ধু, থ্যাংক ইউ।'
পাঁচ
সেদিন শুক্রবার নিবেদিতার ড্রয়িংরুমে তার সঙ্গে বসে আছে সুমন শামস। বাজার করতে যাওয়ার জন্য শাহেদ তার সাথে আসতে পারেনি। নিবেদিতাকে এখন দেখে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। যদিও বাবার মৃত্যুশোকে তার অন্তর্দহন হচ্ছে কিন্তু নিজেকে চমৎকারভাবে সামলে রাখতে পেরেছে এই বিজ্ঞানীকন্যা।
সুমন শামসকে এই কেসের গোয়েন্দা হিসেবে পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত মেয়েটা। সেই আনন্দ প্রকাশ করল মুখে বলে, 'সত্যি, আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ এই কেসটা নিয়েছেন বলে।'
সুমন শামস বলল, 'এখনই এত কৃতজ্ঞতার কী আছে? আগে তো সলভ হোক! তাছাড়া আমার ভাইয়ের ফ্রেন্ডকে হেল্প করা তো আমার দায়িত্বই ছিল।'
কিছুক্ষণ দম নিয়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে এলো শামস, 'আচ্ছা, ডিবি অফিসার রিয়াজ মাহমুদ তো সময় স্বল্পতার কারণে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। কাজেই পুরো কেসটাই আমাকে সলভ করতে হবে। তবে সে একটা জিনিস জানিয়ে আমার সময় বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে।’
(পড়ুন দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব)