(প্রথম পর্বের পর)
আপনার বাবা আপনাকে বলেছিলেন যে তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এই কথা থেকে মনে হয়, তিনি সরকারের সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখতেন বলে হুমকিটা সরকারের তরফ থেকে আসতে পারে।
কিন্তু আপনার বাবা সরকারি দলের হাতে খুন হননি এই তথ্য আমাকে জানিয়েছে রিয়াজ। সে সরকারের ভেতরের মানুষ এবং আমার কাছের বন্ধু হওয়ায় সরকারের পালস বোঝা এবং বিশ্বাস করাটা আমার পক্ষে সহজ হয়ে গেছে। সে এই কেস না নিয়ে অন্য কোনো অফিসার নিলে আমি তাকে কতটা বিশ্বাস করতে পারতাম কে জানে?
সে এতটুকুও বের করতে পেরেছে যে আপনার বাবাকে যে খুন করেছে সে কোনো মোটিভ নিয়ে করেনি। অথবা মোটিভ থাকলেও তা আমাদের চেনাজানা মোটিভের সাথে একেবারেই মিলবে না। মানে আপনার বাবাকে খুন করার কথা কোনো হিংসুটে কলিগের, বহিঃরাষ্ট্রের বা আন্তর্জাতিক আন্ডারওয়ার্ল্ডের কারো। কারণ, তিনি বিলিয়ন ডলার কামানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার নিয়ে ছিলেন।
কিন্তু এমন কিছু হয়নি। আপনার বাবার কোনো প্রতিবেশীর মধ্য থেকে শত্রু ছিল না। আবার তার কোনো ভাই-ভাতিজাও নেই যে জমিজমার পার্সেন্টেজের আশায় খুন করবে। একমাত্র বোনটি সপরিবারে আমেরিকায় সেটেল্ড ছিলেন, তিনিও গত বছর ক্যান্সারে মারা গেছেন। ভাগ্নে-ভাগ্নিরা ওই দেশে স্বচ্ছল জীবন যাপন করছে। কাজেই আত্মীয়-স্বজনও বাদ। তাহলে থাকল কে? পুরো ঘোলাপানি হয়ে গেল। এই ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করতে না করতেই রিয়াজের বদলির আদেশ হয়ে গেল।'
'তাই তো দেখছি! কিন্তু বাবার খুনিকে তো বের করে দিতেই হবে ভাইয়া! আপনার সম্মানী নিয়ে চিন্তা করবেন না!' অনুনয় ঝরে পড়ল নিবেদিতার কণ্ঠে।
'টাকার কথা বলবেন না, টাকাটা আমি থানা থেকে পাব।'
'সে আমি জানি, এর বাইরেও আমি আপনাকে একটা হ্যান্ডসাম পেমেন্ট করব।'
মৃদু হেসে সুমন শামস বলল, 'আচ্ছা, পরের বিষয় পরে। আপনার বাবার খুনিকে বের করাটা আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।'
'তবে আপনাকে একটা সুখবর দিতে চাই মিস নিবেদিতা, রিয়াজ তার সন্দেহের খাতা থেকে আপনাকে বাদ দিয়ে গেছে!' যোগ করল শামস।
'মানে কী! উনি আমাকেও সন্দেহ করেছিলেন নাকি? ডেঞ্জারাস লোক তো!'
'মোটিভ চিন্তা করলে তার সন্দেহ অমূলক নয়। আমরা সন্দেহের খাতা থেকে কাউকেই বাদ দিই না। কারণ, মেয়ে বাবাকে খুন করবে না এমন নিশ্চয়তা কোথাও দেওয়া নেই। আজকাল এমন কিছু বাদ নেই যে ঘটছে না। এ কারণে সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম বলেছেন, “অপরাধ একটি সামাজিক ঘটনা। মানে জন্ম-মৃত্যু, বিয়ে-শাদির মতো অপরাধও স্বাভাবিকভাবেই ঘটবে। একে কোনোভাবেই নির্মূল করা যাবে না। আর এই অপরাধ যে কোনো সময় যে কেউ করে বসতে পারে।”
'তা আমাকে সন্দেহের খাতা থেকে পরে বাদ দেওয়া হলো কী মনে করে?'
'তার আগে বলি, সন্দেহের খাতায় রাখা হয়েছিল কী মনে করে। আপনি আপনার বাবার একমাত্র কন্যা। বাবা মারা গেলে সবকিছুর মালিক হবেন। কাজেই দ্রুত সবকিছুর মালিক হওয়ার তাড়া আপনার মধ্যে থাকতেই পারে। পরে রিয়াজ গোপনে আপনার পার্সোনাল লাইফস্টাইলের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়ে নিশ্চিত হয়েছে যে আপনি এর মধ্যে নেই।'
'যাক!' স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল নিবেদিতা।
'তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি . . .' আবার শুরু করল শামস, 'মোটিভ ছাড়া খুন করতে পারে একমাত্র পাগল। কিন্তু আপনার বাবার খুনি পাগল নয়। পাগল হলে একবার চাকু মেরেই ক্ষান্ত হত। ঘাতক তিন চারবার চাকু মেরেছে একই জায়গায়, মানে কী পরিমাণ জিঘাংসা কাজ করেছে তার ভেতর!
আবার চাকুটা মেরেছে আপনার বাবার কোমর থেকেই বের করে। তারমানে খুনি খুন করার আগে রেকি করেছে; দেখেছে যে তিনি কোমরে চাকু বেঁধে ঘুরেন। পাগলের ঘটে এই বুদ্ধি থাকলে সে আর পাগল হলো কীভাবে? আবার যে চাকু দিয়ে খুন করা হয়েছে তাতে হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি!
সব মিলে দেখা যাচ্ছে, যে খুন করেছে সে যথেষ্ট ঠাণ্ডা মাথায়, প্ল্যান প্রোগ্রাম করেই খুন করেছে। আর যে এত ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে তার মোটিভ না থেকে যায় না। নিশ্চয় ঘাতকের কোনো উদ্দেশ্য আছে যা আমরা এখনও জানি না।'
নিবেদিতা দুই হাত নেড়ে অধৈর্য কণ্ঠে বলল, 'আমি এত কিছু বুঝি না! আমি শুধু বুঝি যে আমার বাবার খুনিকে ধরে দেবেন!'
'সেই চেষ্টা আমরা করছি, মিস। আচ্ছা, সেদিন তো কথার মাঝখানে পুলিশ এসে পড়ায় আপনার বাবার মৃত্যুর ঘটনাটি ভালো করে শোনা হয়নি। আজকে একদম ঠাণ্ডা মাথায় আরেকবার বলুন তো!'
'সেদিন রাত আনুমানিক তিনটার দিকে বাবার আর্তচিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দ্রুত বাবার রুমে গিয়ে দেখি, ভেতর থেকে দরজা বন্ধ! ধাক্কাধাক্কি করে খুলতে না পেরে ভাঁড়ার ঘর থেকে একটা শাবল নিয়ে এসে কাজের বুয়া মিনু খালাকে সাথে নিয়ে দরজাটা ভাঙলাম। ভেঙে দেখি বাবার বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পেটে তার নিজের চাকুটা বসানো। তারপর তো শাহেদকে ফোন করলাম, পুলিশকে ফোন করলাম।'
'এক মিনিট! আপনি বলছেন, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। তাহলে খুনি পালাল কোনখান দিয়ে?'
'সেটা কি আর আমি জানি? এই প্রশ্ন তো রিয়াজ সাহেবও করেছিল।'
'যদি আপনার কথা নির্ভুল হয় তাহলে খুনি তখনও ঘরের ভেতরেই ছিল!'
'মাই গড! বলেন কী!'
'হ্যাঁ, লজিক তা-ই বলে। আপনি কি ঘরের ভেতরটা ভালো করে দেখেছিলেন?'
'সেই সময় দেখার মুডে ছিলাম না। তারপরেও রাফলি চারদিকে তাকিয়ে ছিলাম; কাউকে দেখিনি।'
'তারমানে খুনি আসলেই তখন ঘরের মধ্যে ছিল। হয়তোবা খাটের নিচে; হয়তোবা আলমারির মধ্যে বা যে কোনো জায়গায়। কিন্তু ভেতর থেকে দরজা লক করা থাকলে খুনি ঘরের মধ্যে ঢুকল কেমন করে?'
'বাবা অনেক ভুলোমনা। কোনোদিন দরজা দিতেন, কোনোদিন দিতেন না। হয়তোবা সেদিন দেননি।'
'উঁম।' খানিকক্ষণ চিন্তা করল শামস। যেন ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তারপর আবার বলল, 'সেক্ষেত্রে খুনি নিজেই ভেতরে ঢোকার পর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।'
'অসম্ভব কী, হতেই পারে!' স্বেচ্ছায় মতামত দিল নিবেদিতা।
শামস বলল, 'এতক্ষণে ভালো করে বুঝলাম রিয়াজ কেন আপনাকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছিল। খুনের ব্যাপারটা প্রথম জানতে পারেন আপনি, দরজা ভাঙার উদ্যোগও নেন আপনি। দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল না বাইরে থেকে লাগানো ছিল তা আমরা জানি না।
ডোন্ট মাইন্ড, বাপকে খুন করে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে পরে শাবল দিয়ে ভেঙে ভেতরে ঢুকে যদি প্রচার করেন যে দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল তাতে কারো কিছু বোঝার উপায় নেই। আর আগে থেকে হাত করে রাখলে কাজের বুয়া তো আপনার পক্ষে কথা বলতেই পারে!'
'ভাইয়া! এক কথাটি শুনতে শুনতে আমি কিন্তু অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি! আপনিও কি আমাকে সন্দেহের তালিকায় ফেলেছেন?' একরাশ ক্লান্তি ফুটে উঠল নিবেদিতার কণ্ঠে।
'না! রিয়াজের কাজের প্রতি যদি আমার আস্থা না থাকত, তাহলে আমি আপনাকে আবার সন্দেহের লিস্টে ঢোকাতাম। কিন্তু সে যখন আপনাকে বাদ দিয়েছে তখন আমি আর ঐপথে সময় নষ্ট করব না। তাছাড়া আপনি খুনি হলে খুন করার পর অহেতুক বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে শাবল দিয়ে ভাঙতে যেতেন না।'
'একদম! এই কথাটিই বলতে চাচ্ছিলাম!'
'আপনি যখন ফোন করার জন্য বেরিয়ে এসেছিলেন তখন কি বুয়াও আপনার সাথে বেরিয়ে এসেছিল?'
'হ্যাঁ।'
'তারমানে আপনি যখন বুয়াকে নিয়ে বের হয়েছেন তখনই খুনি ঘর থেকে বের হয়ে কোনোভাবে পালিয়ে গেছে।'
'আমারও তাই মনে হয়!' সমর্থন দিল নিবেদিতা।
আবার জিজ্ঞেস করল শামস, 'আচ্ছা, আপনার বাবার পছন্দ-অপছন্দগুলো আমার একটু জানা দরকার। মৃত্যুর পূর্বে তিনি কী কী করতেন সেসব না জানলে সামনে আগানো যাবে না। এই কারণে তার নথিপত্রগুলোও আমার দেখা দরকার।'
শামসের কথা শুনে নিবেদিতা তাকে তার বাবার হোম ল্যাবরেটরিতে নিয়ে এলো। ল্যাবের আলমারি ভর্তি সারি সারি বই দেখে তাক লেগে গেল শামসের। দেশ-বিদেশের বহু লেখকের বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখা উদ্ভিদতত্ত্বের ওপর মোটা মোটা বই। এক তাকে কিছু বিদেশি জার্নাল।
শামসের উদ্দেশ্য- এসবের ফাঁকফোকরে যদি কোনো গোপন ডায়েরি বা কাগজপত্র পেয়ে যায় যাতে তার সাম্প্রতিক দিনলিপি লিপিবদ্ধ থাকবে তাহলে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে তার চিন্তাধারা জানা যাবে যা অনেক সময় খুনিকে ধরতে সাহায্য করে। কিন্তু এসবের মধ্যে তা খোঁজা খড়ের গাদায় সু্ইঁ খোঁজার শামিল। খুঁজতে খুঁজতে একটা তাকে শামস দেখল তালা লাগানো আছে। সে নিবেদিতার কাছে জানতে চাইল তালা লাগানোর কারণ।
মেয়েটা বলল, 'এই তাকে বাবার স্পেশাল বইগুলো আছে।'
এই জিনিসই তো খুঁজছিল শামস। তড়িঘড়ি করে তাই বলল, 'খোলা যাবে প্লিজ?'
'তাহলে একটু ওয়েট করুন।' বলে নিবেদিতা চলে গেল চাবি আনতে। চাবি এনে সে খুলে দিল তাকটি। তাকটি খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একসারি সাজানো বই। সবগুলোই বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর লেখা। সুমন শামস একে একে নামগুলো পড়ে যেতে লাগল : অব্যক্ত, Response in the Living and Non-Living, Life Movements in Plants, Comparative Electro-Physiology, Plant Response as a Means of Physiological Investigation, The Physiology of Photosynthesis, Researches on Irritability of Plants, The Physiology of the Ascent of Sap, The Nervous Mechanism of Plants, Growth and Tropic Movements of Plants ইত্যাদি।
কিছু পুরাতন জার্নালও দেখা গেল। সেই তাকের নিচের তাকে পাঁচটি বই দেখল যেগুলোর সবগুলোর লেখকের নামের জায়গায় লেখা রয়েছে ড. মামুন খন্দকারের নাম। বইগুলোর পাশে একটা ডায়েরি। শামস ডায়েরিটা নিয়ে দেখল, তার পাতা এখনো রয়ে গেছে।
সর্বশেষ লেখার পাতাটি খুলে দেখল; লেখা রয়েছে—‘আজ আমাকে স্পষ্ট হুমকি দেওয়া হয়েছে! আমার ভয় করছে! কিন্তু ফিরে আসার পথ বন্ধ! মেয়েটাকে ডেকেছি, সে প্লেনে করে রওনা দিয়েছে।’ তারিখ দেওয়া আছে মৃত্যুর আগের দিন। তারমানে এই ডায়েরিটা আদ্যোপান্ত পড়লে মৃত্যুর কারণ কিছুটা জানতে পারার সম্ভাবনা প্রবল।
'ডায়েরিটা আমি পড়ার জন্য নিতে পারি?' নিবেদিতার অনুমতি চাইল শামস।
'তদন্তের কাজে লাগলে তো দিতেই হবে। তবে বাবার শেষ স্মৃতি। যত্ন করে রাখবেন প্লিজ!'
'সে আর বলতে?'
'চলুন, আপনাকে বাবার বাগানটা দেখাই।' বলে নিবেদিতা ল্যাবের একটা দরজা খুলে দিল।
শামস দেখল তারা এক প্রাচীরঘেরা বাগানে উপস্থিত হয়েছে। মটরশুঁটি, লজ্জাবতী, বন-চাঁড়াল, জবা, কল্কাসুন্দরী, ডালিম, বরই, আম—এক কথায় বীরুৎ, গুল্ম, উপগুল্ম, বৃক্ষ কিছুই বাদ যায়নি সেখানে। একপাশে একটা বেডে কয়েক প্রজাতির ক্যাকটাস গাছ রোপিত রয়েছে। এই প্রথম শামস রঙ বেরঙের ক্যাকটাস ফুল দেখল। কণ্টকাকীর্ণ এই গাছে যে এমন স্বর্গীয় ফুল ফুটতে পারে তা তার কল্পনাতেও ছিল না।
একে একে শামস সবগুলো ক্যাকটাস গাছে লাগানো ট্যাগ পড়তে শুরু করল। স্যাগুয়ারো, প্যারোডিয়া, ম্যামিলারিয়া, গোল্ডেন ব্যারেল, অ্যাস্ট্রোফাইটাম, প্রিকলি পিয়ার্স আরো কত কত নাম। স্যাগুয়ারো ক্যাকটাস এর সাইজ দেখে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হলো তার; রীতিমতো এক একটা মানুষের সমান। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে নিবেদিতা জানালো, 'এগুলো বাচ্চা। বড় হলে ৫০ ফুট পর্যন্ত হয়, বাঁচেও ভালো, প্রায় ২০০ বছর।'
শামস গাছগুলোর কাছে গিয়ে দেখল, প্রতিটি গাছের গোড়ার কাছের মাটি নিড়ানি দেওয়ার পর যেভাবে আলগা হয়ে থাকে সেভাবে আলগা হয়ে আছে।
তা দেখে শামস বলল, 'আপনার বাবা নিড়ানি দিতেন নাকি রোজ?'
'রোজ না হলেও বাবা নিয়মিতই যত্ন নিতেন গাছগুলোর। নিজ হাতে মাটি নিড়ানি দিতেন; পানি, সার দিতেন।' উত্তর দিল নিবেদিতা।
হঠাৎ স্যাগুয়ারো ক্যাকটাসের সারিতে একটা জায়গায় দৃষ্টি পড়তে শামস বলল, 'আরে, এই জায়গাটা ফাঁকা দেখছি! মনে হচ্ছে একটা ক্যাকটাস গাছ কেউ উপড়ে নিয়েছে?'
'হুম, এখানে একটা ক্যাকটাস গাছ ছিল। ডালপালা ছড়িয়ে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল। বাবা কয়েকমাস আগে গাছটা কেটে ফেলেন। আর তার ছোট্ট একটা ডাল নিয়ে এখানে লাগিয়ে দেন। সেটা পরে বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল।'
'এখন সেই চারাগাছটা কই?'
নিবেদিতা বলল, 'তা-ই তো দেখছি! আমার অনেকদিন এই বাগানে আসা হয় না।'
কিছুক্ষণ পর আবার বলল, 'দাঁড়ান দাঁড়ান! মনে পড়েছে! আমি সর্বশেষ গাছটা দেখেছি বাবা যেদিন খুন হন সেদিন তার বেডসাইড টেবিলের ছোট টবে!'
নাছোড়বান্দার মতো শামস আবার জিজ্ঞেস করল, 'কই, আমরা যে দেখলাম না সেদিন?'
'হ্যাঁ, বাবার চিৎকার শুনে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখি গাছটা টেবিল টবে, কিন্তু ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আবার যখন ঘরে ঢুকি, ওটাকে আর দেখিনি।' জবাব দিল নিবেদিতা।
'দাম কেমন হতে পারে গাছগুলোর?' জানতে চাইল সুমন শামস।
'এই প্রজাতির ক্যাকটাস আমেরিকায় পাওয়া যায়। বাবা ফুফুর ওখানে বেড়াতে গিয়ে ফেরার সময় নিয়ে এসেছিলেন। সেই দেশে এটা প্রচুর পাওয়া যায়, সেজন্য সেখানে দামও খুব বেশি না। কিন্তু এদেশ হিসেবে দাম ভালোই হবে।'
সুমন শামস একটা ক্যাকটাসের গা থেকে একটা কাঁটা ভাঙতেই দুধসাদা রস বেরিয়ে এলো।
সেটা দিয়ে নিজের আঙুলে খোঁচা দিতে দিতে সে বলল, 'তাহলে তো দেখি কেসটা আরো প্যাঁচিয়ে গেল। কে বা কারা একটা ক্যাকটাস গাছ চুরি করে নিয়ে গেছে, আর মেরে রেখে গেছে আপনার বাবাকে।'
'আপনি কি বলতে চাচ্ছেন এটা কোনো ছিঁচকে চোরের কাণ্ড? একটা ক্যাকটাসের জন্য মানুষ খুন!' সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল নিবেদিতা।
'না, খুনি ছিঁচকে চোর নয়। হতে পারে ক্যাকটাসটাই কোনো কারণে অমূল্য ছিল! কোনো ক্যাকটাসপ্রেমীর কাছে সেটা অমূল্য হতেই পারে। আবার এমনও হতে পারে, এর কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যার কারণে এটা অমূল্য। সেক্ষেত্রে আমাদের বের করতে হবে রাজশাহীর মধ্যে ক্যাকটাসপ্রেমী কারা আছে! কী এই ক্যাকটাসের অমূল্য বৈশিষ্ট্য!
কেসটা এমনিতেই ক্লুলেস, তারওপর এখন ভজঘট পাকিয়ে আরো জটিল করে ফেলল। ঠিক আছে মিস নিবেদিতা। আমাকে আপনার বাবার সাথে যারা চলাফেরা করতেন তাদের নাম ঠিকানার একটা লিস্ট বানিয়ে মেইল করবেন। আর তার মোবাইলের কললিস্টটাও স্ক্রিনশট দিয়ে পাঠাবেন। আজকের মতো ঘরে ফেরা যাক, একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে।'
'আচ্ছা ভাইয়া!'
ছয়
বুকের যত সুপ্ত কথা সব কি রে হয় ব্যক্ত?
কিছু কথা থাক না নাহয় অনুক্ত-‘অব্যক্ত!’
ডায়েরির প্রথম পাতায় এই লেখাটি দেখেই থমকে গেল সুমন শামস। মনে হচ্ছে ড. মামুন খন্দকার বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর লেখা বই ‘অব্যক্ত’ এর দিকে ইশারা করেছেন।
সেক্ষেত্রে খুব মামুলি একটা হেঁয়ালি হয়েছে এটা; হয়তোবা তিনি তেমন লুকোছাপার মধ্য দিয়ে যেতে চাননি। অথবা হয়তো তিনি কোনো হেঁয়ালিই করতে চাননি; ব্যক্তিগত ডায়েরিতে শখের বসে একটু ইঙ্গিতাবহ ভাষায় লিখে রেখেছেন। যেটাই হোক, মনে হচ্ছে অব্যক্ত বইটা পড়লে কিছু একটা জানা যাবে। সঙ্গে সঙ্গে সুমন শামস ডাক দিল শাহেদকে।
শাহেদ আসলে বলল, 'তোর মোটর সাইকেলটা নিয়ে কষ্ট করে নিবেদিতার বাসায় যা তো!'
'কেন ভাই?'
'গিয়ে জগদীশ চন্দ্র বসুর অব্যক্ত বইয়ের কপিটা নিয়ে আয়।'
'এর মধ্যে আবার জগদীশ এসে পড়ল কেমন করে?' বিড়বিড় করে বলতে বলতে চলে গেল শাহেদ।
তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি ফুটল শামসের ঠোঁটে।
কয়েক ঘণ্টা পর নিবেদিতার বাবার স্পেশাল কালেকশন থেকে অব্যক্ত-টা এনে দিয়ে শাহেদ বলল, 'ভাই, তোমার কি ধারণা জগদীশের ভূত নিবেদিতার বাবাকে খুন করেছে?'
'এত বেশি বুঝিস কেন?' হাসতে হাসতে শামস তাকে ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা ছন্দটা দেখিয়ে বলল, 'আমার ধারণা ড. মামুন খন্দকার ইনভার্টেড কমার মধ্যে অব্যক্ত লিখে জগদীশের অব্যক্ত বইটার দিকে ইশারা করেছেন। তাই ভাবলাম, বইটা পড়ে দেখি কিছু পাই কিনা!'
'হুম! হতেও পারে। নিবেদিতাও জিজ্ঞেস করছিল, হঠাৎ সুমন ভাইয়ার অব্যক্ত পড়ার ইচ্ছা হলো কেন?'
'কী বললি তুই?' জানতে চাইল শামস।
শাহেদের জবাব, 'আমি বললাম, জানি না। তখন নিবেদিতা বলল, এরই মধ্যে সুমন ভাইয়া কী করে অনুমান করে ফেলল যে অব্যক্ত বাবার প্রিয় বই ছিল? তিনি কিশোর বয়সে এই বই পড়েই উদ্ভিদবিদ্যা পড়তে আগ্রহী হয়েছিলেন!'
'তাই নাকি! তাহলে তুই এখন যা! নির্ঘাৎ এই বইটা পড়লে কিছু পাওয়া যাবে!'
বইটা খুলতেই শামসের ভেতর এক ঘোরলাগা অনুভূতি হলো। এই বই পড়েই কিশোর বয়সে ড. মামুন খন্দকার বোটানিস্ট হবার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এখনই শামস হাইলাইট করা অংশগুলো পড়ে দেখতে পাবে বইটির কোন অনুচ্ছেদগুলো পড়ে তার কিশোর মন উদ্ভিদ জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল!
সে বিক্ষিপ্তভাবে বইটার পাতা উল্টিয়ে দেখল, মার্কার পেন দিয়ে বইটির জায়গায় জায়গায় হাইলাইট করা আছে। সম্ভবত কলাপাতা কালার দিয়ে হাইলাইট করা হয়েছিল, কালের স্রোতে সেই রঙ এখন বিবর্ণ হয়ে প্রায় সাদা হয়ে গেছে।
যেমন এক জায়গায় মার্ক করা আছে– 'গাছ স্বভাবতঃ কতখানি করিয়া বাড়ে তাহা জানিতে হইলে অনেক সময় লাগে। শম্বুকের গতি হইতে গাছের বৃদ্ধিগতি ছয় সহস্র গুণ ক্ষীণ, এজন্য আমাকে এক নূতন কল আবিষ্কার করিতে হইয়াছে, তাহার নাম ক্রেস্কোগ্রাফ। তাহা দ্বারা বৃদ্ধিমাত্রা কোটি গুণ বাড়াইয়া লিপিবদ্ধ হয়।'
এতটুকু পড়ার পর কৌতূহল বেড়ে গেল শামসের। এই যন্ত্র নিয়ে আগে থেকেই ফ্যাসিনেশন ছিল তার। যখন ক্লাস সিক্সের পাঠ্যবইয়ে প্রথম পড়েছিল যন্ত্রটির কথা। উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও সাড়া প্রদান মাপা যায় এই যন্ত্রের সাহায্যে। কিন্তু এমন অদ্ভূত যন্ত্র কেমন করে কাজ করে তা জানা হয়নি কখনো। এই বইয়ে কি এমন কিছু লেখা আছে? জানার কৌতূহলে শামস পাতার পর পাতা উল্টে চললো।
হঠাৎ কয়েকটি লাইনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো তার– 'গাছের সাড়া দিবার কথা বলিয়াছি। এখন কঠিন সমস্যা এই, কী করিয়া গাছের সাড়া লিপিবদ্ধ করা যাইতে পারে। জন্তুর সাড়া সাধারণত কলম সংযোগে লিপিবদ্ধ হইয়া থাকে।
কিন্তু চড়ুই পাখির লেজে কুলা বাঁধিলে তাহার উড়িবার যেরূপ সাহায্য হয়, গাছের পাতার সহিত কলম বাঁধিলে তাহার লিখিবার সাহায্যও সেইরূপই হইয়া থাকে। এমন-কি, বন-চাঁড়ালের ক্ষুদ্র পত্র সুতার ভার পর্যন্তও সহিতে পারে না; সুতরাং সে যে কলম ঠেলিয়া সাড়া লিখিবে এরূপ কোনো সম্ভবনা ছিল না। এজন্য আমি অন্য উপায় গ্রহণ করিয়াছিলাম।
আলো-রেখার কোনো ওজন নাই। প্রথমত, প্রতিবিম্বিত আলো-রেখার সাহায্যে আমি বৃক্ষপত্রের বিবিধ লিপিভঙ্গী স্বহস্তে লিখিয়া লইয়াছিলাম। ইহা সম্পাদন করিতেও বহু বৎসর লাগিয়াছিল। যখন এই সকল নূতন কথা জীবতত্ত্ববিদদিগের নিকট উপস্থিত করিলাম, তখন তাহারা যারপরনাই বিস্মিত হইলেন। পরিশেষে আমাকে জানাইলেন যে, এই সকল তত্ত্ব এরূপ অভাবনীয় যে, যদি কোনোদিন বৃক্ষ স্বহস্তে লিখিয়া সাক্ষ্য দেয়, কেবল তাহা হইলেই তাহারা এরূপ নূতন কথা মানিয়া লইবেন।
(চলবে)
(পড়ুন তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব)