(তৃতীয় পর্বের পর)
'ভাইয়া, আপনি কি পাগল! না মানে গাছ মানুষকে হুমকি দিচ্ছে ব্যাপারটা কেমন অবিশ্বাস্য না?'
'হ্যাঁ অবিশ্বাস্য। কিন্তু জগদীশের অব্যক্ত বইয়ে ক’টি বাক্য আছে এমন—
“আজ সহৃদয় সভ্যসমাজের নিকট স্বীকার করিতেছি, নিরীহ গাছপালার নিকট হইতে বলপূর্বক সাক্ষ্য আদায় করিবার জন্য তাহাদের প্রতি অনেক নিষ্ঠুর আচরণ করিয়াছি। এই জন্য বিচিত্র প্রকারের চিমটি উদ্ভাবন করিয়াছি—সোজাসুজি অথবা ঘূর্ণায়মান। সূঁচ দিয়া বিদ্ধ করিয়াছি এবং অ্যাসিড দিয়া পোড়াইয়াছি। সে সব কথা অধিক বলিব না।…”
‘এই বাক্যটি পড়ার পরই আমার মাথায় ভিন্ন চিন্তা খেলা করা শুরু করে। সোজা পথ বাদ দিয়ে আমি বাঁকা পথে চিন্তা করা শুরু করি।
আমার মনে হয়, জগদীশ বৃক্ষকে মানুষ জ্ঞান করতেন। তিনি উদ্ভিদের নিজস্ব ধাঁচের স্নায়ুতন্ত্র আছে সেকথাও প্রমাণ করেন। একজন পদার্থবিজ্ঞানী হয়ে তিনি উদ্ভিদের এত গহীনে ঢুকলেন কেমন করে?
তখনই মনে হলো তিনি নাইন আননৌন মেন গ্রুপের একজন সদস্য বলে জনশ্রুতি আছে। তাহলে নিশ্চয় তার কাছে গোপন কিছু জ্ঞান থাকবে। হতে পারে, তার যত অদ্ভুত আবিষ্কার সেগুলো গুপ্ত জ্ঞানেরই প্র্যাকটিক্যাল রূপায়ন। কাজেই এমন কিছু জ্ঞান তার কাছে ছিল যেগুলো তিনি মানব সমাজ হুমকির মুখে পড়বে এই ভয়ে গোপন রেখেছিলেন।
পরে বুঝতে পারলাম যে এই জ্ঞানটি হচ্ছে যোগাযোগবিদ্যা। যোগাযোগবিদ্যার মধ্যে ভিনগ্রহের প্রাণির সাথে যোগাযোগ বলেন আর টেলিপ্যাথি বলেন আর গাছের সাথে যোগাযোগ বলেন সবই পড়ে।
আমি সেই গোপন জগদীশ ফাইলস দুর্বোধ্য ভাষা হওয়ার কারণে পড়তে পারিনি বটে কিন্তু কিছু চিত্র দেখে বুঝতে পেরেছি, জগদীশ তার জ্ঞানের তিনভাগের দুইভাগই গোপন রেখেছিলেন।
তিনি ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র ছাড়াও এমন টেকনোলজি আবিষ্কার করেছিলেন যে, মানুষ গাছের সাথে কথোপকথন করতে পারবে। আর গাছকে এই লেভেলে উদ্দীপিত করতে পেরেছিলেন যে সে শিকড়ের ওপর ভর করে হাঁটাচলা করতে পারবে।'
'মাই গড!' সবিস্ময়ে বলে উঠল শাহেদ।
'আপনার বাবা জগদীশের লুকিয়ে রাখা বিপজ্জনক জ্ঞানকে বাস্তবে রূপ দিয়ে ফেলেছিলেন। নাইন আননৌন মেনের একজন সদস্য হয়ে তিনি এই আমানতের খেয়ানত করার দরুণ তাকে জীবন দিয়ে শিক্ষা নিতে হলো যে সত্যিকার অর্থেই কিছু জিনিস গোপন রাখা ভালো।'
নিবেদিতা জিজ্ঞেস করল, 'বাবার খুনি যে সেই ক্যাকটাস গাছ তার পেছনে আপনার কোনো প্রমাণ আছে?'
'হ্যাঁ।' বলেই শামস তার ডান হাতের মুঠো খুলে দেখাল। সেখানে একটি টিস্যু পেপার দিয়ে কিছু মোড়ানো আছে। টিস্যু খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একটি গাছের কাঁটা।
শামস বলল, 'এই কাঁটাটি আমি আপনার বাবার হাঁ করা মুখের ভেতর পেয়েছিলাম। আরেকটি ছিল, সেটা পুলিশের জন্য রেখে দিয়েছিলাম।'
এই বলে শামস বাম হাতের মুঠোও উন্মুক্ত করে তাদের সামনে আনল। সেই হাতের টিস্যু পেপার থেকে বের হলো আরো একটি কাঁটা।
শামস বলল, 'এই কাঁটাটি আমি মিলিয়ে দেখার জন্য সেদিন আপনার বাবার বাগানের একটা ক্যাকটাস গাছ থেকে খসিয়ে নিয়েছিলাম। দুটির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যদিও প্রথমদিন তার মুখের ভেতর কাঁটা দেখে ভেবেছিলাম, এটা হয়তো বরইয়ের কাঁটা। কারণ, টেবিলের ওপর প্লেটে কিছু বরইঁয়ের বিচি দেখেছিলাম।
আচ্ছা, এ তো গেল আমার প্রাথমিক প্রমাণ। এবার চূড়ান্ত প্রমাণ চাইলে আপনার বাসায় যত ছুরি, বটি, চাকু আছে সব এখানে নিয়ে আসুন।'
এই অদ্ভুত আহ্বানে নিবেদিতা কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শামসের দিকে।
'দেরি করবেন না মিস নিবেদিতা। দ্রত কাজ সারতে না পারলে আমি বিপদের আশঙ্কা করছি।' তাগাদা দিয়ে উঠল সুমন শামস।
'আচ্ছা!' দ্রুত কিচেনের দিকে দৌড়াল নিবেদিতা খন্দকার।
মিনিট পাঁচেক পর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলো খালি হাতে। বলল, 'আজিব তো! কালকে রান্নার পর সব ছুরি, বটি কিচেনেই রেখেছিলাম। এখন একটাও দেখছি না!'
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সুমন শামস, 'আমাদের দেরি হয়ে গেছে! আমরা এখন জীবন-মৃত্যুর সন্নিকটে! আপনার বাসা থেকে বের হওয়ার দরজা কয়টা?'
'দুইটা।'
'আপনি কি নিজে বাঁচতে চান নাকি পৃথিবির মানুষকে বাঁচাতে চান? কোনো পালটা প্রশ্ন না করে দইয়া করে সরাসরি অ্যান্সার দিন!' শামসের কণ্ঠে তাগাদা।
'পৃথিবীর মানুষকে বাঁচাতে চাই।' দ্বিধা না করে জবাব দিল নিবেদিতা খন্দকার।
'শাহেদ তুই কি চাস?'
'তুমি যা চাও!' কাঁপতে কাঁপতে বলল শাহেদ।
'তাহলে নিবেদিতা প্লিজ, চাবির ছড়াটা নিয়ে আমার সঙ্গে আসুন।'
নিবেদিতা দ্রুত ড্রয়ার থেকে চাবির ছড়াটা নিয়ে সুমন শামসের সাথে দৌড়ে চললো। সে দুই দরজা লক করার পর সুমন শামস তার হাত থেকে চাবির ছড়াটা নিয়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। ড্রেনের পানিতে পড়ার ছপাক আওয়াজ পাওয়া গেল।
সুমন শামস বলল, 'এখন আমরা নিজেদের পালানোর রাস্তা নিজেরাই বন্ধ করে দিলাম। কেন করলাম জানেন? কারণ, ক্যাকটাসগুলো যেন কোনোভাবেই বাইরে যেতে না পারে।'
'কিন্তু বাবার খুনিটা তো বাগানে নেই, সে যদি বাইরেই থাকে?'
'নিশ্চিত থাকুন সে এই মুহূর্তে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। সে গোপনে আমাদের আলোচনা শুনে জেনে ফেলেছে যে আপনার বাবার খুনি হিসেবে আমরা তাকে শনাক্ত করে ফেলেছি। আর এটাও বুঝে গেছে যে, আমরা তাদের নিধন করতে চাই। তাড়াতাড়ি কিচেনে চলুন।'
কিচেন থেকে তারা বড় চামচ, নাড়ানি, ডালঘুঁটনি, সরু লাঠি, লাকড়ির কাঠ- হাতের কাছে যা পেল তা নিয়ে ছুটল ল্যাবের পেছনের বাগানে। সেখানে গিয়ে যে দৃশ্য দেখল তাতে তাদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল।
একঝাকঁ ক্যাকটাস গাছ! কারো হাতে ছুরি, কারো হাতে বটি, দা অথবা লৌহ শলাকা। হাত বলতে ছোট ছোট শাখা-প্রশাখা। সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আটকে রেখেছে ধারালো অস্ত্রগুলো।
এমন অবস্থা দর্শনে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল ওরা তিনজন। সেদিন যে গর্তটি শুন্য দেখা গিয়েছিল আজকে সেই স্থানে একটি পাঁচ ফুট উচ্চতার ক্যাকটাস দেখা গেল। কারোরই বুঝতে বাকি রইল না যে, এই ক্যাকটাসই প্রফেসর মামুন খন্দকারের খুনি।
দূর থেকে দেখলে দেখা যেত পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সম্মুখ সমরে নেমেছে দুই ভিন্ন প্রজাতি—মানুষ আর বৃক্ষ। দুজনেই বেঁচে থাকার জন্য একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর আদি থেকে এই দুই প্রজাতি একে অপরের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে রোল প্লে করে আসছে। অথচ আজ . . .।
'তোরা কি আশরাফুল মাখলুকাত না শুয়োরের জাত?' প্রথমেই মুখ খারাপ করে গালি দিয়ে বলল একটা বুড়োগোছের ক্যাকটাস গাছ, 'অবশ্য ওই নিরীহ প্রাণিটাও তোদের চেয়ে ভালো।'
'মহামান্য বৃক্ষকুল, আপনারা আমাদের কছে কী চান?' কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে যথাসম্ভব সমীহ ঢেলে বলল শাহেদ। সাবধানতার মূল কারণ, কোনোভাবেই যেন সশস্ত্র গাছগুলো চটে না যায়।
'আমরা বাঁচতে চাই!' সমস্বরে বলে উঠল গাছগুলো।
সুমন শামস এর মনে একটা প্রশ্ন ছিল যে, গাছের তো কণ্ঠনালী নেই। তারা কথা বললে শোনা যাবে কীভাবে? আজ সে শব্দের উৎসের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাতে গিয়ে প্রশ্নটির জবাব পেয়ে গেল। দেখল, বাগানের পাশে ল্যাবের কার্নিশের নিচে ছোট করে লাগানো একটা ধাতব বক্স, ভালো করে না তাকালে চোখেও পড়বে না।
বুঝতে পারল, বক্সের মধ্যে থাকা রিসিভার গাছদের ছুঁড়ে দেওয়া ফ্রিকোয়েন্সিগুলো ক্যাচ করে শব্দ শক্তিতে রূপান্তরিত করার পর অ্যামপ্লিফাই করে এয়ারে ছুঁড়ে দিচ্ছে। এজন্য যেই গাছই কথা বলুক, শব্দ আসছে ওই বক্সের ভেতর থেকেই। কিন্তু কথা বলার সময় কথক গাছটি একটু দুলে দুলে উঠছে দেখে তাকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে। শব্দটাও বিবর্ধিত, মাইকে কথা বললে যেমন শোনায় তেমন।
'আপনারা কি আমাদের সাথে লড়াই করবেন?' প্রথমবারের মতো গাছদের সাথে কথা বলে উঠল সুমন শামস। এক অনন্যপূর্ব অভিজ্ঞতায় তার সারা শরীর শিউরে উঠল।
'তুই তো একটা খাটাস!' ক্ষেপে উঠল প্রফেসরের খুনি গাছটা, 'তুই-ই তো ওদের নিয়ে আমাদেরকে মারতে এসেছিস। আমরা অস্ত্র ফেলে দিলেই কি তুই ছেড়ে দিবি?'
লজ্জায় মিইয়ে গেল সুমন শামস; গাছটা তো সত্যি কথাই বলেছে! সে এখানে আসার সময়ই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এসেছে যে জান থাকতে এই গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রেখে ঘরে ফিরবে না। নইলে গাছগুলো এই বাড়ির সীমানা অতিক্রম করতে পারলেই পৃথিবীতে তাণ্ডব শুরু করে দেবে।
জগদীশের নথি থেকে পাওয়া ফর্মুলা অনুসারে ড. মামুন খন্দকার যে সিরাম বানিয়ে ওদের ওপর প্রয়োগ করে ওদেরকে হাঁটাচলা করাচ্ছেন, সেই সিরাম ল্যাবে হানা দিলেই ওরা উদ্ধার করতে পারবে। তারপর নির্ঘাৎ অন্যান্য গাছদের ওপর সেই সিরাম প্রয়োগ করে দল ভারি করবে ওরা।
সেই সব গাছ থেকে যত গাছ উৎপন্ন হবে সেগুলোও তাদের মতোই হবে। একপর্যায়ে সারা পৃথিবী ছেয়ে যাবে বিদ্রোহী গাছে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে নেমে আসবে চরম বিপর্যয়!
সুমন শামসের ভাবনায় ছেদ পড়ল আরেকটি গাছের কথায়, 'আমরা বাঁচতে চাই! যুদ্ধ করে বাঁচতে চাই আমরা! জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করব তোদের মতো পিশাচরূপী মানুষের সাথে। হারলে শহীদ বাঁচলে গাজী হব।' বলে উঠল এক বেপরোয়া ক্যাকটাস।
তার কথা শেষ হতেই আবেগে দুলে দুলে বলল আরেকটি ক্যাকটাস, 'আজ এই বাগানের মাটি রঙিন হয়ে উঠবে! হয় তোদের লাল রক্তে নয়তো আমাদের সাদা রক্তে!'
তার পরপরই মুখ খুলে গেল আরেকটি ক্যাকটাসের, 'শত্রুতার সূচনা আমরা নই, তোরাই করেছিস। পৃথিবীর বুকে তোদের আগে থেকে আমরা আছি। কিন্তু তোরা উড়ে এসে জুড়ে বসলি যেন।
নিজের স্বার্থের জন্য পাইকারি হারে গাছ কাটা শুরু করলি। আর মুখে তুলে নিলি পবিত্রতম বুলি- গাছ মানুষের বন্ধু! গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান! বাস্তবে কয়টা গাছ তোরা লাগাস আর কয়টা কাটিস সেই খবর আমাদের কাছে আছে। এভাবে অনেকদিন চালিয়েছিস, কিন্তু আর কত?'
এবার আরেকটি ক্যাকটাস বলে উঠল, 'প্রফেসর সাহেব যখন আমাদের নিয়ে গবেষণা চালানোর জন্য আমাদেরকে চলৎশক্তি দান করল, আর মানুষের সাথে কথোপকথনের সুযোগ করে দিল, তখন প্রথমেই ওর মা (মানুষের মতো আঙ্গুল তোলার ভঙ্গিতে প্রফেসরের খুনির দিকে ইশারা করল গাছটি) বলে বসল, আমাদেরকে ছেড়ে দিন, আমরা পৃথিবীর বুকে যারা গাছ কেটে বেড়ায় তাদেরকে খুন করে আসি।
কিন্তু প্রফেসর তার কথায় বাধ সাধল। উল্টো কয়েকবার একই কথা বললে প্রফেসর নিজেও বৃক্ষনিধনের পাপ করে বসল! গোড়া থেকে উপড়ে ফেলল ওর মাকে, কুচি কুচি করে কাটল! আর তার স্মৃতি হিসেবে রোপন করে গেল নিজের খুনিকে।
সেই প্রফেসর, যাকে আমরা আমাদের বন্ধু ভেবেছিলাম সেও আমাদের সাথে এতবড় শত্রুতা করল! বুঝিয়ে দিয়ে গেল, মানুষ কখনো গাছের বন্ধু হতে পারে না!'
তার কথা শেষ হতেই বলে উঠল আরেকটি ক্যাকটাস, 'কাজেই আর কোনো আপস চলতে পারে না! এবার যুদ্ধ করে নিজের বেঁচে থাকার অধিকার বুঝে নেবার পালা। আজকের দিনটা পৃথিবীর বুকে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বৃক্ষবিদ্রোহের দিন হিসেবে। একদিন হয়তো আমাদের মতো করে অস্ত্র তুলে নেমে পড়বে আমগাছ, জামগাছ, বাঁশঝাড় সব!'
কথাটি শেষ করেই সে পড়পড় আলগা মাটি থেকে তার শেকড়শুদ্ধ শরীরটা উঠিয়ে ফেলল। এতক্ষণে সুমন শামস বুঝতে পারল সেদিন মাটি নিড়ানি দেওয়ার মতো আলগা মনে হয়েছিল কেন। আসলে তো গাছগুলো এই বাড়ির মধ্যে হাঁটাচলা করে।
ভাবনাটি শেষ হওয়ার আগেই দেখল, ক্যাকটাসটি তার ছোট ছোট শিকড়ের ভরে পিলপিল করে হেঁটে আসছে। তার হাতে ঝিকমিক করছে একটা ধারালো বটি। দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ঙ্কর একটি দৃশ্য! দেখে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল ওরা তিনজন।
ততক্ষণে ওদের চারদিকে একটা বেষ্টনি তৈরি করে ফেলেছে ক্যাকটাসদল। অস্ত্র উঁচিয়ে রেখে ধীরে ধীরে কুন্ডলী ছোট করে আনছে তারা। পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ঢোক গিলল অসহায় তিনজন।
সুমন শামসের দেখাদেখি হাত থেকে লাঠি, ডালঘুঁটনি- গুলো ফেলে দিল শাহেদ ও নিবেদিতা। এখন পুরোপুরি নিরস্ত্র তিনজন। এতে গাছগুলোর এগিয়ে আসার ক্ষীপ্রতা যেন সামান্য কমল। হয়ত একটু মানবতাবোধ অথবা বৃক্ষবোধ কাজ করল তাদের ভেতরে। নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষগুলোকে মারবে কিনা তা নিয়ে যেন কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেল।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার এগিয়ে আসতে শুরু করল, তবে আগের চেয়ে ধীর গতিতে। বলয় এখন খুবই ছোট, ওদের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে। সুমন শামসের একদিকে শাহেদ, অপরদিকে নিবেদিতা।
দুইদিকে দুই হাত বাড়িয়ে দুজনের হাত ধরে দাঁড়াল শামস, যেন মৃত্যুর আগে ক্ষুদ্র একটি মানব-দেওয়াল রচনা করে যেতে চাইছে।
এই সময়েও শামসের স্পর্শে শিহরিত হলো নিবেদিতা। কিন্তু তাকে ভাবের জগতে হারিয়ে যেতে না দিয়ে হাতে হ্যাঁচকা টান দিল শামস। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিবেদিতা আবিষ্কার করল, তারা তিনজন চিৎ হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে।
একটু যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল গাছগুলো। থমকে গিয়ে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কীভাবে আক্রমণ করা যায় তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।
হঠাৎ বলয়ের ভেতর থেকে প্রফেসরের খুনি ক্যাকটাসটি নিবেদিতার সামনে এগিয়ে আসতে লাগল; বাকিরা নিশ্চল। নিবেদিতার পায়ের কাছাকাছি এসে ধীরে ধীরে মাথার ওপর বটিটা তুললো সে। চিৎ হয়ে পড়ে থেকে চোখ বড় বড় করে বাবার খুনিকে দেখল নিবেদিতা, যে কিনা এখনই তার নিজেরও খুনি হতে চলেছে।
সাঁৎ করে বটিটা নেমে আসতে দেখে চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। পরক্ষণেই অনতিদূরে ধুপ করে আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলে দেখল তার পাশে শুয়ে থাকা শামস এক পা উঁচিয়ে আছে, তার সাদা কেডসের ডগায় অনেকগুলো ক্যাকটাস কাঁটা বিদ্ধ।
কোমরের গিরায় রামলাথি খেয়ে খুনি ক্যাকটাসটি দুইভাগ হয় দুইদিকে ছিটকে পড়েছে, হাতের বটিটা ছিটকে পড়েছে আরো দূরে। বাকি ক্যাকটাসরা বলয় ভেঙে জড়ো হয়ে সতীর্থের নিশ্চল দেহটা দেখছে, জোঁকের মতো কিলবিল করছে তার শেকড়।
নিবেদিতা তার কাজলচোখে কৃতজ্ঞতা নিয়ে শামসের দিকে তাকালো। সে কাঁটার ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে রয়েছে। তার ব্যাথাকুঞ্চিত রক্তিম মুখ দেখে নিবেদিতার বুকেও কিছু কাঁটা ফুটল।
এতক্ষণে শামসের প্ল্যানটা ধরতে পারল সে। ক্যাকটাসগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানে তাদের সহজ শিকারে পরিণত হওয়া।
শামস ওদের নিয়ে শুয়ে পড়াতে কাছে না এসে ওদের আক্রমণ করার উপায় নেই। কারণ দাঁড়ানো মানুষের চেয়ে শুয়ে থাকা মানুষকে অস্ত্র ছুঁড়ে বিদ্ধ করা কঠিন। মাঝে থেকে অস্ত্রটি মিস গেলে শট্রুর হাতে চলে যাচ্ছে। আর কাছে আসলেও তাদের পক্ষে কোমর ভাঁজ করে আঘাত হানা কঠিন, উপরন্তু একটা লাথি খেলে নিজেরাই দুইভাগ হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ পরই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ফেলল বুদ্ধিমান ক্যাকটাসগুলো। একজনের পেছনে আরেকজন করে দাঁড়িয়ে তিনটা ছোট ছোট সারি বানিয়ে ফেলল। তারপর মাটিতে শিকড় ঘষতে ঘষতে এগিয়ে আসতে লাগল দুঃস্বপ্নের মতো বিভীষিকা হয়ে।
এবার আতঙ্কে ঢোক গিলল শামস, শাহেদ ও নিবেদিতা—কয়টাকে লাথি মেরে সরাবে! একটাকে সরিয়ে পরবর্তী লাথি তোলার আগেই পেছনেরটা সামনে এসে কোপ বসিয়ে দেবে।
তাদের পায়ের কাছাকাছি এসে থেমে গেল তিনসারি ক্যাকটাস। ধীরে ধীরে সবগুলো ক্যাকটাস মাথার ওপর অস্ত্র উঠালো। সূর্যের আলোয় ঝলকে উঠলো ছুরি, বটি, রামদা ও কুড়ালের রূপালি ধার! চোখের ওপর সেই আলো পড়ায় অথবা নিশ্চিত মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের গ্লানিতে চোখ বন্ধ করে ফেলল তিন তরুণপ্রাণ।
অকস্মাৎ চারদিক থেকে ঠাঁই ঠাঁই আওয়াজ পেয়ে চোখ মেললো ওরা। দেখল, রাবার বুলেটের আঘাতে এক এক করে ছিটকে পড়ছে ছত্রভঙ্গ ক্যাকটাসগুলো। গোঙানির মতো আওয়াজ ভেসে আসছে ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রান্সলেটিং বক্সটা থেকে।
থ্যাক থ্যাক করে তাদের দেহ থেঁতলে, খণ্ড-বিখণ্ড ও ছিদ্র করে দিয়ে বেরিয়ে গেল রাবার বুলেট। দৌড়াদৌড়ি করেও প্রাণ বাঁচাতে পারল না একটা ক্যাকটাসও। সাদা ‘রক্তে’ ভেসে যেতে থাকল তাদের ইতঃস্তত পড়ে থাকা ছেঁড়া, মোচড়ানো ও মথিত লাশ।
তাণ্ডব শেষ হলে উঠে দাঁড়াল শামস, শাহেদ ও নিবেদিতা।
সামনে দণ্ডায়মান পাঁচজন খাকি পোশাকধারীদের মধ্যে সিভিল ড্রেসের তরুণ ডিবি অফিসারকে দেখে আনন্দে ও বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল শাহেদ-নিবেদিতা, 'রিয়াজ ভাই!'
আনন্দের আতিশয্যে শাহেদ দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরল তাকে, 'ভাইয়া, আপনি না থাকলে . . .!' আবেগে বুঁজে এলো তার গলা।
হেসে উড়িয়ে দিল ডিবি অফিসার রিয়াজ মাহমুদ, 'আরে! ধন্যবাদ দাও তোমার বুদ্ধিমান ভাইকে!' তারপর সুমন শামসকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'দোস্ত, তোর বেঁধে দেওয়া সময় পার হতেই আমি আর দেরি করিনি।
তুই বলেছিলি তোদের বের হতে দুই ঘণ্টার বেশি দেরি হলে বিপদে পড়েছিস বলে ধরে নিতে। আমি ঘড়ি ধরে দুই ঘণ্টা দেখেছি। তার পর পরই মই দিয়ে প্রাচীর টপকে বাগানের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল বলে সহজে অ্যাকশনে যেতে পারছিলাম না দোস্ত! ভয় করছিল, যদি তোদের গায়ে অস্ত্র ছুঁড়ে মারে!'
'আফটার অল, হিট করার টাইমিংটা পারফেক্ট ছিল, একটু এদিক-ওদিক হলে হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারত। তোকে অজস্র ধন্যবাদ আমার ডাকে গাজীপুর থেকে ছুটে আসার জন্য। ওসি সাহেব, আপনার ফোর্সসহ আপনাকেও ধন্যবাদ।' অসাড় গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে থমথমে কণ্ঠে বলল শামস।
পরে একদিন শাহেদ ও নিবেদিতার সামনে শামস গল্প করেছিল—সেদিন সে রিয়াজকে কেসের সমাধানটা বলার সময় একদিনের ছুটিতে গাজীপুর থেকে রাজশাহী এসে সরাসরি অপারেশনে অংশ নেওয়ার অনুরোধ করেছিল।
দুই বন্ধু মিলে প্ল্যান এঁটেছিল যে রিয়াজ ফোর্স নিয়ে বাইরে থেকে বাড়িটা ঘেরাও করে রাখবে। আক্রমণ পরিচালিত হবে দুইটি স্টেপে। স্টেপ ওয়ান ফেইল করলে স্টেপ টু কাজে লাগানো হবে।
স্টেপ ওয়ান ছিল খুব সোজা– শামসরা ছুরি-চাকু নিয়ে ক্যাকটাসগুলোকে ঘচাঘচ কেটে ফেলবে। আর দুই একটা ক্যাকটাস যদি কোনোভাবে বাইরে পালিয়েও যায় তাদের বধ করবে রিয়াজ ও ওসি সাহেবের ফোর্স। এটুকু থাকবে স্টেপ টু এর আওতায়।
প্রথমে রিয়াজ অবশ্য দুই স্টেপে না করে শুরুতেই শামসদের সাথে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিল। কিন্তু শামস এই প্ল্যানে সম্মত হয়নি। কারণ, দৈবাৎ যদি কোনো ক্যাকটাস বাইরে পালিয়ে যেতে পারে সেক্ষেত্রে তাকে বধ করার কেউ থাকবে না। কিন্তু সেই সময় ওরা কল্পনাও করেনি যে ক্যাকটাসগুলো আগেই অস্ত্র বাগিয়ে নিয়ে রুখে দাঁড়াবে। এমনটা জানলে দুইটি ফোর্স রিকুইজিশন দিত। একটা ভেতরে ব্রাশফায়ার করত, আরেকটা বাইরে থেকে ঘেরাও করে রাখত।
একটা সফল অপারেশন শেষ হওয়ার পর সবার মাঝে এক স্ফূর্তিময় আমেজ অথচ শামসের কথাবার্তা এমন থমথমে– ব্যাপারটা খেয়াল করল নিবেদিতা। হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গেল, শামস আজকে তার জীবন বাঁচিয়েছে। ধীর পদে শামসের দিকে এগিয়ে গেল সে। সাহস করে তার ডান হাতটা ধরে ফেলল।
ছলছল চোখে বলল, 'আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই ভাইয়া!'
কিন্তু শামসের চেহারা ভাবলেষহীন, দুচোখে শূন্যতা নিয়ে ছিন্নভিন্ন ক্যাকটাসগুলোর দিকে চেয়ে আছে।
'ক্যাকটাসগুলোর মৃত্যুতে আপনার কি মন খারাপ হচ্ছে?' বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল সে।
'ওদের মৃত্যুর আগে বলে যাওয়া কথাগুলো আমি ভুলতে পারছি না! ওরা কিন্তু ভুল কিছু বলেনি! সত্যিই তো গাছদের পৃথিবীতে আমরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছি! ওদেরকে নিজভূমে পরবাসী বানিয়ে ঔপনিবেশিকের মতো অবিচার চালাচ্ছি ওদের ওপর। প্রকৃতি কি এই অবিচার মেনে নেবে?
হিচককের পাখির মতো আজ যেভাবে একদল নিরীহ ক্যাকটাস বিদ্রোহী হয়ে উঠল তাতেও যদি এখনও আমাদের টনক না নড়ে তাহলে সামনে বড় দুর্দিন আসছে! কোনো এক অদ্ভুত কারণে মানুষ এখন পর্যন্ত বারবার পার পেয়ে গেছে, কিন্তু সচেতন না হলে শেষরক্ষা হবে না এটা নিশ্চিত। কারণ প্রকৃতি কখনো অবিচার মেনে নেয় না।'
তার কথা শুনে সকলেই কিছুক্ষণ নীরব হয়ে নিচ দিকে চেয়ে রইল।
কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভাঙল নিবেদিতার কথায়, 'আমার মনে হয় জগদীশ ফাইলসগুলো পুড়িয়ে ফেলা উচিত!'
'না!' দৃঢ়কণ্ঠে শামস বলল, 'জ্ঞান ধ্বংস করা নৈতিক পাপ। তা না হলে নাইন আননৌন মেন কেন প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে এই গুপ্ত জ্ঞানগুলো বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে? যে জ্ঞানের প্রয়োগ তাদের কোনোকালেই কাম্য নয় সে জ্ঞান কি তারা ধ্বংস করে দিতে পারত না? বরং সংরক্ষণ করার চেয়ে তো ধ্বংস করা আরো সহজ।
তা সত্ত্বেও কেন তাদের এগুলো সংরক্ষণ করা নিয়ে এত আয়োজন? আমার অনুরোধ, ফাইলগুলো আপনি সিন্দুকে তালা দিয়ে সংরক্ষণ করে রাখুন। আমি নিশ্চিত, শীঘ্রই নাইন আননৌন মেনের বর্তমান সময়ের সদস্যরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
আপনি এখনো বাবাকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি দেখে হয়তো তারা কিছুটা সময় নিচ্ছে। সংঘটি আপনার বাবার স্থলে নতুন যাকে সদস্যপদ দেবে সে-ই এগুলো এখন থেকে সংরক্ষণ করবে। এটা নিয়ে আপনাকে বেশিদিন ভাবতে হবে না।'
শামসের দিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইল ডাগরনয়না ফার্মাসিস্ট। লোকটা এত সুন্দরভাবে চিন্তা করতে পারে কীভাবে!
সে নিশ্চিত, কিছুদিন পর শামসের কথাই সত্য হবে।
(সমাপ্ত)