(প্রথম পর্বের পর)
একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলেন তিনি,
'যা বলছিলাম। সাম্রাজ্য বিস্তার তো অনেকদূর হলো। এবার বিশ্রামের পালা। সিন্ধু নদের কাছাকাছি এক জনশূন্য জংলা এলাকায় ধর্মপাল তাঁবু গাড়ার আদেশ দিলেন। তিনি জানতেন, প্রকৃতি তার ক্লান্তি ঘুচিয়ে দেবে। বিশুদ্ধ বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে, হ্রদের সুপেয় পানি পান করে তিনি নতুন শক্তি অর্জন করবেন।
যেই ভাবা, সেই কাজ। উৎসবমুখর পরিবেশে তাঁবু গাড়া হলো জঙ্গলের ভেতর। লাকড়ি জড়ো করে আগুন জ্বালানো হলো রাতের বেলা। সৈন্যরা সারারাত ফুর্তি করে আকণ্ঠ মদ্যপান করে ঘুমিয়ে পড়ল একসময়। ধর্মপালের চোখে ঘুম নেই। এ জাগরণ আনন্দের, এ জাগরণ আধিপত্যের।
দিনের আলো একটু একটু করে ফুটতে শুরু করেছে। ধর্মপাল সিদ্ধান্ত নিলেন, একা একা একটু জঙ্গলের গহীনে ঘুরে আসবেন।প্রিয় সাদা ঘোড়ার পিঠে চেপে রওয়ানা হলেন তিনি। এই অঞ্চলটা একদম নিরিবিলি। পশু তো দূরে থাকুক, পাখির কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
শুরুর দিকে অচেনা বেগুনি ফুলের ঝোপ। মাতাল করা গন্ধ ভেসে আসছিল সেখান থেকে। অসংখ্য রঙিন ফল দেখা যাচ্ছে চারদিকের গাছগুলোতে। এমন ফল তিনি অন্য কোন রাজ্যে দেখেননি।
আরেকটু ভেতরে যেতেই ফুল-ফল মিলিয়ে গেলো। এখানে শুধু লম্বা লম্বা গাছের সমারোহ, যেন আকাশ ফুঁড়ে উঠে গিয়েছে ওরা। সূর্য উঠেছে অনেকক্ষণ আগে, কিন্তু বনের এই অংশটা রীতিমতো অন্ধকার। এত ঘন গাছের প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেদ করে আলো ঢুকবে কী করে?
কিছুদূর এগিয়ে থেমে দাঁড়াল ধর্মপালের ঘোড়া। এমন আচরণ ও কখনোই করে না। রাজা অবাক হলেন। এই জায়গাটা আগের চেয়ে অনেকটা আলোকিত। ভালো করে সামনে তাকালেন তিনি। যে দৃশ্যটা চোখে পড়ল, তা ভাষায় ব্যাখ্যা দেয়া কঠিন।
মাটিতে বিরাট একটা গর্ত এখানে। প্রায় একটা ছোটখাটো খাল খননের মতো করে জায়গা কেটে রেখেছে কেউ। কিন্তু গর্তটা এতোই গভীর যে সাধারণ কোন মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব বলে মনে হয় না। ঘোড়া থেকে নেমে আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ধর্মপাল।
গর্তের চারদিকে এবড়ো-থেবড়ো। চারদিকে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে আছে। যেন কেউ প্রচন্ড শক্তি প্রয়োগ করে ভেতর থেকে উপড়ে এনেছে কিছু একটাকে। আর সেই স্থলেই সৃষ্টি হয়েছে বিরাট এই গর্ত। নিচে কতদূর নেমেছে, কোনভাবেই বোঝা সম্ভব না। খোলা আকাশের দিকে তাকালে যেমন হঠাৎ করে মাথা ঘুরে ওঠে, গর্তের দিকে তাকিয়ে অনেকটা সেরকম অনুভূতি হলো ধর্মপালের।
এমন সময় পেছন থেকে কারও অস্ফুট কণ্ঠস্বরের আওয়াজ পেলেন রাজা। মুহূর্তেই ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। অভ্যাসবশত কোমর থেকে বের করে আনলেন ধারালো তলোয়ার। এই গহীন জঙ্গলের ভেতর আওয়াজ করছে কে?
শব্দের উৎস অনুসন্ধান করে ধীরপায়ে এগোলেন তিনি। বেশিদূর যেতে হলো না, সামনে তাকাতেই দেখতে পেলেন অদ্ভুত চেহারার এক লোক মাটিতে শুয়ে আছে। তার গায়ে কোন পোশাক নেই। হাতদুটো কব্জির কাছ থেকে কেটে ফেলা। রাজাকে দেখে হামাগুড়ি দিয়ে দূরে সরে যাবার চেষ্টা করছিল। পাতার খসখস শব্দে ধরা পড়ে গেছে।
এমন সময় পেছন থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শোনা গেলো। রাজা ধর্মপালের দুই দেহরক্ষী আর একদল সৈন্য এসে হাজির হয়েছে। সকালে ঘুম ভেঙে রাজার খোঁজ না পেয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। অবশেষে কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে তারা জঙ্গলের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যায়। এভাবেই এই দলটা এসে এখানে পৌঁছেছে।
ধর্মপাল খুশি হলেন। মাটিতে পড়ে থাকা লোকটাকে বেঁধে ঘোড়ার পিঠে চাপানোর নির্দেশ দিলেন সৈন্যদের। সময়টা ভালো না। এই ব্যাটা প্রতিহারের গুপ্তচর হতে পারে। হয়তো রাষ্ট্রকূটের বাহিনীর কাছে মার খেয়ে পালিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল। ঠিকমতো জেরা করতে পারলে অনেক তথ্য পাওয়া যাবে এর কাছ থেকে।
সেদিনই তাঁবু গুটিয়ে রাজ্যে ফিরে এলেন ধর্মপাল। জঙ্গলে খুঁজে পাওয়া আগন্তুককে পোশাক পরিয়ে খাবার-দাবার পরিবেশন করা হলো। কিন্তু সে কিছুই মুখে দিতে পারল না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কথা বলা দূরে থাক, কোন শব্দ পর্যন্ত করে না। এভাবে প্রায় সপ্তাহখানেক কেটে গেলো।
রাজা ধর্মপাল এক সকালে বিরক্ত হয়ে নিজে লোকটার সাথে কথা বলতে গেলেন। ভয় দেখিয়ে, আদর করে, ইশারা-ইঙ্গিতে অনেক কিছু বোঝানোর পর লোকটা এক পর্যায়ে আধো-আধো বুলিতে কী যেন বলল। রাজা বুঝলেন, এই ভাষা এই রাজ্যে কেউ জানে না। রাজসভার লিপিকারকে ডেকে দেখা যাক, সে কিছু বুঝতে পারে কিনা। তিনি আবার বহু ভাষায় পারদর্শী, সিদ্ধপুরুষ বলে কথা!'
'লুইপা!' কাঁপা কাঁপা গলায় উচ্চারণ করল মির্জা ভাই। 'তিব্বতের শাক্য বিদ্যালয়ের মতবাদ অনুযায়ী, লুইপা ছিলেন রাজা ধর্মপালের লিপিকার।'
'ঠিক বলেছেন,' বৃদ্ধ হাসলেন। 'আমি তো আগেই বলেছি, আপনারা জ্ঞানী-গুণী লোক। সবই জানেন, বোঝেন।'
লুইপা কে, এসম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। লজ্জার বশে জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না। দীপু নিজের অজান্তেই একটা উপকার করল। সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসল, 'এই লুইপা আবার কে? নাম শুনে সুবিধার মনে হচ্ছে না।'
'গাধা কোথাকার,' আসিফ একরকম গর্জেই উঠল বলা যায়। 'লিটারেচারের স্টুডেন্ট হয়ে লুইপাকে কীভাবে না চিনিস? বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন কী বল?'
'কেন, চর্যাপদ?'
'হ্যাঁ, সেই চর্যাপদের আদিকবি হচ্ছেন লুইপা। চর্যাপদের প্রথম এবং উনত্রিশতম পদ তাঁরই লেখা। শুধু কবিই নন, লুইপা বজ্রযোগী বৌদ্ধদের চুরাশিজন মহাসিদ্ধ পুরুষের একজন। আচার্য...'
'আমি গল্পটা শেষ করতে চাইছি। হাতে বেশি সময় নেই।' বৃদ্ধের কণ্ঠের শীতলতায় থমকে গেলো আসিফ।
কথা না বাড়িয়ে আমরা সবাই আবারও গল্পে মনোযোগী হলাম।
'লুইপাকে তলব করা হলো। মাটির নিচের এক গুপ্ত কুঠুরিতে আটকে রাখা হয়েছিল জঙ্গল থেকে ধরে আনা লোকটাকে। রাজার আহবানে লুইপা সেখানেই হাজির হলেন।
নিস্তেজ হয়ে মাটিতে শুয়ে ছিল আগন্তুক। লুইপা প্রবেশ করতেই সে ধড়ফড় করে উঠে বসল। মলিন হয়ে যাওয়া চেহারায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল তৎক্ষণাৎ।রাজা অবাক হয়ে লুইপার দিকে তাকালেন। চোখ-মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছেন লিপিকার। তার চোখের তারায় যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ খেলা করছে। ধর্মপাল বুঝতে পারলেন, একমাত্র লুইপাই পারবেন এই আগন্তুকের পরিচয় সম্পর্কে ধারণা দিতে।
কবিকে সেই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই তিনি রাজার কানে কানে বললেন, আগন্তুকের সাথে একা কথা বলতে চান। রাজার উপস্থিতিতে শাস্ত্রীয় জ্ঞান প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।
মহাসিদ্ধ পুরুষের প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক ধর্মপাল বেরিয়ে গেলেন। কুঠুরির পাথরের দরজা বাইরে থেকে আটকে দেয়া হলো। ভেতরে রয়ে গেলো লুইপা আর আগন্তুক।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর, লুইপা ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। রাজা জানতে চাইলেন, আগন্তুকের পরিচয় জানা গিয়েছে কিনা। পাথরের দেয়ালে ঝুলন্ত মশালের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন লুইপা। তারপর, গম্ভীর কণ্ঠে জানালেন, 'না। আগন্তুকের দুর্বোধ্য ভাষা বোঝার ক্ষমতা তাঁর নেই।'
ধর্মপাল ভেতরে ঢুকে আরেকবার দেখলেন। আগন্তুক ততক্ষণে একপাশে মাথা কাত করে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাথরের দরজা ঠেলে তাকে ভেতরে রেখে আসা হলো।
সেদিন রাতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। প্রহরীরা আগন্তুককে খাবার দিতে গিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখল, কুঠুরিতে কেউ নেই। পাথরের দেয়াল, মাটি, ছাদ-সবই অক্ষত। শুধু ভেতরের আগন্তুক হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। রাজার কাছে খবর পৌঁছাতেই তিনি নিজে এসে হাজির হলেন। সমস্ত বন্দিশালা জুড়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও লাভ হলো না। কোথাও দেখা মিলল না বন্দীর।
কবি লুইপা তখন নিজের ঘরে বসে আছেন। তাঁর চোখে-মুখে প্রশান্তির ছাপ। একমনে পদ লিখে চলেছেন,
কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল\
দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ\
সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই\
এড়ি এউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুনুপাখ ভিতি লেহু রে পাস\
ভণই লুই আম্হে ঝানে দিঠা।
ধমণ চমণ বেণি পিণ্ডি বইঠা\
'আপনারা কেউ এর অর্থ জানেন?' প্রশ্ন করলেন বৃদ্ধ।
আসিফ মাথা নাড়ল। সম্মোহিতের মতো ঘাড় নেড়ে আবৃত্তি করল তখনই-
'শরীরের গাছে পাঁচখানি ডাল-
চঞ্চল মনে ঢুকে পড়ে কাল।
দৃঢ় ক’রে মন মহাসুখ পাও,
কী-উপায়ে পাবে গুরুকে শুধাও।
যে সবসময় তপস্যা করে
দুঃখে ও সুখে সেও তো মরে।
ফেলে দাও পারিপাট্যের ভার,
পাখা ভর করো শূন্যতার
লুই বলে, ক’রে অনেক ধ্যান
দেখেছি, লভেছি দিব্যজ্ঞান।'
ছেলেটার কাজ-কারবার দেখে আমি মাঝে-মাঝে ভীষণ অবাক হই। কী আশ্চর্য ব্যাপার, চর্যাপদের শ্লোকের অনুবাদ শুদ্ধ মুখস্থ করে রেখেছে!
'এটা কেমন গল্প হলো?' মির্জা ভাইয়ের রাগান্বিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। 'জঙ্গলে গর্ত খুঁড়ল কে? আগন্তুকের পরিচয় কি? সে গায়েবই বা হলো কীভাবে? হুট করে একটা গল্প শুরু করে এভাবে শেষ করার মানে কি?'
'ধীরে, বাবাজী, ধীরে।' সৌম্যকণ্ঠে উত্তর দিলেন বৃদ্ধ। আরেকটা গল্প যে এখনও বলা বাকি।'
'বলুন, চাচা। আমরা শুনতে চাই।' দীপু বলল। 'আজকে রাতে এমনিতেও বাড়ি ফিরতে পারব বলে মনে হয় না। তার চেয়ে বরং গল্প শোনা যাক। অনেকদিন ভালো গল্প শুনি না। আসিফ শালা আঁতলামি কথা বলতে বলতে কান পচিয়ে দিয়েছে।'
পাশ থেকে ফোঁস করে শব্দ হলো। আসিফ।
'আপনি বৃক্ষদেবতার গল্প বলেছিলেন না?' এ কী, বৃদ্ধ দেখি আমাদের কথাবার্তা কান পেতে শুনছিলেন। বুঝতে পারলাম, প্রশ্নটা আমাকেই করা হচ্ছে।
'এবার তাহলে আরেকটা গল্পে যাই। কেমন? এবারের গল্পটা লুইপাকে নিয়েই। আশা করি, অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।'
আবার এক মুহূর্তের নীরবতা। দু-তিনবার কাশির আওয়াজ। ঝড়ো বাতাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না আর। বৃষ্টিও কিছুটা কমেছে। তবে বিদ্যুতের ঝলকানি সেই আগের মতোই।
অবশেষে মুখ খুললেন বৃদ্ধ।
'আদিকবি লুইপার গল্প দিয়ে শুরু করি। লুইপার অতীত জানা আছে আপনাদের? এই নিয়ে নানান মত আছে, সেগুলো আপনাদের জানা থাকতে পারে। তবে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন।
লুইপা ছিলেন ওড্ডিয়ানের রাজা ললিতচন্দ্রের পুত্র। রাজবংশে জন্ম নিয়েও তাঁর মাঝে রাজপুত্রসুলভ কোন আচরণ ছিল না। ঘর থেকে খুব একটা বাইরে বেরোতেন না। যুদ্ধবিদ্যা অথবা অস্ত্রশিক্ষায় মনোযোগ ছিল না তাঁর। এমনকি খেলাধুলাতেও ছিলেন অনাগ্রহী। সবসময় কেমন যেন খানিকটা আনমনে থাকতেন। ছেলেকে নিয়ে বাবার চিন্তার শেষ ছিল না। এমন হলে ভবিষ্যতে রাজ্যের ভার নেবে কীভাবে?
প্রকৃতির নিয়ম মেনে একসময় কৈশোরে পা দিলেন লুইপা। ঘটনাচক্রে দেখা হলো সিদ্ধপুরুষ শবরপা-এর সাথে। এই শবরপা-ও কিন্তু চর্যাপদের আরেক গুরুত্বপূর্ণ কবি। তিনি ছিলেন লুইপার গুরু।
শবরপা-এর দিব্যজ্ঞানে মুগ্ধ ছিলেন রাজপুত্র। আকুতি জানালেন, জ্ঞান অর্জন করতে চান। গুরু তাকে চক্রসম্বরতন্ত্র সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান দান করলেন, আদেশ করলেন তন্ত্র অনুসরণ করতে। বজ্রযোগী বৌদ্ধদের দেবতা হেরুক আর লঘুসম্বরের প্রকরণের প্রকৃষ্ট স্বরূপ এই তন্ত্র। এই চক্রসম্বরতন্ত্রের মাধ্যমে জাগরণ, নির্বাণ ইত্যাদি অর্জনের প্রথা সম্পর্কে জানা যায়। বিভিন্ন যোগতন্ত্র আর মন্ত্রের প্রয়োগের মাধ্যমেই যা হাসিল করা সম্ভব।
ব্রত ধারণ করে তন্ত্রের প্রতি আরও মনোযোগী হলেন লুইপা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে খুঁজে বের করলেন চব্বিশ সদস্যবিশিষ্ট এক ডাক-ডাকিনীর দলকে। অবশেষে এক কৃষ্ণপক্ষের রাতে লোকচক্ষুর অন্তরালে এক শ্মশানঘাটে হাজির হলেন তারা। কয়লা আর খড়ি দিয়ে পবিত্র চক্র আগে থেকেই এঁকে রাখা হয়েছিল। সেখানেই অনুষ্ঠিত হলো গণচক্র অনুষ্ঠান।
এক পর্যায়ে ডাক-ডাকিনীরা অগ্নিকুন্ডের চারপাশে উলঙ্গ হয়ে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করল। লুইপা তাদের অনুসরণ করলেন। চক্রে অবস্থানকালে একনাগাড়ে মন্ত্রপাঠ করল তারা, মিলিত হলো একে অন্যের সাথে। অবশেষে এক ঋষির মৃতদেহ ভক্ষণের মাধ্যমে সমাপ্তি হলো সেই অনুষ্ঠানের।
গুরুর আশীর্বাদ নিয়ে ওড্ডিয়ান ত্যাগ করলেন লুইপা। ভিক্ষাজীবী সাধু হিসেবে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন পথে-ঘাটে। মনে তখনও অস্থিরতা কমেনি, দিব্যজ্ঞান লাভের আশায় মরিয়া হয়ে আছেন অহর্নিশি।
অবশেষে রাজ্য ঘুরে ঘুরে একদিন তিনি বাংলায় গঙ্গা নদীর তীরে এসে হাজির হলেন। গঙ্গার তীরে এক বিরাট পরিত্যক্ত জঙ্গল। মানুষের আনাগোনা নেই। যতদূর চোখ যায়, শুধু গাছ আর গাছ। প্রায় সপ্তাহখানেক সময় এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালেন লুইপা। এরপর একটা ঘটনা ঘটল। তিনি উপলব্ধি করলেন, ধ্যানের কোন বিকল্প নেই। অতঃপর সেখানেই মাছের অন্ত্রের স্তূপের পাশে বসে লিপ্ত হলেন গভীর ধ্যানে।
একটানা বারো বছর আহার হিসেবে শুধুমাত্র মাছের নাড়িভুঁড়ি গ্রহণ করলেন লুইপা। এভাবে কেটে গেলো দীর্ঘ বারোটি বছর। অবশেষে একদিন বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের সর্বোচ্চ মহামুদ্রা সিদ্ধি অর্জন করলেন তিনি। পরিণত হলেন মহাসিদ্ধ পুরুষে। লুইপা নামের অর্থ হচ্ছে, যে মাছের অন্ত্র ভক্ষণ করে।'
বৃদ্ধ থেমে গেলেন।
আমার দম আটকে আসার মতো অবস্থা তখন। অন্যরাও ধৈর্য হারিয়েছে নির্ঘাত। কোনমতে নিজেকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করলাম, 'কী সেই ঘটনা? আপনি না গাছের গল্প শোনাবেন?'
-'আমি তো বলিনি, গল্পটা শেষ। ধৈর্য হারালে চলবে কি করে?'
বৃষ্টি অনেকটা থেমে গিয়েছে বলা যায়। বাতাসের শব্দও আর কানে আসছে না। মির্জা ভাইয়ের টুলের নিচ থেকে বিড়ালটা সশব্দে শাটারের নিচ থেকে বেরিয়ে গেলো। হেলাল মামার ভাগ্নেও মাথা ঝুঁকিয়ে বেরিয়ে গেল ওর সাথে। দোকানের ভেতর এই উটকো ঝামেলা ওর পছন্দ হচ্ছে না বোধহয়। আমাদের একটানা বকবকানিতে কানে তালা লেগে গেছে!
-'গঙ্গার তীরে জঙ্গলে এসে লুইপা কি দেখেছিলেন, জানতে চান?'
-'হ্যাঁ,' সমস্বরে উত্তর দিলাম আমরা।
'গহীন জঙ্গলে সবার থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে মহাবৃক্ষ। এই মহাবৃক্ষ পৃথিবীতে জন্ম নেয় বিশেষ উদ্দেশ্যে। সৃষ্টির শুরু থেকে তারা মানুষকে জ্ঞান দিয়ে আসছে, পরিচালিত করছে। রক্ষা করছে অশুভ শক্তির হাত থেকে। শুধু মহাবৃক্ষ নয়, প্রতিটা গাছই অসীম শক্তিধর। তাদের নিশ্বাস-প্রশ্বাস থেকে উগড়ে আসা অক্সিজেনে বাঁচিয়ে রাখছে মানুষকে। যুগ যুগ ধরে দিয়ে এসেছে আশ্রয়। এই গোপন অস্তিত্বকে তারা সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে নিজেদের ভেতর।'
'কীসব যা তা বলছেন?' মির্জা ভাইয়ের কণ্ঠ শুনতে পেলাম আমরা।
'যা তা বলছি না, বাবাজী। আপনারাই তো আহমদ ছফার লেখায় বৃক্ষদেবতার কথা আলোচনা করছিলেন। টাঙ্গাইলের সেই লোকটা মহাভাগ্যবান। পুরাণের গল্পে সর্ব-রোগবিনাশী বৃক্ষের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছিলেন নিজেরাই। আমি সেকথাই বলছি। পুরাণের জন্ম এমনি এমনি হয় না। দীর্ঘদিনের লালিত সত্য একটু একটু করে বিস্মৃত হয়ে অবশেষে পুরাণে বদলে যায়।'
'তো, এর সাথে লুইপার সম্পর্ক কী?'
'শুধু লুইপা নয়। মহাপুরুষ ধ্যানের মাধ্যমে মহাবৃক্ষের অস্তিত্বের সন্ধান পেয়েছেন। যুগে যুগে বৃক্ষই তাদের দিব্যদৃষ্টি উন্মোচন করেছে। গঙ্গার তীরঘেষা জঙ্গলে লুইপা তেমনই এক মহাবৃক্ষের সন্ধান পেয়েছিলেন, যার শিকড় আঁকড়ে মাটির নিচে অবস্থান করে বৃক্ষদেবতা। তাঁর সাথেই দেখা হয়েছিল মহাসিদ্ধ পুরুষের।'
'আপনি বলতে চাইছেন, রাজা ধর্মপাল বৃক্ষদেবতার দেখা পেয়েছিলেন?'
'এইতো বুঝতে পেরেছেন। সহজ কথা আমি জটিল করে বলতে চাই না।'
'চাচামিয়ার মাথা খারাপ, ভাই। বাদ দাও।' দীপু ফিসফিস করলো।
'আমার মাথা খারাপ না, বাবা। আমার মাথা খারাপ না। কথাগুলো ভালোভাবে খেয়াল করেন। ধর্মপালের কারাপ্রকোষ্ঠে বৃক্ষদেবতার সাথে দেখা হয়েছিল লুইপার। প্রথম দর্শনেই চিনে ফেলেন তিনি। দুই যুগ আগে, আরেক বৃক্ষদেবতাই তাকে বোধি লাভের উপায় বাতলে দিয়েছিলেন। বজ্রযানের তন্ত্র চর্চা করে লুইপা স্থান, কাল পরিবর্তনের মন্ত্র জানতে পেরেছিলেন। তিব্বতের লামারা যেভাবে শাংগ্রিলায় যাতায়াত করে থাকেন। সেই মন্ত্রই গোপনে শিখিয়ে দিয়েছিলেন বৃক্ষদেবতাকে।'
'বৃক্ষদেবতাকে মন্ত্র শেখাতে হবে কেন? আপনিই না বললেন, গাছের অসীম ক্ষমতা?'
'একটা কথা ভুলে গেলেন কেন? শেকড় আঁকড়ে মাটির নিচে অবস্থান করেন বৃক্ষদেবতারা। মূলবৃক্ষ কোন কারণে অপসারিত হলে, তাঁরাও ক্ষমতা হারান। রাজার সিংহাসন কেড়ে নিলে কি আর সে রাজা থাকে? আরেকটা কথা, দেবতারা বিস্মৃত হলে ক্ষমতা হারান।
তারপর অনেক অনেকদিন পর পুরাণের গল্পে কাল্পনিক অস্তিত্ব হিসেবে দেখা মেলে তাদের। মানুষের শরীর আর বৃক্ষক্ষদেবতার দেহ একই আদলে তৈরি। লুইপা তাঁর পদে ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন, মানুষের দেহ যেন গাছেরই পাঁচটি ডাল। অভিকর্ষের টানে তারা মাটির সাথে আটকে থাকে। কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল...'
ফটফট শব্দে দোকানের ভেতরের টাংস্টেন বাল্ব জ্বলে উঠল। একটানা অন্ধকারে থাকার পর সেই আলোতে চোখ ধাধিয়ে গেল আমাদের। বৃষ্টি থেমে গেছে। সামনের রাস্তায় পানি জমে গেছে বিশ্রিভাবে। দোকানের ছাদের একটা অংশ হেলে পড়েছে এদিকটায়। এমন দুর্যোগে এই আশ্রয়টুকুই বা ক’জন পায়?
'আপনি এতকিছু জানেন কীভাবে?' আসিফই প্রশ্নটা করলো।
হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠায় আমরা তাল হারিয়ে ফেলেছিলাম। আসিফের প্রশ্নে সম্বিত ফিরল সবার। তবে কোন উত্তর পাওয়া গেলো না। শাটারের কোণায় তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে কেউ নেই।
পরিশিষ্ট
পরদিন সকালে অফিস যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সকালের চায়ে চুমুক দিতে দিতে ফেসবুকের হোমপেজ স্ক্রল করা অন্যদের মতো আমারও বদভ্যাস। বাসায় ফিরে মরার মতো ঘুমিয়েছিলাম। রাতে নাকি আবারও তুমুল ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। গতকালকের কালবৈশাখীর খবরে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো সয়লাব হয়ে আছে এখন।
'রাজধানীর কাঁটাবন এলাকায় গাছের চাপা পড়ে জনৈক বৃদ্ধের মৃত্যু।' এই শিরোনাম দেখে চোখ আটকে গেল। অস্বস্তি নিয়ে লিঙ্ক ওপেন করলাম আমি।
গতকাল মাঝরাতে আবারও কালবৈশাখীর তান্ডবের শিকার হয় নগরী। কাঁটাবন এলাকায় একটি বহু পুরনো বটগাছ মাটিতে উপড়ে পড়ে। তাঁর ঠিক পাশেই পাওয়া যায়, জনৈক বৃদ্ধের মৃতদেহ। ধারণা করা হয়, গাছের নিচে চাপা পড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। যদিও তার শরীরে আঘাতের কোন চিহ্ন নেই। বৃদ্ধের পরনে ছিল নীল রঙের চেক লুঙ্গি আর বাদামি রঙের ফতুয়া। এখন পর্যন্ত তার পরিচয় জানা যায়নি।
ম্যাসেঞ্জারে বিপ করে শব্দ হলো। নিউজ থেকে সরে ম্যাসেজ ওপেন করে দেখি দীপুর ম্যাসেজ, 'আচ্ছা, মামা। ধর্মপালের গল্পে বনের ভেতর গর্ত হয়েছিল কীভাবে?'
মোবাইল ফোনটা হাত থেকে সরিয়ে রাখলাম। সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই, জানা সম্ভবও নয়। ঠিক যেমনটা জানা সম্ভব নয়, গত রাতে মারা যাওয়া বৃদ্ধের পরিচয়।
এই মেট্রোপলিসে যারা সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতে মারা যায়, তাদের পরিচয় আমাদের না জানলেও চলবে।
(সমাপ্ত)