এক
'ইগড্রাজিলের নাম শুনেছিস?' একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন মির্জা ভাই।
অন্ধকারের ভেতর সিগারেটের কমলা রঙের আগুনের সাথে সদ্য প্রকাশিত ব্ল্যাকহোলের ছবির অদ্ভুত সাদৃশ্য।
আমি কথাটাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। এই মুহূর্তে, এই পরিবেশে আড্ডাবাজি অথবা জ্ঞানগম্ভীর আলোচনা- কোনটা চালাতেই ইচ্ছে করছে না। ভর সন্ধ্যায় হঠাৎ আকাশ কালো করে তুমুল বৃষ্টি শুরু হবে, এই কথাটা আমাদের কারও মাথায় আসেনি। ক’দিন ধরে যেমন চড়া রোদ, তাতে রীতিমতো গায়ে ফোসকা পড়ে যাবার উপক্রম হয়।
রাতে কোথাও এক ফোঁটা বাতাসের দেখা নেই, কেমন যেন দমবন্ধ ভাব। অথচ আজ কোন পূর্বসঙ্কেত ছাড়াই এই ভীষণ দুর্যোগ। দীপুকে বলতে শুনেছিলাম, 'খোদার কসম, চার মিনিট তেইশ সেকেন্ড আগেও আকাশে মেঘের ছিটাফোঁটা ছিল না!'
ওর কথাকে অবশ্য সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই। ছেলেটা মুখ-চোখ গম্ভীর রেখে এমনভাবে কথা বলে, সত্য-মিথ্যা বোঝার উপায় থাকে না।
বন্ধুমহলে ব্যাপারটা সবাই আগে থেকে জানতো। তবে অফিসের কলিগরা ধরতে পেরেছিল একটু দেরিতে। তারপর তো পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়াল যে, সত্যি কথা বললেও সবাই সেটাকে ঠাট্টা হিসেবে ধরে নেয়। একদিন দুপুরে নাকি সিঁড়িতে নামতে দেখে ওর এক কলিগ জিজ্ঞেস করেছিল কোথায় যাচ্ছে। 'ভাত খেতে যাই, ভাই,' সাদামাটা জবানবন্দি শুনেও হাসতে হাসতে দীপুর পিঠে চাপড় মেরে বলেছিল লোকটা, 'আপনি পারেনও!'
ঝড়-বৃষ্টিকে অবশ্য দোষ দিয়ে লাভ নেই। চৈত্রের শুরুতে কালবৈশাখী বলে-কয়ে আসে না। প্রতিবছর একই কান্ড ঘটে, তবু আমরা ভুলে যাই। ঠিক যেভাবে আমরা ভুলে যাই দেশের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিকান্ড, খুন, ধর্ষণ অথবা জালিয়াতির কথা। ভুলে গিয়ে হয়তো আমরা শান্তি পেতে চাই, চাই অস্থিরতা দূর করতে। নিজেকে বোঝাই, ভালো আছি। এই ভুলে যাওয়া আমাদের মজ্জাগত স্বভাব।
শুধু বৃষ্টি হলে কথা ছিল, কিন্তু তার সাথে বাতাসের গর্জন আর ধুলোঝড় মিলে যে অবস্থা, তাতে রাস্তায় নেমে হাঁটার কথা চিন্তা করা যায় না।
মিশমিশে অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি প্রতারণা করেছিল। বাতাসের দাপটে ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছিলাম না কেউ। হাচড়ে পাঁচড়ে আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়াচ্ছি, এমন সময় আসিফকে বিড়বিড় করতে শুনেছিলাম, 'Air, air, everywhere, nor any air to breathe.' আঁতেল কোথাকার। এই পরিস্থিতির সাথে কেউ স্যামুয়েল কোলরিজের কবিতার সাদৃশ্য খোঁজে?
আসিফটা অবশ্য বরাবরই এরকম। লিটারেরি রেফারেন্স ছাড়া সে কোন কথাবার্তা বলতে পারে না। খাওয়া-ঘুম-চলাফেরা এমনকি দীপুর ভাষায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও নাকি ও সাহিত্যের নিদর্শন খুঁজে পায়।
ভার্সিটিতে আড্ডার ছলে যখন আমরা যখন সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে আলোচনা করতাম, তখনও আসিফের মুখে থেকে সাহিত্যিক চরিত্রের কথা বেরোত। তানিয়া হয়ে যেতো রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য, মোহনা হতো ড্যাফনে দু’ মরিয়ারের রেবেকা। চোখ ধাঁধানো সুন্দরী নুজহাত হয়ে যেতো জেন অস্টেনের এমা উডহাউজ।
পেশাগত জীবনে আসিফ ভালোই খাপ খাইয়েছে বলা যায়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ লিটারেচারের লেকচারার, ওর জন্য নিঃসন্দেহে ড্রিম জব!
আরেকটু দেরি হলে বাতাসে উড়ে যাব বলে মনে হচ্ছিল, এরই মাঝে কীভাবে কীভাবে যেন মির্জা ভাই এই আধা শাটার নামানো বুক বাইন্ডিং- এর দোকানটা খুঁজে বের করে ফেলল। হ্যাঁচকা টানে আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে একে একে পথ বাতলে দিলো দীপু আর আসিফকেও।
মির্জা আজহারুল ইসলাম, পদবীটাকেই ডাকনাম হিসেবে ব্যবহার করে সবজায়গায়। ভার্সিটিতে আমাদের সাথেই ভর্তি হয়েছিল। একই ডিপার্টমেণ্ট, একই সেশন- তবুও শুরু থেকে তাকে কেন 'ভাই' সম্বোধন করা হয়, এই ইতিহাস কারও জানা নেই। কারণ জানতে হবে, সেই তাগিদও ভুলে গিয়েছে সবাই। ওই যে একটু আগে বললাম, ভুলে যাওয়া আমাদের মজ্জাগত স্বভাব।
পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আমরা চাকরিতে ঢুকেছি, কেউ কেউ ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। মির্জা ভাই কিন্তু সেই আগের মতোই আছে। সারাদিন ঘুমায়, বিকালে উঠে কিছু একটা মুখে দিয়ে রাস্তায় ঘুরতে বের হয়। তারপর বাড়ি ফিরে বইপত্র পড়ে কেটে যায় সারা রাত।
বনেদি বংশের ছেলে, উপার্জন না করলে খুব একটা ক্ষতি নেই। পৈতৃক সূত্রে যে সম্পত্তি আছে, আরও দুই পুরুষ ধরে শুয়ে-বসে খেতে পারবে। কিন্তু তাই বলে জীবনের প্রতি এমন নির্মোহ ভাব থাকলে চলে? বাবা-মা আগে চেঁচামেচি করতেন। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছেন তারাও।
সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন করলেও আসিফের মতো হাতে-গোনা দু’-একজন ছাড়া পেশাগত জীবনে কেউ সাহিত্যের সাথে সম্পর্ক রাখেনি। দীপু একটা বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করে, আমি প্রাইভেট ব্যাংকে। ভার্সিটির পর নাকি বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ থাকে না, এই কথাটাকে মিথ্যা প্রমাণ করে আমরা চারজন এখনও পুরোদস্তুর যোগাযোগ বজায় রেখেছি।
ভার্সিটিতে একই হলে থাকতাম। খাওয়া-দাওয়া, ওঠা-বসা সবই একসাথে ছিল। প্রতিদিন বিকালে নিয়ম করে আমরা নীলক্ষেতের গাউছুল আযম মার্কেটের পেছনের চিপা জায়গাটায় বসে আড্ডা দিতাম। কাপের পর কাপ চা ফুরিয়ে যেতো, সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে মিশে যেত মেঘের সাথে। প্লাস্টিকের বয়ামের নোনচা বিস্কুট অথবা মোড়ের দোকানের পোড়া মবিলে ভাজা বিস্বাদ সিঙ্গারা ফুরিয়ে যেতো। ফুরাতো না আমাদের আড্ডা।
এখন আর আগের মতো সময় বের করা সম্ভব হয় না। তবুও প্রতি শুক্রবার বিকালে আমরা চারজন এখানে আড্ডা দিতে আসি। বাস্তবতার বিষবাষ্পে আমাদের শরীরের কোষে কোষে যে মরিচা জমে যায়, তাকে চেঁছে তুলে ফেলতেই আমরা উদ্দেশ্যবহীন আড্ডা দিতে বসে যাই।
নীলক্ষেতের এই গুমোট গলিতে বসে আমাদের মনে হয়, সৃষ্টির শুরু থেকে জায়গাটা এমনই ছিল। সরু অন্ধকার গলি, হাজার হাজার বইয়ের স্তূপ, মানুষের চেঁচামেচি, হইচই- পুরোটা মিলে এ এক অন্য জগত।
এখানকার দোকানদার আর কর্মচারীরা কোন এক অদ্ভুত উপায়ে অমরত্বের সন্ধান পেয়েছে। তাদের বয়স বাড়ে না, স্পর্শ করে না জরা-ব্যধি। হাজার হাজার বছর ধরে যেন তারা উৎসুক দৃষ্টিতে খদ্দেরের দিকে তাকিয়ে হাক পাড়ে, 'মামা, কী লাগব?' অথবা 'নিয়া যান, পঞ্চাশ টাকা কমায়া রাখুমনে।'
প্রতি সপ্তাহের মতো আজ বিকালেও আমরা আয়েশ করে বসেছিলাম।
নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চে বসে ঠাণ্ডা লাচ্ছিতে চুমুক দিতে দিতে অফিসের গল্প শোনাচ্ছিল দীপু। আমি বহুদিন তেমন বইপত্র পড়ি না। তবে কালকে রাতে অফিস থেকে ফিরে আহমদ ছফার ‘পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গ পুরাণ’ বইটা একটানে পড়েছি। গল্পের এক পর্যায়ে সেটা নিয়েই কথা তুলেছিলাম।
-'বুঝলে মির্জা ভাই, ছফা সাহেব টাঙ্গাইলের এক লোকের কথা লিখেছেন। দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার পর ডাক্তাররা যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল, তখন তার এক পরিচিত লোক একটা অদ্ভুত পরামর্শ দেয়। প্রতিদিন সকালে গোসল করে পরিচ্ছন্ন শরীরে নিজের হাতে লাগানো একটা গাছকে জড়িয়ে ধরতে হবে। তারপর সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলতে হবে, 'বৃক্ষদেবতা, আপনি অনুগ্রহ করে আপনার শরীরে আমার রোগটা গ্রহণ করুন এবং আপনার সুস্থতা আমার শরীরে সঞ্চারিত করুন।' অসুস্থ লোকটা সেই পরামর্শ অনুযায়ী প্রতিদিন সকালে সূর্যের দিকে তাকিয়ে তার নিজের হাতে লাগানো একটা আমড়া গাছকে জড়িয়ে ধরে প্রার্থনা করতে শুরু করেছিল। এক মাস পর, মানুষটা সুস্থ হয়ে ওঠে।'
-'গাছটার কী হয়েছিল?'
-'গাছটা মারা যায়, ভাই।'
-'আজব ব্যাপার। গাছ নিয়ে এমন মিথের অভাব নেই। কিন্তু রিয়েল লাইফ এক্সপেরিয়েন্স আগে কখনও কানে আসেনি। আহমদ ছফা কি লোকটাকে চিনতেন?'
-'না। বইয়ে লেখা আছে, তিনি এক পরিচিত লোকের কাছে গল্পটা শুনেছিলেন।'
-'সমস্যাটা এখানেই, বুঝলি? সরাসরি রেফারেন্স কখনোই পাওয়া যায় না।'
-'ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় বৃক্ষের এমন ঐশ্বরিক শক্তির কথা এসেছে, মির্জা ভাই।' মুখ গোমড়া করে বলেছিল আসিফ।
ব্যস! সেখান থেকেই গাছ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। আসিফ আমাদেরকে শুনিয়েছিল মহাভারতের শমী বৃক্ষের কথা। অজ্ঞাতবাসের সময় পঞ্চপান্ডবরা দুর্যোধন আর তার ভাইদের কাছ থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখতে নানান রকম ছদ্মবেশ ধারণ করেছিল। সেই সময় শমী বৃক্ষের আড়ালে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিল তারা। গাছটার নাকি অদ্ভুত জীবনীশক্তি, সব রোগের নিরাময় ঘটাতে পারে অনায়াসেই।
'আমি বিশ্বাস করি, রূপকথা অথবা মিথে যা আছে, তার পুরোটুকু বানোয়াট নয়। মানুষ যা দেখে, তার আদলেই গল্প বানায়,' দীপুর কণ্ঠে রীতিমতো গাম্ভীর্যের সুর। 'একেবারে উদ্ভট, অপার্থিব কিছু হুট করে জন্ম নেয় না।'
'কথাটা ঠিক।' মির্জা ভাই মাথা নেড়ে তাল দিচ্ছিলেন, 'আদিম মানুষের গুহায় আঁকা যেসব অদ্ভুত ছবি আছে, যেগুলোকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কাল্পনিক বলে থাকেন আরকি, ঘুরেফিরে দেখবি সবই পরিচিত জগতের জিনিস। ঘোড়ার মাথায় একটা শিং অথবা মানুষের মুখের সাথে ঘোড়ার শরীর। পার্থিব রূপগুলোই কিন্তু এদিক-সেদিক হয়ে কাল্পনিক হয়ে ধরা দেয়। রোগ সারানোর গাছের কথা বহুভাবে ঘুরে-ফিরে এসেছে। ঠাকুমার ঝুলিতে পড়িসনি? রাজকন্যা অসুস্থ।সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে এক রহস্যময় বৃক্ষ আছে, যার পাতার রস খাওয়ালে অসুখ সেরে যাবে। রাজপুত্র ঘোড়া ছুটিয়ে অসাধ্য সাধন করে সেই পাতা সংগ্রহ করে আনে। তাতেই অসুখ সেরে যায় রাজকন্যার।'
-'হ্যাঁ, ভাই। আলকেমি থেকে শুরু করে অমরত্বের যা শাস্ত্রকথা- সবকিছুতেই গাছের রেফারেন্স। গহীন জঙ্গলে গোপনে নিজের অস্তিত্ব লুকিয়ে রেখেছে সেই মহাবৃক্ষ...'
খকখক...ক্ষাক...খক
প্রচন্ড কাশির শব্দে আমাদের গল্পের এই পর্যায়ে এসে ভাটা পড়েছিল। গম্ভীর চেহারার এক বৃদ্ধ লোক তীব্র আগ্রহে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
আড্ডায় মশগুল আমরা কেউ ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। কাশির শব্দে সেদিকে তাকাতেই, তিনি মাথা নেড়ে মৃদু হাসলেন। নীল চেকের লুঙ্গি পরা, গায়ে একটা বাদামি রঙের ময়লা ফতুয়া।
হুট করে দেখে বয়সের আন্দাজ করা যায় না। তবে চোয়ালগুলো অস্বাভাবিক মজবুত। গায়ের রঙে মলিন তামাটে ভাব। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, বৃদ্ধের চোখজোড়া। সবুজ রঙের মণি জ্বলজ্বল করছিল সেখানে। বাঙালিদের সবুজ চোখ আর কমন সেন্স- দুটোই বেশ দুর্লভ ব্যাপার।
'গাছের কথা ঠিক বলেছেন। গাছ জীবন দেয়, রোগ সারায়।' সংক্ষিপ্ত দুটো বাক্য বলে তিনি চাওয়ালার দিকে তাকিয়ে এক কাপ তুলসি চা চাইলেন, 'অনেকদিনের কাশি। কড়া করে একটা তুলসি চা দাও, দেখি। তুলসি পাতার নির্যাস কফ উপশম করে।'
আমরা কেউই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না। কোথাকার একটা উটকো লোক, আমাদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে চাইছে। সে এসবের বোঝে কী?
ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে গেলো গাছের রোগ সারানোর ক্ষমতার আলোচনা নিয়ে। সেখান থেকে বিষয় ঘুরে গেলো মহাপুরুষ আর ধর্মসাধনার দিকে। বরাবরের মতো আসিফই শুরু করেছিল,
-'বোধিবৃক্ষের কথা তো তোরা সবাই জানিস। গৌতম বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে পূর্বদিকে মুখ করে এক অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে ধ্যানমগ্ন হয়েছিল। এই বোধিবৃক্ষ কিন্তু বৌদ্ধদের কাছে পরম পূজনীয়। সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকালে তাঁর পুত্র-কন্যাকে সেই বোধিবৃক্ষের চারা দিয়েই সিংহলে পাঠিয়েছিলেন।'
'শুধু বৌদ্ধধর্মে না,' মির্জা ভাই বলেছিলেন, 'অসংখ্য মহাপুরুষের জীবনীতে বিশেষ বৃক্ষের কথা এসেছে। দিব্যজ্ঞান লাভ করার আগে তারা কোন এক পবিত্র গাছের সন্ধান পেয়ে ধ্যানে বসেছিলেন। সেখান থেকেই...'
মির্জা ভাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই দূরে কোথাও কান ধাঁধানো শব্দে বাজ পড়ল। গল্পে মজে থাকায়, আমরা কেউ খেয়াল করিনি.. কখন যেন আকাশ কালো হয়ে এসেছে। ঠিকমতো উঠে দাঁড়ানোর আগেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। সাথে প্রচন্ড বাতাস। ধুলোর তান্ডবে আমরা চোখ খুলে তাকাতে পারছিলাম না।
কোনমতে সামনের দিকে দৌড়তে শুরু করলাম। মির্জা ভাই ইশারা দিয়ে এই গলির দিকে টেনে আনলেন আমাদের তিনজনকে। অর্ধেক শাটার নামানো একটা বুক বাইন্ডিং-এর দোকান এভাবেই আমাদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হলো।
দুই
এই মুহূর্তে, নীলক্ষেতের একটা ঘুপচি গলির দোকানে সাতজন আটকা পড়েছি আমরা। না, ভুল হলো। একটা সাদা রঙের পেটমোটা বিড়ালসহ গুনলে আটজন হয়। দোকানের দুইজনের সাথে আমরা চারজন। সপ্তম জন হচ্ছে, একটু আগের সেই তুলসি চায়ে চুমুক দেয়া বুড়ো লোকটা। ঝড়ের সময় নিশ্চয়ই আমাদের পিছুপিছু এখানে দৌড়ে এসেছে।
ছোট্ট একটা জায়গা, এতজন একসাথে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। দোকানের মালিক হেলাল মামা মির্জা ভাইয়ের পূর্ব পরিচিত। সে এক কোণায় জড়সড়ো হয়ে বসে আছে। তার পায়ের কাছে বারো-তেরো বছরের একটা ছেলে। সম্পর্কে ভাগ্নে, পেশায় এই দোকানের হেল্পার।
মির্জা ভাই মাঝখানে একটা টুলে বসা, আমরা তিনজন তার গা ঘেঁষে দাঁড়ানো। বিড়ালটা টুলের ঠিক নিচে বসে আছে চুপচাপ। আর বৃদ্ধ লোকটা শাটারের সাথে ঠেস দিয়ে কী যেন ভাবছে।
ঝড়-বৃষ্টি শুরু হতেই পুরো এলাকার ইলেক্ট্রিসিটি চলে গিয়েছে। চারদিকে মন খারাপ করা অন্ধকার।
দোকানের ছাদ টিনের সাথে পুরনো পলিথিন পেঁচিয়ে বানানো। যথাযথ মেরামত না করায়, ভেতরে চুইয়ে পানি পড়ছে। সামনের শাটার প্রায় আমাদের হাঁটু পর্যন্ত নামানো থাকলেও বাতাসের তোড়ে পানি ছিটকে আসছে ভেতরে। টিনের ছাদে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা আছড়ে পড়ে এমন শব্দ করছে, যেন যেকোনো সময় ছাদসমেত আমাদের মাথার ওপর ভেঙে পড়বে পুরো ঘর। বাতাসের শো শো গর্জন এতটা ভয়ঙ্কর শোনাতে পারে, কোনদিন কল্পনাও করিনি।
তীব্র আলোর ঝলকানিতে ঝলসে উঠল চারদিক। কয়েক সেকেন্ড পরেই কানে তালা লাগানো শব্দে বাজ পড়ল কোথাও। ঠিক যেন অলিম্পাসের চূড়া থেকে ক্ষিপ্ত হয়ে মর্ত্যে নেমে এসেছে বজ্রদেবতা জিউস!
ক্ষণিকের আলোতে দেখতে পেলাম, বৃদ্ধ লোকটা পেছন ফিরে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণায় কেমন যেন তাচ্ছিল্যের হাসি।
মির্জা ভাই এরই মাঝে কখন যেন সিগারেট ধরিয়েছে। পকেটে লাইটার ছিল বোধহয়। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তেই আবার জিজ্ঞেস করল, 'কিরে? ইগড্রাজিলের নাম কেউ শুনিসনি?'
না শোনার ভান করেছিলাম এতক্ষণ। উত্তর না দিলে আসিফ ইতিহাস শোনাতে শুরু করবে, এই ভয়ে বলে ফেললাম, 'হ্যাঁ, শুনেছি। নর্স মিথলজি অনুযায়ী, ইগড্রাজিল একটা বিরাট বড় গাছ। পৃথিবীর নিচ থেকে মহাকাশ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে।'
'তোর মাথা,' মির্জা ভাইয়ের কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর, 'ঠিকঠাক না জানলে বলতে যাস কেন?'
রাগে আমার গা জ্বলে গেলো। ঝড়-বৃষ্টিতে আটকা পড়ে আছি, কখন ফিরতে পারব ঠিক নেই। উনি এসেছেন নর্স মিথলজির গল্প নিয়ে। সব পরিস্থিতিতে কি আড্ডাবাজির মেজাজ থাকে?
'মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারিত হওয়ার আগে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের নিজস্ব ধর্মমত ছিল,' ডানপাশ থেকে আসিফকে বলতে শুনলাম, 'বিশ্বজগত সম্পর্কে তাদের অদ্ভুত এক ধারণা ছিল। তারা বিশ্বাস করত সবকিছুর আদিতে ছিল বিরাট এক গাছ, ইগড্রাজিল। এই গাছকে কেন্দ্র করে নয়টা জগত বিস্তৃত। সেসব জগতের ভেতর দেবতাদের স্থান স্বর্গীয় অ্যাসগার্ডে। মিডগার্ডে বাস করে মানুষ। অন্যান্য স্তরেও এমনভাবে দৈত্য, বামন অথবা অন্যান্য প্রাণীদের বসবাস।'
'ঠিক। প্রাচীন ধর্মগুলোতেও মহাবৃক্ষের অস্তিত্ব আছে। জাপানিজ মিথলজিতেও এমন গাছের ধারণা ছিল। আফ্রিকান মিথেও বাদ যায়নি।'
'গাছ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, বাবারা,' শাটারের কোণা থেকে গমগমে কণ্ঠ ভেসে এলো। সেই বৃদ্ধ আবার আমাদের গল্পে অংশ নেয়ার চেষ্টা করছে।
তার কণ্ঠে কেমন যেন একটা ভারিক্কি ভাব। শুনলে মনে হয় দূরের পাহাড় থেকে প্রতিধ্বনি ভেসে আসছে। বাক্য ফুরিয়ে যাবার পর, বাতাসে মিশে থাকছে তার রেশ। পোশাক-আষাক দেখে নীলক্ষেতের কর্মচারী বলে মনে করেছিলাম। তবে শব্দ উচ্চারণের ভঙ্গিতে আভিজাত্যের স্পষ্ট ছাপ। আগেরবার ভালোভাবে খেয়াল করিনি। একটু অবাকই হলাম।
'জ্বী, চাচা। আসলে আমরা সবাই বাংলাদেশ বোটানি এসোসিয়েশনের মেম্বার, গাছ নিয়ে গবেষণা করি। আমাদের বন্ধু আসিফ বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারে বৃক্ষের ভূমিকা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখছে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু কিন্তু ওর দূরসম্পর্কের দাদা হন।'
আবার বিদ্যুৎ চমকাল। তীব্র বেগুনি আলোতে বৃদ্ধের মুখ দেখা গেলো ক্ষণিকের জন্য। ঠোঁটে হাসির চিহ্ন নেই আর। তীক্ষ্ণ চোয়ালগুলো আরও শক্ত হয়ে উঠেছে। আধো আলো-ছায়াতে তার সবুজ চোখজোড়া চুনি-পান্নার মতো জ্বলছে।
টুলের নিচ থেকে বিড়ালটা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল। বজ্রপাতের শব্দ, বৃষ্টির সাথে ছিটকে পড়া শিলা নাকি বৃদ্ধের জ্বলজ্বলে চোখ- কীসে জানি না, তবে আতঙ্কে আমার গা শিউরে উঠল। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আমার সঙ্গীদেরকেও ছুঁয়ে গেছে সেই ভয়।
'আমি আপনাদের একটা গল্প শোনাতে চাই। সময় হবে?' বৃদ্ধের গলায় আবার সেই রহস্যের সুর।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাথা নাড়লাম আমি। পাশ থেকে মির্জা ভাই অস্ফুট স্বরে হু-জাতীয় কোন একটা শব্দ করল।
কালিগোলা অন্ধকার। কেউ কারও মুখ দেখতে পাচ্ছি না। বৃষ্টির ফোঁটা ছিটকে এসে মির্জা ভাইয়ের সিগারেট নিভিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই। প্রকৃতির আক্রোশের বহুরূপ আওয়াজের বাইরে আর কোন শব্দ নেই এখানে। সময় থমকে গেছে যেন। সেই সাথে থমকে গেছে ঘুপচি গলির এই দোকানে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো।
'গল্পটা বলুন, চাচা। আমরা শুনতে চাই।' অবশেষে অসহ্য সেই নীরবতা ভাঙল আসিফ। মনে মনে ওকে ধন্যবাদ দিলাম। আর কয়েক মুহূর্ত এমনভাবে থাকলে বোধহয় মুখ দিয়ে আমার হৃৎপিণ্ডটা বাইরে বেরিয়ে আসতো!
-'ধন্যবাদ। আশা করি, গল্পটা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।'
গল্পটা এভাবে শুরু হলো-
'আপনারা রাজা ধর্মপালের নাম জানেন নিশ্চয়ই। জ্ঞানী-গুণী মানুষ, না শোনার কোন কারণ নেই। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোপাল। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র ধর্মপালের মাথায় সাম্রাজ্যের মুকুট ওঠে।
রাজা ধর্মপালের সিংহাসনে বসার সময় উত্তর ভারতে রাজনৈতিক আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। বাংলার রাজা হিসেবে তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী ছিলেন। অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে তিনি পূর্বদিকে রাজ্যবিস্তার করে কনৌজ দখলের চেষ্টা করেন। প্রতিহার বংশের রাজা বৎস্যরাজ একই সময়ে মধ্যদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টায় পূর্বদিকে অগ্রসর হন। এই সংঘর্ষে ধর্মপাল পরাজিত হন। এদিকে দক্ষিণ ভারত থেকে রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুব ধারাবর্ষ এসে আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করেন। শুরু হয় ত্রিপাক্ষিক সংঘর্ষের। ধ্রুব ধারাবর্ষের কাছে বৎস্যরাজ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। এরপর তিনি অগ্রসর হন রাজা ধর্মপালের বিরুদ্ধে। ধর্মপাল ইতোমধ্যে মগধ, বারনসি ভূবাগ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছেন। এমন অবস্থায় ধ্রুব সেই অঞ্চলেই ধর্মপালকে পরাজিত করে।
ত্রিপাক্ষিক সংঘর্ষে রাষ্ট্রকূটরাজের সার্বিক জয় হলেও, তিনি কোন সুরক্ষার ব্যবস্থা না রেখে দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান। বৎস্যরাজের পরাজয়ের পর প্রতিহার বংশ এমনভাবে ভেঙে পড়েছিল যে তাদের আর মাথা টুলে দাঁড়ানোর শক্তি ছিল না। আর এই সুযোগেই চতুর ধর্মপাল পরাজিত হয়েও রাজ্যবিস্তারের সুযোগ পান।'
ইতিহাসে এই বৃদ্ধের এতো অগাধ জ্ঞান! অথচ কিছুক্ষণ আগেও ভেবেছিলাম, আমাদের আলোচনায় অংশ নেয়ার মতো যোগ্যতা নেই লোকটার। হাঁ করে কথা শুনছিলাম, নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না কিছুতেই। তখনও বুঝতে পারিনি, বিস্ময়ের জগতে পা রেখেছি মাত্র।
'তো এরপর ধর্মপাল কান্যকুব্জ আক্রমণ করে ইন্দ্রায়ুধের স্থলে চক্রায়ুধকে ওই অঞ্চলের সিংহাসনে বসান। বেশ কিছু জনপথের রাজারা ধর্মপালের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। রাতারাতি রাজা ধর্মপাল বর্তমান মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, পাঞ্জাব ও পাকিস্তানের সিন্ধু নদ উপত্যকা পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করে ফেলেন। আমার গল্পের শুরুটা এখানেই।'
বৃদ্ধ দুইবার কাশলেন। বজ্রপাতের সাথে সেই কাশির আওয়াজ মিলে অপার্থিব এক শব্দের দ্যোতনা ঘটাল।
(পড়ুন দ্বিতীয় তথা শেষ পর্ব)