চার
ধানমণ্ডি এলাকায় এই ক্লাবটা নতুন হয়েছে। দেশি বিদেশি বড় বড় বিজনেস ম্যাগনেটদের আনাগোনা। ভালো পানি, লাল পানি, স্ট্রিপ ড্যান্স, প্রাইভেট কেবিন—সব ধরনের নিষিদ্ধ আনন্দের ব্যবস্থা আছে।
সরকার ইদানিং এসব বিষয়ে উদার মনোভাবের পরিচয় দিচ্ছে। ক্লাবের সামনে গাড়ি পার্ক করল ফাহাদ। শামিমকে নিয়ে ঢুকল ভেতরে। জমকালো লাইটিং আর মিউজিক শামিমের মাথা ধরিয়ে দিলো। ফাহাদ এক কোনায় একটা টেবিল দেখে বসল। সুন্দরী ওয়েটারকে দেখে ভদকা দিতে বলল। মেয়েটা সুন্দর করে “জ্বী স্যার” বলে নিতম্ব দুলাতে দুলাতে চলে গেল।
-“আমি ভেবেছিলাম ত্রিনার ভালোবাসা তোকে বদলে দিয়েছে”
-“ড্যাম ইওর ফা— ভালোবাসা! আমাকে চিনিস না তুই? এক নারী নিয়ে মজে থাকার মানুষ আমি?”
-“চিনি! তবুও মনে হয়েছিল!”
-“ঐ সব রাখ, তোকে যেজন্য ডেকেছি শোন। আজ রাতে আমি ইউরোপ যাচ্ছি। সাথে আমার নতুন সেক্রেটারি রিনা যাচ্ছে। ব্যবসায়িক কিছু কাজ আছে। বাকিটা সময় রিনাকে এনজয় করব। রিনাকে তো দেখিস নি। খাসা জিনিস রে ভাই! বিছানায় তার সে কি পারফর্মেন্স! ভাবতেই গরম হয়ে যাচ্ছি।”
রাগে ভেতরে ভেতরে শামিমের সারা শরীর কাঁপছে। কিন্তু বাইরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে সে।
ফাহাদ বলে যাচ্ছে, “তুই মাঝে মধ্যে বাসায় যাবি, ত্রিনার সাথে দেখা করে তাকে সঙ্গ দিবি। ওকে বলবি যে আমিই তোকে ফোন দিয়ে রিকোয়েস্ট করে সেখানে পাঠাই। ত্রিনাকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করে রাখতে হবে। নইলে অফিসে এসে খোঁজ খবর নিয়ে সব কিছু জেনে ফেলবে!”
শামিম রাগ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে বলল, “এই জীবনই যদি চাস তবে কেন বিয়ে করলি ওকে?”
“সংসার করা লাগবে না? বংশ বৃদ্ধি করা লাগবে না?” ফাহাদ তার সেই চিরচেনা বিরক্তিকর হাসি হাসছে। “যাই হোক, এতো কিছু তোর বোঝার দরকার নেই। যা বলেছি সেটা করিস, তাহলেই হবে”।
-“যদি না করি?”
ফাহাদ আবার হাসল, “বন্ধু হিসেবে বন্ধুর ঘর আগলে রাখা তোর দায়িত্ব না? আফটার অল আমার টাকা পয়সা খেয়েই তো এতোদূর এলি! যার নুন খেয়েছিস, তার কথা তো শুনতেই হবে!”
এই কথার ওপর শামিম আর কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। তার অসহায়ত্ব দেখে ফাহাদ আবার হো হো করে হাসতে শুরু করল। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল,“ওইতো রিনা এসেছে! দেখ! কি মারাত্মক সেক্সি!”
রিনাকে দেখার কোনো আগ্রহ বোধ করল না শামিম। বেরিয়ে এলো ক্লাব থেকে।
রাস্তায় বেরিয়ে কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না শামিম। পায়ের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিলো। আজ পা দুটি যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাবে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। ত্রিনা প্রতারণার শিকার হয়েছে। এই দায়ভার তারই। সে পারতো সহজেই ত্রিনার সাথে ফাহাদের সম্পর্কটা ভেঙে দিতে। কিন্তু ফাহাদ কে সে ভয় পায়। সেই ভয়ের কারনে পারেনি ত্রিনাকে কিছু বলতে। ত্রিনা ঠিকই বলেছে। সে আসলেই একটা কাপুরুষ।
শামিমকে ত্রিনা অসংখ্যবার সুযোগ দিয়েছে কথা বলার। সে পারেনি মনের কথাগুলো তার সামনে বলতে।
একটু সাহসের অভাবে পারেনি ফাহাদ সম্পর্কে ত্রিনার ভুল ধারণা ভেঙে দিতে। একজন কাপুরুষের মতো গুটিয়ে রেখেছিল নিজেকে। তারই মাশুল আজ দিতে হচ্ছে ত্রিনাকে। শামিমের একটু সাহস হয়তো বদলে দিতে পারতো তাদের দুজনের জীবন।
এভাবে কতক্ষণ পেরিয়ে গেল আর কতটুকু হেঁটেছে তা বুঝতে পারল না শামিম। আশে পাশে যা কিছু ঘটে যায় যাক, আজ আর কিছুই যায় আসে না। খেয়াল হলো কেউ একজন চিৎকার করছে। শামিম আবিষ্কার করল সে একটা বড় রাস্তার ইউটার্নের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। আওয়াজ লক্ষ্য করে ঘুরে তাকানোর চেষ্টা করল সে। এক সেকেন্ডের জন্য দেখতে পেল একটা পিক আপ ভ্যান ফুল স্পীডে তার দিকে ছুটে আসছে। সম্ভবত তার কাপুরুষের জীবন শেষ হতে চলেছে!
পিক আপ ভ্যানের ড্রাইভার শেষ মুহূর্তে ব্রেক করার চেষ্টা করল। বনবন করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল।
কিন্তু জায়গাটা ছিল একটা পেট্রোল পাম্পের পাশে। পিকআপ ধাক্কা খেলো তেলের ট্যাংকারে। প্রচন্ড শব্দে আশেপাশের বিল্ডিংগুলো কেঁপে উঠল।
আরও কিছু গাড়ি দিক হারিয়ে এসে ধাক্কা খেলো। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল শহরের এক অন্যতম ব্যস্ত সড়কে। আগুনের লেলিহান শিখা উঁচু হয়েই চলেছে। আজ যেন আকাশটা ছুঁয়েই ছাড়বে!
পাঁচ
প্রায় দুই মাস পর দেশে ফিরল ফাহাদ। ব্যবসায়িক কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল দুই সপ্তাহেই। তারপর সেক্রেটারি রিনার সাথে ইউরোপের নানান দেশে প্রমোদ ভ্রমন করেছে। সাংঘাতিক মজায় কেটেছে সময়, মনটা তাই উৎফুল্ল হয়ে আছে। গাড়িতে করে রিনাকে তার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিলো ফাহাদ। তারপর রওনা দিলো নিজের বাসার দিকে।
শামিমকে একটা ফোন দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে সে। রিনার সাথে বাইরে গিয়ে কী কী করেছে—বলতে না পারলে শান্তি পাচ্ছে না। মোবাইলে শামিমের নম্বর বের করে ডায়াল করল ফাহাদ। শামিম রিসিভ করতেই বলল, “দোস্ত! আমি তো ফিরে আসছি দেশে”।
ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো, “হুম”!
-“তুই কই? বাসায় চলে আয়”।
-“হুম”।
-“কি হুম হুম করছিস? চলে আয় এখনই”।
কী হয়েছে শামিমের? হুম হুম ছাড়া কিছু বলছে না! ফোন কেটে দিয়ে ত্রিনাকে ফোন করল ফাহাদ। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। বিরক্তি লাগছে তার।
বাড়ির সামনে চলে এসেছে ফাহাদ। ড্রাইভারকে গাড়ি গ্যারেজে রাখতে বলে লিফটে চড়ল সে।
গুন গুন করে একটা ইংলিশ গান গাইতে গাইতে আট তলায় উঠে এলো। অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে কলিং বেল চাপলো দুই তিন বার। আওয়াজ হচ্ছে না, সম্ভবত কলিং বেলের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেছে। দরজার নবে হাত রাখল ফাহাদ। মৃদু ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল।
আশ্চর্য ব্যাপার! দরজা খোলা কেন? আস্তে করে ভেতরে একটা পা রাখল ফাহাদ।
ত্রিনার নাম ধরে ডাকার চেষ্টা করল সে। কিন্তু অবোধ্য একটা শব্দ বের হল মুখ থেকে। মাথায় প্রচন্ড জোরে কিছু একটা আঘাত করেছে। চোখের সামনে পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে এলো তার।
জ্ঞান ফেরার পর বেশ কিছুক্ষণ চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা লাগল। মাথা ঝাঁকিয়ে দৃষ্টি পরিস্কার করার চেষ্টা করল সে। মাথায় যেখানে আঘাত লেগেছে সেখানে প্রচন্ড বাথা। একটু পর সে বুঝতে পারল কোথায় আছে! এটা তার বাসার স্টোর রুম। নড়া চড়ার চেষ্টা করতেই বুঝল হাত পা বাঁধা। সামনে কেউ একজন বসে আছে। গায়ে ওভারকোট, মুখটা হুড দিয়ে ঢাকা।
-“কে তুমি? আমাকে বেঁধে রেখেছ কেন?”
লোকটা কেমন যেন যান্ত্রিক কণ্ঠে বলতে লাগল, “এই স্টোর রুমের ভেতর তোমাকে জ্যান্ত কবর দেওয়ার জন্য একটা গোপন কম্পার্টমেন্ট বানিয়েছি আমি।সেখানে এখন তোমাকে ঢুকিয়ে তালা মেরে দেবো। তারপর চাবিটা ফেলে দেবো ড্রেনে। ভাসতে ভাসতে সেটা ম্যানহোলে গিয়ে পড়বে। সেখান থেকে আবার ভাসতে ভাসতে একসময় হারিয়ে যাবে বুড়িগঙ্গার বুকে”।
আতঙ্কিত বোধ করল ফাহাদ। চেঁচিয়ে বলল, “ত্রিনা কোথায়?”
“আহ, চিৎকার করোনা। মেয়েটা ঘুমুচ্ছে”।
“কেন এমন করছ? কী উদ্দেশ্য তোমার? কত টাকা চাও . . .” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল ফাহাদ। কিন্তু লোকটা এগিয়ে এসে তার মুখে একটা ডাক্টটেপ লাগিয়ে দিলো। “আর কোনও কথা নয়। চলো তোমাকে তোমার আসল ঠিকানায় নিয়ে যাই"
হাত পা ছুড়ে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল ফাহাদ। কোনো লাভ হলো না। শক্ত দুটো হাত তাকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল একটা বুক শেলফের কাছে। তারপর বুক শেলফের পেছনে কিছু একটা ধরে টান দিতেই দেয়ালের গায়ে একটা ফোঁকড় সৃষ্টি হলো। অবাক হয়ে গেল ফাহাদ, কেউ বলে না দিলে ধরাই যাবেনা এখানে একটা গোপন কুঠুরি আছে!
দুহাতে তুলে তাকে ভেতরে আছড়ে ফেলল লোকটা। প্রাণপণে চিৎকার করার চেষ্টা করল ফাহাদ। কিন্তু মুখ দিয়ে ঘোঁত ঘোঁত জাতীয় শব্দ ছাড়া কিছু বের হচ্ছে না। লোকটা কুঠুরি আটকে দিচ্ছে! যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল, “তোমার নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কে তোমাকে তোমার বাড়ির ভেতরেই চিরতরে আটকে রাখছে?”
ফাহাদ ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকল। লোকটা মুখের ওপর থেকে হুড সরিয়ে নিলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না ফাহাদ! মনে মনে বলল, ‘'এটা কীভাবে সম্ভব? নিশ্চয়ই আমি ভুল দেখছি। না না এ হতে পারেনা!’' আর বেশি কিছু ভাবতে পারল না সে। তার আগেই কুঠুরি আটকে গেল। নেমে এল নিকষ কালো অন্ধকার। সত্যিই কি তবে এখানে আটকে থেকেই ক্ষুধা-পিপাসায় ভুগে পচে গলে মরতে হবে তাকে?
ছয়
একটা অস্বস্তি নিয়ে ঘুম ভাঙল ত্রিনার। মনে হলো কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঝট করে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল বিছানার পাশে ফাহাদ বসে আছে। ঠোঁট টিপে মৃদু হাসল ত্রিনা। “কী ব্যাপার? তুমি এখানে বসে আছ?”
“তোমাকে দেখছিলাম”, ফাহাদ হাসল। “ঘুমন্ত অবস্থায় তোমাকে অপ্সরীর মতো লাগে।”
হাসিটা ধরে রেখেই ত্রিনা বলল, “তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো কেন?”
ঝুঁকে এসে ত্রিনার কপালে একটা চুমো খেলো ফাহাদ। তারপর মুখ তুলে বলল, “এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই”
ত্রিনা উঠে বসল। দু’হাতে ধরল ফাহাদের একটা হাত। “তোমার মত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমি সত্যিই ভাগ্যবতী।"
কয়েক সেকেন্ড নীরবে কেটে গেল। তারপর নীরবতা ভেঙে ফাহাদ বলল, “একটা প্রশ্নের জবাব দেবে ত্রিনা?”
“কি প্রশ্ন?”
“আমাকে কি তোমার কাপুরুষ বলে মনে হয়?”
ত্রিনা ফাহাদের গলার ক্ষতচিহ্নটা হাত দিয়ে স্পর্শ করল, “এমন ভয়ানক একটা অ্যাক্সিডেন্টের পরও যমের সাথে সাথে যুদ্ধ করে তুমি ফিরে এসেছো আমার কাছে। এরচেয়ে সাহসী কাজ আর কী হতে পারে? তুমি আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী পুরুষ।”
ত্রিনাকে বুকে জড়িয়ে ধরল ফাহাদ। তার বুকে মাথা রেখে আস্তে করে বলল ত্রিনা, “তবে এই সাহসটা আরও আগে করতে পারলে আমাদের জীবনটা আরও সুখের হতে পারতো।”
ভীষণভাবে চমকে উঠল ফাহাদ। ত্রিনাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
“কী ভেবেছিলে তুমি? আমি বুঝতে পারবো না?”, তিক্ত ভঙ্গিতে হাসল ত্রিনা।“পাঁচ বছর একটা লম্পটের সাথে ঘর করেছি, যার চোখে লোভ ছাড়া আর কিছুই দেখি নি”।
ফাহাদের হাত-পা কাঁপছে। হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়ল সে। মাথা নিচু করে রেখেছে।
ত্রিনা বিছানা ছেড়ে নামল। এগিয়ে আসছে। বলছে, “তোমাকে আমার অসম্ভব ভালো লাগতো। কিন্তু তোমার ভীরু আচরণ আমাকে কষ্ট দিতো। আমি চেয়েছিলাম তুমি সাহস করে নিজের মনের কথাটা বলো। কিন্তু তুমি তা কখনও করোনি। এদিকে ফাহাদ আমাদের দুজনের মাঝে এসে দাঁড়াল। গরীবের ঘরের মেয়ে ছিলাম। অভাব ভয় পেতাম। তাই প্রাচুর্য্যের লোভে ফাহাদের মতো লম্পটকে বিয়ে করলাম। বুঝতে পারিনি যে টাকায় সব কেনা গেলেও, সুখ কেনা যায় না!”
ত্রিনা এগিয়ে এসে ফাহাদের মুখটা উঁচু করে ধরল দুই হাতে, “চেহারা লুকিয়েছ, কিন্তু চোখ ভরা আমার জন্য ভালোবাসা—তা কী করে লুকাবে বলো?”
ফাহাদরূপী শামিম উঠে দাঁড়াল। দুহাতে ত্রিনার গাল স্পর্শ করল।
গভীর আবেগে ত্রিনার চোখে পানি চলে এলো। সেই চোখে আছে অনন্ত সুখের আহবান।
(সমাপ্ত)