(প্রথম পর্বের পর)
চার
হাফেজ জালাল উদ্দিন সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত। মেয়েটিকে নিয়ে সবাই বাড়ি ফিরেছে প্রায় আধঘণ্টা হচ্ছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেও ওর পেট থেকে কোনো কথা বের করতে পারেননি তিনি। এরই মাঝে রাহেলা বেগম একটা শাল দিয়ে মেয়েটাকে ঢেকে দিয়েছেন। এক কাপ গরম লেবু-জলও করে এনেছিলেন, কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধে হয়নি। রুনু অবশ্য আশেপাশে নেই, বাচ্চা তিনটেকে নিয়ে অন্য ঘরে শুয়ে আছে।
আসার পর থেকেই মেয়েটা সমানে কাঁদছে। অবস্থাটা জালাল উদ্দিন বুঝতে পারছেন, কিন্তু মেয়েটিরও তো তাদের ব্যাপারে একটু ভাবা উচিৎ। কোথাকার মেয়ে, কেমন করে এল এই গহীন জঙ্গলে, বাপ-মা কোথায় থাকে এই তথ্যগুলো জানা দরকার। পুলিশে খবর দেবার ব্যাপার আছে। না হলে কোন ফাঁক দিয়ে আবার তাদেরকেই ফাঁসিয়ে দেয়া হবে, পরে পরিবার-সুদ্ধো হয়তো শ্রীঘর দর্শনে বের হতে হবে।
ওই ছয় জনের দল থেকে কেউ যদি কোনো উপায়ে জালাল উদ্দিন সাহেবের ঠিকানা বের করে ফেলতে পারে, আর পুলিশের কাছে খবর দিয়ে আসে, অমুক ঠিকানায় একটি মেয়েকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে, তাহলে প্রাথমিকভাবে পুলিশ কোনো ধরনের ভেরিফিকেশনের তোয়াক্কা করবে না। এসেই সবাইকে অ্যারেস্ট করবে। ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাই করা হবে হাজতে ঢোকার পরে।
অবশ্য ব্যাপারটা তিনি যেভাবে ভাবছেন, অতটা সহজও নয়। পেশায় তিনিও একজন ফরেস্ট অফিসার। তার ক্ষমতাও নেহাত কম নয়। তবু, পুলিশকে খবর দিয়ে মেয়েটার একটা গতি তো করতে হবে। হাজার হোক পরের মেয়ে বলে কথা, তার উপর বিপদগ্রস্ত! কিন্তু, মেয়েটারও তো উচিৎ এই কান্নাকাটি থামিয়ে তার প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়া।
জালাল উদ্দিন সাহেব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ঝেড়ে কাশো তো মেয়ে! ঝেড়ে কাশো! প্রথম থেকে কীভাবে কী হয়েছিল খুলে বলো। আমরা তোমার বাবা-মার কাছে খবর পাঠাই।’
জবাবে মেয়েটা আরো জোরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে ‘খুক খুক’ শব্দ করে কাশিও দিল কয়েকবার! কত্ত বড় ফাজিল মেয়ে! সেকি বাংলা বুঝে না? জালাল উদ্দিন সাহেব এবার বাঁজখাই গলায় একটা ধমক দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তবে রাহেলা বেগম আর সে সুযোগ দিলেন না, একটানে তার হাত ধরে নিয়ে এলেন পাশের ঘরটায়।
কলিম উল্লাহকে আবার পাঠালেন, অল্পস্বল্প লাকড়ি যা পায় তাই যেন নিয়ে আসে। তখন ওই বিভীষিকার মাঝে আর লাকড়ির প্রতি মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু, রাতে তো ভাত-ডাল রাঁধার জন্য হলেও অল্প কিছু লাকড়ি চাই। তারপর, নিজের স্বামীকে কিছুক্ষণ বাইরের ঘরটায় অপেক্ষা করতে বলে একটানে দরজা লাগিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন।
‘আশেপাশে এখন কোনো পুরুষ-মানুষ নেই রে,’ রাহেলা বেগম বেশ বুঝতে পারছিলেন মেয়েটার ভয় কীজন্য কমছিল না, ‘তোর নামটা বলবি? বয়সে আমি কিন্তু তোর বুবুর সমানই হবো। তোকে তুই করে বলছি বলে রাগ করছিস না তো?’
অনেক্ষণ পর মেয়েটা এবার হালকা নড়ে বসল। মাথা নেড়ে জানাল যে সে রাগ করছে না। কিন্তু, তার দু’চোখের অশ্রু-বিসর্জন তখনও থামেনি।
‘তোর নামটা বলবি?’
মেয়েটা বেশ হালকা স্বরে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে জবাব দেয়, ‘চন্দ্রা।’
‘বাহ চন্দ্রা! কি সুন্দর নাম তোর! তোর মা রেখেছিলেন নামটা?’ রাহেলা বেগম চেষ্টা করছিলেন ক্ষণিকের জন্য হলেও মেয়েটার দুঃখবোধকে একটু হলেও কমিয়ে দিতে।
‘আমার দাদু!’ অশ্রুসিক্ত গলায় মেয়েটা আবার জবাব দেয়।
‘তাই বুঝি? তোর দাদি এত সুন্দর নামটা কোত্থেকে পেলেন বলতো?’
‘কইতে পারি না বুবু! মনের খেয়াল ছিল, তাই রাখছেন!’
‘আচ্ছা, শুন না। যে লোকটাকে দেখলি এতক্ষণ তোকে জেরা করছিলেন, উনাকে মোটেও ভয় পাসনে, কেমন? উনি কিন্তু দেবতূল্য মানুষ।’
‘পুরুষ-মানুষ দেবতার মতো অয় না আফা! ইবলিশ তাগো লগে লগে ঘুরে।’ এতটুকু বলেই চন্দ্রা আবার কাঁদতে শুরু করল।
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুই দু’এক দিন থাক তোর বুবুর বাসায়। তাহলেই বুঝতে পারবি?’
‘আমারে তাড়াই দিয়েন না আফা!’ মেয়েটির কান্না যেন থামছিলই না।
‘সেকি রে? বাড়ি যেতে চাস না?’
‘চাই বুবু। কিন্তু অহন বাড়ি গেলে বেবাক লোকে জানতে পারব। বাপজানে গলায় দড়ি দিব।’
‘আচ্ছা তাহলে এখন যাসনে। যতদিন ইচ্ছা থাক আমার বাসায়। কিন্তু, আগে বল তো, ওই গহীন বনে তুই কি করতে গিয়েছিলি? এতটুকু পথ নিশ্চয়ই এরা তোকে জোর করে নিয়ে যায়নি।’
‘আমারে অবিশ্বাস করিয়েন না বুবু। আগে কথা দেন, আমারে আপনেগো বাড়িতে কাম দিবেন?’
‘সেকি! কাজ করতে হবে না রে। এটা তোর বুবুর বাড়ি মনে করবি, এখানে তুই মেহমান।’
‘না বুবু, এইসব মিষ্টি কথার চিড়া আমি খাই না। আগে কথা দেন।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, তোর যা মন চায় করিস,’ রাহেলা বেগম রাজি হয়ে গেলেন,’ কিন্তু, এবার তো বল তোর গ্রামের বাড়ি কোথায়। কীভাবে এলি এখানে?’
‘বুবু আমার বাড়ি অইলো চর এলাকায়। তয় নারায়ণগঞ্জের এক বস্তিতে থাইকতাম।’
‘তাই নাকি? তা এখানে মরতে এলি কেন?’
‘বস্তির এক খালা গাজীপুরে বরফ কলে চাকরি দিব কইয়্যা আমারে লইয়া আসে। হেরপর দুইদিন আমারে তার আত্মীয়ের বাসায় রাহে। দুইদিন পার হইয়া গেলে আরেক বেডায় আমারে নিতে আসে। জঙ্গলে বরফ কল আছে কইয়্যা হেই বেডাই আমারে জঙ্গলে নিয়া আসে!’
‘ও আচ্ছা!’ রাহেলা বেগম অতি সাবধানতার সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন, পেটের দায়ে খাটতে এসে আজ হয়তো জীবনটাই খুইয়ে বসত মেয়েটা।
‘আচ্ছা, আমরা না হয় পুলিশ-কে......’ এটা বলার সাথে সাথেই চন্দ্রা রাহেলা বেগমের হাত চেপে ধরে, ‘না বুবু, জানাজানি হইলে বাপজান গলায় দড়ি দিব!’
‘কিন্তু, বস্তির সেই খালার তো একটা শিক্ষা হওয়া উচিৎ,’ রাহেলা বেগমের মন মানতে চায় না।
‘অহন না বুবু, সবসময় গরিবগো বিচার চাওন লাগে না। মাঝেমইধ্যে মুখ বুইজ্জা-ও সহ্য কইরতে হয়!’
রাহেলা বেগমের আর কিছুই বলার থাকে না। নিরুপায় হয়ে মেয়েটির কথাতেই এক প্রকার রাজি হয়ে যান তিনি।
পাঁচ
পরদিন সকালে খুব ভোরে রাহেলা বেগমের ঘুম ভাঙে। ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ফোটেনি। এর মাঝে সদর দরজা খুলে উঠোনে বের হবেন, এমন সময় লক্ষ করলেন সদর দরজার ছিটকিনি লাগানো নেই! আলগোছে দরজাটা বন্ধ করে রাখা, একটা বাতাসের ধাক্কাতেই খুলে যাবে।
দরজা পেরিয়ে উঠোনে পা রাখতেই তার চক্ষু চড়ক গাছ! পুরো উঠোন ঝেড়ে একেবারে সাফ-সুতর করে রাখা। কল-পাড়ে দেখলেন একটা বালতি থেকে সাবানের ফেনা গড়াচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখলেন তাতে এই বাড়িটার সবগুলো জানালার পর্দা সাবান-জল মেখে ভিজিয়ে রাখা হয়েছে।
কল-পাড় থেকে এবার রান্নাঘরের দিকে যেতেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হলেন। রান্নাঘরটার মেঝে ছিল মাটির তৈরি। এই মেঝের বাইরের অংশটাকে গ্রাম্য ভাষায় বলা হয় ‘ডেল।’ এই ডেলাতে সময়-সময় পর ভিজে মাটির প্রলেপ দিতে হয়, নাহয় একসময় মাটি শুকিয়ে তাতে ফাটল ধরে। কেউ একজন এই কাক ডাকা ভোরে এই কাজটাও করে রেখেছে! রান্নাঘরের পেছনের দিকে যেতেই মানুষটাকে আবিষ্কার করলেন রাহেলা বেগম, চন্দ্রা! মাটি লেপা আরো একটু বাকি ছিল, একমনে সেটাই শেষ করছিল।
‘কিরে চন্দ্রা? এই সাত সকালে এসব কী শুরু করলি তুই?’ রাহেলা বেগম কপট রাগ দেখালেন।
‘বুবু, সাত সকালে উইঠা কাম না করলে আমি বরকত পাই না।’
‘আরে বোকা মেয়ে! তুই আরাম করে শুয়ে-বসে খেলেও কি কেও তোকে বকবে? তুই না আমাকে বুবু ডেকেছিস?’
জবাবে চন্দ্রা মৃদু হাসল।
রাহেলা বেগম বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছিলেন, মেয়েটির আত্মসম্মান-বোধ খুব প্রবল। পরের বাড়ির আশ্রিতা হলেও নিজে গায়ে-গতরে খেটে সেটাকে পুষিয়ে দিতে চাচ্ছে। রাহেলা বেগমের মনে চন্দ্রার জন্যে বেশ মায়া হলো।
চন্দ্রার গায়ে রাহেলা বেগমের দেয়া একটা পুরোন শাড়ি জড়ানো ছিল । আজই সদর হতে দু’টো ভালোমানের শাড়ি কিনিয়ে আনবেন তিনি চন্দ্রার জন্যে।
সকাল থেকে একবারের জন্যেও রাহেলা বেগম বা রুনু, কাউকেই রান্নাঘরের দিকে যেতে হয়নি। অবশ্য যেতে হয়নি- না বলে বলা উচিৎ যেতে দেয়া হয়নি। রুনু বা রাহেলা বেগম অল্প সময়ের জন্য হলেও রান্নাঘরে ঢুঁ মারতে গেলেই চন্দ্রা আপত্তি জানিয়েছে। তার একটাই কথা, ‘আইজ যদি রান্না-বান্নায় আমি ফেইল যাই, তাইলে কাল থেইক্কা আমিই আর রসুই ঘরে আসুম না। কিন্তু আফামনি আইজ আফনাগো দুইজনেই ছুটি নিবেন। আইজ আমার পরীক্ষা!’
রাহেলা বেগম অবশ্য কেউ তার রান্নাঘরের তদারকি করুক এটা পছন্দ করেন না। জালাল উদ্দিন সাহেবেরও বেশ বাছ-বিচার করেই খাওয়ার অভ্যেস। রাহেলা বেগমের হাতের রান্না না হলে তিনি খেতে পারেন না। চন্দ্রাকে না করে দিলে সে মনে কষ্ট পাবে, এটা বুঝে তিনি চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলেন।
কিন্তু, খাওয়ার টেবিলে বসেই রাহেলা বেগমের এই বিরুপ মনোভাব পুরোপুরি কেটে গেল। চন্দ্রার রান্নার হাত যে এতটা ভালো হবে সেটা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেন নি। খাবার টেবিলে বসেও বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলেন, এই না জালাল উদ্দিন সাহেব ‘লবণ হয়নি’ বলে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েন। কিন্তু, এক লোকমা ভাত মুখে দিয়েই বুঝতে পারলেন, তার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল।
সাধারণত শাক-সব্জি থাকলেই জালাল উদ্দিন সাহেব ‘ঘাস-লতা-পাতা’ সম্বোধন করে সেগুলোকে টেবিলের এক পাশে সরিয়ে রাখেন। সেই জালাল উদ্দিন সাহেব-ই আলু ভাজির পদটাকে ‘অমৃত’ বলে সম্বোধন করলেন! আলু ভাজার সাথে সাথে টেংরা মাছের ঝোল করা হয়েছে, এই ঝোল নিয়ে এক সময় শ্যামলি আর শাওনের মাঝে এক প্রকার কাড়াকাড়ি শুরু হলো। অথচ, মাছ জাতীয় রান্না শাওন সব সময়ই এড়িয়ে চলে!
রাহেলা বেগম বেশ কষ্টে হাসি আড়াল করলেন। চন্দ্রা তার পরীক্ষায় বেশ ভালভাবেই পাশ করেছে। তিনি নির্ভয়ে এই মেয়ের হাতে রসুই ঘরের দায়িত্ব দিতে পারবেন।
তিন চারদিনের মাঝেই চন্দ্রা সংসারের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব নিজ ঘাড়ে তুলে নিল। আর প্রতিটা কাজ এতটা যত্নের সাথে সম্পন্ন করত চন্দ্রা, যে কারো কোনো অভিযোগ থাকত না। ঘর ধোয়া মোছা, রান্না-বান্না থেকে শুরু করে রান্নার লাকড়ির প্রয়োজন হলেও সেটাও সে নিজেই জোগাড় করে নিত!
এই অল্প কয়েকদিন আগেই এই বনের ভেতর কি ভয়ানক বিপদেই না সে পড়েছিল, অথচ এরই মাঝে ভয়-ডর সব হাওয়া! লাকড়ির প্রয়োজন হলে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই একটা কুড়াল নিয়ে বনে চলে যেত, আর অল্পক্ষণের মাঝে মাথা বোঝাই করে ফিরে আসত। একটু আরাম-আয়েশের সুযোগ পেয়ে রাহেলা বেগম-ও সেটা উপভোগ করা শুরু করলেন। ক’জনের ভাগ্যেই বা এমন কাজের লোক জোটে?
চন্দ্রা বাড়িতে আসার পঞ্চম দিন ঘটল ঘটনাটা। এরই মাঝে রাহেলা বেগম আর রুনুর সাথে তার বেশ খাতির জমে গেছে। বাড়ির কর্তা হাফেজ জালাল উদ্দিন সাহেবও যে তাকে বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন, এটাও সে বেশ বুঝতে পারে। কিন্তু, শ্যাওন বা শ্যামলি এদের সাথে তার তেমন কোনো ভাব জমেনি। আর শ্যামলির ছোট ভাই তখনো বেশ ছোট, আধো আধো বুলিতে কথা বলে কেবল।
সেদিন শ্যামলি আর শাওন মিলে ঠিক করল, ভেজা মাটি দিয়ে পুতুল বানাবে। যদিও এই মেয়েলি কাজে শাওনের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না, কিন্তু তার বোনের দিকে তাকিয়ে সেও রাজি হয়ে যায় তাকে সাহায্য করতে। পুতুল বানানোর উপকরণ হাতের কাছেই ছিল, রান্নাঘরের ‘ডেলায়’ আলগা মাটির প্রলেপ দেয়ার জন্যে কিছু মাটি আগেই আলাদা করে রেখেছিল চন্দ্রা। সেখান থেকে অল্প কিছু মাটি নিয়ে দুই ভাই-বোন কাজ শুরু করে দিল।
গাজীপুরের বেশিরভাগ অঞ্চলের মাটিই এঁটেল মাটি। প্রচণ্ড আঠালো। পুতুল বা মাটির উপকরণ তৈরিতে বেশ উপযোগী। তবে কাজ শুরু করার আগে মাটিকে অবশ্যই বেশ কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়।
দশ-পনেরো মিনিট মাটিকে ভিজিয়ে রাখার পর তাতে হাত দিতে যাবে ঠিক এমন সময় চন্দ্রাও তাদের সাথে এসে জুটলো।
‘বাবুমনিরা, কি বানাইবা? পাখি?’ শাওন আর শ্যামলিকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে চন্দ্রা।
‘পাখি, লক্ষ্মী পরী, আর ফুল,’ হেসে হেসে জবাব দেয় শ্যামলি।
‘আইচ্ছা, আসো! আমি তোমাগোরে লক্ষ্মী পরী বানাইয়া দিই,’ শ্যামলির চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল চন্দ্রা।
ছোট মাটির একটা ঢেলাকে হাতে নিয়ে এদিক-সেদিক নাড়িয়ে বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই সেটাকে একটা লক্ষ্মী পরীর রুপ দেয় চন্দ্রা। আনন্দে হাত তালি দিয়ে ওঠে শ্যামলি। এরপর একে একে বানিয়ে ফেলে ফুল, পাখি আর একটা নেকড়ের মূর্তি! অবাক হয়ে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল শাওন আর শ্যামলি।
‘এগুলোরে শুকান লাগবো, বুঝলা বাবুমনিরা?’
‘আচ্ছা দিদি,’ জবাব দেয় শ্যামলি,’ এখানেই রেখে দিব?’
‘না না, ওই দিকটায় দিয়া আসি, চলো,’ বলে উঠোনের এক কোণে যেখানটায় রোদ বেশি পড়ে সেদিকটায় ইঙ্গিত করলো চন্দ্রা।
পুতুলগুলোকে আলগোছে তুলে নিল তারা, যেহেতু তখনো শুকায়নি, একটু চাপ পড়লেই ভেঙ্গে যেতে পারে। শ্যামলির হাতে ছিল ফুল আর নেকড়ে মূর্তি, আর শাওনের হাতে ছিল লক্ষ্মী পরী। কিন্তু, অসতর্কতায় মাঝপথেই শাওনের হাত থেকে লক্ষ্মী পরীটা ছিটকে পড়ল। আর সাথে সাথেই কিম্ভূতকিমাকার একটা মাটির ঢেলায় পরিণত হয় সেটা।
ঠিক তখনই ঘটলো ঘটনাটা। শাওনের চোখাচোখি তাকিয়ে বেশ শান্তভঙ্গিতে ‘হি হি’ করে একটা হাসি দিল চন্দ্রা। সেই হাসির শব্দে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। কোন তীক্ষ্ণতা ছিল না। কোন রাগ বা উপহাস-ও ছিল না। বেশ মোলায়েম একটা শব্দ কেবল!
কিন্তু, হাসিটা শোনার সাথে সাথেই তীব্র একটা চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাল শাওন। এতই জোরে চিৎকার দিয়েছিল শাওন যে বাড়ির ভেতর থেকে রাহেলা বেগম আর রুনুও বের হয়ে আসল। জালাল উদ্দিন সাহেব সেসময়টায় অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
বেশ কিছুক্ষণ নাকে মুখে পানি ছিটাতেই শাওনের জ্ঞান ফিরল, কিন্তু জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই সে ‘দাঁত সাদা, দাঁত সাদা’ বলে আবার দ্বিতীয়বারের মতো অচেতন হয়ে পড়ল!
কিছু একটা দেখে শাওন প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে এটা রাহেলা বেগম বুঝতে পারছেন, কিন্তু এই দাঁত সাদা—কথাটার মানে কি? দাঁতের রঙ তো সাদাই হবে, সাদা দাঁত দেখে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই!
শ্যামলিকে জিজ্ঞেস করেও কোনো কারণ জানা গেল না, শ্যামলি পুরোপুরি চুপ! একটা টুঁ শব্দও করছিল না। আর চন্দ্রা কোন ফাঁকে রান্নাঘরের দিকে চলে গিয়েছে কেউ খেয়াল করেনি।
দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারানোর পর রাহেলা বেগম বেশ বুঝতে পারছিলেন, শাওনকে একটা ডাক্তার দেখানো দরকার। কোনো কারণে তার নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়েছে। অবহেলা করলে যেকোনো ধরনের বিপদ ঘটতে পারে।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। শাওনকে কোলে নিয়েই ছুটলেন জালাল উদ্দিন সাহেবের অফিসের দিকে। এই বিজন জায়গায় রিকশা বা ভ্যানের কথা কল্পনা করাও বোকামি। তবে আশার কথা, জালাল উদ্দিন সাহেবের অফিস ঘর বেশি দূরে নয়। মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথ। সেখানে পৌঁছে গেলে দ্রুত সদরে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করা যাবে। শ্যামলি আর তার ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে রুনুও তার সাথে চললো। বাড়িতে একা ছিল কেবল চন্দ্রা!
স্মেলিং সল্টের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে লাগতেই শাওনের জ্ঞান ফিরে এল। ইতোমধ্যে সদরে বসু ডাক্তারের চেম্বারে আসতে আসতে বেশ অনেকটা সময় পার হয়েছে। তবু শাওনের জ্ঞান ফেরেনি। শেষে ডাক্তার বাবুর চেম্বারে বিছানায় শুইয়ে দিতেই ডাক্তার বাবু নাকের কাছে অল্প করে স্মেলিং সল্ট নাড়াচাড়া করলেন। প্রায় সাথে সাথেই ফল পাওয়া গেল।
জ্ঞান ফিরে আসার পর ডাক্তার বাবু বেশ অনেকটা সময় দিলেন শাওনকে। ইশারায় বাকি সবাইকে কথাবার্তা বলতে না করে দিলেন। যদিও বসু ডাক্তারের কম্পাউন্ডার রোগীর সাথে এক জনের বেশি লোক প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছিল না, কিন্তু রুনু আর রাহেলা বেগমের কাকুতি-মিনতিতে শেষে সবাইকে চেম্বারে প্রবেশের অনুমতি দিলেন ডাক্তার সাহেব।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নাড়ি পরীক্ষা করলেন বসু ডাক্তার। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘টেকিকার্ডিয়া। অস্বাভাবিক নয়।’
তারপর একটা ছোট পেন টর্চ দিয়ে চোখের উপর আলো ফেললেন, টেম্পারেচার নিলেন, স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে হৃদস্পন্দন শুনতে শুনতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ভয় পেয়েছিলে, বাছা?’
শাওন দুর্বল গলায় বললো, ‘হ্যাঁ!’
‘কী দেখে ভয় পেয়েছিলে?’
‘দাঁত সাদা . . . চন্দ্রার দাঁত সাদা!’ বেশ দুর্বল কণ্ঠে জবাব দেয় শাওন।
‘বাছা, দাঁত তো আমারও সাদা। এই দেখো,’ বলে ডাক্তার বাবু নিচের পাটির দাঁত দেখালেন শাওনকে।
‘উঁহু, চন্দ্রার দাঁত সাদা!’ একগুঁয়ে স্বরে আবারো বলল শাওন।
‘শাওন বাবা, তুই কি মাথায় ব্যথা পেয়েছিলি’ রাহেলা বেগম এতক্ষণে মুখ খুললেন।
‘আহা, আপনারা চুপ থাকুন তো।’ ডাক্তার বাবু মৃদু ধমক দিয়ে উঠলেন।
‘ডাক্তার বাবু, আমার ছেলেটার কী হলো? এসব কি আবোল-তাবোল বলছে ও?’ রাহেলা বেগম আবারো অধৈর্য্য স্বরে বলে উঠলেন।
শাওনের কথা এখন কেউই বিশ্বাস করছে না। আসলে বিশ্বাস নয়, শাওনের কথার মানেই ধরতে পারছিল না কেউ। কিন্তু, শ্যামলি জানে শাওনের কথার মানে কি। শাওন যা দেখেছিল, পাশে দাঁড়িয়ে শ্যামলিও ঠিক একই জিনিস-ই দেখেছিল।
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মুখের ভেতর বত্রিশটি দাঁত থাকে। এর প্রতিটি দাঁতের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, এই বৈশিষ্ট্য-ভেদে এদের আলাদা আলাদা নামও আছে। কয়েকটির নাম শ্যামলি নিজেও জানে! তার বড় খালুই তাকে শিখিয়েছিলেন। মোলার টিথ, ইনসিসর টিথ, এমন আরো কয়েকটা কঠিন কঠিন নাম আছে। সাধারণত কোনো দাঁতই কিন্তু অপর দাঁতের সাথে জোড়া লাগানো থাকে না। সব গুলো দাঁতই আলাদা আলাদা সারিবদ্ধভাবে সাজানো থাকে।
কিন্তু, চন্দ্রার মাড়ির সবগুলো দাঁতই ছিল জোড়া লাগানো! সেখানে আলাদাভাবে কোনো দাঁত ছিল না! পুরো মাড়ি জুড়েই একটা আস্তরণ ছিল, কিন্তু সেই আস্তরণটা কোনোমতেই মানুষের দাঁতের মতো নয়। আর সেই আস্তরণটার রঙ ছিল মুক্তোর চেয়েও সাদা!
শ্যামলি তার এই ছোট্ট জীবনে এতটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি। কিন্তু, কোনো এক অদ্ভুত কারণে সে জ্ঞান হারায়নি সেদিন!
(পড়ুন তৃতীয় তথা শেষ পর্ব)