শপথ গ্রহণ করা হয় ভাঙার জন্যই।
কথাটা খুব ফিল্মি শোনালেও আপাতত নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য এটাকেই প্রবোধ হিসেবে ধরে নিতে হচ্ছে এসআই সালামকে। একেবারে অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা ছেলে সে, মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন। বছর তিনেক আগে লাখ দশেক টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে। গরিব বাবার দু-টুকরো ধানী জমি ছিল। ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় মায়া ছাড়তে দেরি করেননি ভদ্রলোক। আশা ছিল, সরকারি চাকরি হলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।
কিন্তু চাকরিজীবনের তিন বছর অতিবাহিত হলেও, পারিপার্শ্বিকতার সাথে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেনি সালাম। উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায় পোস্টিং পেয়েছে। আশেপাশে দেদার সুযোগ। কিন্তু কনস্টেবল থেকে থানার ওসি পর্যন্ত যেখানে যার কাছ থেকে যেমন পারে টাকাপয়সা বাগিয়ে নেয়, সেখানে সে আজ পর্যন্ত ঘুষ স্পর্শ করেনি। পুলিশের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর পাঠ করা শপথবাক্য মাথায় গেঁথে রেখেছে বেদবাক্যের মতো। কিন্তু এবার আর রক্ষা হবে না মনে হয়।
কিছুদিন আগে ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে সালামের বাবার। খুব খারাপ অবস্থা এখন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বোন-ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করা না হলে বাঁচানো অসম্ভব। আশার কথা হলো, আগের মতো এখন আর এই রোগে বিদেশ যাওয়া লাগে না। দেশেই আছে ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা। তবে খরচ পড়বে প্রায় লাখ সাতেক টাকার মতো।
অল্প কিছু জমা টাকা হাতে আছে সালামের। কিন্তু এখনও যোগাড় করতে হবে অর্ধেকের বেশি। তাই কোর্টে চালান করার জন্য রাখা আসামীর কাছ থেকে যখন লোভনীয় প্রস্তাবটা এল, সে আর মানা করতে পারেনি।
রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। ঘড়ির কাঁটা নয়ের ঘর ছাড়িয়েছে। গন্তব্যে পৌঁছে গেছে হাবিব। পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল, জিনিসগুলো জায়গামতো আছে কি না।
আছে . . .।
বাড়িটার গেটের সাথে লাগোয়া কাঁচের একটা ঘর। দারোয়ান বসার জায়গা। ভারী লোহার গেটটার একপাশ খোলা। অফিস আওয়ার শুরু হয়ে গেছে। কর্মজীবীরা বেরিয়ে যাবে যে যার মতো। বারবার যাতে উঠে খোলা-বন্ধ করা না লাগে, সেই ব্যবস্থা করে রেখেছে দারোয়ান।
একপাশের দেয়ালে ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের নাম আর কলিংবেলের সুইচ। পাঁচ নম্বর সারিতে বড় বড় হরফে লেখা কাঙ্ক্ষিত নামটা—ড. আরিফ। ওপরের সারিতে আরেকটা নাম। মহসিন খন্দকার। হাবিবের প্রাথমিক টার্গেট এই ব্যাটাই। দারোয়ানের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির মুখে হাতের বাক্সটা বাড়িয়ে ধরল সে। মহসিন সাহেবের জন্য কুরিয়ার আছে।
ইন্টারকমে ছয় তলায় ফোন করল সোলায়মান। বেশ অনেকদিন যাবত এই বাড়ির কেয়ারটেকারের দায়িত্বে আছে সে। ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়াদের যেকোনো সমস্যায় দরকার পড়ে তার। চাকরিতে ঢোকার পরপরই মিথ্যা অভিযোগ দেখিয়ে দারোয়ানের চাকরি খেয়েছে। মালিককে বলেছে, গেট খোলার মতো সামান্য কাজে আরেকজন লোক রাখার মানে হয় না। ও নিজেই পারবে।
প্রস্তাবটা লুফে নিতে দেরি করেননি দূরে থাকা বাড়িওয়ালা। দু’জনকে পুরোপুরি চাকরিতে রাখার চেয়ে অল্প কিছু টাকা বাড়িয়ে একজনকে রাখা ভালো। তাছাড়া সোলায়মান তার এলাকার লোক। যথেষ্ট বিশ্বাসী।
মহসিন সাহেবের সরকারি চাকরি। নয়টা বাজার আগেই বেরিয়ে যান ভদ্রলোক। আজ অবশ্য সোলায়মান খেয়াল করেনি তার গাড়িটা। কাচের ঘরের ভেতর বসে আয়েশ করে টিভি দেখছিল। ফোনে মহসিন সাহেবের স্ত্রী জানালেন, প্যাকেটটা এখনই ওপরে পৌঁছে দিতে।
কুরিয়ার দিয়ে যাওয়া লোকটা চলে গেছে। খিস্তি বকে বাক্স হাতে কাঁচের ঘর থেকে বেরিয়ে এল সোলায়মান। বেশ জমেছে সিনেমাটা। বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পিস্তল হাতে খন্দকার সাহেবকে দাবড়ানি দিয়েছে ওমর সানি। এমন সময় টিভি ছেড়ে ওঠা যায়?
ভুল ভেবেছে সোলায়মান। হাবিব যায়নি। গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। ফোনে দারোয়ানকে কয়েকবার ‘জ্বি . . . জ্বি’ বলে প্যাকেট হাতে সিঁড়ির দিকে এগোতে দেখে বুঝে নিল, কাজ হয়েছে পরিকল্পনায়। দেরি না করে চলে এল গেট পেরিয়ে।
নিচতলার পুরোটাই গ্যারেজ। একপাশে দারোয়ানের থাকার জন্য ছোট্ট একটা ঘর। সে যা ইচ্ছা হোক। তার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা উল্টোদিকে পার্ক করা। লাল রঙের একটা টয়োটা। গাড়িটা তার বন্ধু ড. আরিফের।
ব্যস্ত হাতে পকেট থেকে মাস্টার-কী বের করে আনল হাবিব। তিন সেকেন্ড লাগল পেছনের ডানদিকের দরজাটা খুলতে। কপাল ভালো, গাড়িতে বাড়তি কোন সিকিউরিটি সিস্টেম ব্যবহার করেনি ডাক্তার। নইলে তালার ফুটোতে কিছু ঢোকানোর সাথে সাথে ট্যাঁ-ফোঁ চিৎকার শুরু হয়ে যেত এতক্ষণে।
টয়োটার পেছনের সিটের সামনে, পা রাখার ফাঁকা জায়গায় বসে পড়ল হাবিব। ছোটখাট মানুষ সে। এঁটে গেল সহজে। তার আগে অবশ্য দরজাটা আবার ভেতর থেকে লক করে দিতে ভোলেনি। কালো কাচ লাগানো থাকায় বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না, এখানে লুকিয়ে আছে কেউ। মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম অংশ সফল হয়েছে।
ড. আরিফ সাড়ে নয়টায় বেরোবে। আপাতত অপেক্ষা ছাড়া কিছু করার নেই। তাই মনে মনে পরিকল্পনাটা আবার ঝালিয়ে নেয়ার প্রয়াস পেল হাবিব। তবে বারবার মগজে ঘাই মারতে থাকা অতীতকেও প্রশ্রয় দিল ফাঁকে ফাঁকে।
একেবারে শূন্য থেকে উত্থান ঘটে হাবিবের। ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারানোর পর ঠাঁই হয় মামার মধ্যবিত্ত সংসারে। ছোট থেকে ডানপিটে হওয়ায় লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল না তেমন একটা। টেনেটুনে ম্যাট্রিক পাসের পর আর পড়েনি। ঢাকায় এসে ঢুকে পড়ে একটা গার্মেন্টসে। পনেরো বছর আগের কাহিনী ওটা। চোদ্দশো টাকা বেতনে তখন মেসে একা একজনের কোনোমতো চলে যেত।
বড় কিছুর আশা কখনও ছিল না হাবিবের। ভবিষ্যতের চিন্তা করেনি। সামনে সুযোগ এলে দেরি করত না লুফে নিতে। তাই ওপরওয়ালার সুদৃষ্টিও পড়েছে দ্রুত। গার্মেন্টস সেক্টরে অধৈর্য হলে চলে না। লেগে থাকতে হয়। ধাপে ধাপে উন্নতি করতে করতে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে সে। মেস ছেড়ে উঠেছে ভালো বাসায়। নিজে চলে, মামাকে মাসকাবারি কিছু খরচা পাঠিয়ে, টাকাপয়সাও জমিয়েছে বেশ কিছু। সেই সাথে জুটেছে বন্ধুবান্ধব।
তাদের সাথে আড্ডা দিতে দিতেই বছর দুয়েক আগে দেখা মেলে সুমাইয়ার। দেখতে শ্যামলা হলেও মেয়েটার চোখ দুটোতে কী যেন আছে! দেখলে মায়া ধরে যাবে যে কারও। হাবিবের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি।
অল্পদিনের চেষ্টায় একতরফা প্রেম পরিণত হয় ভালোবাসায়। সুমাইয়ার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর পর ছেলের মা-বাবা নেই বলে পরিবারের লোকজন একটু গাঁইগুই করেছিল। তবে কিছুদিন পর মেনে নেয় ভালো চাকরি দেখে। বিয়ে হয়ে যায় ওদের।
বছরখানেক ভালোই চলে সংসার। গর্ভবতী হয়ে পড়ে সুমাইয়া। কিন্তু পাঁচ মাসের মাথায় মিসক্যারেজ হলে দৃশ্যপটে আগমন ঘটে ডাক্তার আরিফের। আরিফ আর হাবিব স্কুলে একসাথে পড়ত। হাবিব ঢাকায় চলে আসার পর আর যোগাযোগ ছিল না দু’জনের। সুমাইয়াকে যে হাসপাতালে নেয়া হয়, সেখানেই পুনর্মিলন ঘটে দুই সহপাঠীর।
বলা হয়ে থাকে পৃথিবীতে দুই ধরণের সম্পর্ক একটু আলাদা হয়: ডাক্তার-রোগী আর উকিল-মক্কেল। এই সম্পর্কে কিছু লুকানো হয় না বলে দুই পক্ষের সখ্যতা গড়ে ওঠে খুব দ্রুত। আর রোগী এখানে পুরনো বন্ধুর স্ত্রী বলে, ক্রমে সুমাইয়ার আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার সুযোগ পায় আরিফ।
ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল হাবিবের মুখ দিয়ে। দশ মিনিট পেরিয়েছে। আরও বিশ মিনিট বাকি। উবু হয়ে গাড়ির মেঝেতে বসে থেকে পিঠে খিল ধরে গেছে। গার্মেন্টসে কাজ শুরু করার সময় থেকে টানা বসে থাকতে হত বলে পিঠ ব্যথার প্রকোপ আগে থেকেই ছিল। সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে উপদ্রব।
আরাম পেতে সাবধানে একবার সোজা হয়ে বসল হাবিব। সামনে উঁকি মেরে দেখল, ওপর থেকে ফিরে এসেছে দারোয়ান। আবার মগ্ন হয়ে পড়েছে টিভিতে। গ্রামের মানুষজনের এই নেশাটা একটু বেশিই থাকে।
ব্যথার স্রোতটা নেমে যেতে আবার উবু হয়ে গেল হাবিব। পকেটের উপর হাত বুলিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল পিস্তলটার উপস্থিতি সম্পর্কে।
অপেক্ষা . . .।
ডাক্তারির সুবাদে ঢাকায় একাই থাকে আরিফ। বয়স পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে গেলেও বিয়ে-থা করেনি এখনও। উপভোগ করছে জীবনটা। সামনে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার একটা সুযোগ আছে। তার আগে বিয়ে করে গলায় ঝামেলা ঝোলানোর ইচ্ছা নেই।
এত বছর পর হাসপাতালে হাবিবের সাথে দেখা হওয়ায় বিস্মিত হয়েছিল একটু, তবে বিস্ময়ের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে পড়ে তার বউকে দেখে। হাবিবের গায়ের রং ময়লা। চেহারায় রুক্ষতা আছে। স্কুলে থাকতে আড়ালে আবডালে মোষ বলে ডাকত সহপাঠীরা। কী দেখে এই মেয়ে ওর প্রেমে পড়ল, আবার বিয়েও করল . . . বোধগম্য হয়নি তার। তবে কথায় বলে, প্রেম মানে না কোন বাধা। এক্ষেত্রেও সম্ভবত তাই হয়েছে। কিংবা হতে পারে, টাকাপয়সা দেখেই হাবিবের প্রতি গলেছে সুমাইয়া।
ব্যাচেলর জীবন উপভোগের অন্যতম একটা পন্থা হচ্ছে নারীসংসর্গ। দেখতে শুনতে বেশ সুপুরুষ আরিফ। ফর্সা চামড়া, ছয় ফুট উচ্চতা, গায়ে মেদের বালাই নেই। ডাক্তারির সুবাদে আয়-রোজগারও মন্দ নয়। এসব পুঁজি করে আজ পর্যন্ত কম মেয়েকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেনি সে। সুমাইয়ার চোখ দুটো দেখার সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল—যেভাবেই হোক, একে হাত করতেই হবে।
বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর দেখভালের বাহানায় মেয়েটার সাথে বেশি বেশি সময় কাটাতে শুরু করে আরিফ। ডাক্তার হওয়ায় বন্ধু হাবিব তেমন কিছু সন্দেহ করেনি। তাছাড়া প্রাইভেট সেক্টরে চাকরির কারণে সে খুব একটা বাসাতেও থাকার সময় পেত না। সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল আরিফ। মিষ্টি মিষ্টি কথা, গিফট, বাইরে ঘোরাঘুরি ইত্যাদির মাধ্যমে কয়েক মাসের মধ্যে পটিয়ে নিল সুমাইয়াকে।
বন্ধুর ভাগ্য দেখে ঈর্ষান্বিত বোধ করে আরিফ। এই চেহারা-সুরত নিয়ে এমন একটা মেয়ের সাথে থাকছে ব্যাটা! তাছাড়া স্বভাবের পাশাপাশি বিছানাতেও বেশ তেজি সুমাইয়া। অনেক মেয়ের সাথে শুয়েছে আরিফ। কিন্তু এমন তৃপ্তি তাকে সচরাচর কেউ দিতে পারেনি।
ভালোই চলছিল তাদের এই গোপন অভিসার, কিন্তু একদিন . . .।
ঘটনাটা গতকালের।
বিদেশী বায়ারের সাথে মিটিং থাকায় বাসায় ফিরতে দেরী হবে বলে সুমাইয়াকে ফোনে জানিয়েছিল হাবিব। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ফ্লাইট ক্যান্সেল হওয়ার বায়ারের আসা পিছিয়ে যায়। তাই নির্ধারিত সময়ের আগেই বাসায় ফেরে সে। স্বামী প্রায় রাতে দেরি করে ফেরে বলে দরজা লক করে ঘুমাত সুমাইয়া। বাড়তি চাবি ছিল হাবিবের কাছে। দরজা খুলেই দেখতে পায় ড্রয়িংরুমে বহিরাগত কারও জুতো। বেডরুমে ঢুকে আকাশ ভেঙে পড়ে তার মাথায়। সুমাইয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে বন্ধু আরিফ।
নরক নেমে আসে যেন বাসার ভেতর। বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে লকার থেকে লাইসেন্স করা পিস্তল বের করে গুলি চালায় হাবিব। উত্তেজনা আর রাগে কাঁপতে থাকায় লক্ষ্য ঠিক থাকেনি। আরিফের কপালে আলতো চুমু খেয়ে বেরিয়ে যায় বুলেট। গুলির আওয়াজ শুনে প্রতিবেশী ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ফোন করে পুলিশকে। খুনের চেষ্টার দায়ে হাবিবকে ধরে নিয়ে যায় ওরা।
গাড়িতে বসে মুচকি হাসল হাবিব। তার মতো ঘাগু লোককে পুলিশ আটকে রাখতে পারবে ভেবে খুব বড় ভুল করেছে আরিফ আর সুমাইয়া। আজ সকালে কোর্টে চালানের জন্য তৈরি করা হচ্ছিল ওকে। দায়িত্বে ছিল সালাম নামের এক সাব-ইন্সপেক্টর। ফোনে কারও সাথে কথা বলছিল লোকটা।
কথোপকথন থেকে হাবিবের বুঝতে বেগ পেতে হয়নি, প্রচণ্ড চাপে আছে এসআই। জরুরি ভিত্তিতে মোটা টাকা দরকার তার। সুযোগটা কাজে লাগায় ও। মুক্তির বদলে পাঁচ লাখ টাকা দেয়ার প্রস্তাব করে।
চিন্তার জন্য খানিকটা সময় নিলেও চুক্তি মেনে নেয় এসআই সালাম। ঠিক করা হয়, ভিড়ের মধ্যে কোথাও হাবিবকে নামিয়ে দেয়া হবে। চার্জশিটে লিখবে, কনস্টেবলের হাত ফসকে হাতকড়াসহ গাড়ি থেকে পালিয়েছে অপরাধী।
গ্রামের বাড়িতে মামার কাছে বেশ কিছু টাকা জমা ছিল হাবিবের। ফোন করে বলে দেয় পাঁচ লাখ টাকা এসআই-এর অ্যাকাউন্টে জমা করে দিতে। গাড়িতে থাকা কনস্টেবলকে অবশ্য কিছুটা ভাগ দিতে হবে লোকটার। তা যা খুশি করুক, হাবিব মুক্তি পেলেই খুশি। তারপর সে দেখাবে আসল খেলা . . .।
চেহারা খারাপ হওয়ার দোষ তো তার নয়। ওপরওয়ালা এভাবেই বানিয়েছেন হাবিবকে। এক সময়ের বন্ধু আরিফ সুন্দর চেহারা দেখিয়েই কেড়ে নিয়েছে তার ভালোবাসা। গতকালের গুলিটা সেই সুন্দর মুখটাতে একটা দাগ ফেলেছে কেবল, তবে আজ বড় ধামাকা হবে। সুমাইয়া জাহান্নামে যাক। এমন মাগী জীবনে কত আসবে যাবে . . !
এসআই সালামের কাছ থেকে একটা মাস্টার-কী চেয়ে এনেছে হাবিব। সাথে একটা পুরনো পিস্তলের আবদারও করে। জানে—পুলিশের কাছে সবসময় কিছু অবৈধ অস্ত্র, গুলি আর মাদক থাকে। কোনো আসামীকে ক্রসফায়ার করার সময় লাশের সাথে ফেলে আসতে হয়। নিরুপায় লোকটা আপত্তি করেনি। নিজের বাবাকে বাঁচানোর জন্য হাবিবের হাতে তুলে দিয়েছে আরেকজনের প্রাণ নেয়ার হাতিয়ার।
জেলে বসেই গতকাল রাতে মাস্টারপ্ল্যান সাজিয়ে নেয় হাবিব। ছাড়া পেয়ে আরিফের বাসায় এসে লুকিয়ে থাকবে গাড়িতে। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হলে, অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নিয়ে যাবে পূর্বাচলের দিকে। ফাঁকা একটা জায়গা দেখে এক গুলিতে ভবলীলা সাঙ্গ।
তারপর চলে যাবে চট্টগ্রামে। কাস্টমসে এক বন্ধু আছে আছে হাবিবের। কিছু টাকা খাওয়ালে অনায়াসে জাল পাসপোর্ট বানিয়ে বিলোনিয়া স্থলবন্দর পার করে পাঠিয়ে দেবে ভারতে। সঞ্চয়ের পাশাপাশি গ্রামে কিছু জায়গাজমি কিনেছিল। মামাকে দিয়ে সেগুলো বেচিয়ে বেশ কয়েক বছর আরামেই চলে যাবে। এর মধ্যে পাকাপোক্ত কোন একটা ব্যবস্থা করে নিতে হবে। তার মতো বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে এসব কোনো ব্যাপারই না।
আরিফকে গাড়ির দিকে এগোতে দেখে বাস্তবে ফিরে এল হাবিব।
খেলা শুরু . . .।
চাবি দিয়ে দরজা খুলল ডাক্তার। হাতের ব্যাগটা পাশের সিটে রেখে উঠে বসল ড্রাইভিং সিটে। ইঞ্জিন স্টার্ট করার পর গিয়ার ফেলে পা দাবাল এক্সেলারেটরে। গলি ছাড়িয়ে মেইন রোডে আসার পর টের পেল, পেছনে কেউ একজন আছে। কারণ গোলাকার, ধাতব, শীতল একটা নলের মতো জিনিস গুঁতো মেরেছে ঘাড়ে।
‘একদম নড়বি না, শুয়োরের বাচ্চা,’ শান্ত গলা হাবিবের।
‘ত-ত-তুই?’ ঢোক গিলল আরিফ। ‘তোকে না আজ কোর্টে তোলার কথা? আমাকেও তো দুপুরের দিকে সাক্ষী দিতে যেতে বলা হয়েছিল।’
‘হা হা হা . . .’ দেঁতো হাসি হাসল হাবিব। ‘তোর আর তকলিফ ওঠাতে হলো না। ভাবিস না, একটু পর বাকি সব জ্বালা-যন্ত্রণা থেকেও উপশম পাবি। চুপচাপ গাড়ি চালাতে থাক। বিন্দুমাত্র স্মার্টনেস দেখাতে গেলেই গুলি খাবি ঘাড়ে।’
‘ক-ক-কোথায় যাব?’
‘পূর্বাচলের দিকে। স্টেশন রোড হয়ে বাইপাসে উঠবি।’
চুপচাপ হুকুম তামিল করল আরিফ। মোড় ঘুরে এসে গাড়ির নাক তাক করল বাইপাস রোডের দিকে। রাস্তায় ট্রাফিক আছে মোটামুটি, তবে ভারী যানজট নেই। একপাশে এক ট্রাফিক পুলিশ দেখতে পেয়ে গলা দিয়ে চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল প্রায়, কিন্তু গাড়ির কাচ ওঠানো থাকায় কাজের কাজ কিছু হতো না। পেছনে বসা হাবিবও দেখেছে পুলিশ। ঘাড়ে পিস্তলের নলের চাপ বাড়িয়েছে তাই।
‘আ-আ-আমাকে মাফ করে দেয়া যায় না দোস্ত?’ আর থাকতে না পেরে বলে উঠল ডাক্তার। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চায়। চিরন্তন স্বভাব।
কিছু বলল না হাবিব। গুনগুন করে জনপ্রিয় একটা হিন্দি গানের সুর তুলল। সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক এগোচ্ছে। একটু পর আবার মুখ খুলল আরিফ। এবার গলা অপেক্ষাকৃত নরম। ‘তোর সাথে কথা আছে আমার . . .।’
‘চুপ,’ খেঁকিয়ে উঠল হাবিব। ‘বিশ্বাসঘাতকের সাথে আমার কোনো কথা নেই।’
‘আসলে সুমাইয়া . . .।’
‘সুমাইয়ার গুলি মারি, বাঞ্চোত।’
‘জানি আমি ভুল করেছি,’ আরিফ তবু নাছোড়বান্দা। ‘কিন্তু ও তোর ভালোবাসার যোগ্য ছিল না কখনোই।’
‘ছিল, কি ছিল না, তা নিয়ে তোর মাথা না ঘামালেও চলবে। নিজের কথা ভাব।’
‘কী চাস তুই? যত টাকা চাস আমি দেব। ছেড়ে দে আমাকে দোস্ত।’
‘হা হা হা . . .’ হাসল হাবিব। ‘সে আমার অনেক আছে। আপাতত তোকে শাস্তি দিতে চাই। আর কিছু না।’
‘বোকামি করিস না, হাবিব। আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা নিয়ে চলে যা যেখানে খুশি। এমনিতেই তোর উপর খুনের চেষ্টার অভিযোগ আছে। উল্টোপাল্টা কিছু করলে কিন্তু ফাঁসির দড়ি জুটবে কপালে।’
হাবিব জবাব দিল না। রাস্তার এদিকটা ফাঁকা। পাশে একটা জংলামতো জায়গা দেখে ব্রেক কষতে বলল আরিফকে। মেঠো পথ চলে গেছে প্রধান সড়ক থেকে ভেতরের দিকে। হাত নেড়ে ওদিকে এগোতে বলল বন্ধুকে গাড়ি নিয়ে।
পাঁচ মিনিট পর গাড়িটা আবারও উঠে এল হাইওয়েতে। এবার চালকের আসনে হাবিব নিজে। আগের দিনের গুলিটা আরিফের কপালে ছোট্ট একটা দাগ কাটা ছাড়া কিছু করতে পারেনি। কিন্তু আজকের কথা ভিন্ন। উড়ে গেছে বেচারার কপালের একপাশ।
ফুরফুরে মনে শিস বাজাতে বাজাতে গাড়ি চালাতে লাগল হাবিব। বন্ধুকে খুন করেছে, কিন্তু মনে কোনো অপরাধবোধ নেই। থাকার কথাও না অবশ্য। প্রতারকের পরিণতি এমনই হওয়া উচিত।
ডান হাত স্টিয়ারিং-এ রেখে বাম হাতে ড্যাশবোর্ডের ড্রয়ার খুলে টয়োটার কাগজপত্রগুলো বের করে আনল। রেজিস্ট্রেশন পেপার, ইন্স্যুরেন্স, ফিটনেস সার্টিফিকেট ইত্যাদি সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। আরিফের লাশের মানিব্যাগ থেকে ড্রাইভিং লাইলেন্সটা আনতে ভোলেনি। সকালে একটা স্টুডিও থেকে ছবি তুলে রেখেছিল। এক জায়গায় থেমে লাইসেন্স থেকে আরিফের ছবিটা খুঁচিয়ে তুলে লাগিয়ে নিল নিজেরটা। চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে হাইওয়েতে মাঝেমধ্যে চেকিং হয়। এত বড় মাস্টারপ্ল্যান সফল হওয়ার পথে তুচ্ছ কারণে ধরা খাওয়া চলবে না।
কাচপুর ব্রিজ পেরোনোর পরই একটা চেকপোস্ট দেখা গেল। দুটো পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ব্যারিকেডের পাশে। সাথে কয়েকজন পুলিশ। ইশারা পেয়ে ব্রেক কষল হাবিব। মাথা বের করে দিল জানালার ফাঁক গলিয়ে।
‘কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি, অফিসার?’
‘না,’ জবাব দিল দায়িত্বরত অ্যাসিস্টেন্ট সাব-ইন্সপেক্টর। ‘রুটিন চেক। গাড়ির কাগজগুলো দেখি।’
‘অবশ্যই,’ বলে বাম হাতে সবগুলো পেপার্স বাড়িয়ে দিল হাবিব। হিন্দি গানের সুরটা আউড়াতে শুরু করেছে আবার। কাগজগুলো নিয়ে নিজের গাড়িতে ফিরে গেছে পুলিশের লোকটা। পাশে আরেকজনকে কি যেন বলে মাথা দোলাল।
তা যা খুশি বলুক। সাধারণত এসব চেকপোস্টে শুধু একবার সবকিছুতে চোখ বুলিয়েই ছেড়ে দেয়া হয়। আর ওই চোখ বুলানোতে হাবিবের লাইসেন্স জালিয়াতি ধরা পড়ার কথা না। পুলিশের চোখে সে এখন জেল পালানো আসামী হাবিবুর রহমান নয়, নামী ডাক্তার আরিফুল ইসলাম।
মিনিটখানেক পর ফিরে এসে কাগজগুলো ফিরিয়ে দিল এএসআই। ‘আপনি ড. আরিফ?’
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিতে দিতে আরিফ লক্ষ্য করল, পিস্তল বেরিয়ে এসেছে পুলিশের লোকটার হাতে। পাশে দাঁড়ানো বাকিরাও শটগান উঁচু করছে। ‘কী হয়েছে, অফিসার?’ ভ্রুকুটি করল আরিফ।
‘আপনার এই লাল টয়োটার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমরা। হয়তো ভেবেছিলেন, কাজটা কেউ টের পাবে না। সকালে অফিসের জন্য বেরিয়ে আসার সাথে সাথে আপনার ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। আবিষ্কার করা হয়েছে লাশটা। এক প্রতিবেশী চিৎকার আর ধ্বস্তাধ্বস্তির আওয়াজ শুনে থানায় খবর দেয়। তারপর ফোন ট্র্যাক করে আপনার এদিকে আসার খবর জানিয়ে দেয়া হয় পুলিশের সবগুলো চেকপয়েন্টে। মেয়েটার চরিত্র খারাপ ছিল মানছি, কিন্তু কাজটা আপনি ঠিক করেননি। ড. আরিফুল ইসলাম, প্রেমিকা সুমাইয়া রহমানকে খুনের দায়ে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।’
(সমাপ্ত)