এক
প্রিজনভ্যানে হাতকড়া পরে বসে আছে শাহেদ। আদালতে ওর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সরকারী উকিল দেয়া হয়েছিল। তবে তা ছিল কেবল নিয়মরক্ষার্থে। বাদীপক্ষের উকিলের উপস্থাপিত অকাট্য যুক্তি আর প্রমাণের তোড়ে শাহেদের উকিল বানের জলের মতো ভেসে গেছে।
তাছাড়া উকিলের আচরণ বাদীপক্ষের কাছ থেকে টাকা খাওয়ার স্পষ্ট সাক্ষ্য দিচ্ছিল। সরকারী উকিল তাকে বাঁচাবার কোনো চেষ্টাই করেনি। দ্রুতবিচার আইনে যাবজ্জীবনের রায়টাও তাই খুব দ্রুতই দিয়ে দেয়া হয়েছে। সত্যিকারের মামলার চাইতে সাজানো মামলার সবকিছু অনেক নিখুঁত থাকে, যাতে কেউ সন্দেহের আঙুল তুলতে না পারে।
তবে ফাঁসির আদেশ না দেয়াতে শাহেদ বেশ অবাক হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা, দুটো মিলিয়ে বেশ গুরুতর অপরাধ। মামলাটা সাজানো হলেও ফাঁসির আদেশ দেয়াটাই যুক্তিযুক্ত হতো।
যে মেয়েটিকে ধর্ষণ এবং খুনের দায়ে তাকে জেলে নেয়া হচ্ছে, তার বয়স ছিল খুবই কম। বড়জোর আঠারো থেকে উনিশের ভেতর হবে। ধর্ষণের পর ছেলে দুটো মেয়েটির গলার রগ কেটে রাস্তার পাশে একটা ঝোপের ভেতর ফেলে রাখে। শাহেদ যখন ওখানে পৌঁছে, তারা দুজন তখন চলে যাচ্ছিলো। ছেলে দুটোর মুখ শাহেদ দেখেনি, দেখেছে কেবল পেছন দিকটা। এমন সময় ঝোপের ভেতর থেকে রক্তমাখা হাত উঁচিয়ে মেয়েটি শাহেদকে ডাকার চেষ্টা করে।
ঝোপে আলো ফেলে রক্তে মাখামাখি নগ্ন একটি মেয়েকে পড়ে থাকতে দেখে শাহেদ। মেয়েটির এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখে খুন চেপে যায় তার মাথায়। দেরি না করে পেছন থেকে ছেলে দুটোকে চিৎকার করে ডাকে। ততক্ষণে ছেলে দুটো খানিকদূরে পার্ক করে রাখা গাড়িতে চড়ে বসেছে। রাতের সুনসান নীরবতা ভেদ করা চিৎকার কানে যেতেই একটা ছেলে পেছন ফিরে তাকায়। তারপর তড়িঘড়ি করে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে পালায়।
শাহেদের সঙ্গে গাড়ি ছিল না। আর অত রাতে রাস্তায় ট্যাক্সি বা অন্য কোনো বাহনও চোখে পড়েনি। তাই ছেলে দুটোর পেছনে ধাওয়া করার আশা বাদ দিয়ে মেয়েটির কাছে ফেরত আসে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ততক্ষণে মেয়েটি নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। শাহেদ তাকে কোলে তুলে ঝোপের বাইরে নিয়ে আসে।
অকুস্থলে ছেলে দুটোর ফিরে আসতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তবে এবার ওরা পুলিশের গাড়ি সঙ্গে নিয়ে ফিরেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারজন সশস্ত্র পুলিশ ওকে ঘিরে ধরেছিল। ওদের সবার হাতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। সাবেক সেনাসদস্য শাহেদ আগ্নেয়াস্ত্রের ধরন চেনে। সে জানে, সাধারণ পুলিশের হাতে এত উন্নতমানের আগ্নেয়াস্ত্র থাকে না। এরা স্পেশাল ফোর্স। একটু বেতাল দেখলেই গুলি ছুঁড়তে দ্বিধাবোধ করবে না। অযথা ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। হয়তো যথাযথ প্রমাণ পেলে শাহেদকে ওরা ধরে রাখবে না।
শাহেদ ইকবাল, জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো এক মানুষ। বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। সেনাবাহিনীর সাবেক ক্যাপ্টেন। নিজের গোঁয়ার্তুমির কারণেই বহিষ্কৃত হয়েছিল সেনাবাহিনী থেকে। তারপর অনেকটা ক্ষোভের বশেই খারাপ মানুষদের সঙ্গে জড়িয়ে অন্ধকার জগতে পা রাখে।
সেনাবাহিনীর কমান্ডো স্কিলের কারণে অন্ধকার জগতের সবচাইতে কঠিন কাজগুলোর দায়িত্ব দেয়া হতো তাকে। পারিশ্রমিকও পেত অন্য সবার চাইতে বেশি। নিখুঁত কাজের কারণে পুলিশের খাতায় নাম ওঠেনি কখনও।
তারপর একদিন তারিন নামের এক মিষ্টি মেয়ের প্রেমে পড়ে অন্ধকার জগৎ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। বিয়ে করে সংসার পাতে। কপালে সুখ খুব বেশিদিন টেকেনি। শাহেদের একসময়কার জীবনসঙ্গী সেই তারিন আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু অন্ধকার জগতের শত্রুদের অনেকেই এখনও আছে। পুরনো শত্রুতার জের ধরে তারা এখনও খুঁজে বেড়ায় তাকে। তাই পরিচয় লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়।
তারিনের স্মৃতি বুকে নিয়ে নিরুপদ্রব জীবন কাটাতে চায় শাহেদ। কিন্তু ঝামেলা যেন তার পিছু ছাড়ে না। এই যেমন এখন জড়িয়ে পড়েছে নতুন আরেক ঝামেলায়।
স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা থানায় নেবার আগে একটা বাড়িতে নিয়েছিল ওকে। সেখানে বসেই দুই ছেলের বাবাদের ফোনে ডাকা হয়। দুজনই শহরের প্রভাবশালী ব্যক্তির সন্তান। কোঁকড়াচুলো পাঁচ ফুট দশ উচ্চতার ছেলেটির নাম রাতিন। ওর বাবা শহরের মেয়র। আর পাঁচ ফুট সাতের ছেলেটি সুকান্ত। তার বাবাও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বেশ হোমরাচোমরা একজন ব্যক্তি।
রাতিন আর সুকান্তের বাবা ওই বাড়িতে উপস্থিত হবার পর সবাই মিলে যুক্তি করে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় শাহেদকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলে। ধর্ষিতা যে মেয়েটি মারা গেছে, তার নাম স্নিগ্ধা। শহরের নামকরা এক ব্যবসায়ীর মেয়ে। শাহেদকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা শেষে রাতিন আর সুকান্তের বাবা নিজ নিজ ছেলেকে বকাঝকা করতে করতে সঙ্গে নিয়ে চলে যান।
এরপর একজন পুলিশ সদস্য বাইরে থেকে ভাসমান এক পতিতা ধরে আনে। চেয়ারে বাঁধা অবস্থাতেই শাহেদের পরিধেয় ট্রাউজার খোলা হয়। পুলিশের নির্দেশিত কায়দায় মুখ ও হাতের সাহায্যে শাহেদের বীর্যস্থলন ঘটায় ভাসমান পতিতা। অন্য দুজন পুলিশ তখন বাথরুমে স্নিগ্ধা মেয়েটির গোপনাঙ্গ পরিষ্কারে ব্যস্ত।
ছোট একটি পাত্রে শাহেদের বীর্য সংরক্ষণের পর মোটা অংকের টাকা দিয়ে বিদায় করে দেয়া হয় পতিতাকে। তারপর বেশ কায়দা করে স্নিগ্ধার গোপনাঙ্গের ভেতর আর বাইরে লাগানো হয় বীর্য। পুলিশ রাতিনের কাছ থেকে ছুরিটা জব্দ করেছিল। ছুরির বাঁট ধুয়ে-মুছে শাহেদের হাতে ধরিয়ে নতুন করে হাতের ছাপ বসানো হয়। কায়দা করে ছুরিতেও মাখানো হয় স্নিগ্ধার শরীরের রক্ত।
ফাঁসানোর সব আয়োজন সমাপ্ত করে স্নিগ্ধার লাশসহ থানায় নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। থানা থেকে ফোন করে স্নিগ্ধার বাবা-মাকে খবর দিয়ে আনানো হয়। সাক্ষীর তালিকায় পুলিশের চারজন অফিসারের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তারা একটি বিশেষ অভিযান সেরে ফিরছিল।
এমন সময় শাহেদকে মেয়েটির লাশ হাতে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হতে দেখেন তারা। তাৎক্ষণিকভাবে গাড়ি থামিয়ে শাহেদকে গ্রেফতার করা গেলেও স্নিগ্ধাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শাহেদের কাছ থেকে জব্দ করা স্নিগ্ধার হাতব্যাগে তার বাড়ির ঠিকানা ও মোবাইল ফোন পাওয়া গেছে।
শোকে বিহ্বল স্নিগ্ধার বাবা তৎক্ষণাৎ শহরের মেয়রকে ফোন দেন। ফোন পেয়ে মেয়র হন্তদন্ত হয়ে ছুটে থানায় আসেন। থানায় উপস্থিত হয়ে কেসের সকল দায়-দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে স্নিগ্ধার বাবা-মাকে সুবিচারের আশ্বাস দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
এরপরের ঘটনাগুলো ঘটেছে খুব দ্রুত। ময়নাতদন্তে স্নিগ্ধার যৌনাঙ্গে শাহেদের বীর্যের নমুনা পাওয়া যায়। পরীক্ষায় যদিও আরও কয়েকজনের বীর্যের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু সুকৌশলে সেসব ধামাচাপা দেয়া হয়। যে ছুরিটি দিয়ে স্নিগ্ধার গলায় পোঁচ দেয়া হয়েছে, তাতেও শাহেদের হাতের ছাপ গেছে। চারজন পুলিশ অফিসারের সাক্ষীতে স্নিগ্ধা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় দেয়া হয় খুব দ্রুত।
রায়ে শাহেদের ভাগ্যে জোটে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। যদিও এই মামলা ও বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই জানে এই লোক নিরপরাধ। ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার কারণ কী তবে এই? প্রিজনভ্যানের ব্রেক কষার ঝাঁকুনিতে শাহেদের চিন্তার সুতো ছিঁড়ে যায়।
দুই
প্রিজনভ্যানে শাহেদের সঙ্গে ছিল আরও প্রায় জনা বিশেক আসামী। গেটে নাম নিবন্ধনের পর ওদের পুরো শরীর সার্চ করা হলো। শাহেদের পাশে নিতান্ত অল্পবয়সী দুজন ছোকরা। ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ওদের সম্ভবত ছয়মাসের কারাবাস দেয়া হয়েছে।
‘হালার পুতের বডি কাটিং কইলাম ভালাই।’ শাহেদের শরীর সার্চ করতে থাকা কারারক্ষী লোকটা বলে ওঠে। ‘উঁচা লাম্বাও আছে।’
‘হের লাইগাই একলা কাম সারবার পারছে। নাইলে রেপ করতে কমপক্ষে দুইজন মানুষ লাগে।’ পাশের অপর কারারক্ষী তার কথায় তাল মেলায়।
‘তুমি করছিলা নাকি মাইনুল ভাই?’ শাহেদের শরীর সার্চ করতে থাকা কারারক্ষী এবার খিক খিক শব্দে হেসে ওঠে।
‘করোন লাগে নাকি? এইটা তো এমনেই আন্দাজ করা যায়। মাইয়া হাত-পাও ছোঁড়াছুঁড়ি করোনের সময় একজনের ধইরা রাখোন লাগে না? সিনামায় রেপের সিন দেখোছ না?’ মাইনুল খানিকটা থতমত খেয়ে জবাব দেয়। তার মনের কোণে সুদূর অতীতের একটি ঘটনা এসে উঁকি মেরে যায়।
‘থাক। আর কইতে হইবো না। আমার যা বোঝার, বুঝচ্ছি।’
‘আজাইরা কথা বাড়াইছ না তো। জলদি হাতের কাম শেষ কর।’
সবার পকেটের টাকা-পয়সা বের করে জমা রাখা হলো পারসোনাল ক্যাশে। পারসোনাল ক্যাশ থেকে টাকার পরিমাণ উল্লেখপূর্বক পিসি কার্ড দেয়া হবে। সেই পিসি কার্ড দিয়ে পরবর্তীতে টাকাগুলো জেলখানার অভ্যন্তরে ব্যবহার করা যাবে। হাতের আংটি, কোমরের বেল্ট, মোবাইল, ঘড়িসহ অন্যান্য ধাতব জিনিসও রেখে দেয়া হলো। জেলে এসব নিয়ে ঢোকা যাবে না।
ফাইলে ওদের নাম যাবার পর মাথা গুণে দ্বিতীয় গেট দিয়ে পাঠানো হলো আমদানীতে। আজকের রাত সবাইকে আমদানীতে কাটাতে হবে। আগামীকাল শাস্তির গুরুত্ব বিবেচনা করে তাদের বিভিন্ন সেলে পাঠানো হবে।
আমদানীতে চুপচাপ বসে আছে শাহেদ। এত ছোট অন্ধকার একটি কক্ষে একসঙ্গে এতজন গাদাগাদি করে থাকতে খুব খারাপ লাগছে। ইতিপূর্বে একবার হাজতবাস করলেও কখনও জেল খাটা হয়নি। যদিও প্রক্রিয়াগুলো জানা আছে। আমদানীতে বার বার চেক করা হবে। সেইসাথে জেলখানা সম্পর্কে নানান ভয়ভীতি মনে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। রাতে খাবার হিসেবে দেয়া হবে খিচুড়ি। এক প্লেটে দুজনকে খেতে হবে।
রাতে খিচুড়ি খাবার পর জেলখানার নিয়মনীতি বয়ানের জন্য আমদানীতে একজন লোক এলো। জেলে এদের রাইটার বলা হয়। রাইটার লোকটা জেলখানার পরিবেশ, কী কী করা যাবে এবং যাবে না, এসব বোঝাতে থাকলেও ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রকার ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে শুরু করলো।
তার কথার সারমর্ম হলো—এখানে ভালোভাবে থাকতে চাইলে টাকা খরচ করতে হবে। যারা ভালোভাবে থাকতে চায়, তাদের নাম খাতায় তুলে রাখা হবে এবং পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। কয়েকজন তাদের নাম খাতায় তুলতে বলল। শাহেদের কাছে ভালো থাকার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা-পয়সা নেই। আপাতত খারাপই থাকতে হবে।
পরদিন ভোরবেলা সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো জেলখানার মাঠে। জেলার সাহেব ওদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন। মাঠে শাহেদরা ছাড়াও রয়েছে নতুন অনেক হাজতী। সবাই মাঠে বসে জেলারের জন্য অপেক্ষা করছে। একসময় জেলার এসে তার বক্তৃতা শুরু করলেন—
‘আপনাদের কৃতকর্মের জন্যই আজ এই নরকে আসতে হয়েছে। অনেকে আছেন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। ছাত্র হয়েও আজ এই নরকে আপনাদের উপস্থিতি। অনেকেই হয়তো রাজনীতির সাথে জড়িত। তাদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা আপনাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ কয়েদী ও হাজতীদের মাঝে ছড়াবেন না।
সবাই আল্লাহর কাছে বেশি বেশি করে দোয়া করেন যেন তাড়াতাড়ি এই নরক থেকে মুক্তি পেতে পারেন। যারা মাদক মামলার কারণে কারাবাস করতে এসেছেন, তাদের জেলখানার অভ্যন্তরে মাদক কেনাবেচার সাথে জড়িত না হবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। তারপরও কেউ জড়িত হলে তাদের নামে নতুন করে আবারও মামলা করা হবে।’
জেলার আরও অনেক কিছুই বললেন। বেশিরভাগই দাগী অপরাধীদের উদ্দেশ্যে। যদিও শাহেদ দাগী অপরাধী নয়, কিন্তু জেলখানার সবাই ওকে দাগী অপরাধীর দৃষ্টিতেই দেখছে। জেলারের বয়ান শেষে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো চুল কাটাতে। একে একে সবার জামাকাপড় খুলে শরীরের কোথাও জন্মদাগ আছে কিনা, সেসব পর্যবেক্ষণ করে একটা খাতায় লিখে নেওয়া হচ্ছে। এসব তথ্য কেস-কার্ড তৈরির সময় প্রয়োজন পড়বে।
মামলার ধারা অনুযায়ী প্রত্যেকের নামে একটি কেস-কার্ড তৈরি করে তাদের দেয়া হবে। কেস-কার্ডে সংশ্লিষ্ট কয়েদীর ছবি সংযুক্ত থাকবে। তথ্য নেয়া শেষে সবাইকে একটি করে থালা, বাটি আর কম্বল ধরিয়ে দিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে (জেলখানার প্রতিটি সেলকে ওয়ার্ড বলা হয়) পাঠিয়ে দেয়া হলো। শাহেদের স্থান হলো তেইশ নাম্বার ওয়ার্ডে। শুরু হলো শাহেদের বন্দী জীবন।
তিন
বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রাপ্তদের সশ্রম কারাদণ্ড প্রাপ্ত কয়েদীদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হয়। বিনাশ্রম কয়েদীদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক বন্দী। শাহেদকে দেয়া হয়েছে সশ্রম কারাদণ্ড। তবে বিনাশ্রম হোক আর সশ্রমই হোক, সবাইকে ফজরের ওয়াক্তে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়।
কারাগারে সবচাইতে দুর্লভ বস্তু হলো পানি। এই পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে সশ্রম, বিনাশ্রম, হাজতী-সহ সবাইকে প্রচুর কসরৎ করতে হয়। গোসল করতে গেলে হাউজে নেমে খাবার জন্য দেয়া বাটি দিয়ে গায়ে পানি ঢালতে হয়। তাড়াতাড়ি না করলে পানি শেষ হয়ে যায়। অবশ্য অন্য ব্যবস্থাও রয়েছে। পানির দায়িত্বে থাকা কয়েদীর সঙ্গে সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হলে সহজেই পানি পাওয়া যায়।
ভোরে উঠে একটা মোটা রুটি চানার ডাল দিয়ে খেয়ে মাঠের শেষপ্রান্তে কাজে যায় শাহেদ। ওদের কয়েকজনকে মাটি কেটে ডালায় করে আরেক জায়গায় নেবার কাজ দেয়া হয়েছে। দুপুর বারোটা পর্যন্ত একটানা কাজ চলে। ঠিক বারোটায় জমাদার এসে আরেকবার ফাইল করে, অর্থাৎ কয়েদীদের মাথা গুণে দেখে ঠিক আছে কিনা।
এরপর দেওয়া হয় দুপুরের খাবার। যারা গোসল করবে, তারা এরমধ্যেই গোসল সেরে ফেলে। শাহেদ রোজ রোজ গোসলের ঝামেলায় যায় না। ওর মতো আরও অনেকেই আছে, যারা পানির ঝামেলার কারণে প্রতিদিন গোসল করে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাতের সাথে কাঁকরোলের তরকারী মেখে লোকমা মুখে পোরে শাহেদ। এখানে আসার এক সপ্তাহ হয়ে গেল। সবজী বলতে এরা বোঝে কেবল বিচিওয়ালা কাঁকরোল। সপ্তাহে দুইদিন এক টুকরো মাছ অথবা দু-টুকরো মাংস খেতে দেয়া হয়। আর বাদবাকী দিন শুধু কাঁকরোল। শাহেদের প্লেটে এখনও অনেকটা ভাত রয়ে গেছে। ওরা হাতা ভর্তি করে ভাত দিলেও তরকারী দেয় খুবই সামান্য। প্লেটের অর্ধেক ভাত ফুরানোর আগেই তরকারী ফুরিয়ে যায়।
‘ভাই, আমার তরকারীগুলা নিবেন?’ শাহেদের তরকারী শেষ দেখে পাশে বসা অল্পবয়সী ছেলেটি বলে ওঠে।
‘তোমার প্লেটে তো দেখছি ভাত রয়েছে। তুমি খাবে কীভাবে?’
‘আমার খাওয়া শেষ। শরীরটা ভালো লাগতেছে না। আর খাবো না।’
শাহেদ ছেলেটার মুখের দিকে তাকালো। বেশ মায়াকাড়া চেহারা। মেয়েদের মতো ডাগর ডাগর চোখ। বয়স খুব বেশি হলে বাইশ তেইশ। এত অল্প বয়সে এরা কোন পাপে যে জেলে আসে, তা একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন।
‘শান্ত!’ দশাসই চেহারার এক লোক পেছনে এসে ছেলেটার নিতম্বে চাপড় মারে। ‘আজকে কিন্তু মিস দেওয়া চলবে না। গতকাল ফাঁকি মারছোস।’
‘জুলফিকার ভাই, প্লিজ আজকে না। আজকে আমার শরীরটা খারাপ।’ শান্ত নামের ছেলেটা কাতর কন্ঠে বলে।
‘হুম্মুন্দির পুত, তাইলে গতকাইল আসোছ নাই ক্যান?’
‘গতকালকেও শরীর খারাপ ছিল।’
‘এত কথা বুঝি না। আইজ রাইতে তোরে না পাইলে কইলাম খবর আছে।’ শান্তকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লোকটা চলে গেলো।
‘কোথায় যাবার কথা বললেন উনি?’ কেন জানি লোকটার কথাবার্তা ভালো লাগেনি শাহেদের।
‘বুঝেন নাই? অবশ্য আপনি নতুন। আর কয়টা দিন গেলে বুঝবেন।’
শান্ত অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তরকারীগুলো শাহেদের প্লেটে দিয়ে চলে গেলো। শাহেদ যে একেবারেই কিছু বোঝেনি, তা নয়। জেলখানায় সমকামিতার ব্যাপারে অনেক কথা শুনেছিল। কিন্তু ব্যাপারটা যে এভাবে নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখবে, তা কখনও কল্পনাও করেনি।
চার
জমাদার এসে ফাইল করে যাবার পর দুপুরের খাবার জন্য ফিরে যাচ্ছিল শাহেদ। হঠাৎ দূরে কয়েকজন কয়েদীর জটলা চোখে পড়ায় থমকে দাঁড়াল। কী মনে করে জটলার কাছে গিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। জটলার ঠিক মাঝখানে খানিকটা খালি জায়গা। আর সেই খালি জায়গায় জুলফিকার নামের লোকটা শান্তকে একতরফাভাবে মেরে চলেছে।
শান্ত’র নাক-মুখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। মার প্রতিরোধ করার মতো শক্তি তার শরীরে নেই। শান্তকে মারার জন্য জুলফিকার আরেকবার হাত উঠিয়েছে, এমন সময় ভিড় ঠেলে শাহেদ গিয়ে তার হাত চেপে ধরল। জুলফিকার বিস্মিত নয়নে তাকালো শাহেদের দিকে। জেলখানায় কেউ তার হাত চেপে ধরেছে, তা যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না।
‘নতুন কয়েদী এইসবের মধ্যে হান্দাইছোস ক্যান? তুই চিনোছ আমারে?’
‘ছেলেটাকে মারছ কেন?’
‘হেইডা তোরে কইতে হইবো?’ জুলফিকার সমানে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু শাহেদ নিজে ছেড়ে না দিলে ওর বজ্রআঁটুনি থেকে ছাড়া পাওয়া এত সহজ নয়। বিশেষ করে আনআর্মড কমব্যাটে অনভিজ্ঞ মানুষেরা কিছুতেই পারবে না।
‘যথেষ্ট হয়েছে। ছেলেটার গায়ে আর একটা টোকাও দেবে না তুমি।’
‘ওই কুত্তার বাচ্চা!’ জুলফিকার হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। ‘তাইলে কি ওর বদলে তুই শুবি আমাগো লগে?’
শাহেদ এবার জুলফিকারের হাতটা মুচড়ে পিঠের দিকে নিয়ে আসে।
‘ওরে মাওে . . . বাবাগো!’ বেমক্কা মোচড় খেয়ে জুলফিকারের গলা চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে।
‘আশা করছি এটুকুতেই কাজ হবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ আর করবে না।’
শাহেদ জুলফিকারের হাতটা ছেড়ে দিয়ে শান্তকে ওর সঙ্গে চলে আসার জন্য ইশারা করে। পেছনে ঘুরে তাকালে দেখতে পেত, আগুনঝরা চোখে জুলফিকার তাকিয়ে আছে ওর গমনপথের দিকে।
‘আপনি কাজটা খুব খারাপ করলেন।’ ফেটে যাওয়া ঠোঁটের কারণে কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে শান্তর।
‘আমাকে নিয়ে তোমার দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না।’
‘আপনি এখনও জেলের ভিতরের পরিবেশ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ওরা সবাই একাধিক খুনের আসামী। ওদের কেস এখনও চলতেছে। সবাই একজোট হয়ে থাকে। জেলখানার কেউ ওদের ঘাঁটায় না। এমনকি জেলার স্যারও না।’
‘বলো কী! ওদের এত ক্ষমতা?’ শান্তর কথা শুনে শাহেদ বেশ অবাক হয়।
‘আপনার ব্যাপারটা কিন্তু এইখানেই শেষ হয়ে যায় নাই। জুলফিকার গিয়ে নালিশ করবে ওদের ওস্তাদের কাছে। শাহেদ ভাই, আপনি সাবধানে থাকবেন।’
‘হুম, থাকব। এখন চলো, তোমার আঘাতগুলোতে ওষুধ লাগানো দরকার।’
পাঁচ
আজ মাঠের কোণে আবারও বেশ কিছু কয়েদী জটলা পাকিয়েছে। তবে জটলার কারণ আজ ভিন্ন। গ্রাম্য পঞ্চায়েতের মতো মাঠের কোণে সালিশ ডাকা হয়েছে। সালিশের বিচারক খুনি রুম্মন ও তার সঙ্গী কালু খাঁ। রুম্মনের নামে সাত খুনের মামলা আর কালু খাঁ-র নামে ছয়। কালু খাঁ-র খুনের সংখ্যা রুম্মনের চাইতে একটা কম। এ নিয়ে তার মর্মপীড়ার শেষ নেই। অথচ নাম শুনে লোকজন তাকেই বড় খুনি বলে মনে করে। তার চেহারাতেও তাই বলে।
রুম্মন দেখতে ছাপোষা মধ্যবিত্ত কেরানীদের মতো। তাকে দেখে কোনো এ্যাঙ্গেলেই খুনি বলে মনে হয় না। উচ্চতাও অনেক কম। মাত্র পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। ছয় ফুটি কালু খাঁ-র পাশে দাঁড়ালে তাকে দেখতে হাস্যকর লাগে। তবে কালু খাঁ কখনও রুম্মনকে দেখে হাসেনি। এই মানুষটাকে মনে মনে সে অনেক সম্মান করে। কিছুটা ভয়ও পায়। রুম্মনের ছুরি চালানো যারা নিজ চোখে দেখেছে, তাদের অবশ্য ভয় পাবারই কথা।
সালিশের বাদীপক্ষ জুলফিকার, বিবাদী শাহেদ ইকবাল। বাদী জুলফিকারকে তার অভিযোগ উত্থাপন করতে বলায় গতকালের পুরো ঘটনাটা আরও রঙ চড়িয়ে বয়ান করল।
‘দেখো নতুন কয়েদী, এই কারাগারের ভিতরে আমাদের নিজস্ব কিছু নিয়ম-কানুন আছে। যা তুমি ভঙ্গ করছো। এর জন্য তোমাকে শাস্তি পাইতে হবে। আর সেই শাস্তি দিবে কালু খাঁ। গতকাল নাকি জুলফিকারের সাথে অনেক ভেলকিবাজি দেখাইছো? পারলে কালু খাঁ-কেও সেইসব ভেলকিবাজি দেখাও। সাথে আমরাও দেখি।’ জুলফিকারের কথা শেষ হবার পর রুম্মন খুব ঠাণ্ডা সুরে শাহেদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে।
‘শাহেদ ভাই, আপনি এখনই ওদের পা ধরে মাফ চান। কালু খাঁ-র শরীরে প্রচণ্ড শক্তি। খালি হাতে মানুষ খুন করতে পারে। আপনার দুই পয়সার টেকনিক এখানে কোনো কাজে আসবে না।’
শান্তর কথাতে কান নেই শাহেদের। তার দৃষ্টি এখন কালু খাঁ নামের প্রকাণ্ড শরীরের অধিকারী মানুষটার ওপর নিবদ্ধ। শাহেদের নিজের উচ্চতাও ছয় ফুটের কাছাকাছি। কয়েদীর পোশাকের আড়ালে পেটানো শরীর। কিন্তু তারপরও বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোয় কালু খাঁ-র সামনে নিজেকে তার খাটো বলে মনে হচ্ছে। আশেপাশের কয়েদীরা সবাই পিছিয়ে জায়গা করে দিয়েছে। কয়েদীদের মধ্যে গতকাল অনেকেই শাহেদের ভেলকি দেখেছে। এই লোক আজ কালু খাঁ-র সঙ্গেও একই ভেলকি দেখাতে পারে কিনা, সেটা দেখার জন্য তারা অপেক্ষায় আছে।
কালু খাঁ উঠে দাঁড়িয়ে শাহেদকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরতে আরম্ভ করেছে। শাহেদও তাল মিলিয়ে তার সাথে ঘুরতে লাগল। সে বুঝতে পেরেছে, এই লোক মল্লযুদ্ধে অভ্যস্ত। যা করার সব গায়ের জোরে করে। কালু খাঁ হঠাৎ দুই হাত সামনে বাড়িয়ে শাহেদের দিকে ধেয়ে এলো। উদ্দেশ্য দুই হাতে চেপে ধরে গুঁড়ো করবে শাহেদের হাড়। একেবারে শেষ মুহূর্তে শাহেদ সরে গিয়ে কালু খাঁ-র বাম পাঁজর বরাবর কষালো মোক্ষম একটা পাঞ্চ। থ্যাঁচ!
সাধারণ কেউ হলে শাহেদের এই পাঞ্চে এতক্ষণে মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি খাবার কথা। কালু খাঁ-র তেমন কিছুই হলো না। পিঁপড়া কামড়েছে এমন একটা ভাব করে জায়গাটা হাত দিয়ে ঝাড়া দিলো।
কালু খাঁ তার বিশাল শরীর নিয়ে শাহেদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার মতলব ধরতে পেরেছে শাহেদ। একবার হাতের নাগালে পেলে ওকে চেপে ধরে পিষ্ট করে ফেলবে। শাহেদ ডানদিক দিকে এগোনোর ফলস মুভ দিয়ে বামদিকে এ্যাটাকে গেল। সেকেন্ডের অর্ধেক সময়ে কালু খাঁ-র গলায় ও পেটে দমাদম দুটো ঘুষি চালিয়ে পেছনদিক থেকে হাঁটুর জয়েন্টে কষে লাথি হাঁকালো। কালু খাঁ হাঁটু ভাঁজ করে মাটিতে বসে পড়েছে। তাকে ধাতস্থ হবার সময় দিলো না শাহেদ। গলার একপাশে ব্রাকিয়াল প্লেক্সাসে হাতের একটা কোপ দিতেই কালু খাঁ-র প্রকাণ্ড শরীরটা কাটা গলা গাছের মতো দড়াম করে আছড়ে পড়ল মাঠের ওপর।
উপস্থিত কয়েদীদের মুখ হাঁ হয়ে গেছে। গতকালই তারা আন্দাজ করেছিল, এই লোক সহজ পাত্র নয়। কিন্তু এতটা কঠিন, তা ছিল কল্পনার বাইরে। কালু খাঁ-কে ধরাশায়ী হতে দেখেও রুম্মনের চেহারায় কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। তবে পাঁচ ফুট চারের মানুষটা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। কয়েদীরা এবার আরও খানিকটা দূরে সরে গেল। রুম্মন খালি হাতে উঠে দাঁড়ালেও সবাই জানে তার গুপ্তস্থানে ছুরি লুকানো আছে। শরীরের কোথায় কোথায় সে ছুরি লুকিয়ে রাখে, তা একমাত্র উপরওয়ালাই ভালো জানেন।
রুম্মন ছোটখাট মানুষ হলেও শাহেদ তাকে অগ্রাহ্য করেনি। শুরু থেকেই সে লক্ষ্য করেছে, লোকটা সবার ওপর কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে। জেলখানায় সবাই অপরাধী। কেউ কাউকে মান্য করে না। যা করে তা হলো ভয়। সবাই ছোটখাট এই মানুষটাকে ভয় করে, সমঝে চলে, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে। কারণটা যে ছুরি চালনায় পারদর্শিতা সেটা ধরতে ধরতেই ধারালো ছুরির ফলা শাহেদের পেটের চামড়া কেটে মাংস ছুঁয়ে গেলো।
রিফ্লেক্সের বশে শেষ মুহূর্তে কয়েক ইঞ্চি সরে গিয়েছিল, তা না হলে ছুরির ফলা আরও গভীরে পৌঁছাতো। ধাতস্থ হয়ে শাহেদ একটা লাথি কষাতেই নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলো রুম্মন। ও এখন ছুরি হাতে শাহেদের চারপাশে ঘুরছে। আক্রমণের আগে শিকারী বাঘ যেমন তার শিকারের চারপাশে ঘোরে, ঠিক তেমন করে।
শাহেদ বুঝলো এই লোকের নাগাল এত সহজে পাওয়া যাবে না। কাছে গেলেই ছুরির কোপ খেতে হবে। ঝট করে ঝুঁকে এক মুঠো বালু নিয়ে রুম্মনের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো শাহেদ। এই ব্যাপারটার জন্য রুম্মন মোটেও প্রস্তুত ছিল না। চোখে মুখে অন্ধকার দেখেও শাহেদের অবস্থান আন্দাজ করে হাতের ছুরিটা ছুঁড়ে দিলো সে।
‘বাবারে!’ ওপাশ থেকে একজন কয়েদীর আর্তনাদ শোনা গেল। ছুরিটা সোজা গিয়ে বিঁধেছে তার উরুতে। ততক্ষণে রুম্মনকে মাটিতে ফেলে দমাদম ঘুষি চালাতে শুরু করেছে শাহেদ। তারপর ওর বামহাত মুচড়ে ধরে পুরো শরীর হাতড়ালো। রুম্মন বামহাতি। তার সকল শক্তি বামহাতে। তবে ডানহাতটাও হাঁটু দিয়ে মাটির সঙ্গে চেপে রেখেছে। রুম্মনের কোমরের কাছে আরেকটা ছুরি পাওয়া গেল।
মুচড়ে ধরা হাতটায় ক্রমশ চাপ বাড়াচ্ছে শাহেদ। এক পর্যায়ে আর সহ্য করতে না পেরে রুম্মন পরাজয় স্বীকার করে নিলো। তাকে ছেড়ে দিয়ে শান্তর দিকে এগিয়ে গেল শাহেদ।
‘চলো শান্ত। দুপুরের খাবার সময় হয়ে এসেছে। আশা করি এরপর থেকে কেউ আর তোমাকে ডাকাডাকি করবে না।’
শান্ত ঘোরলাগা দৃষ্টিতে শাহেদকে দেখছে। ছেলে হয়ে জন্মানোয় তার কোনদিন আফসোস হয়নি। তবে আজ হচ্ছে। মেয়ে হয়ে জন্মালে নির্ঘাৎ এই লোকটার প্রেমে পড়ে যেত।
ছয়
‘ওস্তাদ, আমরা আপনাকে চিনতে পারি নাই। ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা চাই।’
‘বস, সচরাচর আমার মানুষ চিনতে ভুল হয় না। আপনার ক্ষেত্রে আমি নিজেও ভুল করে ফেলেছি।’
রুম্মন আর কালু খাঁ-র কাঁচুমাচু মুখ দেখে হেসে ফেললো শাহেদ। বিশেষ করে কালু খাঁ-র মতো বিশালদেহী মানুষটাকে এমন কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সত্যিই খুব হাসি পাচ্ছিল। অনেক চেষ্টা করেও তাই গাম্ভীর্য ধরে রাখতে পারেনি।
‘ওস্তাদ, আপনে হাসতেছেন? তাইলে কি ধরে নিবো আমরা মাফ পাইছি?’
‘বস, আপনি তো জানেন বছরের পর বছর জেলে নিঃসঙ্গ জীবন কাটালে শারীরিক একটা চাহিদা তৈরি হয়। সেই কারণেই এইসব করা। তাছাড়া এই নিয়ম তো আমরা চালু করি নাই। জেলখানায় অনেক আগে থেকেই এইসব চলে। কে চালু করেছে সেইটা আমরা জানি না।’
‘তাহলে কথা দিচ্ছো, আজ থেকে তোমরা আর এসব করবে না?’ এতক্ষণে শাহেদ মুখ খোলে।
‘ওস্তাদ, আপনে না চাইলে আর করবো না।’
‘অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। তবুও কথা দিলাম, এমনটা আর হবে না।’
‘ওস্তাদ, আমিও ওয়াদা করলাম। সাধারণ মানুষে ওয়াদা করলে ভাঙে। কিন্তু খুনিরা ওয়াদা ভাঙে না।’
‘বস, কিছু মনে নিবেন না। ম্যাটের (জেলখানার প্রতিটি ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা কয়েদীদের ম্যাট বলা হয়) কাছ থেকে জানতে পারলাম, রেপ আর মার্ডার কেসের জন্য আপনার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।’
‘ওস্তাদ, আপনে চাইলে শত শত মার্ডার করতে পারেন। এইটা আজকে থাইকা আমরাও বিশ্বাস করি। কিন্তু আপনে ধর্ষণ করছেন, এইটা আমাদের বিশ্বাস হয় না।’
‘জ্বি বস। একটু ভেঙে বললে মনে শান্তি পাইতাম।’ রুম্মন পুরো ঘটনা জানার আবেদন জানায়।
‘ওস্তাদ, বইলা ফালান। আমারও রিকুয়েস্ট।’ কালু খাঁ-ও তার সাথে তাল মেলায়।
দুজনার ক্রমাগত জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে পুরো ঘটনাটা খুলে বলে শাহেদ। সব শোনার পর রুম্মন আর কালু খাঁ দুজনই খানিকক্ষণ থম মেরে থাকে।
‘বস, এইভাবেই অপরাধ ধামাচাপা পড়ে। একজনের পাপের সাজা অন্যজনে খাটে। এই জেলখানাতেই এমন অনেক কয়েদী আছে।’
‘ওস্তাদ, রুম্মনের খুনের সংখ্যা আমার চাইতে একটা বেশি। আমার বহুদিনের ইচ্ছা, পর পর দুইটা খুন কইরা ওরে টপকাইয়া যাওয়ার। সেই সুযোগটা আপনে কইরা দিলেন।’
‘বস, আমরা খুনি ঠিকই কিন্তু এখন পর্যন্ত একটাও ভালো মানুষরে খুন করি নাই। এই পর্যন্ত যাদের খুন করছি তারা সবাই আমাগো কাতারের লোক।’
‘মেয়র আর রাজনীতিবিদের পোলার কথা কইলেন না? এরপরে কোর্টে আমাগো কেসের ডেট পড়লেই ওই দুইজন শ্যাষ।’ কালু খাঁ সদম্ভে ঘোষণা করে।
‘কালু, তোর ভাগে একটা। আরেকটা আমার ভাগে।’
‘তাইলে তো তুই আমার উপরেই থাইকা যাবি।’
‘একটা পূণ্যের কাজ করার সুযোগ পাইছি। এই কাজে ভ্যাজাল করিছ না। আমাকেও একটু পূণ্য কামাইতে দে।’
শাহেদ অবাক হয়ে ওদের দুজনার তর্কাতর্কি দেখে। জেলের কয়েদী হয়ে তারা বাইরের মুক্ত অপরাধীদের কীভাবে শাস্তি দেবে, তা সে জানে না। তবে অজানা অচেনা একজন মানুষের জন্য কুখ্যাত দুই খুনির এমন উপচেপড়া ভালোবাসা দেখে কৃতজ্ঞতায় চোখের দুই কোণ ভিজে ওঠে তার। ক্ষণিকের অসাবধানতায় কেউ তাকে কাঁদতে দেখুক, তা কোনোভাবেই চায় না শাহেদ। তাই মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।
সাত
দুপুরের দিকে খবর এলো কোর্টে নিয়ে যাবার পথে রুম্মন আর কালু খাঁ পালিয়েছে। ওদের সাঙ্গপাঙ্গরা সশস্ত্র হামলা চালিয়ে দুজনকেই মুক্ত করে নিয়ে গেছে।
গাড়ির পেছনের সিটে মেয়েটাকে শরীরের নিচে ফেলে পিষ্ট করছে রাতিন। দুজনেই ইয়াবার নিষিদ্ধ নেশায় উন্মত্ত। হঠাৎ রাতিনের পায়ের কাছের দরজাটা খুলে গেলো দড়াম করে। শক্তিশালী একজোড়া হাত গাড়ির সিট থেকে শূন্যে ভাসিয়ে বাইরে বের করে আনলো তাকে। সিটে শুয়ে থাকা মেয়েটি পাহাড়ের মতো বিশালদেহী মানুষটাকে দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।
প্রচণ্ড শক্তিতে রাতিনকে দুই হাতে চেপে ধরেছে কালু খাঁ। নিজের পাঁজরের হাড় ভাঙার মট মট শব্দ নিজ কানে শুনতে পেলো রাতিন। ব্যথায় মুখের ভেতর থেকে জিব অনেকখানি বাইরে বেরিয়ে এসেছে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য চিৎকার দিতে চাইলেও গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না। একপর্যায়ে আর কোনো শব্দ করার মতো অবস্থায় রইলো না সে।
একটা নাইট ক্লাবে অনেক রাত অবধি পার্টি করে বন্ধুদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে সুকান্ত। আর ঠিক তখনই রাস্তা পার হয়ে ছোটখাট গড়নের একজন মানুষ তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।
‘তোমাদের মধ্যে সুকান্ত কার নাম?’
‘আমিই সুকান্ত। কী সমস্যা, মিস্টার নাটি বিস্কুট?’ একরাশ তাচ্ছিল্য গলায় ঢেলে ছোটখাটলোকটার উদ্দেশ্যে কথাগুলো ছুঁড়ে দেয় সুকান্ত।
সুকান্তের সঙ্গীরা লোকটাকে অন্ধকারে সামান্য নড়ে উঠতে দেখে। তার সেকেন্ডখানেকের মাথায় গলা দিয়ে খক খক আওয়াজ তুলে দড়াম করে রাস্তায় আছড়ে পড়ে সুকান্ত। নিয়ন বাতির আলোয় তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রক্তগুলোকে কালচে দেখাচ্ছে।
সুকান্তের বন্ধুরা চোখে অবিশ্বাসী দৃষ্টি নিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা শরীরটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই ওদের মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে ডাক দেয় ক্লাবের সিকিউরিটিকে। ততক্ষণে ছোটখাট গড়নের মানুষটা ভোজবাজির মতো চোখের সামনে থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
কীভাবে যেন কারাগারে আগুন ধরেছে। ভয় পেয়ে কয়েদীরা সবাই উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক ছোটোছুটি করছে। শান্তকে সঙ্গে নিয়ে মাঠের এক কোণায় এসে চুপচাপ দাঁড়িয়েছে শাহেদ। আগুন খুব একটা ছড়ায়নি। তাই নেভাতে সময় লাগবে না।
এমন সময় দুম করে বোমা বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দ হলো। শান্ত চমকে পিছু ফিরে দেখে, ওদের পেছন দিকের দেয়ালে বড়সড় একটা গহ্বরের সৃষ্টি হয়েছে। ধোঁয়ার রেশ কাটতেই ফুটো দিয়ে ওপাশে দুজন লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। উচ্চতার কারণে একজনের মাথা ঠিকভাবে দেখা যাচ্ছে না।
ছোটখাট মানুষটা ফুটোর কাছে মাথা এনে শাহেদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘বস, জলদি করেন। আমরা আপনাকে নিতে আসছি।’ লোকটাকে চিনতে পেরে খুশিতে শান্তর সব ক’টা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। শাহেদ কিছু না বলে ওদের নিকটবর্তী ওয়াচ টাওয়ারের দিকে তাকাল। ওয়াচ টাওয়ারে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রুম্মন আর কালু খাঁ গার্ডকে কী করেছে, কে জানে।
শান্ত তাকাল শাহেদের দিকে, ‘শাহেদ ভাই, চলেন। আর দেরী করাটা ঠিক হচ্ছে না।’ তারপর একটু থেমে শাহেদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাই, আপনি কাঁদছেন?’
‘আরে না। সিমেন্টের কণা উড়ে এসে চোখে পড়েছে বোধহয়।’ অপ্রস্তুত শাহেদ মুখটা হাসি হাসি করে লজ্জা ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াস চালায়। আজ কেন জানি আবারও তার চোখজোড়া সমস্যা করতে শুরু করেছে।
(সমাপ্ত)