(প্রথম পর্বের পর)
অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাপ হাতে নিল দুজন। টং এর দোকান থেকে বের হয়ে অটোরিক্সা করে ওরা চলে গেল কিছুটা খোলা বসতিপূর্ণ এলাকাতে। একটা বাংলো টাইপ বাসার কাছাকাছি এসে অটো থামল।
নাসির সাহেব বললেন, 'তোমরা ভেতরে চলে এসো। কোন ভয় নেই।'
সাদিয়াদের বাসা মধুপুরে। অর্থাৎ সাদমানের খালার বাড়ি এখানে। তাই সাদমানের এতটা ভয় লাগছে না।
নাসির দেওয়ান বললেন, 'তোমরা কী ভেবেছ? দেশের এত বড় বড় জ্ঞানী লোক খুন হবে আর সরকার থেকে কোন গোয়েন্দা নিয়োগ করা হবেনা? আমি হচ্ছি সরকারি সেই গোয়েন্দা। তবে তোমাদের প্রশংসা করতেই হবে। তোমরাই আমার তদন্তকে অনেক সহজ করে দিয়েছ। আমি রহস্য সমাধানের একেবারে দোরগোড়ায় আছি এখন। আর খোরশেদ সাহেব, ও বেচারা একেবারেই নির্দোষ। ওকে তোমরা শুধু শুধু সন্দেহের বশে গ্রেফতার করিয়েছ। যাইহোক, একটু পর হেলিকপ্টার চলে আসবে। আমরা সুন্দরবনের দিকে অগ্রসর হব। তোমরা এখন বিশ্রাম করো।'
নাসির সাহেবের সাথে দেখা হওয়ার পর সাদমান এবং অলক কেউ এপর্যন্ত একটা কথাও বলেনি। অবাকই হতে চলেছে শুধু।
সাদমান বলল, 'মানে বুঝতে পারছি না নাসির সাহেব, হঠাৎ সুন্দরবনের দিকে কেন?'
নাসির সাহেব বললেন, 'শোন তাহলে, আমি অনেক দূর এগিয়েছি এই কেসটাতে। তোমরা জানলে অবাক হবে এই কেস নিয়ে আমি কাজ করছি প্রায় তিনবছর যাবত। এই তিন বছরেও আমি খুনিকে ধরতে পারিনি। প্রত্যেকবার আমার চোখে ধুলো দিয়ে যায় এই খুনি। কিন্তু এবার ওর আস্তানাটিই আমি খুঁজে বের করে ফেলেছি। এই সিরিয়াল কিলারের আস্তানা সুন্দরবনে।'
অলক বলল, 'কীভাবে খুঁজে পেলেন সেই আস্তানা?'
নাসির সাহেব বললেন, 'ইন্ডিয়ার একজন সাংবাদিক আছেন। নাম মাইকেল ফ্রেড। ওর সাহায্য নিয়ে। জন্মসূত্রে ও ইন্ডিয়ান হলেও নিজের দেশে কখনো থাকেনি। ফ্রেড সুন্দরবন নিয়ে একটি আর্টিকেল লিখেছিল গতবছর। সুন্দরবনের কাছে বাংলাদেশের দিকটাতে একটি বাংলোতে থাকত। ওর ওপর বিদেশি অনেক জার্নালের ইনভেস্টমেন্ট ছিল। তাই প্রচুর টাকা খরচ করেছে সুন্দরবন নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে।'
একটু থেমে নাসির সাহেব আবার বললেন, 'প্রতি বিকেলেই ফ্রেড হেলিকপ্টার নিয়ে বের হয়ে যেত সুন্দরবনের ওপর দিয়ে ঘোরাঘুরি করতে। আর ওপর থেকে ছবি তুলতো। প্রতিরাতের মত ফ্রেড দিনে তোলা ছবিগুলো চেক করছিল একরাতে। হঠাৎ ও দেখতে পায় গাছপালার মাঝখানে অদ্ভুত একটি স্থাপনা। পরদিন আবার সেই স্থাপনার ভেতরে ঢোকে ফ্রেড। ভিতরে ঢোকার পর বুঝতে পারে ওটা আসলে একটি মিউজিয়াম এবং দেখতে পায় হাড় হিম করা এক জিনিস।'
দশ
সাদিয়ার চোখ গড়িয়ে হঠাৎ এক ফোঁটা পানি পড়ল। সাদিয়ার অনেক ইচ্ছে করছে এই পানির ফোঁটাকে মাইক্রোস্কোপের নিচে ফেলে দেখতে। এটা কি কষ্টের অশ্রু নাকি ভালোবাসার অশ্রু বিষয়টা ওকে বুঝতে হবে। সাদমানের যদি সত্যিই কোন বিপদ হয়ে থাকে!
সাদিয়া শুনতে পেল আযানের ধ্বনি। ওযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। নামাজ শেষে সাদমানের জন্য দোয়া করল মন ভরে। তারপর বিছানায় শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। রুমে এখন কেউ নেই। সাদমানকে কি একটা ফোন করা যায়! মন সায় দিল না সাদিয়ার। নিজের মনের প্রতি রাগ নিয়ে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
এগারো
হঠাৎ হেলিকপ্টারের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল সাদমানের। বাংলোর সামনে চকচকে একটি হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরছে। অবশ্য আশেপাশে কিছুটা ধুলো তৈরী হয়েছে। সাদমান এই প্রথম কোনো হেলিকপ্টারে উঠতে যাচ্ছে।
নাসির সাহেব বললেন, 'উঠে পড়। রওনা দিতে হবে একটু পর। অলককে ডাক।'
'নাসির সাহেব, আপনি অলকের নাম জানলেন কীভাবে?'
'কীভাবে আবার! যেভাবে তোমাকে খুঁজে পেয়েছি। পত্রিকায়। আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা মধুপুর আসবে না। তাই হেলিকপ্টার নিয়ে প্রথমে ঢাকা যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম। সেখান থেকে তোমাদেরকে নিয়ে তারপর সুন্দরবন।'
সাদমান মনে মনে আফসোস করল। হেলিকপ্টার নিয়ে ওদেরকে কেউ নিয়ে যেতে এসেছে বিষয়টা ওদের জন্য অনেক সম্মানজনক হতে পারত।
নাসির সাহেব বললেন, 'এটা ফ্রেডেরই হেলিকপ্টার। একমাস যাবত ওর সাথে আমার যোগাযোগ হচ্ছে। আমরা এখন ফ্রেডের বাংলোতেই যাব।'
চোখের পলকেই যেন মধুপুর থেকে সুন্দরবন পৌঁছে গেল ওরা। যদিও সন্ধ্যা নেমে গেছে। একদিনে এত ভ্রমণ ওরা কখনও করেনি। মাইকেল ফ্রেডের সাথে কিছুক্ষণ ইংরেজিতে কথা বার্তা চালাল সাদমান-অলক-এর। এই লোক ইংরেজী ছাড়া ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দী পারে। তবে বাংলা একেবারেই পারে না।
ফ্রেডের সাথে কথা বলেই বোঝা গেল, লোকটা বেশ অবাক সুন্দরবনের মাঝে এমন একটা মিউজিয়াম দেখে। নাসির সাহেব খোলাসা করে কিছুই এখন পর্যন্ত বলেননি। হয়তো তিনিও পুরো রহস্য জানেন না।
সারারাত সাদমান অলক কেউই ঘুমাল না। পিশাচ রহস্য ওদেরকে ঘুমাতে দিচ্ছে না।
সকালে ওরা হেলিকপ্টারে রওনা হলো সেই অদ্ভুত মিউজিয়ামের সন্ধানে। একদম গহীন বনে সেই মিউজিয়াম। বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে অনেক। ফ্রেডের কাছে রিভলভার রয়েছে। নাসির সাহেবের কাছেও রয়েছে হয়তো।
মিউজিয়ামের কাছেই ফাঁকা জায়গা ছিল। সেখানেই ল্যান্ডিং করা হলো। ফ্রেড রিভলবার বের করে পেছনের দিকটাতে নজর রাখছে। আর নাসির দেওয়ান সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। মাঝখানে সাদমান-অলক। পাইলট হেলিকপ্টারের ভেতরেই বসে আছেন।
মিউজিয়ামে ঢুকতে হবে বিশেষ পদ্ধতিতে। হালকা বাঁকানো দুটি দেয়াল রয়েছে মিউজিয়ামের একদিকে। দুটি দেয়ালের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় ঢুকতে হবে। অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর একটি দরজা দেখতে পাওয়া যাবে ডানদিকে। ওখান দিয়েই ঢুকতে হবে প্রধান কক্ষে।ফ্রেড এবার আগে আগে চলে গেল। সে এখানে এর আগে প্রবেশ করেছিল। ফ্রেডের পিছু নিল বাকি সবাই।
নাসির সাহেব বললেন, 'এই মিউজিয়ামে এলোমেলো দেয়াল কেন করা হয়েছে বুঝতে পারছ?'
নাসির সাহেবের প্রশ্ন শুনতে শুনতে ওরা দুই দেয়ালের ফাঁকা জায়গায় প্রবেশ করল।
সাদমান বলল, 'বুঝতে পারছি না কেন এই বিচিত্র ডিজাইন।'
'পরে বলব সব।' নাসির সাহেব বললেন।
ভেতরের কক্ষটা একদম বৃত্তাকার। বৃত্তাকার কক্ষের ফ্লোরে পা ফেলতেই সাদমানের মনে হলো এ কক্ষের মেঝের ভেতরটা ফাঁপা। যেকোন সময় পায়ের নিচ থেকে ফ্লোর সরে যেতে পারে। ফ্রেড টর্চের আলো জ্বালাল। দেয়ালে ঝুলতে দেখা গেল অনেক পেইন্টিং। পেইন্টিংগুলো দিয়ে ব্যাক্তিগত মিউজিয়াম তৈরী করেছে খুনি পিশাচ।
পেইন্টিংগুলোর পাশেই সাদমান দেখতে পেল সবচাইতে বিভৎস জিনিসটি। নিজের চোখকে এই প্রথম বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সাদমানের।
পাশাপাশি কতগুলো বক্স আঁকা রয়েছে দেয়ালে এবং প্রত্যেকটি বক্সে কালো কালি দিয়ে একটি করে চোখের সিম্বল আঁকা রয়েছে। এর মধ্যে বিভৎস ব্যাপারটি হচ্ছে, সিম্বলের যে অংশটাতে মণি থাকার কথা ছিল ঠিক সেখানে আঠা জাতীয় কিছু দিয়ে এঁটে দেয়া হয়েছে সত্যিকারের মানুষের চোখ।
সাদমান গুনে দেখল মোট দশটি বক্স রয়েছে দেয়ালে।
এসময় নাসির সাহেব বললেন, 'এই চোখ গুলোই হচ্ছে এতোদিন যাবত খুন হওয়া সকল মানুষের চোখ। আমার ধারণা লোকটি শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত-মায়ানমারেও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। বাংলাদেশে হয়েছে এখন পর্যন্ত চারটি খুন। অর্থাৎ বাকি চোখগুলো অন্যদেশ থেকে সংগৃহীত হয়েছে। দশটি বক্সের মধ্যে আটটি চোখ লাগানো হয়ে গেছে। খালি রয়েছে দুটি বক্স। এই দুটি বক্সের মধ্যে একটি খুন অলরেডি হয়ে গেছে। মধুপুরের সেই কৃষক। কৃষকের চোখ অতি তাড়াতাড়িই সিম্বলের ওপর লাগিয়ে দেবে সেই খুনি। ওটা লাগানোর পর আর বাকি থাকবে একটি ঘর। তারমানে ওকে আরো একটি খুন করতে হবে।'
হঠাৎ বাইরে শোনা গেল বিকট একটি শব্দ। সাদমান বুঝতে পারল এটা বাঘের গর্জন।
বাইরের পরিস্থিতি জানার জন্য ফ্রেড কল দিল হেলিকপ্টারে থাকা পাইলটকে। পাইলটের কাছ থেকে জানা গেল বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আগাগোড়া কালো কাপড়ে মোড়ানো এক লোক। তার সাথে রয়েছে একটি বাঘ। সম্ভবত পোষা বাঘ।
অলক বলল, 'তাহলে এখন আমরা কী করবো নাসির সাহেব?'
নাসির সাহেব বললেন, 'পিশাচ এসে গেছে। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দাও কুইক।'
সাদমান আর অলক দৌড়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
নাসির সাহেব বললেন, 'ঘাবড়ে যেও না। আমাদের হাতে অনেক অপশন রয়েছে এই মুহূর্তে। আমরা চাইলে এই চোখগুলো দেয়াল থেকে তুলে ফেলতে পারি। সেটা কখনো এই পিশাচ চাইবে না। ফ্রেড,টেল দ্য পাইলট টু টেক অফ ফ্রম হেয়ার। নাও।'
'ওকে, ওকে।'
বাঘের গর্জন তীব্র হচ্ছে ক্রমশই। একপর্যায়ে হিংস্র বাঘ নখ দিয়ে আঁচড় কাটতে শুরু করল লোহার দরজায়। একই সাথে মনে হচ্ছে গোলাকার কক্ষটা যেন আস্তে আস্তে ক্লক ওয়াইজ ঘুরছে।
যদিও দুটো রিভলভার রয়েছে এখানে কিন্তু বাঘের মুখোমুখি হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। হেলিকপ্টার উড়ে চলে যাওয়ার শব্দ পাওয়া গেল কিছুক্ষণ পর।
নাসির সাহেব বললেন, 'কোনো প্রকার ভয় পাওয়ার দরকার নেই। চুপ করে বসে থাক।'
কিন্তু কয়েকহাত দূরেই বাঘের গর্জনকে ভয় না পাওয়ার কোনো উপায় নেই। আজীবন যারা নিজেকে সাহসী ভেবে এসেছে তারা বাঘের মুখে পড়লে বুঝতে পারবে মানুষ কতটা অসহায় প্রাণি। প্রত্যেক গর্জনে হৃদপিণ্ড একবার করে লাফ দিয়ে উঠছে।
পিশাচের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে এল বাইরে থেকে, 'ওহে বোকার দল। তোরা তিনবছর যাবত আমাকে ধরতে পারিসনি, আজও পারবি না। গোলাকার এই কক্ষ স্ক্রু এর মতো করে তৈরী করেছি আমি। প্রত্যেকবার ঘূর্ণনে তোরা এক ইঞ্চি করে মাটির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিস। তোদের মৃত্যু অবধারিত। তোদেরকে অনাহারে মরতে হবে নতুবা বাঘের খাবার হতে হবে। তোদের রক্তেই অঙ্কিত হবে শেষ চিত্র। পরিপূণ হবে গোটা আয়োজন।'
নাসির সাহেব বজ্রকণ্ঠে হেসে উঠলেন।
'আর আমরা যদি চোখগুলো দেয়াল থেকে খুলে ফেলি?'
'খামোশ! দেবতা হোরাসের অভিশাপে ভস্মীভূত হয়ে যাবি তুই আর তোর দল। তার চেয়ে বাঘের আহার হয়ে যা। তোরা অনাহারে মরার চেয়ে ওর একবেলা আহারের মূল্য অনেক বেশি। হি ইজ দ্য গার্ডিয়ান ওফ মাই টোম্ব।'
'কিন্তু বাকি দুটো চোখ দেয়ালে না লাগালে তো আর দেরতা হোরাস জীবিত হবে না। কী? ঠিক বলেছি?'
হুংকার মিশ্রিত আর্তনাদ করে উঠল খুনি পিশাচ। একই সাথে বাঘটি যেন শেষবারের মত থাবার সমস্ত শক্তি দিয়ে লোহার গেটে আঁচড় কাটল।
ফ্রেড বলল, 'লেট আস গো। প্লিজ। উই ওন্ট বি ব্যাক।'
হঠাৎ বাঘের গর্জন থেমে গেল। খুনি হয়তো বুঝতে পেরেছে আমাদের চাইতে ও বেশি বিপদে আছে। নাসির সাহেব ফ্রেডকে বললেন পাইলটকে আবার ফেরত আসার জন্য। কিছুক্ষণ পর পাইলট ফেরত এলো। পাইলট এসে বলল বাইরের পরিস্থিতি ভালো। আশেপাশে কেউ নেই।
নাসির সাহেব বললেন, 'আমরা এবার বের হব। আমি থাকব সামনে। তোমরা দুজন মাঝখানে। আর ফ্রেড পেছনে। কেউ ভয় পেয়ে দৌড় দেবে না। সবাই মনকে এভাবে প্রস্তুত করো যেন এখান থেকে বের হলেই আমাদেরকে বাঘের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু ভয় পাওয়া যাবে না। আন্ডারস্ট্যান্ড, ফ্রেড?'
ফ্রেড বলল, 'ইয়েস, ইয়েস।'
ফ্রেড সম্ভবত নাসির সাহেবের হাতের ইশারাতেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে।
সাদমান দরজা খুলে দিল। নাসির সাহেব এগিয়ে গেলেন দুহাতে রিভলভার ধরে।
বারো
'কিন্তু নাসির সাহেব, দেয়ালে এভাবে চোখ আটকিয়ে রাখার মানেটা কী?' অলকের প্রশ্ন
নাসির সাহেব ফ্রেডের ল্যাপটপ থেকে একটি ফটো বের করলেন।
'এটা হচ্ছে হোরাসের চোখ। এই সিম্বলটাই দেয়ালে আঁকানো রয়েছে এবং কালো যে বৃত্তাকার অংশটি রয়েছে সেখানেই মানুষের চোখগুলো লাগানো ছিল। হয়তো সেটা তোমরা খেয়াল করেছ।'
সাদমান মাথা নাড়ল।
নাসির সাহেব দ্বিতীয় ছবিটি বের করে বললেন, 'এই হলো ‘হোরাস।’ মানুষের দেহে ঈগলের মাথাযুক্ত দেবতা। হোরাস ছিল প্রাচীন মিশরের যুদ্ধের দেবতা। বাবার খুনের প্রতিশোধ স্বরূপ চাচা ‘সেট’ এর সাথে হোরাসের কয়েক দফায় প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে হোরাস জয়লাভ করলেও হারিয়ে ফেলে একটি চোখ। জাদুবিদ্যার মাধ্যমে সেটি আবার ফেরত আনা হয়। এরপর থেকে চোখ উৎসর্গ করে মৃত আত্মাকে জীবিত করার প্রক্রিয়াও চালু হয় মিশরে।'
একটু থেমে নাসির সাহেব আবার বললেন, 'এই চোখের বিনিময়ে আত্মা ফেরত আনার একটি পরিমাপও রয়েছে।
১ জন মানুষের চোখের বলিদান = ১ জন মানুষের প্রাণহানি
১ জন দেবতার চোখ = ১ জন দেবতার জীবনদান
১০ জন প্রভাবশালী মানুষের চোখের বলিদান = ১ জন দেবতাকে জীবনদান
এসব ইনফর্মেশন ফ্রেডই খুঁজে বের করেছে।'
সাদমান বলে উঠল, 'আচ্ছা, এজন্যই লোকটি দশটি চোখ উৎসর্গ করেছে একটি দেবতার আত্মাকে ফিরিয়ে আনার জন্য।'
'হ্যাঁ, ও হচ্ছে হোরাসের উপাসক। হোরাসের আত্মাকে ফিরিয়ে আনার জন্যই ও দশটি চোখ উৎসর্গ করার প্ল্যান করেছে এবং যে মানুষগুলোকে খুন করেছে প্রত্যেকটা মানুষই কোন না কোন দিক থেকে মূল্যবান।'
সাদমান বিড়বিড় করে বলল, 'রহস্য অনেক গভীরে গিয়ে সমাপ্ত হলো তাহলে।'
অলক বলল, 'আচ্ছা নাসির সাহেব, শুধু শুধু পেইন্টিং এর ক্লুগুলো কেন রেখে গেল পিশাচটা?'
'ও কিছু নয়, অন্য কোন চিত্রশিল্পীকে ফাঁসানোর ধান্দা।'
'কিন্তু নাসির সাহেব, খুনিটাকে তাড়াতাড়ি আটকানো দরকার। দশ নম্বর খুনটা কিন্তু ও এখনও করেনি।'
সাদমান ফোন হাতে নিল। একটা ম্যাসেজ টাইপ করতে হবে।
তেরো
মেসেজ টোনে সাদিয়ার ঘোর কাটল। আজীবন ফোন ভাইব্রেট করে রাখলেও ইদানিং কেন যেন মেসেজের এই টোনটা ওর কাছে খুব ভালো লাগে। সাদমানের ম্যাসেজ— 'সাদিয়া, আমরা ঐ খুনিটাকে খুঁজে বের করেছি। কালকের মধ্যে সবকিছু জেনে যাবে তুমি।'
চৌদ্দ
একদিন পর
সুন্দরবন
সশস্ত্র একটি বাহিনী তৈরী হয়ে আছে সুন্দরবনের ওপারে। তারা ইনফরমেশন পাবার সাথে সাথেই ছুটে আসবে। যেভাবেই হোক দশ নম্বর খুন করার আগে ওকে পাকড়াও করতেই হবে। হেলিকপ্টার থেকে নেমে ওরা সেদিনের মত চলে গেল মিউজিয়ামের কাছে।
কিন্তু একি! গোলাকার কক্ষটার কোনো অস্তিত্বই নেই। আরেকটু কাছে গিয়ে টের পাওয়া গেল সত্যিই এই কক্ষটা স্ক্রু এর মতো তৈরী করা হয়েছিল। এখন সেটা একেবারে মাটির ভেতরে।
বহু কষ্ট করে গোলাকার সেই কক্ষটাতে প্রবেশ করা গেল। অতঃপর সেই কক্ষে নিথর ভাবে পড়ে থাকতে দেখা গেল স্বয়ং খুনিকে। আত্মহত্যা করেছে সে এবং মারা যাওয়ার আগে দশ নম্বর অর্থাৎ শেষ চোখ হিসেবে নিজের চোখটি উপড়ে ফেলে উৎসর্গ করে গেছে দেবতা হোরাসকে।
অলক দেখল খুনির পাশেও রয়েছে একটি পেইন্টিং। সেই পেইন্টিং এ আঁকা রয়েছে একটি তুলির অবয়ব।
ওরা সবাই বের হলো কক্ষটা থেকে। ঠিক তখনই দূর থেকে একটি বাঘকে গর্জন করতে করতে আসতে দেখা গেল ওদের দিকে।
নাসির সাহেব বললেন, 'খুনির বলে যাওয়া লাস্ট বাক্যটা মনে আছে?'
'হুম।' অলক জবাব নিল।
'কী বলেছিল?'
'হি ইজ দ্য গার্ডিয়ান অফ মাই টুম্ব।'
(সমাপ্ত)