(দ্বিতীয় পর্বের পর)
সাত
সকালে ব্যাংক খোলার কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরে দুই দফায় চার জন অশ্বারোহী ঢোকে। তাদের একজন মিগুয়েল। ধীরেসুস্থে হেঁটে শহরে ঢোকে তারা, তাদের যে বদমতলব আছে, তা আন্দাজও করতে পারেনি কেউ। সকাল বলে শহরের রাস্তায় ভিড়ও কম ছিল অনেক।
ব্যাংক ডাকাতির উদ্দেশ্য ছিল তাদের। পরিকল্পনামাফিক তিনজন ভিতরে ঢোকে ব্যাংকের, আর একজন বাইরে থাকে তাদেরকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য। এই একজন মিগুয়েল।
হোটেলের ঘর থেকে বেরোনোর সময় মার্ক যে ওকে দেখেছে, তা জানতো না মিগুয়েল। ওর অনুপস্থিতির খবর যে ক্রিসমাস আর ড্যানির কানেও পৌঁছে গেছে, জানতো না সেটাও। ওকে ব্যাংকের সামনে প্রথম দেখে ড্যানি, দেখেই এগিয়ে যায় ওর দিকে।
ওকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রমাদ গোনে মিগুয়েল। সর্বনাশ! ভেতরের কাজ তো এখনও শেষ হয়নি!
তারপরেও একটা গল্প খাড়া করছিল সে, কিন্তু সাড়ে সর্বনাশ ঘটে যায় তখনই, যখন ভেতর থেকে মুখে কাপড় বাঁধা অবস্থায় তার তিন সঙ্গী বেরিয়ে আসে।
যা বোঝার বুঝে যায় ড্যানি, হাত বাড়ায় অস্ত্রের দিকে। আর ঠিক তখনই ওকে গুলি করে মিগুয়েল।
গুলির শব্দে সবাই ছুটে আসার আগেই ভেগে যায় চার তস্কর।
পসি গঠন করতে সময় লাগল ঘণ্টাখানেক। মার্ক যোগ দিল, যোগ দিল শহরে আসা সেই চার্লি উডও। শহরের আরও কয়েকজন ভদ্রলোকও যোগ দিলেন। সব মিলিয়ে পসির সদস্য সংখ্যা দাঁড়াল আটজন।
ডাকাতের দল ওদের থেকে এগিয়ে গেছে অনেকটাই। তারপরেও স্বস্তি বোধ করলো ক্রিসমাস, কারণ ডাকাতরা যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকে পৌঁছানোর একটা গোপন রাস্তা জানা আছে ওর।
একটা অ্যামবুশের ব্যবস্থা করা যাক।
‘আমি কি মারা যাচ্ছি, শেরিফ?’ হেঁচকি তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল মিগুয়েল।
‘হ্যাঁ, মিগুয়েল।’
দু’হাতে পেট চেপে ধরে মাটিতে শুয়ে আছে মিগুয়েল, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ক্রিসমাস। জোড়া গুলি পেটে লেগেছে মিগুয়েলের, বাঁচার কোনো আশা নেই।
গোপন রাস্তা ধরে জোর কদমে ঘোড়া হাঁকিয়েছিল পসি, একটা সময় মনে হচ্ছিল, ডাকাত দলকে ধরা আর সম্ভব হবেই না বোধহয়। কিন্তু তারপরেই জায়গামতো পৌঁছে যায় ওরা, পৌঁছে পজিশন নেয়। কপাল ভালো ওদের, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে এসে পড়ে মিগুয়েল আর তিন সঙ্গী।
ওদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বলে ক্রিসমাস। পসির সবার হাতে উদ্যত অস্ত্র দেখে দমে যায় ডাকাতের দল। কিন্তু প্রাণের চেয়ে টাকার মায়া বড় হয়ে যায় তাদের কাছে, অস্ত্র বের করে আনে তারা।
তিনজন সাথে সাথে মারা যায়, পেটে দুটো গুলি খেয়ে ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে মিগুয়েল। ক্রিসমাস জানে, বুলেট দুটো ওর সিক্সগান থেকেই বেরিয়েছে।
‘মিগুয়েল, মরার আগে বলে যাও, মি. বসম্যান আর মি. মরমন্টকে কেন খুন করলে?’ জিজ্ঞেস করল ক্রিসমাস।
‘কা-কাউকেই আমি খুন করিনি, শেরিফ।’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মিগুয়েল।
‘মিথ্যে কথা।’
‘মৃত্যুর আগ মুহূর্তে কেউ মিথ্যে বলে না, শেরিফ। মি. বসম্যান অথবা মি. ম-মরমন্ট, কা-কাউকেই আ-আমি খুন করিনি। আমি ডা-ডাকাত হতে পারি, কি-কিন্তু নিজের ব্র্যান্ডের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করব না . . .।’
মিগুয়েলের শেষের কথাগুলো আর কানে গেল না ক্রিসমাসের। প্রচণ্ড অবাক হয়েছে ও। কী বলছে মিগুয়েল? ড্যানিকে গুলি করার পর মিগুয়েলই যে খুনী, সে ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ ছিল না ওর। কিন্তু মিগুয়েল বলছে, ও খুন করেনি!
আবার হেঁচকি তুলল মিগুয়েল। শেষ সময় সমাগত। ওর পাশে হাঁটুগেড়ে বসলো ক্রিসমাস। ‘মিগুয়েল, শেষ একটা প্রশ্ন করছি। তাড়াতাড়ি উত্তর দাও। এম আর টি এই দুটো অক্ষর খোদাই করা ছুরি কারো কাছে দেখেছ?’
দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল মিগুয়েল। ‘দে-দেখেছি।’ কণ্ঠস্বর ক্রমেই দুর্বল হয়ে আসছে। ‘মা-মা-মার্ক . . .’ শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল মিগুয়েলের শরীর থেকে।
মার্কের কাছে এম.টি. লেখা ছুরি দেখেছে মিগুয়েল!
আড়চোখে একবার মার্ককে দেখে নিল ক্রিসমাস। বিরক্তির সাথে এক ডাকাতের লাশে লাথি মারছে সে।
কিন্তু ড্যানি তো বলেছিল, মার্কের বিশ্বস্ততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সাথে মার্কের শারীরিক গঠনও খুনীর সাথে যায় না।
আচ্ছা, মিগুয়েল মাইক বলেনি তো?
মার্ক . . . মাইক . . . মার্ক . . . মাইক . . .।
কাছাকাছি দুটো শব্দ। হতেই তো পারে, না? অসম্ভব নয়।
ক্রিসমাসের মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। কী হচ্ছে আসলে? এই কেসের মতো প্যাঁচালো কেস আর জীবনে পায়নি ও, খাবি খাইয়ে দিচ্ছে একদম।
লাশ চারটে ঘোড়ার পিঠে তুলে রওনা দেয়ার আদেশ দিল ক্রিসমাস।
আট
শহরে ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে গেল। একটা বড় চমক অপেক্ষা করছিল শেরিফের জন্য। রেডউডের প্রধান রাস্তায় প্রায় ত্রিশ গজ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে জোসেফ ব্রাউন আর মুখঢাকা এক আগন্তুক! ডুয়েলে নেমেছে তারা। তার মাথায় হ্যাট, চোখদুটো দেখা যাচ্ছে শুধু। আততায়ীকে খুব চেনা লাগল ক্রিসমাসের।
চট করে পাশে একবার দেখে নিল ও। মার্ক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এখনও, ওদিকে মারা গেছে মিগুয়েল। তাহলে মুখ ঢাকা এই লোকটা কে? জাজ টাইলার? নাকি অন্য কেউ? এই লোকটাই কি খুনী? নাকি শহরের এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে উদয় হয়েছে অন্য কোনো বদমাশ?
রাস্তার দুই পাশে প্রচুর লোক দাঁড়িয়ে আছে। নিরাপদ দূরত্বে অবশ্যই। বাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ঘরের মেয়েরা। সবার মুখেই একটা আতঙ্কের ছাপ।
একটা নিঃশ্বাস ফেলল ক্রিসমাস, নিজেকে ব্যর্থ বলে মনে হলো। আসলে তো ও ব্যর্থই। মি. মরমন্ট আর মি. বসম্যান হত্যার কিনা এখনও করে উঠতে পারেনি। জোড়া খুনের পরে ব্যাংক ডাকাতিতে ভয় পেয়ে গেছে শহরের লোক, এরমধ্যে আবার শুরু হয়েছে ডুয়েল নামের নাটক। নাহ, এসব চলতে দেয়া যায় না। থামাতে হবে এখনই।
ভাবার সাথে সাথে পা বাড়ালো ও। কিন্তু ওকে থামালো মার্ক। ‘শেরিফ, দুজন পুরুষ ডুয়েলে নেমেছে। এটা একটা ফেয়ার ফাইট। এখানে তোমার নাক গলানো সহ্য করবে না ওদের কেউই। আর লোকটা মি. জোসেফকে কী বলেছে, দেখোনি?’ বলে একটা কাগজ ওর হাতে দিল বক্স বি’র কাউবয়।
কাগজে লেখা “জোসেফ ব্রাউন একজন মিথ্যাবাদী ও কাপুরুষ”।
জোসেফের অফিসে পৌঁছাতে পারেনি আগন্তুক। পারেনি নাকি যায়ইনি, সেটা জানা নেই কারোরই। অফিসে না গিয়ে মোক্ষম চাল দেয় সে, অনেকগুলো কাগজে লেখাটা লিখে শহরময় ছড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে রাস্তায়।
ব্যাংক ডাকাতরা দারুণ একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল তার সামনে, কারণ ক্রিসমাস শহরে থাকলে কঠিন হতো কাজটা করা। কাগজটা দেখে জোসেফ, এরপরেই নিজের নতুন দুই উপাধিদাতার মোকাবেলা করার জন্য বেরিয়ে আসে সে।
সেই মুহূর্তে মাথা থেকে হ্যাট নামিয়ে দিল আগন্তুক, মুখ থেকে খুলে ফেলল ব্যান্ডানা। তাকে দেখে বিস্ময়ে আঁতকে উঠল সবাই।
আগন্তুক আর কেউ নয়! ফাদার মার্কাস জনসন!
মুখ খুলল সে। ‘জোসেফ ব্রাউন, কার হাতে মরতে যাচ্ছ, জেনে যাও মরার আগে। আমি পিটার ট্রিমেনের ছেলে।’
হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো ক্রিসমাস, এত অবাক হয়েছে যে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। শেষ পর্যন্ত ফাদার মার্কাস!
পিস্তলে যথেষ্ট চালু জোসেফ। পশ্চিমের বিখ্যাত গানফাইটারদের মতো না হলেও যথেষ্টই দ্রুত। ওকে একবার অ্যাকশনে দেখেছিল ক্রিসমাস। সেই জোসেফও ফাদার মার্কাসকে দেখে বিমূঢ় হয়ে গেল এক মুহূর্তের জন্য, তারপরে সে-ও পিস্তল তুলে নিল।
কিন্তু ওই এক মুহূর্তই যথেষ্ট ছিল মার্কাসের জন্য। সিক্সগান তুলে গুলি করল সে, প্রথম গুলিতেই হৃদপিণ্ড ফুটো হয়ে গেল সেলুন মালিকের। কিন্তু তারপরেও থামল না সে, জোসেফের লাশ মাটিতে পড়ার আগে আরও পাঁচবার গুলি করল। গুলি শেষে মাটিতে ফেলে দিল খালি সিক্সগান।
‘এই তাহলে আপনার ঈশ্বরের নাম জপো, ফাদার?’ তিক্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো ক্রিসমাস।
‘ন্যায়বিচার ঈশ্বরেরই আরেক নাম।’ বলল মার্কাস। ‘এবার আমাকে গ্রেফতার করতে পারেন, শেরিফ। কার্ল বসম্যান আর জ্যাক মরমন্ট নামের নরকের কীটদুটোকে আমিই খুন করেছি।’
নয়
আমার আসল নাম মার্কাস ট্রিমেন। বাবার নাম পিটার ট্রিমেন। বাবা ছিলেন টেক্সাসের সবচেয়ে বড় র্যাঞ্চ ডাবল ডব্লিউয়ের ফোরম্যান। র্যাঞ্চের মালিক ছিলেন উইলিয়াম ওয়ালার নামে এক ভদ্রলোক।
আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের কথা। ট্রেইল ড্রাইভের মৌসুম ছিল তখন। প্রায় পনেরোশ’ গোরু আর ছয়জন কাউবয় নিয়ে পুবের পথে যাত্রা করেন বাবা। তখন আমার বয়স ছয় বছর। সে বছর গোরুর বাজার খুব চড়া যাচ্ছিল বলে শুনেছিলাম, প্রত্যেকটা গোরু বিকোচ্ছিল প্রায় ত্রিশ ডলারে। সে হিসেবে পনেরোশ গোরুর দাম আসত পঁয়তাল্লিশ হাজার ডলার।
এক থেকে দেড় মাসের মাথায় বাবার ফেরার কথা ছিল। কিন্তু বাবা আর কোনোদিনই ফিরলেন না। কেন ফিরলেন না, তা আর জানা হয়নি তখন। তবে বাবা না ফিরলেও ফিরে এলো তার সাথের ছয়জনের তিনজন কাউবয়। তাদের নাম কার্ল বসম্যান, জ্যাক মরমন্ট এবং জোসেফ ব্রাউন।
এসে অদ্ভুত এক গল্প শোনাল তারা। গোরু নিয়ে জায়গা মতো পৌঁছেছিলেন বাবা, বিক্রি করে টাকাও হাতে পেয়েছিলেন। যেদিন রওনা দেয়ার কথা, তার আগের দিন শহর থেকে উধাও হয়ে যান। তারপরে আর নাকি দেখা যায়নি তাকে।
বাকি তিনজন কাউবয়ের কথা জিজ্ঞেস করায় তারা বলল, পাওনা বুঝে নিয়ে তারা নিজেদের পথে চলে গেছে। তাদেরকে নিয়ে মাথাও ঘামাল না কেউ, কারণ তারা র্যাঞ্চের নিয়মিত কাউহ্যান্ড ছিল না।
র্যাঞ্চের মালিক মি. ওয়ালার মুষড়ে পড়লেন এই ঘটনায়। বাবাকে অনেক বিশ্বাস করতেন তিনি, বিশ্বাস ভঙ্গের যন্ত্রণা আর টাকার শোক কুরেকুরে খাচ্ছিল তাঁকে। এই ঘটনার কয়েকদিন পরে তিনি মারা যান।
মি. ওয়ালারের ছেলের নাম ছিল স্যাম ওয়ালার। সে এখনও বেঁচে আছে কিনা জানি না। বাপের এই মৃত্যুর জন্য সরাসরি আমার বাবাকে দায়ী করল সে। শুধু তা-ই না, আমাদেরকে বাড়ি থেকে বেরও করে দিল।
আমাদের বলতে আমি আর আমার মা। আমাদের থাকার জন্য র্যাঞ্চের পিছনেই ছোট একটা বাড়ি করে দিয়েছিলেন মি. ওয়ালার, স্বর্গের সমতুল্য ছিল জায়গাটা। সেখানে থাকার সময়টা এখনও মনে পড়ে আমার।
বাবার অপরাধের শাস্তি আমরা পেলাম। আমার মা তখন গর্ভবতী। আমার এখনও সেই দিনের কথা মনে আছে। অন্তত বাচ্চা হওয়ার সময়টুকু যেন তাকে থাকতে দেয়া হয়, এই বলে মিনতি করছিল মা। কিন্তু সেটা কানেই তোলেনি স্যাম।
তবে পৃথিবীতে ভালোমানুষ যে একেবারেই নেই, সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে। আমাদের দুর্দিনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন ফাদার পাওয়েল। স্থানীয় চার্চের ফাদার ছিলেন তিনি, তার বাড়িতে আশ্রয় দিলেন আমাদের।
আশ্রয় একটা পেলাম বটে, তবে সমস্যা শুরু হলো সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে। পশ্চিম খুবই অদ্ভুত জায়গা। এখানে অনেক কিছুই হয়, আবার কিছু ব্যাপার একেবারে নিষিদ্ধ। বিশ্বাসঘাতকতা তার একটা।
আমাদেরকে প্রায় একঘরে করে দেয়া হলো। কেউ মিশতো না, কথাও বলতো না কেউ। আমাদের জীবনটা আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠল, যখন সবাই তর্জনী উঁচিয়ে বলত, আমরা বিশ্বাসঘাতক পিটার ট্রিমেনের পরিবার। আর আমি সেই পিটার ট্রিমেনের ছেলে।
ছয় বছরের একটা ছেলের জীবন সম্পর্কে ধারণা আর কতটুকুই বা থাকে! আমার জন্য ভয়াবহ কঠিন ছিল সময়টা। বাবা যে আর কোনো দিন ফিরবেন না, বুঝে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেন তিনি এভাবে আমাদেরকে ফেলে চলে গেলেন, সেটা বুঝতে পারিনি তখন। বাবার প্রতি ভালোবাসা আস্তে আস্তে ঘৃণায় রূপ নিচ্ছিল।
এরপর একদিন সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটল। মানুষের তীর্যক বাক্যবাণে অতিষ্ঠ হয়ে ঘরে আগুন লাগিয়ে আমিসহ আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন মা। আমারও হয়তো মারা যাওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু সেবারও ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন ফাদার পাওয়েল। তার কাছে যে কী পরিমাণ কৃতজ্ঞ, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।
আগুনে মুখটা পুড়ে গেলেও বেঁচে গেলাম আমি। কিন্তু মা’র তত সৌভাগ্য হলো না। আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলেন তিনি।
এই ঘটনার পরে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, দুনিয়ার শেষ প্রান্তে গিয়ে হলেও বাবাকে খুঁজে বের করব। জানতে চাইব, কেন তিনি আমাদেরকে একা ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন।
ছয় থেকে বারো, এই ছয়টা বছর আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়। আগুনে পোড়া বিকৃত মুখের এক ছেলে, তার বাপ আবার বিশ্বাসঘাতক! আমার বয়স যখন বারো বছর, তখন আমি একটা ঘোড়া আর একটা ছুরি অবলম্বন করে বের হয়ে পড়ি।
বের না হয়ে উপায়ও ছিল না, কারণ আমার এতদিনের আশ্রয়দাতা ফাদার পাওয়েল মারা যান তখন। নামটাও পাল্টে নিই সেসময়ে। মায়ের আসল নাম ছিল শ্যারন জনসন, সেখান থেকে আমি হয়ে গেলাম মার্কাস জনসন।
এরপরে আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি। ভাগ্য ভালো, এই পশ্চিমে মানুষ অতীতের কথা খুব বেশি মনে রাখে না। এখানে একজন পরিচিত হয় নিজের কাজ দিয়ে। মাইনারের কাজ করলাম, কাউবয় হলাম। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় অস্ত্র চালানো শিখলাম। ষোল বছর বয়সে শটগান হাতে ওয়াগনের পাহারায় পর্যন্ত বসলাম। আর প্রতিটা মুহূর্তে খুঁজে বেড়ালাম বাবাকে।
কোনো সেলুন বাদ দিইনি, কোনো হোটেল বাদ রাখিনি। এমন কি শেরিফের অফিস আর বেশ্যালয়েও খোঁজ নিলাম বাধ্য হয়ে। কেউই পিটার ট্রিমেনের কোন খবর বলতে পারেনি।
হতাশ হয়ে পড়ি একসময়। বুঝতে পারছিলাম, এভাবে হবেনা। সেসময়ই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। ফাদার পাওয়েলের সাথে থেকে বেশকিছু ধর্মীয় আচার শিখেছিলাম, অনায়াসে একজন পাদ্রীর কাজ চালিয়ে নিতে পারতাম আমি।
এই কাজের যে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করতো আমাকে, তা হলো—কনফেশন। একজন লোক বা মহিলা এসে অবলীলায় নিজের পাপের কথা স্বীকার করছে, নিজের গোপন কথা, নিজের অন্ধকার জীবন তুলে ধরছে, ব্যাপারটা শিহরণ জাগাতো আমার মাঝে।
এই কনফেশন দিয়েই আমি একদিন আমার বাবাকে খুঁজে পেলাম!
পাদ্রী হিসেবে কাজ শুরু করার পরে নানান জায়গা ঘুরতে লাগলাম। আজ এখানে তো, কাল ওখানে। অনেক জায়গা ঘুরলাম। শেষ পর্যন্ত বছর দুয়েক আগে এসে হাজির হলাম এই রেডউড সিটিতে।
এখানে যে কেন এলাম, আর কেনই বা এত দিন আছি, তা আমি নিজেও জানি না। হয়তো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অথবা অন্য কিছু টেনে এনেছিল আমাকে। আগের কোনো জায়গাতেই এতদিন থাকিনি আমি। তবে এই এলাকা ছাড়ার সিদ্ধান্তও আমি নিয়ে ফেলেছিলাম, কয়েক সপ্তাহ পরেই চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই গত সপ্তাহে একটা ব্যাপার ঘটল। আমার কাছে কনফেস করতে এল স্বয়ং জ্যাক মরমন্ট!
এসে আমার কাছে কেঁদে পড়ল সে। অতীতে একটা পাপ করেছিল সে আর তার দুই বন্ধু, তার জন্য সে খুব অনুতপ্ত, পাপ স্বীকার করে ক্ষমা চায় ঈশ্বরের কাছে। সে নাকি ইদানীং রাতে ঘুমাতে পারে না, ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে প্রায় প্রতি রাতেই। তিনজনের মধ্যে ও-ই সবচেয়ে দুর্বল ছিল কিনা!
আমাকে জানালো, ত্রিশ বছর আগে একজন লোকের টাকা আত্মসাৎ করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, সেই সাথে লোকটার নামে দুর্নামও রটিয়ে দিয়েছিল। এবার চমকে উঠি আমি, হতভাগ্য লোকটার নাম জানতে চাই।
জ্যাক মরমন্ট আমাকে বলে, ‘লোকটার নাম ছিল পিটার ট্রিমেন!’
পিটার ট্রিমেন!
বাবা মারা গেছেন আরও ত্রিশ বছর আগেই!
অথচ এতদিন আমি তাকেই ঘৃণা করেছি!
স্ত্রী আর ছেলের কাছে ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু পারেননি। তাকে খুন করেছে এই তিনজন!
জ্যাকের কনফেশন চলাকালীনই আমি সিদ্ধান্ত নিই, খুন করবো এদের সবাইকে। বাকিটুকু আপনারা সবাই-ই জানেন।’
আদালতে বসে ফাদার মার্কাস জনসন ওরফে মার্কাস ট্রিমেনের কথা শুনছিল সবাই। রেডউডে আলাদা আদালত কক্ষ নেই, স্কুলের একটা ঘরকেই আদালত হিসেবে ব্যবহার করা হয় প্রয়োজনের সময়। কথা শেষ হলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্রিসমাস, গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন জাজ টাইলার। শুধু মার্কের দৃষ্টি থাকল মার্কাসের দিকে, সেই দৃষ্টিতে আগুন।
‘কার্ল বসম্যান, জ্যাক মরমন্টকে হত্যার দায়ে আসামী মার্কাস ট্রিমেনকে আগামীকাল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেয়া হলো।
আজকের মতো আদালত এখানেই সমাপ্ত।’ বলে হাতুড়ির একটা বাড়ি দিলেন জাজ, তারপর উঠে চলে গেলেন।
‘জন, খারাপ লাগছে তোমার?’ ক্রিসমাসকে জিজ্ঞেস করলেন জাজ।
জাজের দিকে তাকাল ও। এই প্রথমবার ওকে শেরিফ বলে না ডেকে নাম ধরে ডাকলেন জাজ।
‘ব্যাপারটা আসলে খারাপ লাগা নয়, জাজ।’ বলল ক্রিসমাস। ‘আপনি তো জানেন, আইনকেই সবসময় প্রাধান্য দিয়ে এসেছি আমি। সেই আইনের ফাঁক গলে যখন কার্ল, জ্যাক আর জোসেফের মতো অপরাধী পার পেয়ে যায়, তখন আমার আফসোস হয়। কিন্তু . . .’ এক মুহূর্ত বিরতি দিল ও, ‘. . . তার চেয়েও বেশি আক্ষেপ আর দুঃখ হয় মার্কাসের মতো মানুষের জন্য। কী চমৎকার একটা জীবন হওয়ার কথা ছিল তার! অথচ কী হলো? একটা সুস্থ জীবন পাওয়ার কথা থাকলেও কয়েকজন মানুষের লোভের কারণে এলোমেলো হয়ে গেল তা। মার্কাসকে আমি আর দোষ দিই না, ওর জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো একই কাজ করতাম। আমি জানি, সে অপরাধী। কিন্তু . . .।’
‘কিন্তু?’
‘আজ আইনের বিপরীতে গিয়ে ওকে মুক্ত করে দিতে ইচ্ছা করছে!’ ওর কথা শুনে কিছুই বললেন না জাজ।
চুপ করে অনেকক্ষণ বসে রইলো ক্রিসমাস, তারপরে উঠে বেরিয়ে গেল।
পরিশিষ্ট
পরদিন সকালে অল্প কয়েকজন শহরবাসীর উপস্থিতিতে পাদ্রী মার্কাস ট্রিমেনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। শেরিফের উপস্থিত থাকার নিয়ম থাকলেও সেখানে যায়নি ক্রিসমাস, বরং এরপরেই চাকরিতে ইস্তফা দেয় ও। যাননি জাজ মাইকও। জল্লাদের ভূমিকা পালন করে মার্ক নিজে। শোনা যায়, ফাঁসির সময়ও হাসি ঝুলছিল মার্কাস ট্রিমেনের মুখে, মৃত্যুর পরেও সেটা মলিন হয়নি একবিন্দু।
চাকরি ছেড়ে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায় ক্রিসমাস, নিজের সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে র্যাঞ্চিং শুরু করে। মার্কাস ট্রিমেনের ঘটনাটা প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছিল ওর ওপরে। এরপরে তার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি, জীবনের বাকি দিনগুলো হয়তো ভালোভাবেই কাটিয়েছে।
ড্যানি আর সুজানার বিয়ে হয়েছিল, বিয়ের পরে পশ্চিম ছেড়ে পুবে চলে যায় তারা। ওদের সাথে চলে যান জাজ মাইক টাইলারও। কিছুদিন পরে মারা যান তিনি।
ক্রিসমাস চলে যাওয়ার পরে অপরাধের মাত্রা খুব বেড়ে যায় রেডউড সিটিতে। আইনের বালাই না থাকায় দুনিয়ার গুণ্ডা, বদমাশ আসতে থাকে সেখানে। শহরবাসীরা কয়েকজনকে শেরিফের দায়িত্ব দিলেও ব্যর্থ হয় তারা। রেডউড সিটি পরিণত হয় এক জীবন্ত নরকে।
এরপর থেকেই শহর ছাড়তে শুরু করে সবাই। যেখানে নিরাপত্তা নেই, সেখানে মানুষ থাকবে কেন? আর মানুষ না থাকলে ব্যবসাই বা হবে কীভাবে? জোসেফ ব্রাউন মারা যাওয়ার পর থেকেই পতন হচ্ছিল তার রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যের, লোকজনের শহর ত্যাগ সেটাকে আরও ত্বরান্বিত করে মাত্র।
আস্তে আস্তে সবাই চলে যায় রেডউড থেকে, রয়ে যায় শহরের কঙ্কালটা। যাদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল শহরটার যাত্রা, তাদের মৃত্যুতেই ধ্বংস হয়ে যায় তা।
প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এক শহর থেকে মৃত এক নগরীতে পরিণত হয় রেডউড সিটি!
(সমাপ্ত)