ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা, সুনসান নীরবতা। আজকাল এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা খুব একটা চোখে পড়ে না। রোড ল্যাম্প না থাকলেও চারিদিকে গড়ে ওঠা জনবসতির জন্য একেবারে নিঝুম অন্ধকার রাস্তা আজকের দিনে গ্রামগঞ্জেও বিরল।
এই এলাকার রাস্তাঘাট কেমন বিশ্রী রকম নীরব, গায়ে কাঁটা দেয়। অধিকন্তু নিকষ অন্ধকার বলে একটা ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কাছেই কিছুক্ষণ পরপর একটা পেঁচা ঘোঁৎঘোঁৎ শব্দে ডেকে চলেছে। দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক শোনা গেল।
গত কদিন ধরে থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। আজও আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, থেকে থেকে মেঘ ডাকছে। অনেকক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে। বাড়ি ফিরছে জামাল। বাস থেকে নামার পর ভ্যান বা রিকশায় করে দু মাইল উত্তরে বালুরহাট পর্যন্ত পাঁচ টাকা ভাড়া। কিন্তু এরপর প্রায় দেড় মাইল মতো সুনসান এই রাস্তা মাড়িয়েই ওকে পানকৌড়ি গ্রামে পৌঁছাতে হয়।
প্রতিদিনই এক প্রকার অস্বস্তি নিয়ে এ পথ দিয়ে বাড়ি যায় সে। মাস খানেক আগেও এমন অস্বস্তি কাজ করেনি। এখন করছে, কারণ গত মাসের পঁচিশ তারিখে একটা জোড়া খুন হয়েছে এ রাস্তায়। এক দম্পতিকে গলা টিপে মেরে ফেলে রেখে চলে গেছে দুর্বৃত্তরা। তারপর থেকে নাকি অনেকেই ওদের আত্মা দেখেছে।
তবে একেকজনের কাছে ঘটনার বর্ণনা একেকরকম। কেউ কেউ দেখেছে রক্তমাখা জামা কাপড় পড়ে দুজন মানুষ রাস্তার ধারে বসে আছে। কেউ দেখেছে রাস্তার পাশের ছাতিম গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে। পালবাড়ির মোড়টা পার হবার পর যে বিশাল বড় বট গাছটা আছে সেখানেও নাকি মাঝে মাঝে দেখা যায় ওদের।
এইতো সেদিনের ঘটনা, গত বুধবার। আজিজার মিয়া গঞ্জ থেকে মায়ের জন্য পান সুপারি আর ঘরের টুকিটাকি বাজার-সদাই করে বাড়ি ফিরছিল। পথিমধ্যে ছেলেবেলার বন্ধু শাজানের সাথে দেখা। এরপর গল্প, গল্প থেকে আড্ডা, আড্ডা থেকে শেষমেশ বন্ধুবান্ধবদের সাথে তাস পিটাতে বসে পড়তে বাধ্য হয়। এদিকে কখন যে সন্ধ্যে গড়িয়ে গভীর রাত হয়ে গিয়েছে টেরই পায়নি।
বিদ্যুৎ চমকানি আর মেঘের গর্জনে টনক নড়ে আজিজার মিয়ার। কিন্তু ততোক্ষণে ঘড়িতে রাত একটা বেজে গেছে। এই সময় আর কোনো ভ্যান রিকশাও পাওয়া যাবে না। কিন্তু বাড়িতেও তো ফিরতে হবে। অগ্যতা হেঁটেই রওনা করে সে। সামনে বালুরঘাট ভ্যান-রিকশা স্ট্যান্ড। এরপর উত্তর দিকে কাঁচা রাস্তা।
দিনের বেলা তবুও ভ্যান পাওয়া যায়, কিন্তু রাত আটটার পর অসম্ভব। হেঁটে রওনা করার পর এক সময় সেই ছাতিম গাছটার পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় হঠাতই তার পাঁচ থেকে সাত গজ সামনে একটা আধলা ইট পড়ে।
আকস্মিকতায় ভড়কে যায় আজিজার মিয়া। এই সুনসান এলাকায় কোত্থেকে কে ছুঁড়বে এই আধলা ইট?
ভয় পেয়েও থামে না সে। দ্রুত পায়ে এগোতে থাকে সামনের দিকে। কিন্তু যেই না সান্টু বিলের কাছাকাছি চলে এসেছে অমনি ওর শরীর লক্ষ্য করে কে যেন কাঁদা ছুঁড়তে লাগল। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল আজিজার। বিলের আশেপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, বিশ হাত সামনেও কিছু দেখা যায় না।
এমন সময় হঠাৎই পা পড়ে একটা গর্তে। হৃদস্পন্দন আটকে যাবার উপক্রম হলো আজিজারের। অনেক টানাটানি করেও লাভ হয় না। কিছু একটা টেনে ধরে রেখেছে ওর পা। যতই টানছে গর্তের নীচ থেকে কেউ যেন শক্ত করে টেনে ধরছে।
সুরা ইউনুস পড়া শুরু করে দেয় সে। এদিকে বিলের পানি ফুলে উঠতে শুরু করেছে। এ কি ওর দেখার ভুল? নাহ, ওই তো ফুলে উঠে পানি পাক খেতে শুরু করেছে। এর ভেতর থেকে কীসের যেন শব্দ ভেসে আসছে। পাঁকের ভেতর থেকে কাচের চুড়ি পরা একটা হাত উঠে আসছে।
ঘটনার দুদিন পর আজিজারের মৃত্যু হয়। জামাল নিজে গিয়ে দেখে এসেছে। মারা যাবার আগে ঘটনাটা এ পর্যন্ত বলেই এক ধরণের অচেনা শব্দ বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছিল লোকটা। সেদিন কী ঘটেছিল ওর সাথে, কীভাবে সে বাড়ি পৌঁছেছিল—কিছু বলতে পারেনি।
জামানের অস্বস্তি লাগতে লাগল। বুকের ভেতর কেমন যেন ধড়ফড় করছে। এমন অস্বস্তি লাগছে কেন? ওর মতো সাহসী মানুষ দু চার গ্রামে আরেকজন খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আকাশ ফেটে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ছাতাটা তাসের আড্ডায় ফেলে এসেছে। রুমাল বের করে মাথায় বেঁধে নিল সে। এমন সময় চোখের কোণা দিয়ে সাদা মতো কী একটা দ্রুত সরে যেতে দেখল। নাহ্ কিছু নেই, নির্ঘাত চোখের ভুল।
ব্যাগ হাতে দ্রুত কদমে এগিয়ে চলেছে জামাল। কাউকে যদি সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যেত, তাহলে আর কোনো সমস্যা হতো না। পরনের লুঙ্গিটা ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। হাতের ব্যাগ নামিয়ে ঠিক করে ফেলা যায়, কিন্তু কী এক আতঙ্ক কাজ করতে থাকে মনের ভেতর।
এক হাতে বাজারের ব্যাগ আর অন্য হাতে লুঙ্গি সামলিয়ে কোনো মতে পথ চলছে সে। বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ে পথ পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে ঝলকে ওঠা বিদ্যুৎ চমকে দেখা যাচ্ছে—জায়গায় জায়গায় বৃষ্টির পানি জমেছে।
সামনে একটা ছোট মোড়। ওটা পেরোলে পালবাড়ির মোড়। এর পর সেই ছাতিম গাছ। তারপর বিল। এই কয়টা পেরোতে পারলেই ব্যস, নিশ্চিন্ত। শরীরটা খারাপ লাগছে, বাড়িতে গিয়ে একটা জম্পেশ ঘুম দিতে হবে।
সামনের মোড়টা মনে হচ্ছে হাজার মাইল দূরে। ছোট মোড়টা ঘুরে কয়েক পা এগোলেই দ্বিতীয় মোড়। মোড় ঘোরার সাথে সাথেই একটা আতঙ্কিত কণ্ঠের চিৎকার কানে এলো। কাছেই গাছের কোন ডালে বসে পেঁচা ডেকে উঠেছে। আর কিছুদূর এগোলেই ছাতিম গাছটা।
জামাল খুব স্বাভাবিকভাবেই পার হলো জায়গাটা। যাওয়ার সময় শুধু দেখল যে পরিত্যক্ত পাল বাড়ির ইটের দেয়াল খসে খসে পড়ছে। নিশ্চয়ই এরই একটা কোনোভাবে খসে পড়েছে পথে, যেটা দেখে আজিজার মিয়া ভেবেছে ভূতের কাণ্ড।
মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল জামালের। সামনে সেই বিল। জায়গাটা আসলেই বেশি সুনসান। রাস্তাটার বাম আর ডান দুদিকেই বিশাল বিল। ওইতো দেখা যাচ্ছে। তবে দূরে তাকালে কেমন ধোঁয়াশাময় লাগে।
জামাল এগিয়ে চলেছে। স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে হাঁটতে সামান্য সমস্যা হচ্ছে, রাস্তার সাথে আঠার মতো আটকে যাচ্ছে বারবার। এদিকে বৃষ্টির পানি পড়ে রাস্তা কাদা-কাদা হয়ে পড়েছে। এমন সময় জামালের মনে হলো, কে যেন ওর পিঠে কাদা ছুঁড়ছে! একেবারে নরম কাদা হাতে নিয়ে ছুঁড়লে পানির ফোঁটার মতো যেভাবে গায়ে লাগে, ঠিক তেমন।
হঠাৎ কী যেন খেলে গেল জামালের মাথায়। শব্দ করে হেসে উঠল সে। নিজের কাছেই যেন সেই হাসিটা বড় বেশি ভয়ঙ্কর বলে মনে হলো।
রহস্য উদ্ধার করে ফেলেছে সে। আসলে আজকের মতো সেদিনও ছিল গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির রাত। আজিজার মিয়াও ওর মতো স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে হাঁটছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই নরম কাদা মাটির রাস্তায় স্যান্ডেল মাড়িয়ে যাওয়ায় চটাস চটাস করে রাস্তার কাদা পানি ছিটে এসে গায়ে লেগেছে। আজিজারের ভীত-সন্ত্রস্ত মন ওর কাছে বিষয়টা ভৌতিক করে তুলে ধরেছে, অন্য কিছু নয়।
হাঁটছে জামাল। এখন আগের চাইতে অনেক নির্ভার। ভয়ের ভাবটাও আর নেই। বিলের কাছে আসতেই হঠাৎ ওর একটা পা রাস্তায় আটকে গেল। ডান পা এগিয়ে সামনে চলে গেছে। বাম পা-টা পেছন থেকে টেনে সামনে বাড়াতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে যে উঠছে না। এবার খানিকটা অস্বস্তি লাগতে শুরু করল ওর।
ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চমকে উঠল আকাশে। ক্ষণিকের ঝলকানিতে জামাল দেখল যে এবড়ো থেবড়ো রাস্তার বেশ কিছু জায়গায় ছোটছোট গর্ত, তাতে অল্প পানি জমে রয়েছে। বুঝল, ওরকম একটাতেই ওর পা আটকেছে। একটু কসরত করলেই উঠে আসবে।
পায়ের তলায় কিনকিনে ব্যথা হতে লাগল জামালের, অনেকটা যেন সূচ ফোটানোর মতো অনুভূতি। তীব্র ব্যথায় ককিয়ে উঠল সে। গায়ের সর্বস্ব জোর দিয়ে টানল। উঠছে না, বরং এঁটে বসছে আরো। শুকনো ডাল কিংবা লোহার আংটা জাতীয় কিছু একটা রয়েছে গর্তটাতে। অধিক টানাটানিতে মনে হচ্ছে চেপে বসছে ওটা।
আবারও বিদ্যুৎ চমকে উঠল আকাশে। সেই ঝলকানিতে জামাল স্পষ্ট দেখল- একটা মাংসবিহীন মানুষের হাত ওর পায়ের পাতা আটকে ধরে রেখেছে। গলার কাছে চিৎকার এসে দলা পাকিয়ে আটকে গেল জামালের। পায়ের পাতায় যেন নীচ থেকে সুই ফুটিয়ে দেয়া হয়েছে। আর ওপর থেকে সাঁড়াশির মতো চেপে বসেছে কঙ্কালসার হাত।
মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগল জামাল। না, এমন কিছু হতেই পারে না। নির্ঘাৎ মনের ভুল। এদিকে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে পেছনে। যেন ঝড় বয়ে চলেছে প্রচণ্ড গতিতে। একটু পর টগবগ করে পানি বলকানোর শব্দ আসতে লাগল রাস্তার দুপাশের বিল থেকে।
আড়চোখে সেদিকে তাকাল জামাল, বিলের পানি ধীরে ধীরে ফুলে উঠতে শুরু করেছে। যেন জীবন্ত এক সত্তা ফুঁসে উঠছে প্রচণ্ড রাগের বশে।
না, চোখের ভুল। চোখের ভুল এটা!
তাকাবে না তাকাবে না করেও বাম দিকে তাকালো জামাল। এদিকে নির্দিষ্ট সময় পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মুহুর্মুহু। হাতের সোনালি রঙের ঘড়িতে রেডিয়াম জ্বলছে—রাত দুইটা পঁয়ত্রিশ। জামাল দেখল, ফুলে ফেঁপে উঠে পাক খেতে শুরু করেছে বিলের পানি। তার ভেতর থেকে কালো মতো কিছু একটা একটা নড়ে উঠল। একটা হাতের মতো অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল ধীরে ধীরে।
চুড়ি পরা একটা হাত, শান্ত ভঙ্গিতে পানির ওপর উঠে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ডান দিকে তাকিয়ে দেখল সেদিকেও একই অবস্থা! তবে একটা পুরুষের হাত। বিদ্যুতের আলো ঝলকে উঠল। হাতের কব্জিতে হুবুহু ওর ঘড়ির মতো দেখতে একটা সোনালি রঙের ঘড়ি। কী বীভৎস দৃশ্য! চোখ মেলে তাকানোর সাহস করাই দায়!
এভাবে যেন কেটে গেল অনন্ত কাল। পেছন থেকে কাচের চুড়ির রিনঝিন শব্দ শুনতে পেল জামাল। যেন দূর থেকে ভেসে আসছে নারী কণ্ঠের হাসি আর কান্নার মাঝামাঝি একটা মিহি শব্দ। হঠাৎ কাঁধের ওপর আলতো স্পর্শের অনুভূতি টের পেল সে।
‘কী! আমাগো চেনা যায়?’ খ্যাশখ্যাশে কণ্ঠে বলে উঠল কেউ।
বুকের ভিতর ধ্বক করে উঠল জামালের! তাকিয়ে যে দৃশ্যটা দেখল, তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করা যায় না। এ কী করে সম্ভব!
গতমাসের পঁচিশ তারিখ, গভীর রাতে শেষবারের মতো কাকুতি-মিনতি করা কণ্ঠটা শুনেছিল জামাল। ‘আমাগো মাইরেন না। আল্লাহর দোহাই লাগে, যা আছে সব নিয়া যান। আমাগো জানে মাইরেন না . . .।’
না, সেদিন একা ছিল না জামাল। অসহায় সেই দম্পতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল ওর অন্তরঙ্গ বন্ধু আজিজার মিয়াও।
নিশুতি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে জামালের উপলব্ধি হলো, জীবনের বিনিময়েই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে আজ!
(সমাপ্ত)